ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(১০)
জ্বর এসেছিল রাতে। সমুদ্র থেকে
ফিরে এসে ক'দিন কাজে কাজে কেটে গেছে। ডিজাইনের কাজ করতে করতে
লেখাও বন্ধ ছিল। কাজ শেষ হলো
আর জ্বর এ্লো। পুরনো
ব্যথাটা ভোগায় এখনো। মাঝেমধ্যেই বাঁ দিকটা ফুলতে থাকে। ক'দিন বেশি চাপ পড়লেই শুরু হয়ে যায় ব্যথার মরসুম।
তিতলি নেই। তিতলি গেছে
তার বাবা- মা'র কাছে। অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে থাকাটা বেশ ক্লান্তিকর। ঘুম আসছে না। দিনের
বেলা ঘুমোনো অভ্যাস নেই তার এমন তো না! কিন্তু সে হলো সারারাত টানা কাজের
পর ঘুমোনো। এভাবে রাতের ঘুমের পর দিনের ঘুম শরীর চায় না। মন চায় না। মন চায় যা তা
মন পাবেই এমনও তো না! মন চায় সঙ্গ। সঙ্গ কই?
দেড় বছর শুয়েছিলাম একটা বিছানায়।
তার জানালা
দিয়ে আসত দিন, আসত রাত। বিতস্তা
আসেনি কখনো। যখন সুস্থ ছিলাম তখন ফোনে জানতে চাইত রাত-বিরেতে,
- তুমি
আমাকে একটুও ভালোবাসো
না, না?
এ কথার উত্তর হয় না। বা উত্তর
একটাই। এমন
মোলায়েম বিধুর স্বরের মধ্যে দিয়ে আসা শব্দতরঙ্গ একটা ঢেউ তুলবে,
এই তো চাওয়া? বুঝতে পারতে হয়।
আমি বুঝিনি।
আমি ঢেউ-এর পেছনে পেছনে একটি সমুদ্রের আগমনের আশায় আশায় থেকেছি প্রতিদিন। বিতস্তা
কেন, প্রায় কেউই আসেনি। হাতে গোণা কয়েকজন। বাকি যাদের জন্য দিনরাত এক করে খেটেছি,
খাইয়েছি-পরিয়েছি, সারাদিন উদ্বিগ্ন থেকেছি, তারাও কেউ আসেনি। তারা কেউ আমাকে ভালোবাসে বলে গোলাপী রঙ-এর
দাগ কাটেনি।
বিতস্তা কেটেছিল। এবং তখন বিতস্তার দিনরাতের ব্যস্ততা ছিল তার অফিসের প্রেমিক যে তাকে বেড়াতে
নিয়ে যায় তাকে নিয়ে। বাইরের প্রেমিক যে তার সিভি লিখে দেয়,
তার জন্য বাজার করে, মদ কেনে, তার নানা ঢঙের ছবি তুলে দেয় তাকে নিয়ে। দেড় বছরে বিতস্তা দেড়দিনও জানতে চায়নি আমি বেঁচে আছি না
মরে গেছি।
বাথরুমের প্যানটার কালো কাভারটা ফেলে
দিয়ে তিতলি বসাতো আমাকে। ভালো করে দেখে নিত জলটা ঈষদুষ্ণ হয়েছে কী না! তারপরে
আমি চোখ বুজে ফেলতাম। তিতলি মাথায় আস্তে আস্তে জল ঢেলে দিত। চুলগুলোর মধ্যে দিয়ে
আঙুল চালিয়ে চালিয়ে মাথার চামড়া অবধি যাতে জল যায় সুনিশ্চিত করত। খুব আলতো করে
সাবান মাখিয়ে দিয়ে গোটা গা ডলে দিত। বাঁ হাতটা তুলতে পারতাম না বলে নিজের কাঁধে
নিয়ে আধবসা আধা দাঁড়ানো অবস্থায় নিঃশব্দে স্নান করিয়ে দিত। চোখ বন্ধ করে আমি ফিরে
যেতাম শৈশবে। মা স্নান করিয়ে দিচ্ছে আমাকে। শীতের দিনগুলো সকালে রোদে বসিয়ে তেল
মাখিয়ে দিত তিতলি। তারপরে স্নান। স্নান হয়ে গেলে মাথা,
গা সব মুছিয়ে দিয়ে সারা গায়ে পাউডার মাখিয়ে দিয়ে চলে যেত বাথরুমের
বাইরে। তোয়ালেটা খুলে নিয়ে থাই, শিশ্নের আশেপাশের
খাঁজখোঁজগুলো এক হাতে মুছে নিতাম। অনেকক্ষণ সময় লাগত।
একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জী পরার
অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত বাথরুমের বাইরে। শেষ হয়ে গেলে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতাম।
ততক্ষণে হাতটা আরো ব্যথায় নিঝুম হয়ে গেছে। তিতলির কাঁধের উপর ভর দিয়ে বিছানায়
বসতাম গিয়ে। যেদিন নিজের হাত আর চলতে চাইত না সেদিন খাইয়ে দিত তিতলি। নিজের ভিজে
জামাকাপড়ে বসে থেকে খাইয়ে দিয়ে তারপরে স্নানে যেত। আমি বসে থাকতাম কিছুক্ষণ খবরের
কাগজটা সামনে নিয়ে। তারপরে এক সময় আর যখন পারতাম না, তখন
শুয়ে পড়তাম।
প্রতিদিন দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকার সময়টাকে বাড়াতে চেষ্টা করতাম। একটু
একটু করে বেড়েছে সে সময়। আশেপাশে ছড়ানো বইগুলোর থেকে একটা টেনে নিতাম। কাগজটা শেষ
হয়ে গেলে বই-এর পাতায় ডুবে যেতাম। তারপরে ঘুম নেমে আসত ক্লান্ত শরীর জুড়ে।
ভাঙত যখন কোনো কোনোদিন দেখতাম পাশে
মাটিতে বসে মন দিয়ে টিভি দেখে যাচ্ছে মুনাই। মুনাই আমার সঙ্গে কাজ করত। আরো অনেক
ছেলেমেয়ের মধ্যে মুনাই আর তার বান্ধব প্রদীপ ছিল। আমাদের পত্রিকার,
গানের দলের, আঁকার শিবিরের সবেতেই ওরা থাকত।
মুনাই দুপুর বিকেলের দিকে মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেত আমি ঠিক আছি কী না! তিতলি
দুপুরের দিকে অফিস যেত। রাতে ফিরবে। মধ্যে মুনাই এসে চলে গেলে কখনো কখনো প্রদীপ
আসত। বা থাকতে থাকতেই আসত। অথবা আসত না। মুনাই চলে যেত অন্য কোথাও। প্রদীপ অন্য
কিছুতে ব্যস্ত। সন্ধেবেলা রান্না করতে আসত বেলা। রান্না করে সন্ধের জলখাবার সাজিয়ে
দিয়ে চলে যেত। আমি উঠতাম। যখন ব্যথা ছেয়ে ফেলত সারা শরীর, তখন
একেকটা জিনিস ধরে ধরে যেতাম বাথরুমে। অন্যান্য সময় তবু স্বাভাবিক ছন্দে হাঁটার
চেষ্টা করতাম। সারা সন্ধে ওই হাঁটা আর হাঁটার চেষ্টা আর হাঁটতে না পারার মধ্যে
দিয়ে নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যেতাম। শরীরের প্রতিটি অঙ্গসন্ধি যখন বিদ্রোহ করত তখন
আবার এসে বসে পড়তাম
বিছানায়। বিছানা পিঠটা টেনে নিতে চাইলে যতক্ষণ সম্ভব আটকে রাখতাম।
এক সময় আর পারতাম না। ঘুমে ঢুলে যেতাম। রাতে তিতলি আসবে। খাইয়ে দাইয়ে লেখার
সরঞ্জাম হাতের কাছে রেখে নিজে খেতে বসবে। আমি লিখব, তিতলি খাবে। আমি লিখব, তিতলি ঘুমিয়ে পরবে এক সময়। আমি
লিখব আর রাত একটু একটু করে ফুরিয়ে যাবে। আরেকটা
নতুন দিন আসবে। আমার কোনো নতুন দিন আসবে না তবু। এবং বিতস্তা দেড় বছরে বহু দূর
থেকে ফোনে দেড়বার শুধু জানতে চেয়েছে আমি তাকে একটুও ভালোবাসি কী না!
প্লটের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল
সুনীল। পাশে যুবতী। যুবতী সুনীলের সঙ্গে এক মেলা থেকে পালিয়ে চলে এসেছিল। সুনীল আর
যুবতী আলাদা আলাদা জাত। যুবতী মাহাত, সুনীল পটুয়া।
যুবতী ও সুনীল, দুজনেরই সমাজে নিজেদের মধ্যেই শুধু সাঙা হয়।
যুবতী ও সুনীল দুজনেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে এ সব মানামানি। কাজটা সহজ ছিল না। ওদের
জাতির ইতিহাস ওদের নিজেদের মধ্যে নিজেদের আটকে রেখেছে, নিজেদের
বাঁচিয়ে রাখতে। কলিঙ্গ থেকে এসেছে সুনীলরা। অনেক
প্রজন্ম আগে এসেছিল। তখন তাম্রলিপ্ত বন্দর ছিল। কলিঙ্গে ভাস্কর ছিল এরা। ছিল
চিত্রকর। সেখান থেকে কাজের জন্য চলে এসেছিল তাম্রলিপ্ত। কেন, তা বলা মুশকিল! ওরা নিজেরা জানে না। শোনা কথা ওদের, যে
মুসলমান আমলে ওদের কাজ জুটছিল না, তাই কাজের জন্য এদিক ওদিক
অনেক জায়গাতেই চলে এসেছে। আবার এখানে এসেও বামুনদের চাপে ছিল বলে একসময় অনেকেই
মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু পট আঁকা কেউ ছাড়েনি। পট দেখিয়ে গান গাওয়াও ছাড়েনি।
তারপরে তাম্রলিপ্তর পতন হলো যখন, তখন তারা সরে গেল
মেদিনীপুরের আরো ভেতরে। ওড়িশায় রাজারা এককালে কাজ
জানা লোকদের সম্মান দিতেন মহাপাত্র পদবী দিয়ে। হয়তো সে সম্মানে টান পরেছিল,
তাই মেদিনীপুরের দিকে ওদের চলে আসা। সেখানে আসার পরেও সুনীলদের কেউ
সম্মান দেয়নি। বামুন কায়েত মাথার উপর পা দিয়েই
রেখেছে। সুনীল মহাপাত্র এখানে সুনীল পটুয়া শুধু।
- জগন্নাথ
কার দেবতা হে?
- অনেক
গল্পকথা আছে। এক শবররাজ বিশ্ববসু ওড্র দেশের এক প্রাচীন অরণ্যের এক গুহায় পূজা
করতেন নীল-মাধবের। সেই নীলমাধবের কথা শুনে বিদ্যাপতি নামে এক ব্রাহ্মণকে সে
দেশে পাঠান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। সেই ব্রাহ্মণ নানা সন্ধান করে-টরে একদিন পৌঁছন
বিশ্ববসুর গৃহে। সেখানে গিয়ে বোঝেন যে শুরুতেই নীলমাধবের কথা জানতে চাওয়া যাবে না।
তাতে হিতে বিপরীত হবে। বিশ্ববসুর গৃহে তার আতিথ্যে থাকতে থাকতে তার কন্যা ললিতার
সঙ্গে প্রেম হয় সেই ব্রাহ্মণ যুবকের। বিয়ে করেন। তারও কিছুকাল পরে এক রাত্রে
কন্যার সনির্বন্ধ অনুরোধ ফেলতে না পেরে বিশ্ববসু ব্রাহ্মণকে নিয়ে যান সেই
নীলমাধবের গুহায়। সে গুহায় শবররাজ প্রতি রাতে আসতেন পূজা করতে। ব্রাহ্মণের চোখ
বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন শবররাজ। কিন্তু বিদ্যাপতি বুদ্ধি করে যাবার পথে তেলের বীজ
ছড়িয়ে রেখে গিয়েছিল। সেই নীলমাধবকে দেখে ফিরে আসার পরে একদিন সে অঞ্চল থেকে
অন্তর্হিত হয়ে যান বিদ্যাপতি। ফিরে যান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। রাজা তার
বাহিনীশুদ্ধু এসে ওই তেলের বীজ থেকে উৎপন্ন গাছের পথ ধরে ধরে সে অরণ্যের সেই
গুহাতে গিয়ে পৌঁছন। কিন্তু ততদিনে নীলমাধব সেখানে আর নেই। মনক্ষুণ্ণ রাজা তখন
ফেরার পথে স্বপ্নাদেশ পেলেন যে শ্রীক্ষেত্রে মন্দির স্থাপন করুক,
সেখানেই আবির্ভূত হবেন নীলমাধব।
- মানে
গল্পের গরু যেমন গাছে ওঠে আর কী!
- ইতিহাস
তো এর বেশি
কিছু বলছে না।
- তাই?
বলছে না, জগন্নাথধাম আসলে বৌদ্ধমঠ?
- বলছে!
এদিক ওদিক বলছে। কংক্রিট কিছু নেই।
- বলছে
না,
নব কলেবরের সময় যে
নাভিটিকে কখনো বদলানো যাবে না,
সেই নাভিটির
মধ্যে আসলে বুদ্ধের দাঁত আছে?
- দাঁত
আছে কি না কে জেনেছে? আর কে ভাই জানে কোনটা কার দাঁত?
- বলছে
না,
ভূমিস্পর্শমুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি আছে মন্দিরের পেছনে, যাকে
দেওয়াল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে?
- দেওয়ালের
ওপারে কি তো মৃত্যুর ওপারে কি আছের মতো,
কেউই জানে না!
- বলেনি,
জগন্নাথের রথযাত্রা আসলে বৌদ্ধদের রথযাত্রার অনুকরণে বদলে নেওয়া
যাত্রা?
- ঝেড়ে
কাশো! এখানে তোমার ভূমিকা কি?
- অশোক
ব্যতীত
এই কাহিনী হয়? আমি না থাকলে হয়?
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন