'চাদর হো গই বহুত পুরানি...'
'বেঁচে থাকার অনেক আশা প্রিয়তমা বধূ আমার
তোমাকে ভালোবাসার মতো একাগ্র বেঁচে থাকা...'
গান কেন শোনে মানুষ? কবিতাই বা কেন? বা যা কিছু সৃষ্টির খতিয়ান তেল-নুন-লকড়ির বৃত্ত পেরিয়ে মানুষকে আরো ভালোতর মানবের দিকে একটু এগিয়ে দেয়। গান না শুনলে কীই বা ক্ষতি বা শুনলে কোন মুদ্রাময় লাভই বা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায়। জানি না, কারণ এই নিয়ে ভারতের সংবিধানে তো কিছুই লিখে যাননি কত্তারা। আমরা পোকামাকড়, কীভাবেই বা বিচার করব তার।
হয়তো প্রশ্নটি নিতান্ত সহজ, মানুষ কেন গানের কাছে আসে? আসতে চায়? গানের কাছে কী প্রত্যাশা থাকে শ্রোতার? উত্তরটিও বিশেষ কঠিন নয়। সমস্ত সিদ্ধ শিল্পীর নিজস্ব ধরনের যাত্রা থাকে, আর থাকে একান্ত আকাঙ্ক্ষা, শ্রোতাকে নিজের সহযাত্রী করে নেবার। তন্নিষ্ঠ শ্রোতার আকাঙ্ক্ষা, গানের অনন্ত ঝরনাতলায় সাঁঝের বেলায় গিয়ে বসার জন্য একটি আসন। আর কিছু নয়। তবু প্রশ্ন একটা থেকেই যাচ্ছে, যদি শুনি, তবে কোন গান শুনব? কখন শুনব, কীভাবে শুনব?
আমার এক প্রিয় বন্ধুকে একটি গানের অনুষ্ঠানে যখন সঙ্গে যাবার কথা বললুম, সে একটুক্ষণ ভেবে আমাকে একটা দারুণ প্রশ্ন করল। ওরা তো গাইবে, বাজাবে;
যতক্ষণ সে সব শুনব, ততক্ষণ আমি ঠিক করবটা কী? এমন একটি প্রশ্ন একেবারে আশংকা করিনি। একটু হতভম্ব হয়ে বললুম, কেন গান শুনবি!
তা তো এমনিতেই শুনব, কিন্তু করবটা কী?
প্রশ্নটি একটু হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সরল নয়। শিল্পী যখন গান শোনান, শ্রোতার ভূমিকাটি কতটা সকর্মক? প্রশ্নটির উত্তর খুব একটা স্বতঃসিদ্ধ নয়। 'একাকী গায়কের নহে তো গান' ইত্যাদি ব্যাখ্যা চলেই আসতে পারে। কিন্তু সে তো দীক্ষিত মননের লক্ষণ। শতকরা কতজন 'দুইজনে' মিলে গাইবার এলেম রাখেন? শ্রোতা হিসেবে নিজস্ব প্রস্তুতির মাত্রাটি কী পরিমাণ হলে যথেষ্ট হবে? শিল্পীর প্রতি 'অপরিণত' ও 'পরিণত' শ্রোতাবর্গের প্রত্যাশা কীভাবে তৈরি হয়? একটা উদাহরণ দিই। সুমনের একটি গান আছে। সেখানে তিনি প্রথমেই আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন একজন কিংবদন্তীর কাছে, যাঁর নাম ভীমসেন যোশি। যাঁরা ভীমসেন বা সুমনের গান দুইই চেনেন, বড় কিছু একটার স্বাদ পেতে প্রস্তুত হতে থাকবেন। তাঁদের প্রত্যাশার একটা রূপরেখাও তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু যাঁরা দুজনকেই ঠিকঠাক চেনেন না, কিন্তু গানটি শুনছেন, তাঁরা ঠিক কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, যখন একটু এগিয়ে সুমন ভীমসেনের বকলমে কোমল রেখাবের রূপ নিয়ে উতলা হয়ে পড়তে চাইছেন! যে শ্রোতা কোমল রেখাবের শাস্ত্রীয় বা অন্তর্লীন জাদু নিয়ে খুব একটা ওয়াকিফও নয়, সেও একটু এগিয়ে গিয়ে বুঝতে চাইছে এই কোমল-টোমল ব্যাপারটা কী? তারপর জোগিয়ার হাত ধরে প্রবেশ করছেন নজরুল। একটু একটু চেনা লাগছে যেন। ধীরে শ্রোতারা বালিকাটির ফুল ছড়ানোর খেলায় অজান্তে মিলিত হয়ে যাচ্ছেন। সুমনের গলায় সুরের অনর্গলতা নিয়ে যদি সংশয় থাকে তবে বলি, তাঁর কণ্ঠ মূলত ব্যারিটোন। এই ধরনের কণ্ঠে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগরূপ ফুটিয়ে তুলতে যে মোচড় আনতে হয়, তা সর্বদা আসে না। উঁচু স্কেলে গেলে তীক্ষ্ণতা আসবে, কিন্তু মাধুর্য আসবে না। তাই সুমন সে প্রয়াস করেন না। তাঁর যেটা সম্পদ, মন্দ্র সপ্তকে কণ্ঠকে বশে রেখে খেলানোর কৌশল, সেটিকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করেন। অর্থাৎ গানের একটা শরীর তিনি তৈরি করে দিচ্ছেন, শ্রোতার ধরাছোঁয়ার মধ্যে। এবার শ্রোতা সেই গানটি নিয়ে কী করবেন, সেটা তাঁর অধিকার। তবে এটা নিশ্চিত, গানের শরীর নিয়ে যাই অবস্থান থাকুক না কেন, শিল্পী ও শ্রোতার ভিতর একটা ভাববন্ধন তৈরি হচ্ছে। গানের কাছে সেটাই তো প্রত্যাশা।
গান শোনার ইচ্ছে কি কোনও পূর্বাগ্রহের উপর নির্ভর করে? অর্থাৎ, যে জাতীয় গান আমি দীর্ঘকাল ধরে শুনে একটা অভ্যেস তৈরি করে ফেলেছি। যেমন ধরা যাক, রবিবাবুর গান। এত শোনা, এত এত শোনা, তবুও সেখানে নতুন কিছু আবিষ্কার করার একটা নেশা ধরে গেছে। 'এই উদাসি হাওয়ার পথে পথে' বা তার অসংখ্য সহোদর গান কী কখনও আমাকে 'বোর' করতে পারবে? ভাবা যায় না। আবার অন্য একটা দৃষ্টিকোণও তো আছে। গুলাম আলি যেমন বলেছিলেন, যা কিছু সুরে গাওয়া হয় আমি তার গোলাম। বা ভৈরবীর জাদু বোঝাতে গিয়ে উস্তাদ আমজাদ আলি খান সরোদ নামিয়ে গেয়ে ওঠেন, 'চিঙ্গারি কো-ই ভড়কে...'
গানের শরীর কীভাবে তৈরি করা হয়, সেটা বোঝার আগে কয়েকটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে। সুরস্রষ্টারা আমাদের রাগ সম্পৃক্ত গানগুলি কম্পোজ করার সময় আমাদের টাইমস্কেল বা ঋতুমনস্ক স্বরের প্যাটার্নগুলি মনে রেখে চলেন। রাতের রাগ বা ভোরের সুর, বর্ষা বা হেমন্তের আবেশ কীভাবে সুরের মধ্যে আসবে তা নিয়ে প্রায় দু'হাজার বছর ধরে দিগগজেরা সীমাহীন ডিসকোর্স করে গেছেন। যদি আমরা তাঁদের এই সেরিব্রাল সাধনার স্বরূপটি বুঝতে চাই, তবে তো নিজেকে সামান্য 'শিক্ষিত' করতেই হবে। কয়েকটি পর্দা নিয়ে গঠিত সুরের নির্দিষ্ট ফ্রেজগুলি কেন একটা বিশেষ আবহ তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হয়, তার একটা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেটাকে প্রশ্ন করে আত্ম অভিমান অনুভব করা যায় হয়তো, কিন্তু শিল্পসন্ধানের একটা আবশ্যিক শর্ত হিসেবে সমর্পণের বিকল্প নেই। আবহমান ব্যবস্থাটির প্রতি কিছু ভরসা রাখতে হবেই। এটাই হয়তো কন্ডিশনিং। যেমন ছবিতে যেখানে ধূসর রং দিয়ে মেজাজ তৈরি করার কথা, সেখানে সিঁদুর লাল লেপে দিলে সেটা আর শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। সুরের ক্ষেত্রেও সে রকম আমরা দেখতে পাই আমাদের গানে কোমল রেখাব বা কোমল নিষাদের মায়াবী জাদু। কীভাবে, কোন মুহূর্তে একটি ক্ষণিক স্পর্শস্বর দিয়ে শ্রোতার মনে একটা হুলুস্থূল ঘটিয়ে দেওয়া যায়, সেটাই তো শিল্পের সিদ্ধি। কোনও রকম বিশদ কালোয়াতি তান সরগম সেসব ক্ষেত্রে বাহুল্য বোধ হয়। অস্যার্থ, একটি গানকে কানে শুনে নিজের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাইলে কিছুটা ব্যক্তিগত প্রস্তুতি প্রয়োজন। আগেকার দিনে রাজাবাদশার দরবারে উচ্চাঙ্গের গান শুনতে তাঁদেরই প্রবেশাধিকার ছিল, যাঁরা কিছুটা হলেও গানের গভীরে যাবার অধিকারী হতে পারতেন। একালে কারিগরি উন্নতির কল্যাণে গান শোনার সুযোগ অনন্ত, কিন্তু সঙ্গীতের গভীরে যাবার শিক্ষা কোনও ইশকুল-কলেজে দেওয়া হয় না। শ্রোতা বেড়েছে, সমঝদার কমেছে। বহ্বাড়ম্বর বেড়েছে, উপলব্ধি কমেছে। কারণ চালাকি ও মহৎ কাজ হাতে হাত রাখে না, কখনোই।
অভ্যস্ত বা মরমী শ্রোতা যখন একটি প্রত্যূষে গেয় রাগ শুনতে যাবেন, তখন তাঁর প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যাবে ভোরের সুরে নিজেকে ধুয়ে নেবার জন্য। সমস্ত ভোরের রাগে মূলত কোমল বা অন্য রেখাবের জাদু শ্রোতাকে তৎক্ষণাৎ মুগ্ধ করে। যদি তার বিশদ হাল হকিকৎ শ্রোতার জানা নাও থাকে, তবু সে এটুকু অনুভব করবেই, কুছ বাত বন রহি হ্যাঁয়। এই রকম একটা সময়ে সিদ্ধ শিল্পী অকারণ তানকারি আর সরগম করার ইচ্ছে সম্বরণ করবেন। সেটাই শিল্পীর সংযম। সুরের শাস্ত্রীয় তাৎপর্য সম্বন্ধে খুব উত্তম রূপে ওয়াকিফ যে শিল্পী, তিনি নিজের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাকেও এগিয়ে যা'ন। অপরিণত গায়কদের ক্ষেত্রে চমকে দেবার প্রবণতা খুব সুলভ। একই নিয়মে অপরিণত শ্রোতারাও 'চমকে' যেতে ভালোবাসেন। ডুবে যেতে তাঁদের তেমন মন করে না।
সম্ভবত খেয়ালের জাদুকর রজব আলি খান গাইবার সময় সরগম পাল্টা এসব করতেন না। তাঁকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, যখন বাড়িতে অতিথিকে দাওয়াত দেওয়া হয়, তখন কি ভোজনের সময় বিভিন্ন কাঁচা মাল, মশলা ইত্যাদি সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশন করা হয়? সরগম পাল্টা রিয়াজের অঙ্গ, আসরে গাওয়ার বস্তু নয়। তবু বহু সিদ্ধ শিল্পী গায়নের সময়, শ্রোতারা চায় বলে সরগম-পাল্টা প্রস্তুত করেন, কিন্তু সংযত মাত্রায়, পরিণত শৈলীতে। আর তাও নিখাদ খেয়াল পরিবেশনের সময়ই করা হয়। কোনও কোনও লঘুসঙ্গীত গায়ককে দেখা যায় বাহাদুরি দেখানোর অপরিসীম ইচ্ছায় বাংলা কাব্যগীতি পরিবেশন করার সময় যদৃচ্ছ পাল্টা-সরগম করে যেতে চান। সবাই তো আর মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় হয়ে জন্মান না! এ ব্যাপারটি ভুলে গেলেই বিপর্যয়। কণ্ঠ বা গায়নের তৈয়ারি খুব জরুরি শর্ত, কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে, গানটি শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছোল। কণ্ঠসম্পদকে যথাযথ সংযম ও পরিণতমনস্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারার মননটিই একজন শিল্পীর সিদ্ধি।
বিভিন্ন গানের টিকে থাকা নিয়ে যে প্রশ্ন ওঠে, সেখানে দেখি আজকের টু মিনিট কালচারে দশবিশ বছর যেসব গায়ক টিকে যাচ্ছেন, তাঁরা নিজেকে বেশ তালেবর ভেবে থাকেন। হেমন্ত-মান্না ছেড়েই দিচ্ছি, পান্নালাল ভট্টাচার্য, অখিলবন্ধু ঘোষ, শচীন দেববর্মণ ষাট সত্তর বছর ধরে শ্রোতার কানে ও মননে যে ধরনের আবেদন রাখছেন, তার জুড়ি এ সময় কতজনের মধ্যে আছে? অথচ পরবর্তীকালে কণ্ঠসম্পদ ও গায়ন দক্ষতার অভাব তো দেখি না। গত দুই দশক জুড়ে টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অসংখ্য নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের পরিবেশনা শোনা যায়। এককথায় অনেকেই চমৎকৃত করেন। উল্লেখিত এই সব শিল্পীর গান নিয়ে যখন আমাদের ছোটবেলায় বাবা-মা উচ্ছ্বসিত হতেন, আমাদের বিস্ময় জাগত। কী আছে এই সব প্যানপ্যানানি গানে? তার পরে যখন আমাদের একটু কান তৈরি হলো, ঘন্টার পর ঘন্টা এঁদের গান শুনেছি, আমার মেয়েরা বিস্মিত হতো, বাবা কী শোনে সর্বক্ষণ? একদিন বসে তাদের বোঝাই, ওদের সময়ের কম্পোজার, ধরা যাক, শান্তনুর তৈরি গানে কীভাবে নিছক পুরনো মেলোডির নানা বিন্যাসকে নতুন ছাঁটের জামা পরিয়ে একের পর এক জেন-এক্সের হিট উঠে আসছে। তারা চমৎকৃত হয়।
অনেক শ্রোতার সঙ্গীতরুচি একটু সৃষ্টিছাড়া। অথবা বলা যায় সীমাহীন তার তেষ্টা। এই সব শ্রোতা পার্থিব যুদ্ধের গান অথবা অপার্থিব দেবতাকে শোনানোর মগ্ন আবেগের সুর, তার মধ্যে কোনও ব্যবধান কখনও খুঁজে পায় না । যেমন ভীমসেন যখন বলেন 'যো ভজে হরি কো সদা, সো হী পরমপদ পায়েগা, তখন এটা তো জানাই আছে যে হরি কোথায় থাকেন, আদৌ আছেন কি না সে সবের কোনও মানে নেই এখানে। কিন্তু ভীমসেন যেভাবে আমাকে বলছেন, তার মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোনও অবকাশ নেই। তিনি আমাকে হরির কাছে নিয়ে যাবেনই। একেই কি সন্মোহন বলে? বা তিনি যখন অভঙ্গ ভজন করতে গিয়ে বিঠ্ঠলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান, আমি জানি বিঠ্ঠল এই সুবিশাল দেশের কোনও এক প্রান্তের স্থানীয় দৈবী বিশ্বাসমাত্র। ব্যক্তি আমার কাছে তাঁর কোনও আবেদন নেই। কিন্তু বুঁদ হয়ে শুনে যাই, 'তীর্থ বিঠ্ঠল, ক্ষেত্র বিঠ্ঠল'। অথবা অশ্বিনী দেশপান্ডে যখন শোনান, 'চাদর হো গই বহুত পুরানি, অব তো শোচ সমঝ অভিমানী...'। সেই নিবিড় রূপসী শিল্পী, যাঁর গায়ন আরো রূপস্বিনী, এত অভিরাম মগ্নতায় বলে যান, 'শোচ সমঝ অভিমানী...'। তখন যতই না কেন নিজেকে বলি, 'না আমি অহংকারী নই, আমি ভালো হতে চাই, তিমিরবিনাশী হতে চাই...' কিন্তু ভিতরের অন্ধকার তো ঘোচে না। সে কথা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? হ্যাঁ জানে, সেটাই আমার গান।
ইদানিং বাংলা গান বিচারের একটা অর্বাচীন লক্ষণ হলো গানের আগে রাগ'কে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ প্রয়াস। যেমন অনেকে এখন রবিবাবুর গানকেও মূল রাগের সুরসংস্থান অনুযায়ী ভাগ করে গাইতে চান বা পৃথকভাবে তার বর্গীকরণ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, গানটি 'হয়ে' উঠছে কি না তা নিয়ে চিন্তা করা অথবা তার সুরের কাঠামো কোনো রাগের আরোহ-অবরোহের সঙ্গে মিলছে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। রবিবাবুর পর বাংলা কাব্যগীতিতে লিরিকের সম্মান সুরের উপরে চলে গেছে। কিন্তু 'গান' যেহেতু 'গাওয়া' হয়, আবৃত্তি করা হয় না, তাই সুরের প্রতি তন্নিষ্ঠ না থাকলে শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি দাঁড়াবে না। এ একটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ ও সংযমের খেলা। তাই বাংলা গানটির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি আমরা অপ্রয়োজনীয় ভাবে নিকটতম একটি রাগের আরোহ-অবরোহের বিস্তার করতে থাকি তবে তা বিড়ম্বনার সূচনা করে। যদি আমাকে সেই 'রাগ'টিকে জড়িয়ে ধরতে হয় তবে তার জন্য তো অঢেল মহীরূহদের জাগ্রত সৃষ্টিগুলি আমার শোনার অপেক্ষায় রয়েছে। কাব্যগীতির কাঠামোয় 'রাগ' প্রতিষ্ঠার আতিশয্য অবাঞ্ছিত বোধ হয়। কবি বলছেন, 'যেন আমার গানের শেষে, থামতে পারি সমে এসে...'। এই সমে থামতে পারার ক্ষমতাই সব সৃষ্টির সাফল্যের প্রথম ও শেষ কথা।
জানি বাংলাগানে বড়মাপের শিল্পীদের আকালের দিনে লোকপ্রিয় শিল্পীদের দায়িত্ব অনেক। যাঁদের সাঙ্গীতিক কৌশলের মধ্যে খামতি বাকিদের থেকে কম, তাঁদের কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকে। পরবর্তী প্রজন্মের শ্রোতাদের রুচি তৈরি করতে তাঁদের দায়িত্বও অন্যদের থেকে বেশি। কোনও জীবন্ত সংস্কৃতির জন্য সুরের স্রোত মানবশরীরে রক্তস্রোতের মতো জরুরি। তাই তার প্রতি সনিষ্ঠ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। 'গান' শুধু জনমনোরঞ্জনের মাধ্যম নয়, তা মানুষের বৌদ্ধিক অস্তিত্বের অঙ্গ। শিল্পী এটা বুঝতে পারেন বলে জিতে যান। আবার এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকার দায়ে শুদ্ধমাত্র গায়ক অনেক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ম্লান হয়ে যান।
সন্ত কবির যে বলেছেন, 'চাদর হো গই বহুত পুরানি...'। তবুও সুননেওয়ালোঁর মাথায় চারদিকে মৌমাছির মতো গুনগুন করে গান ঘুরে বেড়ায় সব সময়। চাদর কি সত্যিই অনেক পুরনো হয়ে গেছে? নতুন করে কিছু ভাবা যায় কি? মানুষেরই বানানো কোনও অলীক আমিন মেপে দিয়ে গেছে আমাদের সাড়ে তিন হাত জমি। সেখান থেকে গান কি আবার উঠে আসবে "আজ নূতনের বাঁশিতে"?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন