হেরম্বচরিত
পথ ও প্রান্তর
নিঃশব্দে ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হতে গিয়ে হেরম্বকে
দ্বিধা জড়তা সরিয়ে ফেলতে হয়। আত্মপরিচয়কে যথাযথ
মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করবার মরিয়া এক প্রয়াস হেরম্বকে ইতিহাসের অন্তর্ভুক্তই করে ফেলে সম্ভবত। কিন্তু ইতিহাস কি
তাকে গ্রহণ করে, স্বীকৃতি দেয়? নাকি ইতিহাসের
একতরফা অংশ হয়েও ইতিহাস তাকে ব্রাত্যই করে রাখে। প্রান্তিকতার
বেদনাজাত অনুভূতি নিয়েই হেরম্ব তো গোটাটাই সংযুক্তি বিযুক্তির অস্পষ্টতায় ইতিহাসের অন্তর্ভুক্তি থেকে বারবার সরেও
আসে। ইতিহাসের সব পথপ্রান্তর খেত মাঠ মানুষজনের নৈকট্য নিবিড়তায় সে অন্তহীন হেঁটে
যেতে থাকে। হাটের গোলকধাঁধায় শিহরণে হাট ছোঁয়া বাতাসে চলাচল
রহস্যময়তার দৈনন্দিনে আন্তরিক এক রহস্যময়তাই ফিরিয়ে আনতে থাকে। সে ইতিহাসের প্রকরণ
ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিজেই ইতিহাস হয়ে ওঠে। মানুষের যাপন বেঁচে থাকা
জীবনের ব্যপ্ততম হয়ে ওঠা পুরাণ গাছলতা অনেক পাখির উড়ে যাওয়া নদীর চর চরাঞ্চল থেকে
বহমান ইতিহাসের বর্ণ গন্ধ জারকরস সব যেন অনাকাঙ্ক্ষিত উপেক্ষাগুলিকে
স্বীকৃতি অস্বীকৃতির তুচ্ছতায় হেঁটে যাওয়া মানুষের ছায়ার মতো মেধাহীন সময়ের স্বর্ণাভতাকে নিঃশব্দে যেন
ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলতে চায়। এইসব ঘটতে থাকে, ঘটে যায়; কিন্তু প্রান্তিকতার
ধুলোমলিনতা ঝেড়ে ইতিহাস প্রকৃতই মান্যতর ইতিহাস হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না। ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হতে গিয়ে, শরিক হতে গিয়ে হেরম্ব
একসময় ইতিহাসটাকেই তার সত্বা অনুভূতি থেকে সরিয়ে দেয় ঘর্ম নিঃসরণের মতো। এভাবে ইতিহাসটাকে
সরিয়ে দেওয়া নিয়ে নতুনতর দ্বিধা সংশয় তাকে উদ্বিগ্ন তাড়িত করে তুললেও সে কিন্তু
অস্থিরতার দ্বারা চালিত হয় না। মাঠে মাঠে শূণ্যতায়
বিষাদগ্রস্থ হেরম্ব একাকীত্বকে অগ্রাহ্য করে প্রকৃতি চরাচর গোলাবাড়ি মেঠো ইঁদুর
গান নাচের সমবেত সঙ্গ উত্তাপের দিকে নিজেকে এগিয়ে
দেয়।
হাটের ভিতর হাট
যাত্রাকালীন সংকট
বিপন্নতাগুলির সূত্র ধরে ধরে হেরম্বকে আবার প্রবেশ করতে হয় হাটেরই বৃত্তের
অভ্যন্তরে। বৃত্তের মহত্বকে উপেক্ষা করে বৃত্তের আরো একটু
প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে দিয়ে হাটের জমজমাট এক
জমে ওঠার কেন্দ্রাতিগ পরিণতিত্ব এনে দিতে দিতে হেরম্ব
হা্টের মোহমায়ার মহত্বে হয়তো পৌঁছে যায়। প্রাগৈতিহাসিক এক
শারীরিক অনুভূতি, পর্যবেক্ষণ ও জীবনযাপন সহ হেরম্ব আপাদমস্তক
হাটের হাট হয়ে ওঠাটাকেই প্রত্যক্ষ করে। প্রত্যক্ষতা থেকে সে
বুঝে ফেলতেও পারে, হাটের ভিতর অনেক হাট। জীবনটাই কি হাটের
শাখাপ্রশাখাময় প্রচ্ছায়ায় আশ্চর্যময়ী এক রংবেরং হাটই হয়ে উঠতে থাকে! হাটের গুটিয়ে নেওয়ার
ভঙ্গ-বিভঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় হেরম্বকে। তখন সারিন্দা বাজিয়ে
কবেকার কোন এক মনসাভাসানের সুর ছড়াতে থাকে কানীবুড়ি। তার বসন্তক্ষতময়
মুখমন্ডলে অপরাহ্ণের রোদ; জল বাতাসের ঝাপট। সমগ্রতা থেকে
অংশগুলির বেরিয়ে আসাটা হেরম্বকে প্লাবিত করে। প্লাবন স্রোতে বসতবাড়ি
ধানমাঠ গবাদি পশুপাখি পুঁথিপত্র সবই ভেসে যায়। ভাসতে ভাসতে একসময়
জীবন হয়ে ওঠে হাটের আদ্যন্ত এক বিনির্মাণ। সাদা কাপড় ঢাকা
চারণকবির মতো হেরম্ব পুরনো সময়ের এক হাট থেকে নতুন নতুন হাটের বৃত্তায়নে পা বাড়ায়। আবহমানের এক জীবন
নিয়ে সে যেন বলে যায় হাটগঞ্জ প্রান্তিকতার চিরভাস্বর সব শোলোক টুকরো। কোনো হাটে বসে কোনো
এক রাণীমার দরবার তো কোথাও খড়ম জোতদারের পঞ্চায়েতী জনসংযোগ; কিংবা কখনো জলধোয়া
বসুনিয়ার সঙ্গী হয়ে সে দেখেও নিতে পারে কামতাপুরের স্বতন্ত্র রাজ্যের মিছিল। যাত্রাকালীন
বিপন্নতা সংকট তাকে আরো ঘনবদ্ধ সংকটে ঠেলে দিলেও হেরম্বকে কিন্তু ঢুকে পড়তেই হয়
হাটের কেন্দ্রে; হাটের ভিতরকার সব হাটখন্ডে।
কালখন্ড
হেরম্ব তো নিজেই এক
কালখন্ড। সে জড়তাহীন হেঁটে যেতে থাকে হাটের খোঁজে। সে কি হাট খুজঁতে
থাকে! নাকি প্রতি পদক্ষেপে আদ্যন্ত হাটবাজার হাটগঞ্জ
তাকে জড়িয়েই থাকে! হাট থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিটাই হেরম্বকে
নিরাপত্তাহীন করে ফেলতে পারে; নিরাপত্তাহীন জীবনযাপনের
সংকটময় অস্থিরতার বাইরে বেরোবার উপায় ও অবলম্বন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করাটা সহজ নয়
জেনেও হেরম্ব আপাতবিরোধী কালখণ্ডের ওপর টেনে আনতে থাকে হাটগঞ্জ হাঁটাপথ
প্রান্তিকতাকে। নিজের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করতে করতে হেরম্ব তাই
পরিক্রমণ করে হাটের পর হাট। দেশকাল পরিধি বৃত্তের বাইরে এসে
সে নিজেকে আরো নিরাপত্তাহীন ভাবে। তাই লোকপ্রান্তরের নিজস্ব
ইতিহাস চেতনায় বর্ণে গন্ধে শ্রীহেরম্বচন্দ্র বর্মণকে
হাজার হাজার বৎসরের চলমান ধারাবাহিকতায় সমর্পণ করে। ধারাবাহিকতার
ধারাবাহিকে অমাবস্যা জ্যোৎস্না হাট বড় নদী ছোট নদী অরণ্যপ্রান্তর খেতখামার চরাঞ্চল
মোল্লাবাড়ি বাস্তুহারাদের বসতভুমি হাতি বাইসন ফকিরি তত্ব আদিবাসীপাড়া অজস্র পুরাণ
মিথ লোকগান আবহমানের চিরন্তনতা মাখা মানুষজন সব, সব কিছুর সখ্যতায়, সঙ্গ ও নিঃসঙ্গে আপন গতিতেই মিশে যেতে
হয়।মিশে যাবার ধারাবাহিকতায় হেরম্ব জীবনের প্রকৃত যাপনপদ্ধতি নিয়ে ধারাবাহিক
জীবনকথাই তো বলতে চায়। হাট তো প্রতীক। হাঁটাটাও। জীবনের সবটুকু কি সে
দেখতে পায়? সে কি চূড়ান্ত নিঃসঙ্গতার মুহূর্তেও বুঝতে পারে
মানুষ কেন বাঁচে? বেঁচে থাকতে চায়? কালখন্ডের অনিবার্য
অংশরূপে হেরম্ব কিন্তু ধারাবাহিক সময়পর্বে, সময়পর্বকেই
প্রতিনিধি স্থানীয় কালখন্ডের অন্তর্ভুলত করে ফেলে। এখানেই তার কৃতিত্ব, উত্তরণ। হাট থাকে হাটের ভিতর
স্বাচ্ছন্দ্যতায়; ধারাবাহিকতাকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে কালখন্ডের
ভিতর হেরম্বকে এনে ফেলতে হয় বদলে যাওয়া, বদলাতে না চাওয়া
অনন্তের সব হাটবাজার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন