বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

বারীন ঘোষাল

নতুনের কোনো দুঃখ নেই



                                                                    
আজ আমি কর্‌র্‌র্‌ কবি স্বদেশ সেনন্‌ন্‌ন্‌ন্‌ন্‌ সম্পর্কে দুচারর্‌র্‌র্‌র্‌ কথা বলতে চাইইইইইইই......

মাইকটা একটা বোকাচোদা -- অলোক বিশ্বাসের বকখালি সমুদ্রতীরে বলা মজার কথাটা মনে এলো, যখনই বলতে গেছি, মাইকটা বেগরবাঁই করেছে যেই না বলেছি –“বাংলার তথা ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন স্বদেশ সেন”, তার ঠিক পরেই সমস্যা শুরু হলো এইরে! কিচিরমিচির পেরিয়ে ‘শালা পাগলা’ ভেসে এলো নামোল্লেখে আমার  ডানহাত কানে, আর হাতে শব্দ মিসাইল এবং মধু চোখ, বঙ্কিম হাসি, রবিনিষদ,  জীবনবিষাদ, বিনয়গলি ঠেকিয়ে জখমপোষ বাতাসে হাঁপাতে থাকি। ভাবি, চট করে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা ঠিক হলো? অন্যতম শ্রেষ্ঠ বা অসাধারণ বা অপরিচিত সুন্দর বা  তারিফ ঝরানো পংক্তিতে বসে পড়া দীর্ঘ উচ্চারণে বাহার দিলে ভালো হতো না কি? ৭৯ বছরের জীবনে মাত্র তিনটি চটি বই কবিতার আর একটা নির্বাচিত সমগ্র। ব্যস। বাংলার কত বহুপ্রজ কবি, বিখ্যাত, পুরস্কৃত, বিক্রীত, পাঠক নিন্দিত মঞ্চসফল কবি আছেন যুগ যুগ ধরে, সেখানে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই আর অভিনয় সবাই দেখতে পায় যে। স্বদেশ সেন নিয়ে আমার মন্তব্যটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না! তাঁকে তো কেউ চেনে  না, কেউ দেখেনি, বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায় নন্দনে, কফি হাউসে কখনো যাননিএবার একটু নাড়াচাড়া করে দেখতে হয়কী বলেন?

স্বদেশ সেন যে আদৌ এক কবি তা তাঁর পাড়ায় কেউ জানত না। জামশেদপুরে গুটিকয় লোক জানত যারা ষাট দশকে স্থানীয় নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পিকনিক পার্টিতে যেত, আর যারা কৌরবের সঙ্গে তাঁকে দেখেছেসেক্ষেত্রে তাঁকে নিয়ে পত্রিকায় আলোচনা করাটা প্রায় টিম্বাকটুর রাজার প্রশস্তির প্রস্তরলিপি ছাড়া কিছু কম ছিল না, মনে হতো এককালে। আজ তাঁর প্রয়াণের পর নানা জায়গায় সাড়া দেখছি, অন্তত ফেবুর দেওয়ালে বাঙালির আবেগের বাড়াবাড়ি দেখে তাই মনে হয়েছে। অনেক  পত্রিকা ওঁৎ পেতে থাকে তাদের আগামী সংখ্যার নতুন বিষয়ের জন্য। আর পায় কে? শ্মশানে তাঁর মরদেহ চুল্লির ভেতর, বাইরে ফোন আসছে – “স্বদেশদার ওপর আজই একটা টাটকা লেখা লিখে ফেলো আমাদের পত্রিকার জন্য”। ভাবা যায়! বলতে গেলে তিনি ৫০ দশকের লেখক। স্কুল কলেজ কলকাতার কাছে আড়িয়াদহে থাকাকালীন। এস এফ আই করেছেন। অবিভক্ত কমুনিস্ট পার্টির কার্ড হোল্ডার ছিলেন। পরিচয় ও অন্যান্য পত্রিকায় লিখতেন স্বপ্নের কবিতা। ভাবা যেতে পারতো স্বদেশ সেন আর পঞ্চাশের অন্য কবিরা পরস্পর পরিচিত। কিন্তু স্বচক্ষে দেখি ১৯৬৯ সালে, জামশেদপুরে, সুনীল শক্তি তাঁকে - ভালো তো? – ব্যাস। কমুনিস্ট হিসেবে পার্টির নির্দেশ ছিল পঞ্চাশের উন্মার্গগামী কবিদের ছায়াও না মাড়াতে। অতএব। ৬০ দশকে জামশেদপুরে চলে আসেন চাকরির খাতিরে। তাঁর বাবাও এখানেই চাকুরিরত ছিলেন। কমুনিস্ট পার্টি বিভাজিত হতে স্বদেশদা পার্টি ও আই পি টি এল-এর সংস্র ব ত্যাগ করেন। লেখা বন্ধ হয়ে যায়। সময় কাটাতে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যেতে থাকেন। মনমরা। ১৯৬৮ সালে কৌরবের সাথে সম্পর্ক হয় অদ্ভুত ভাবে। কৌরবের আমরা জামশেদপুরে স্থানীয় ১০ জন কৃতি সাহিত্যিককে সম্বর্ধনা দিতে মনস্থ করলে স্বদেশ সেনের নাম ওঠে। এখানে ভালুবাসায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন স্বদেশ সেন কমল চক্রবর্তী আর অরুণ আইন গিয়ে তাঁকে প্রস্তাবটি দিলে রাজি হন। তখনো কৌরবের নাম শোনেননি। সেই যে এলেন, শুরু হয়ে গেল আমাদের কবিতার ইতিহাস। যারা স্বদেশ সেন পড়েনি তাদের কাছে এই গদ্যটা মূল্যহীন। নির্লিপ্ত উদাসীন এই কবিকে প্রয়াণপারে না ঘাঁটলেই ভালো ছিল মনে হচ্ছে 

স্বভাব লাজুক ছিলেন তিনি। কস্মিনকালে নিজে থেকে কোনো পত্রিকায় লেখা দেননি।  কলকাতার মিডিয়া এবং ছোট পত্রিকা অফিসে তাঁর পায়ের দাগ নেই। কোনো মঞ্চে  কবিতা পড়েননি। জিজ্ঞেস না করলে, না খোঁচালে কথাও বলতেন না। কৌরব ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১-এ পত্রিকা না বেরনো পর্যন্ত একাদিক্রমে ৩০০ পাঠসভা করে কবিতা ও গল্প পাঠের। ৫০ পরবর্তী প্রায় সব সভাতেই উপস্থিত ছিলেন। কবিতা পড়েছেন, আলোচনা করেছেন। আর কখনো নিখিল বঙ্গ বা প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘে ফিরে যাননি। সেই থেকে স্বদেশদা কৌরবের পাতায় শীর্ষে। মৌলিক কবিতার সন্ধানে আশি দশকে আমাদের আউটডোর কবিতার ক্যাম্পগুলিতে বরাবরই সঙ্গে ছিলেন। ১৯৮২তে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'রাখা হয়েছে কমলালেবু' প্রকাশিত হয় পত্রিকার ৩৩তম সংখ্যা হিসেবে। তাঁর বয়স ৪৭। গোটা পত্রিকাটিই বইয়ের আকারে সুদৃশ্য প্রচ্ছদ সহ। অসামান্য কবিতা সব। কবিতাগুলো লিজেন্ড হয়ে রইলো। তুলনায় আজকের কবিরা সেই বয়সে ১০টি করে ফেলে। প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতির মোহ তাঁর কোনোদিনই ছিল না। ক্যাম্পগুলোতে আমরা রেশন নিয়ে দু-তিনদিনের জন্য শহর,  সংসার ছেড়ে নদী জঙ্গল পাহাড় সমুদ্রের তীরে গিয়ে থাকতাম তর্ক বিতর্ক পড়াশোনা আলোচনা নিয়ে, পানে ভোজনে, এবং খুঁজতাম কবিতা লেখার মৌলিক ভাষা, ফর্ম, কনটেন্ট এবং ধারা কবিতা ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপায় নিয়ে। স্বদেশদা অনেক তর্ক, পরামর্শ, উদাহরণ দিতেন। আমাদের সাথে উত্তেজিত হয়ে কথাও বলতেন। কিন্তু অচেনা মানুষের সামনে মুখ খোলার দ্বিধা তাঁর কখনো যায়নি। ১৯৮৮-তে কৃষ্ণনগরে 'শতজল ঝর্না' নামের প্রতিষ্ঠান বিরোধী অনুষ্ঠানে যোগ দেবার নিমন্ত্রণ  পেয়েছেন। যাবেন না। আমাকে আর কমলকে ডাকা হয়নি। তাঁকে কেউ না চিনলেও দেবদাস আচার্য এটা করেছিলেন। আমি বললাম – চলুন, আমিও যাই আপনার সাথে। রাজি হলেন। গেস্ট হাউসের একটা ঘরে আমার আর স্বদেশদার থাকার জায়গা হলোসেই বাড়িতেই, কী আশ্চর্য, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের বন্ধুরা, যারা ভবিষ্যতে  স্বদেশদার ফ্যান হবে, পরবর্তীকালের কবিতা ক্যাম্পাসের সবাই, ছিলাম এক ছাদের নিচে। আমরা কেউ কাউকে চিনি না। স্বদেশদার নামও কেউ শোনেনি। সভায় স্বদেশদা কিছু না বললেও একবার জড়তা কাটতে দেখলাম। সাহিত্যিক উদয়ন ঘোষ কৌরবকে প্রতিষ্ঠান বলে নিন্দা করতেই যখন আমি উত্তেজিত হয়ে জোর গলায় প্রতিবাদ করে উঠলাম মাইক টেনে নিয়ে, স্বদেশদা উশখুশ করে বললেন -- কী মিথ্যাবাদী! পরে চা পানের বিরতিতে সভার বাইরে উদয়ন ঘোষকে চেপে ধরে মিথ্যা কথা বলার জন্য বকলেন। উদয়ন ঘোষ ক্ষমা চেয়েছিলেন স্বদেশদার কাছে। আমি অবাক। সেই একবারই মাত্র।

বরাবরই চাপা স্বভাবের স্বদেশ সেন, কৌরবের তারুণ্যের উন্মাদনার আকর্ষণে বাঁধা পড়লেন। আমরা ছটফট করি। তিনি স্থির। আমাদের সামনে এক কবি বসলেন যিনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন যা কখনো লেখা হয়নি। এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। কী করে এই দিগন্ত উন্মোচিত হলো, কোন চাপ তৈরি ছিল ফুঁসে ওঠার জন্য, লাভার  মতো ভালোবাসা উদ্‌গীরণ হতে থাকলো, মানুষের ভালোর জন্য শব্দরা সশব্দে বেরোতে  থাকলো – এ এক আশ্চর্য বিবাহ। অথচ তিনি মুখচোরা, লাজুক, ক্ষীণকায়। জনসমক্ষে আমাদের হম্বিতম্বির মধ্যেই গোবেচারা স্বদেশ সেন মাথার মণি হয়ে উঠলেন ক্রমশ। ৩০০ সভা শেষ হতে আমরা সভার স্থান চেঞ্জ করলাম। প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁর বাড়িটা হয়ে উঠল আমাদের কাছে তীর্থক্ষেত্র। একাদিক্রমে ১৫ বছর। আমরা হেঁটে যেতাম দু'মাইল তাঁর কথা বলতে বলতে, ফিরে আসতাম তাঁর কথায়। ঘরে একটা  চৌকি, তোষক চাদর পাতা সেখানে সবাই বসতাম -- কবিতা পড়া, আলোচনা, বাংলা কবিতার হালহকিকৎ আর নিজেদের ভালো লাগা মন্দ লাগা, বিস্ময়, মুগ্ধতা  জাহির করতে। আমরা নতুন কিছু চাইছি। স্বদেশদা সেই নতুনের ইশারা দিচ্ছেন। তাঁর কোনো ঈর্ষা বা ক্লেশ নেই। অনায়াসে বলছেন – সুনীলের কবিতাটা পড়েছো?  দেশে মল্লিকা কী সুন্দর লিখেছে! মৃদুলকে দেখো। সবেতেই তাঁর বিস্ময়। রিজেকশন  নেই। বলতেন অডেন, স্পেন্সার, ডিলান টমাস-এর কবিতার কথা। এক নিঃশ্বাসে বলতেন জয় সুবোধ দেবদাসের কথা। অর্থাৎ, কোনো পলিটিক্স নয়, যেখানে যা ভালো  লক্ষ্য করসবটা লক্ষ্য করে ছেঁচে গ্রহণ কর। যেখানে দেখিবে ছাই... এরকম। কমল এগুলো চ্যালেঞ্জের মতো নিতো, ঈর্ষা করত, নতুন লেখার জন্য লড়ে যেতআমাকে বলতেন – তোমার কবিতা হয় না বারীন, ছেড়ে দাও। বরং তুমি ভালো গল্প লেখো,  সেটাই কর। ভালো গদ্য লেখো, তাই কর। আমি গল্প লেখা ছেড়ে দিলাম। গদ্য লেখা  ছাড়লাম না অবশ্য, কারণ খোঁজ সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনাগুলো লিখে রাখছিলাম যা কমিটমেন্ট ছিল আমার কাছে। কিন্তু কবিতা লেখা চালিয়ে গেলাম। বুঝতাম, এগুলো নেগেটিভ উৎসাহদূরের বাজে উদাহরণকে ভালো বলা আর নিজের ভা্লোকে তুচ্ছ করা। মনে হতো এগুলো স্বদেশদার স্ববিরোধ। ১৯৯৮-এ 'কালিমাটি' পত্রিকা স্বদেশ  সেন সংখ্যা করে। তাতে মলয় রায়চৌধুরি স্বদেশ সেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বুঝি, গোটাটাই মলয়দার বানানো। সেই মানসিক পরিপ্রেক্ষিতে কলোনিয়াল, পোস্ট কলোনিয়াল, মডার্ন-পোস্টমডার্ন, মলয়-পোস্টমলয় জাতীয় কথা জেনারেশন, ডিজেনারেশন করেছেন। স্বভাবলাজুক স্বদেশদা জিভ নাড়াননি বোঝাই যায়, তবে মলয়দা স্বদেশদাকে উন্মোচিত করার খুব কাছাকাছি গেছিলেন। ক্রেডিট টু হিম... এইইইই... এই হিম পড়ে যাবার একটা কবিতার লাইন হয়ে যাক -- যদিও মলয়হীন বাষ্পে জমানো রামধনু টুকরো হলেও টুকরোরা সব রঙ ধরে রাখে, ছাড়ে না কাউকে--  
                ... এভাবে যে হিম দেখা দিলো
                    কে বলবে অতঃপর সেই হিমের কি হল
                    কেননা হিমেরও একটা কথা ছিল। ......                                         
                                      (কথা হয়েছিল)

বা,            ... কোন এক নীরব ও নিয়ত কথা আছে
                    এখন এখানে থেমে, আস্তে এসে, চুপ করে আছি
                    সব মায়া যোগ করে এই সব অন্তর্ভুক্ত কথা
                    জেনে যে নিতেই হবে জীবনে। ......
                                        (কিভাবে, কখন)
                                 

শুনে মনে হয় অল্প সাধারণ কথা এসব। জীবনের অনুভূতিগুলি, প্রাণ ধারণের  কথাগুলি নিঃশ্বাসের মতো লঘুসুরে বলেন তিনি সহজ সরল করে। আধুনিকতার বস্তুবিষাদ অবক্ষয়গুলো নয়, গিমিক নয়যুক্তিফাটলহীন জটিলতাহীন অনায়াসের  জীবনকথা। একজন ঋষির মতো উচ্চারণ, পরিষ্কার করে, আনন্দের বিস্ময়ের গ্রহণের কথা। তিনি বলতেন – ‘শব্দগুলো লক্ষ্য কর’। শব্দই আসল। ‘শব্দ’ ব্যবহারে ফোটেযেমন ‘হিম’ কথাটা কর্তা হয়ে গেলে হিম-কে কিভাবে উচ্চারণ করা যাবে, এবং সেই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ভাবনা কত নতুন পথে যাবে। শান্ত হও। নীরবের অবিরত কথা শোন। নিজেকে জাহির করা নয়, কথাগুলো তৈরি করে দেওয়া, ঘরের ভেতরের কথাগুলি, অন্তরের কথাগুলি। বিষয় বস্তু ও সময়ের প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, শারীরিক প্রেমের বদলে আন্তরিকভাবে কথা বলো।

তিনি কবিতায় প্যাশন, আবেগ, ইজম্‌, আন্দোলন, ট্রেন্ড এবং প্রভাব – সব কিছু এড়িয়ে গেলেন শুধু আবহমান বাংলা কবিতার পরম্পরাকে মান্য করে। কত কবিই তো আজও, এমন কি অনেক তরুণ কবিও, পরম্পরাকে স্বীকার করে নিয়ে গতানুগতিক কনভেনশনাল কবিতা লিখে চলেছে। কিন্তু সহজ সরল অথচ নতুনভাবে বলতে পারছে কে?

স্বদেশদা বলতেন – “ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি শব্দ, এবং শব্দকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সাজানো, অর্থাৎ, গঠনই কবিতার মূল চ্যালেঞ্জ। বিষয়বস্তু বলব না, কিন্তু একটা চিন্তাসূত্র বা চিন্তার আধার জরুরি। এই ধরতাইটা যদি অন্যরকম হয় তবে শব্দের ব্যবহার ও বাক্যের গঠনও অন্যরকম হয়ে যাবে। আমি কবিতায় এই দুটো দিক নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কতটা পেরেছি জানি না। কোন অনমনীয় উদ্যম নয়, দাঁতে নখে নয়। যা করেছি সজ্ঞানে, হৃদয়ের সম্মতি নিয়ে। এবং এই সব করতে গিয়ে পান্ডুলিপিতে অনেক সময় অনেক রকম যোগ বিয়োগ করতে হয়, আমিও করেছি। তবে এক-একজনের পরিমার্জনের উদ্দেশ্য এক-একরকম থাকে। অনেকেই তা করে থাকেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ব্যতিক্রম, যিনি বলেছিলেন – পরিমার্জনে ওনার বিশ্বাস নেই।। যিনি অন্যরকম কিছু করতে চান বা লিখতে চান তাকে সব সময় বিকল্পের কথা ভাবতে হয়। এই বিকল্পের ভাবনাই পরিমার্জন নিয়ে আসে। যথাযথটাই যথেষ্ট নয়। তার বাইরে যেতে হবে। এই বাইরে যাওয়া যতটা হৃদয়সম্মত ও অবলীলায় হয়, ততই ভাল”।(সাক্ষাৎকার, গ্রন্থি )।


যে বাক্যের কথা বলছেন তা তাঁর কথা, তাঁর কবিতা। এমন অবলীলায় গভীর বোধে সহজ করে বলা, যা মনে থেকে যায়। তুমি ধরো আপেল খাচ্ছো, বিশেষ করে, তুমি স্বাস্থ্য খাচ্ছো। কি করো তুমি -- জবাবে বল -- আপেল খাচ্ছি। বড় জোর নিউটনের দৃশ্যটি বা সূর্যটি। স্বদেশ সেন লিখলেন --
         “আপেল ঘুমিয়ে আছে, ওকে তুমি দাঁত দিয়ে জাগাও
         নতুন ছালের নিচে রক্ত চেপে খেলা করে দাঁত
        সহজে, আপন মনে, চরাচর শান্ত দেখে খুন হয়ে যায়”
                                      (আপেল ঘুমিয়ে আছে)

     
যখন শরৎ, আমাদের অঞ্চলে মেঘ সরে নীলাকাশ উঁকি মারছে, স্বদেশদা লিখলেন – “নীল রবারের থাবা পড়ে গেছে ওই সব আকাশের গায়ে”...... (দূরে এবার)। আবার কথায় আসি ---
                     “আমার কথার ওপরে এল তোমার কথা
                      ফুটে উঠলে তুমি গ্রামের রেলগাড়ির মতো ধীরে
                      একটা ঘাসের কায়দায় দাঁড়িয়ে শুনলে দুই কানে
                      এ জীবন থেকে ওই অন্য জীবন কথা”। ... 
                                        (সদা ফিল্মগুলি)
              
ভাবছি, আর উদাহরণ দেব না। সবাই স্বদেশ সেনের কবিতার বই পড়ে নিক। তাঁর প্রথম বই কৌরব প্রকাশনীর ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ – নিঃশেষিত। দ্বিতীয় বই ১৯৯৫ সালে কৌরব থেকেই ‘মাটিতে দুধের কাপ’। এটিও ফুরিয়ে গেছে। তৃতীয় বই 'কালিমাটি প্রকাশনী' থেকে ‘ছায়ায় আসিও’। নিঃশেষ। তিনটিই জামশেদপুরের প্রকাশনী। কলকাতায় না না না। এরপর কৌরব থেকেই ‘ঝর্নাকলম’ সমবেত সংকলনে ২০০৩ সালে তাঁর একগুচ্ছ কবিতার পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল। তাও নেই। সর্বশেষে ২০০৬ সালে কৌরব থেকেই ‘স্বদেশ সেনের স্বদেশ’ নামে নির্বাচিত কবিতা সমগ্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেটির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

যাকগে। স্বদেশদা আমাদের থেকে বছর দশেকের বড়। কিন্তু কবিতা নিয়ে কখনো মাস্টারি করেননি। শুধু বলতেন – পরম্পরাকে মনে রেখো। শব্দ নিয়ে ভাবো। সেই ভাবনাই অন্যরকমভাবে দেখতে বুঝতে লিখতে সাহায্য করবে। আমরা যতই পরম্পরা এবং পূর্ববর্তী কবিদের, এমনকি সমসাময়িক কবিদের অগ্রাহ্য করি, কবিতা ধর্ষণ করি, স্বদেশদা শান্ত চিত্তে বলেন – নেগেট কর তাদের নির্মাণকে। তাদের ভাবনাকে নয়। কবি মানুষগুলোকে অস্বীকার করো না। কবিতার ক্যাম্পে সমানে তর্ক হতো। চললেন তিনি আমাদের সাথে ক্যাম্পের পথে সমান তালে। নবগ্রহ সম্মেলনের দিন দুপুরে চাঁদিপুরে একমাইল জলের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমাদের সাথে হাঁকড়ে পাকড়ে বুক ঘষটে দলমা চূড়োয় উঠলেন। বরাইবুরু ডাকবাংলোয় বা সুবর্ণরেখার গায়ে জয়দার বাংলোয় সারারাত তর্ক করলেন। আমাদের আর এক বন্ধু ছিলেন প্রয়াত বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, বীরেনদা, যিনি সুদর্শন আর শৌনক গুপ্ত ছদ্মনামে অনেক উপন্যাস ও জীবনীগ্রন্থ লিখেছিলেন, বিদেশী সাহিত্য আর সাহিত্যিকদের পরিচয় করিয়েছিলেন, আমাদের পশ্চিমের জানালা, ভীষণ ভালোবাসতেন আমাদের। বীরেনদা  আর স্বদেশদাকে দুই বগলে চেপে, অর্থাৎ আমার মোটর বাইকে বসিয়ে হাইওয়ের পাশে মাঠের গাছতলায় বসে মদ্য সহযোগে পদ্য নিয়ে সমস্যার গল্প চালানো ঘন্টার পর ঘন্টা -- অর্থাৎ স্বদেশ সেনকে পিছুপা হতে দেখিনি কখনো। কিন্তু আমাদের মতো টগবগ করতেন না তিনি। ধীর স্থির শান্ত ছিল তাঁর মতামত। সবসময় ঘটনার পজিটিভ দিকটা দেখতে আর কবিতায় প্রকাশ করতে বলতেন। আজীবন তিনিও তাই করে গেছেন। আশি, নব্বই, এমনকি শূন্য দশকের কবিদের কাছেও তিনি এক বিরল কবি। তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ পেলে আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেত সবাইপরম্পরা, শব্দ, বাক্যের কথা, কনভেনশন থেকে অন্যরকমের কথা, নতুন কবিতার কথা বলবেন না তিনি আর কোনোদিন নিঃশব্দ হয়ে গেছে তাঁর ছবি।

কম বয়সে সবাই সিনিয়ার কবিদের কবিতা পড়ে প্রভাবিত কবিতা লেখে। আমি কিন্তু কমল চক্রবর্তীকে আমার প্রথম গুরু মেনে তাকে ফলো করতাম। তারপর স্বদেশ সেন আমাদের প্রভাবিত করেন, কমল বাদে। সেই প্রভাব আমরা কাটিয়ে উঠেছি নিজস্ব ডিকশন তৈরি করে। স্বদেশদা ডিকশনের কথা খুব বলতেন। তাঁর কবিতার লাইনগুলো কথাই। এমন সরল স্বাভাবিক মুখের কথার মতো কথা যে, তা থেকে নিষ্কৃতি ছিল না। ভাবতাম, স্বদেশদার কবিতায় কারো প্রভাব দেখি না কেন? ১৯৬৮-তে কৌরবের সঙ্গে মেশার আগেকার কবিতা আমরা পড়িনি, তিনি দেখাননি কখনো। হয়তো সেখানে ছিল কোনো সূত্র। পরে বোঝাই যায়নি। যিনি পরম্পরাতে তাঁর শিকড়  বলে স্বীকার করতেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের মতো মহীরুহ পেরিয়ে নতুন কবিতার জীবন পেলেন কীভাবে? সব কবিকেই একটা লড়াই চালাতে হয় প্রভাবমুক্ত  হয়ে, মৎস্যমুক্ত হয়ে একই সমুদ্রে স্বাধীন সাঁতার কেটে টিঁকে থাকার জন্য। একটা কবিতা যেমন আর একটা কবিতাকে ট্রিগার করে, একজন মহাকবিও তেমনি আরো কবির জন্ম দেন। জন্মসংবাদটি কবি গোপন করে, অস্বীকার করে, প্রতিবাদ করে। তারপর সব ভুলে যায়। এই লড়াই পরম্পরার মধ্যে এক অদ্ভুত লড়াই। স্বদেশ সেন বারেবারে পরম্পরার কথাই বলেছেন। বরিশাল জেলার বারোকরণ গ্রামে জন্ম তাঁর। জীবনানন্দের জন্মও সেই জেলায়। বরিশাল থেকে হোক বা বাংলার প্রাকৃতিক প্রাণবায়ুর জন্য হোক, তাঁর কবিতায় ক্ষীণ সম্পর্ক পাওয়া যায় একমাত্র জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে, গ্রামবাংলার গন্ধ মাখা যদিও দুজনের ডিকশন আলাদা, ছন্দ, উচ্চারণ, দৃষ্টি আলাদা। স্বদেশ সেন শুধুমাত্র বাংলা ভাষার স্বাভাবিক লিরিক ব্যবহার করেছেন জীবনানন্দ প্রায় সর্বত্র পয়ার ছন্দ। জীবনানন্দ আধুনিকতার অবক্ষয় থেকে তাঁর কবিতা ভাবনা পেয়েছিলেন, স্বদেশ সেন সেই আধুনিকতাকে সম্পূর্ণ পরিহার করে গেছেন। তিনি পশ্চিমের শেখানো উত্তর আধুনিকতাকেও অর্জন করেননি। নকল করার প্রবণতা তাঁর মধ্যে ছিলই না। অথচ যত না তিনি বাংলার কবিদের কথা বলতেন, তার চেয়ে বেশি বলতেন বিদেশী ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ কবিদের কথা। তিনি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত নন। মাত্র প্রবেশিকা স্নাত। কলেজে ঢুকেও শেষ করতে পারেননি অর্থাভাবে। চাকুরিতে অ্যাকাউন্ট সেকশনে সামান্য কেরাণির পদে থেকে সংসার চালানো মুশকিল হলে প্রাইভেটে কস্টিং পড়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন চাকুরিতে উন্নতির জন্য। “কোন বিপর্যয়ের মাধ্যমে জীবন থেকে জ্ঞানার্জন হয়”, এই কথা তাঁর ওপর খাটে না। বরং পরে দেখি কোম্পানিতে তালা লাগলে উপার্জন নিয়ে ঘোর সমস্যায় পড়েছিলেন। তার আগেই অবশ্য তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর ভাবনাচিন্তাজাত সেদিনের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি।



আরো একটা ব্যাপার আছে। ‘থ্রোনেস’। মায়াহীনভাবে নিজের সমস্ত উপার্জন ছুঁড়ে ফেলা, ত্যাগ করা, দাবী নেই – এমন ভাব। কত কম কাজ করে কবিরা নিজের ঢাকঢোল বানিয়ে ফেলে নিজেই তা বাজাতে থাকেন লজ্জা পেলে ঢাকি জোগাড় করে নেন অনুগত কবিদের মধ্য থেকে। বছরের পর বছর আমরা বাজনা শুনতে থাকি। কান ফেরাবার উপায় নেই। আর এই স্বদেশ সেন শুধু কথাগুলো তৈরি করেছেন আর উচ্চারণ করে ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের অস্তিত্ব, প্রতিষ্ঠা, আর কবিতাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না তাঁর। সেই উচ্চারণ লেগে আছে আমাদের কানে, আমাদের  জিভে। অতি বড় জ্ঞানী বা বিজ্ঞানীর কথা নয় সেসব। সেসব সাধারণ মানুষের সাধারণ কথা, কবির কলমে। সত্য নিয়ে একেবারেই ভাবিত ছিলেন না তিনি। সংবাদ নিয়েও। সেসব সমাজসেবী বা রাজনীতিকের দায়িত্ব – তাঁর কথা। সত্য বা সংবাদ কবিতার অনুভূতি জাগায় না। কবির বিবেচ্য তার শিকড়ের কথা, অন্তরের কথা,  ঘরের কথা, জীবনের কথা। সেখানে স্মার্টনেস, বাউন্ডুলেপনা, ভ্রমণ, বেঁচে থাকার কৌশল, অলীক স্বপ্ন আর বিপ্লবের বাণী ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে বেরোতে পারে নাঅথচ তাঁর কবিতা নৈর্ব্যক্তিক নয়। কবিতার কথা বলেন সবাইকে জড়িয়ে। বলেন                          
                   ... ‘হে অনেক আমগাছের দেশ’......
                   ... ‘ওই দ্যাখো ময়মনসিংহের ছেলে চলে যাচ্ছে’......
                   ... ‘ধরে রেখে লোকটাকে চেনো’......
                   ... ‘মনে হয় পরিতোষ, মনে হয় কত দিন ছিল’......
                   ... ‘কার মন তোমার সোয়েটারে’......

না, আর বলব না। ভেবে দেখেছি স্বদেশ সেনের কবিতা স্পর্শ করার জন্যও একটা নির্মল হৃদয় চাই। সেই পাঠককে চাই যে হৃদয়ের কথা শোনে। বললে অবাক লাগবে দোস্ত, সবাই হাঁপিয়ে উঠেছে। নির্মল হৃদয় আসলে সবার চাই, সবাই চায়। সবার মধ্যেই সেই দরজাটা আছে। স্বদেশ সেনের কবিতা পড়লে সেই দরজা খুলে যায়জ্ঞান, উত্তর আধুনিকতা, আত্মাভিমান, নার্সিসাস কমপ্লেক্স, টিঁকে থাকার স্মার্টকার্ড --সব ভেসে যায়। মানুষের নির্মল মনটি বেরিয়ে এসে আনন্দে স্নান করে।
                               ‘কোথায় এক পরিবর্তন
                                প্রচল থেকে কোথায় আছে অন্য
                                অরুণা যায় থেকে অরুণা আসে
                                এই সামান্য মুদ্রায়
                                দিনরাত ও শরৎ হেমন্ত সব যায়’।
                                     (কোথায় এক পরিবর্তন)
                          
                   ‘নতুন কোথায় থাকে, নতুনের কোন দুঃখ নেই?
                   মানুষ যেমন করে কুসুমপাতায় ঠোঙা বাঁধে
                   সেভাবেই বাঁধো তুমি মেঘ থেকে জল নামানো পাতা?’
                                  (নতুনের কোন দুঃখ নেই)    

        
    
আর নয়। এবার একটু অন্য কথা। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে, যারা চিন্তা ভাবনা করেন তাদের মধ্যে বেশি করে, স্ববিরোধিতা থাকেকবির মধ্যে স্ববিরোধিতা কবিতায় নয়, তার স্বভাবের মধ্যে থাকে যা তার সাংসারিক ইমোশনাল কোশেন্টের রিফ্লেকশন। অন্যের প্রতি ব্যবহারে স্ববিরোধিতার প্রকাশে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে অনবহিত থাকেন তিনি। সেটা অপরের কাছে দুঃখসূচক। মানুষ হিসাবে কবি স্বদেশ সেনের মধ্যে এই দোষটি লক্ষ্য করেছিলাম আমি। আমার ধারণা কবি বা পাঠকদের মধ্যে শ্রদ্ধাশীলতা পারস্পরিক হয়। রাম অচেনা শ্যামের কবিতা খুব পছন্দ করলে শ্যামও অচেনা রামের কবিতা পছন্দ করবে, কারণ তাদের ভালো লাগার বিবেচনা  কাছাকাছি। আমি স্বদেশ সেনের কবিতা অসম্ভব পছন্দ করতাম। তার মানে এই নয় যে সব কবিতা-পাঠকরাই স্বদেশদার কবিতা ভালোবাসেন। তাঁর কবিতার বইয়ের  বিক্রির রেকর্ড দেখলে সেটাই মনে হয়। ১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হলে সর্বপ্রথম, ও একমাত্র আমিই সেই বই নিয়ে বিস্তারে গদ্য লিখেছিলাম কৌরবে প্রথমে, এবং পরে অজস্র পত্রিকায় তাঁর অন্যান্য কবিতা নিয়ে অক্লান্তভাবে। সেসব লেখার কোনোটাতেই তিনি আমল দেননি, খুশি হয়েছেন বোঝাননি, আস্থা দেখাননি  আমার বোঝাপড়ার ওপর। কারণ আমাকে তিনি কবি বলেই ভাবেননি কখনো। আশি দশকে কৌরবের কবিতার ক্যাম্পের ফলশ্রুতি হিসেবে আমার কবিতার বই বেরিয়েছিল,  'মায়াবী সীমূম' ১৯৮৫ সালে। বইটি আমি স্বদেশ সেনকে উৎসর্গ করেছিলাম। বইটি  তাঁর বাড়িতে তাঁকে দিতে গেলে তিনি বাড়িতে উপস্থিত থেকেও বইটি গ্রহণ করেননি। এই দুঃখ আমি কোনোদিন ভুলবো না। তাঁর কবিতার প্রশংসা ‘একদিন’ পত্রিকার  গোঁসাই বাগানে জয় গোস্বামী যখন করলেন, স্বদেশদা সেই পত্রিকা সংগ্রহ করেন বাজারে গিয়ে এবং তাতে তিনি ভিসুয়ালি অহংকৃত হন। নব্বই দশকে কবিতা ক্যাম্পাসের দশকব্যাপী কবিতার কর্মশালায় আমি স্বদেশ সেনের কবিতার পরিচয় দেবার পর নতুন কবিতার সন্ধানী কবিরা স্বদেশ সেনকে ‘নতুন কবিতার জনক’ আখ্যা দিলে তিনি সেটাকে আমল দেননি। সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। স্ববিরোধিতার আরো অনেক উদাহরণ আছে তাঁর জীবনে। সবারই আছে। কিন্তু তা যে মানুষকে দুর্বল করে সেটাই টের পান না কেউ। স্বদেশ সেনের প্রয়াণের পর কবি হিসেবে একমাত্র আমিই তাঁর মৃতদেহে প্রণাম করে চুল্লিতে দিয়েছিলাম। খরকাই নদীর জলে অস্থি বিসর্জন করে ফেলেছিলাম প্রিয়জন বিচ্ছেদের অশ্রুআমাদের স্বদেশদা আর নেই। রয়ে গেছে তাঁর ছেড়ে যাওয়া অক্ষর কথামালা, কোনো পাঠকের জন্য। সকালে উঠিয়া  আমি মনে মনে বলি --  যদাপি আমার লেখা মন্দ বলেন / তথাপি আমার গুরু স্বদেশ সেন।
 ঠিক হলো না, না? যাক গে। অলমিতি।



(স্বদেশ সেন। জন্ম – ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫ সাল, বরিশালে। মৃত্যু – ৫ মার্চ ২০১৪  সাল, জামশেদপুরে।)
                                                       

            

1 টি মন্তব্য:

  1. লেখাটি বেশ ভালো লাগলো।সর্বশেষ প্যারডিটি এককথায় দারুণ। প্রসঙ্গত জয় গোস্বামীর 'গোঁসাইবাগান। কলমটি খুব সম্ভব 'প্রতিদিন' পত্রিকায় বের হতো, 'একদিন' নয়।

    উত্তরমুছুন