হেরম্বচরিত
জন্মান্তর
এই সব রাস্তা দিয়ে
হেঁটে যাওয়া কতবার। জন্মান্তরের সব ঘাট-আঘাটা। যাতায়াতের গতিপ্রকৃতি থেকে তো কিছু
একটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়। বেঁচে থাকবার চৌহদ্দী থাকে যার ভিতরে আকাশমাটির
বাতাসতাতাসের এক জীবন ।শীত ঘন হতে থাকে। কাঁপন লাগে হাড়ে
হাড়ে। আসারিকান্দির দিকে বগরিবাড়ির দিকে পিলখানার দিকে লাওখাওয়ার বিল পেরিয়ে
হাওয়ার শব্দ ও শীত বিছিয়ে পড়লে বসন্ত মালির চেতনায় ঘা পড়লে সে স্মৃতিময় হয়ে উঠতে
থাকলে গদাধরের উপর পাখিদের ছায়া পড়ে। বসন্ত
মালি টলমল পায়ে তার জন্মান্তরের ঢোল, ঢোলের কাঠির কাছেই আশ্রয় নেয়। যাপনের টুকরো টাকরা
দিয়ে কি আর গোটা এক জীবনযাপনকে স্থিরতর করে দেওয়া যায়! বসন্ত খুঁজতে শুরু করে
ব্রহ্মপুত্রের ছোট ছোট চর, হ্যাজাকবাতির আলোয় ভরভরন্ত সব গানবাড়ি, নাচুনির দলবল। চরাঞ্চল
বনাঞ্চল বাইচের নাও জাফর ব্যাপারির ধনদৌলত পান্তাভাত আর শুটকীসিদোলের আখ্যানগুলি
দিয়ে বসন্ত মালি কেমন দূরাগত হয়ে উঠতে থাকে আর নিজেকে এগিয়ে দেয় মস্ত এক উপকথার
স্মৃতি বিস্মৃতির ভিতর! শীতরাত ভোরের দিকে গড়ায়। পাছা রাত্তিরের মোরগ ডেকে উঠলে
বসন্তের তো আর কিছু করার থাকে না। দূরদেশ থেকে যুবতী কইন্যার গান উড়ে আসে-
‘গনেশ হাতির মাহুত রে
মোক নিয়া যান বাপভাইয়ের দ্যাশে’
সে কি আসলে ভয়
দেখাতে চাইছে! আতঙ্কিত হবার সুযোগ সেভাবে না থাকলেও পূর্ববর্তী দিনকালগুলিকে
উদাহরণযোগ্য মনে হতেও পারে। হরিচরণ আর বুড়াবাবুর দ্বন্দ্ব সংঘাতকে উচ্চমার্গীয়
স্তরে নিয়ে গেলেও আসলে কোথাও কোনো গুলির শব্দ নেই। তবে বন্দুক আছে। বন্দুকবন্দনার
জন্য ফাঁকা মাঠের জুলুস আছে। বুড়াবাবুর কেশর ফোলানো ঘোড়া কখন যেন ছুটে আসে
পাটখেতের অন্তরাল থেকে। ‘বন্দুক হাতে রায়সাহেব’ মহার্ঘ ছবি হয়ে ঘুড়ে বেড়ায় জোতজমির
সুজলা সুফলার প্রাকৃতিক প্রাত্যহিকতায়।
রহস্যের মায়ামাখা
সেই বন্দুক প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠতে উঠতে বর্ষা শীত হেমন্তের দিনগুলিকে আত্মগত করতে
থাকলে বিলখালের মাছেরা পাশ ফেরে নুতন খাতে প্রবাহিত জলধারায় আকুলিবিকুলির জেগে
থাকবার দৃশ্যময় বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনবার প্রয়াসটুকুন নিয়ে পুরাকালীন কোনো
যুদ্ধক্ষেত্র যেন জীবন্তভাবেই জীবিত হয়ে ওঠে! হরিচরণের হাতে হাতে হেন্তালের লাঠি। উলটে
যাওয়া কচ্ছপকে সোজা করতে করতেই তার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসে। বুড়াবাবুর টাড়ির দিকে
বিকেলের শেয়ালেরা।
বন্দুকের জং ধরা
ট্রিগারে ক্ষয়াটে আঙ্গুল রাখলেও হরিচরণকে মোটেও বয়োবৃদ্ধ মনে হয় না। বন্দুকের
রহস্য ভেঙ্গে দিতে চাইলেও কোথাও বুঝি কপট এক আড়াল। রক্তপাত হাহাকার পলায়নের তাড়সে
কাঁপতে থাকলেও বন্দুক কিন্তু ফোটে না। ফাটে না। গুলির শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনি
মিথ্যে মনে হয়। বন্দুকের গল্পটিও হরিচরণ তার উত্তরকালের হাতে বাধ্যতই সঁপে দেন!
খুটার বন্দুক
‘কি গান শোনালু বাপই
রে’
হাহাকার ভরা পাথারবাড়ি
থেকে ধুতুরার ফুল নিয়ে ফিরছে আলিজান মিঞা। নয়ারহাট জোড়শিমুলি কেশরীবাড়ি টপকে টপকে
কন্ঠে গান গান নিয়ে সর্বাঙ্গে নাচ নিয়ে জলঢাকার চরে শেষতক তাকে প্রবেশ করতে হবে আর
খন্ড অনুখন্ড দিয়ে আলিজান মিঞা নিজের মতোন সাজিয়ে নিতে থাকবেন বৃত্তান্তের পর বৃত্তান্তই!
তো, এক বিকেলডোবার
ক্ষণে টুনুমুনু এক্কার সাথে দেওয়ান বর্মনের দেখা হয়ে গেল। দেওয়ানের কপালে ঘাম, ঘাড়ের
গামছায় মুখ মুছে সে যখন ধানহাটি থেকে বেরিয়ে আসছে তখনই দেখা পেল টুনুমুনু এক্কার। কালো
পেশল শরীরে ঢেউ তুলে তুলে ধামসা মাদলের তালে শরীর দুলিয়ে টুনুমুনু তখন প্রবেশ করতে
যাচ্ছে মোরগলড়াই পর্বে। হাড়িয়াহাট পর্বে। দেওয়ান বর্মণ কি টুনুমুনু এক্কাকে গ্রহণ
করবে? না কি তিন নদী পাঁচ ফরেষ্ট ঘেরা তার জোতজমির ভিতর, দিক ও দিগরের ভিতর ছড়িয়ে
দেবে! দেওয়ানের প্রবীণ চোখের কুঞ্চনে সাময়িক দ্বিধা তৈরি হতে থাকলেও দেওয়ান কিন্তু
টুনুমুনুর দিকে মুখভরতি হাসি নিয়ে পানের
পিক নিয়ে হাজির হয়। টুনুমুনু তখন দেওয়ানের দিকে হাততালি ছুঁড়ে দেয়। বর্ণাঢ্য
উৎসবের দিকে টেনে আনতে থাকে দেওয়ানকে। চারপাশের নদীগুলি ফরেষ্টগুলি হাতিমাহুতের
গানগুলি মনকেমনের দিনগুলি থেকে প্রবল একাকীত্ব আর বিষাদ যেন চুঁইয়ে নামতে থাকে। জোতজমির
খালবিলের বাড়িটাড়ির গানবাজনার হাসিতামাসার এক পরিপক্কতায় কেমনতর এক দিনদুনিয়াই
বুঝি সংশয়তাড়িত করে ফেলতে থাকে সমগ্র পরিপার্শটুকুন আর মহিষের গাড়ির সমবেতে
ঘুমকাতুরে এক অসহায়তায় দ্বন্দদ্বিধা নিয়ে দেওয়ান দাঁড়িয়ে থাকেন আর একসময় জাঁকজমকের
সঙ্গে ফিরতে থাকেন আবহমানের জোতজমির দিকে। পূর্বস্মৃতির তোয়াক্কা না করেই, যেভাবে
মাদলধামসায় মেতে ওঠে টুনুমুনু এক্কা।
নির্মাণ বিনির্মাণ
নিয়ে একা একা বসে থাকা। রাজার হাতির পিছে পিছে দেওয়ানের ঘোড়া যুক্ত হয় আর বিস্তৃত
কালখণ্ডে স্মৃতিকাতর হতে থাকা ।দেওয়ান বর্মনের জোতজমি পত্তন করেছিল
মেঘা বর্মণ। হাটের ভিতর মাঠের ভিতর রাতদিন খেলে বেড়াতো বাঘ ।বাঘের নখ বাঘের লেজ অতিসন্ত্রস্ত জনপদগুলিতে কেবল হাওয়া ছড়িয়ে দিত। হাওয়ায় ভেসে আসা
গান মাঘকুয়াশায় দলা দলা একাকীত্ব নিয়ে বিষাদ নিয়ে পুর্নজন্মের কথকথার বৃত্তে
সীমায়িত হতে গিয়েও হোঁচট খায় আর দশ কুড়ি পঞ্চাশ গঞ্জগাঁ জুড়ে রবিশস্যের লকলকে
সম্ভার। রাস্তায় রাস্তায় গান বাজে। বাজনায় বাজনায় নৃত্যে নৃত্যে আশ্চর্যতম দুলুনির
ভরকেন্দ্রে গিয়ে ঝাকড়া সব গাছপালায় অতিজীবিত হতে থাকা অনুখণ্ডগুলি দিয়ে ধরাছোঁয়ার
এক জীবন ক্রমে টেনে নিয়ে চলে আর তখন দেওয়ান বল টুনুমুনু বল ধানহাটির ইঁদুর বল সব
কিছুই যেন বৃত্তায়নে আটকে পড়া মজা ও ম্যাজিক। ধামসামাদল না থামলেও বজ্রবিদ্যুৎ সহ
বৃষ্টি নামে। উঠোনের নিকানো অংশে কীর্তনসুর প্রতিষ্ঠিত হলেও কোথাও কোনো স্বীকৃতি
জোটে না। কেবল নদীর ওপর সাঁকো আর ওপারের ছায়াছন্নতায় বুঁদ হয়ে যাওয়া বিষণ্ন সব
মানুষেরা হাড়হিম এক নির্জনতাই ফিরিয়ে আনতে
আনতে গান গাইতে গাইতে কীভাবে অন্যমনস্ক ও
আত্মগত হয়ে উঠতে থাকে!
কলাবাগিচা
হাজার হাতির মিছিল
তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। চিলাপাতা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাইসনের পাল ফের
জঙ্গলেই। নদী পেরিয়ে চলে যাওয়া ধাইধাই বিটে। এমত দোলাচলে বাঁধা না দিয়েও আদিঅন্ত
মেঘের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে কীভাবে দূরাগত গন্তব্য নির্ধারিত হতে থাকলে সোনাভাবী হাসির বান
ডেকে আনে। কাঠের বাড়ির সিজিলমিছিল দেখে বুক ভরা শ্বাসে নতুন ভাবে বেঁচে থাকতে
চাওয়া। বৃক্ষ নদী আকাশ পুকুর হালগেরস্থির ভরভরন্তির ভেতর জীবনের পর জীবনের
প্রবাহিত হতে থাকা। মহল্লায় মহল্লায় মাদলধামসা জেগে উঠলে টুনুমুনু শনিচরী ফাগুলাল
চুনিয়া মালতিরা গাথা কিংবদন্তির লহর তোলে। করম পূজার মাঠ জুড়ে অন্ধকার নামে। জোনাই
জ্বলে। মোরগলড়াই শেষে ফিরতে থাকে চিলবানুস ওরাও। চিলবানুসের পীঠে চিতার থাবার দুরন্ত
আঁচড়। অতি পুরাতন পৃথিবীর বাঘে-মানুষের লড়াইয়ের গল্প স্বপ্নতাঁত বুনতে থাকলে
চিলবানুস কখন কীভাবে যেন ‘বাঘুয়া’ হয়ে ওঠে। অতিকথার পৃথিবীতে এইসব চলতেই থাকে। দেড়শো
ঘোড়া তিরিশ হাতির দেওয়ান ধনী টুনুমুনু এক্কাকে চিনতে পারার প্রয়াসটুকুন জারি রাখেন
আর সব পেরিয়ে জীবনযাপনের অর্ন্তগতে
অবধারিত ভাবেই টুনুমুনু, তার বাড়িটাড়ি গানকিসসা হর্ষবিষাদ ও হাটগঞ্জ সমেত। তখন পথে
পথে কত কত কলাবাগিচা! কলাবাগিচা বিভ্রমের ভিতর বিভ্রম ঢুকিয়ে দিতে থাকে আর পথের
দিকে যুক্ত হতে থাকা নানান পথঘাট শাখাপ্রশাখাময় এক আবহমানের দেশদুনিয়ার চালচিত্র
বয়ন করে ফেলে। অথচ টুনুমুনু তার আস্ত জীবনের, জীবনযাপনের কোনো উদ্দিস খুঁজেই পায়
না! সে কেবল সমাধানহীন এক বিভ্রান্তির ধাঁধাগোলকে আটকে পড়ে; অনেকটা কলাবাগিচার
আন্ধারে হারিয়ে যাবার মতোন। টুনুমুনু এক্কার শরীরের পেশীময়তার দিকে দলা পাকানো
কুয়াশারা, যেন শীত ও শিশিরের ভূবনমায়াই রচনা করে ফেলে। তবে কি কলাবাগিচায় ঘুমিয়ে
পড়বে সে! না কি কলাবাগিচার ভিতরে নুতন করে আবিষ্কার করে ফেলবে অগনণ নদী ও নালা! না কি জীবনযাপন নিয়ে তার সব ভ্রান্তি বিভ্রান্তি
অগ্রাহ্য করে সে ফিরে আসতে থাকবে বাড়িটাড়ি আর জীবনযাপনের দিকেই! যদিও তার চোখের
খুব ভিতরে জীবন্ত হয়ে জেগে থাকবে কলাবাগিচার আলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন