আবীর মিত্রের আত্মহত্যা
সরকারী তহবিলে গরমিল
এবং ঘুষ নেবার অভিযোগে আবীর মিত্রকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল। সকাল থেকে সারা আকাশ
সেদিন কেবল মেঘ আর বৃষ্টি। রাস্তাঘাটে মানুষ কম, তবুও ভরদুপুরে পাড়ার মোড়ের
বারোয়ারি রকে গুটিগুটি জমায়েত।
টাকার কুমির আবীর
মিত্রের রসালো কথা শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে বড় বটগাছ হতে হতে রাত।
চেতলার এঁদো গলির
স্যাঁতসেতে ঘরের মেঝেতে শুয়ে হাড়জিরজিরে একটা ছেলে তুখোড় হবার স্বপ্ন দেখত। তুখোড়
সে ছিল - লেখাপড়ায়, গানে, কবিতায় সে তুখোড় হতে চেয়েছিল পোষ্টমাস্টার বাবার কষ্ট দূর
করার জন্য। দুই দিদির বিয়ে দিয়ে সর্বসান্ত তার বাবার প্রতিদিনের যুদ্ধ তাকে
টানত। সে সৈনিক হতে চেয়েছিল, তুখোড় সৈনিক!
কোনো এক বারবেলায়
কবিতা পাঠের আসরে এক ঝাঁক হাসি তার খোলা মনের রোদ্দুর ঢেকে দিল। শব্দ ছন্দ ভাষা
হারাল। সে নেমে গেল গেঁড়ি গুগলি শ্যাওলা ঝাঁঝি পেড়িয়ে আরো নিচে কালো সবুজ জলে। ডুবো সাপের মতো
আঁকাবাঁকা লতা জড়ানো আবীর মিত্র
তখন সবে তেইশ।
স্বপ্ন বদলে গেল। অহনা সোম তাকে পাগল
করে দিল। অহনার হাসি, অসম্ভব শিল্পী ঠোট, ঠিক তার ওপরে অভিমানী একলা তিল। আবীর ডজন খানেক
কবিতা লিখে ফেলল। তারপর একদিন জ্যোৎস্নার আঁশে ঢেকে পৃথিবী যখন
মাছের মতো শুয়ে আছে, সে ঢুকে পড়ল পারাপারহীন
এক সমুদ্রের পেটের ভেতর। অহনার শরীরের টানে
সে ভেসে গেল।
অহনা বলতে চেয়েছিল
তার অতীত। এক চতুর শিল্পীর মায়াজালে অহনা ঘর ছেড়েছিল কুড়িতে। উচ্চাশার তাড়নায় রূপ
ভেঙে ভেঙে গড়েছিল ইমারত। স্বপ্নেরা টুকরো দু’বছরে। অপমানের বেদনা একা
বইতে পারেনি অহনা। গোটা কুড়ি ঘুমের বড়ি গিলে
মরতে চেয়েছ... জীবন যায়নি, পেয়েছে এক মমতাময়ী হাত। তার ছায়ায় বেঁচে আছে
সে। এখন সে সাতাশ।
আবীর শুনতে চায় নি,
শোনেও নি। তার সমস্ত শরীর মন তখন
অজানা তাপে গলে
ঝরে ঝরে পড়ছে। সে
তখন মৃত তুখোড় সৈনিকের চোখের পাতা ভেঙে উঠে চলেছে আকাশের
দিকে - আকাশ না বাষ্পকোটর, কে বলবে?
অহনার বাড়ি চাই, গাড়ি চা্ রঙমিলান্তি শাড়ি
চাই, হীরে মানিক চাই, টিভি ফ্রিজ গ্যাজেট চাই; আরো কত কত চাই,
শুধু চাই। চেতলার এঁদো গলি ইতিহাস হয়ে গেল। ক্রমাগত হাতুরির ঘা
পড়ছে। আবীর নামক সোনার ঘড়া থেকে উপুর হয়ে ঝরছে নতুন
নতুন অলংকার।
সরকারী চাকরীটা
পেয়েছিল অহনার পরিচিতির জোরে। বাকিটুকুর দাবী সম্পূর্ণ আবীরের। আবীর যত উপরে উঠেছে অহনা তত ঝলমলে
হয়েছে। এক সময়ের শুকনো আবীর তেল চুকচুকে চেহারা নিয়ে তিন হাজার স্কোয়ারফুট
ফ্ল্যাটের বসার ঘরে বসে রোজ রাতে একা স্কচ
খায়। অহনা তখন চারপাশে স্তাবকের দল নিয়ে হুল্লোড় করে বেড়ায়।
তারপর আরো একদিন
আবীর নিজের গলার স্বর খুজতে গিয়ে হারিয়ে গেল মধ্যরাতে। জমজমাট পার্টিতে এক
বহুল চর্চিত পড়ন্ত অভিনেতার পাশে অহনা তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। সেদিন ডুবুরি নামিয়ে
আবীর দেখল, চেনা স্রোতের ভেতরে শুধুই পাথর। সে ছিল কেবল উপলক্ষ্য - প্রতিশোধের। অহনার পায়ের নিচে প্র্ণামের মতো পড়ে আছে তার ভালোবাসা। ঘেঁটে গেল আবীর। অহনার নতুন শখ পূরণ
করতে গিয়ে ভুল করে ফেলল।
আবীর সত্য গোপন করে
নি। সাজা তার হবেই। এগার বছরের আমূল
ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক
আচ্ছন্নতায় মগ্ন হয়ে আছে সে। বাবার কথা মনে এলো,
সততা আর বিশ্বাস যার
একমাত্র মূলধন। শেকড়ের মান আবীর রাখতে পারে নি,
নিজের মতোও হতে পারে
নি সে। যে উদাসীন মানচিত্র পেরোবে বলে তার এই অধঃপতন, সে এক ছায়াশরীর মাত্র, স্বপ্নের চেয়েও মিথ্যে এক
ভ্রষ্ট সচলতা।
নিঃসাড়ে দিনভর
অভিযোগ গড়িয়ে পরে নিজের ই গায়ে।
দিন পাঁচেক পরে
সন্ধ্যে সাতটার ব্রেকিং নিউজ - ‘ঘুষ নেবার দায়ে ধৃত
সরকারী উচ্চ পদাধিকারী আবীর মিত্রের আত্যহত্যা’। পাড়ার রকে আরো একবার
রসালো গুলতানি। অহনা তখন ইউরোপ ট্যুরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন