রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫

তুষ্টি ভট্টাচার্য

ঝোলাঝুলি





প্রায়ই দেখা যায়, ঝুলে থাকছি। মানে মাঝামাঝি অবস্থায় কেউ যেন পেরেকে লটকে দিল। না পারছি নামতে, না পারছি উঠতে। একদম পারফেক্ট ত্রিশঙ্কু অবস্থা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ঝুলে থাকছি, কোথায় ঝুলে থাকছি এবং ঝোলালো কে? আর এর উত্তরগুলোও আমাকে দিতে হবে! এইরকম ভাবে জবাবদিহি শুধু আমাকে না, যারা যারা ঝুলে রয়েছেন, ওই ঝুলন্ত অবস্থা থেকেই তাঁদের উত্তর দিতে হবে। উত্তর না দিলে ঝাঁকে ঝাঁকে আঙুল ছুটে আসবে আমার এবং আপনার দিকে। আরও নানারকম প্রশ্নে জেরবার হয়ে যাব বা যাবেনতার চেয়ে ওই প্রথম তিনটে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেওয়াই সহজ হবে বোধহয়।

ধরুন আপনি বাজারে যাচ্ছেন, আপনার হাতে সময় বেশি নেই, মাছওলা বলল, একটু দাঁড়াতে হবে আপনার পছন্দের মাছ ছাড়িয়ে কেটে নিতে গেলে। এখন এখানে দাঁড়ালে আপনার সব্জি কেনার সময়ে টান পড়বে। তার চেয়ে ওকে কাটতে বলে সব্জি কিনে নিয়ে এলেন। সময় ম্যানেজ হয়ে গেল। কিন্তু বাজার থেকে আপনি যখন অনেকটা দূরে চলে গেছেন, তখন মনে পড়ল একটা জরুরী ওষুধ কেনার ছিল! এখন ফেরত গিয়ে আবার ওষুধ আনতে গেলে আপনার সময়ে অফিস যাওয়া হবে না। দেরী হলে, বসের  ঝাএদিকে ওষুধ না নিলে গিন্নীর চোটআর এই সময়ে আপনি দেখলেন, আপনি ঝুলে আছেন। হয়তো ওষুধ কিনেই ফিরবেন। কারণ হোমফ্রন্ট না সামলালে সমূহ বিপদ। তার চেয়ে বসের গাল ভালো। একটা সিদ্ধান্তে যেই এসে গেলেন, আপনার ঝুলন্ত অবস্থার শেষ হলোব্যাস্‌।

কিন্তু আপনি যদি পরকীয়া করে থাকেন তো গেলেন। আজীবন আপনার ঝুলন্তু অবস্থা থেকে মুক্তি নেই। সে আপনি পুরুষ হোন বা নারী। এক্ষেত্রে আপনি কিন্তু হোমফ্রন্টকে অত সহজে প্রায়োরিটি দিতে পারবেন না। তাহলে ও পক্ষ চটবে। আর ও পক্ষ চটলে আপনার ঘুম হবে না, ভীষণ অম্বলে গলা বুক জ্বালা করবে, মাথা যন্ত্রণা, গা বমি বমি ভাব, আরও কত উপসর্গ আসবে। তাই আপনার অবস্থান হবে এখন মাকুর মতোএকবার খটাস করে এদিকে ছুটবেন, আর একবার খটাস করে ওদিকে। ছুটতে ছুটতে আপনার বিতৃষ্ণা আসবে নিজেরই ওপর। মনে হবে, এই সুখই কি আপনি চেয়েছিলেন? নিজেকে প্রশ্ন করতে গিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি সেই প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন এবং আপনার সাথে সাথে আর সবাই বুঝে গেছে আপনার ঝুলে থাকার কারণ। 

এবার আপনার বা আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পালা। কোথায় ঝুলছেন বা ঝুলছি? মনে হয়, এই প্রশ্নের উত্তর সহজে দেওয়া যাবে না। আসলে এটার উত্তর জানা যায় নি। আপনি তো মাটিতে পা দিয়েই চলতে চাইছেন, কিন্তু আপনার পা কিন্তু মাটি থেকে অনেক ওপরে ঝুলছে। আপনি ভাবলেন, আকাশে গিয়ে পৌঁছবেন, কিন্তু দেখলেন সেই আকাশ আপনার অধরাই থেকে গেল। মাটিতে পা না-দেওয়া আপনি, আকাশ না-ছোঁওয়া আপনি, কোন শূন্যের ওপর ঝুলে আছেন বলুন দেখি এবার! জানেন আপনি এই শূন্যতার গভীরতা, পরিমিতি বোধ, ঘনত্ব, লঘুত্ব- এসব সম্বন্ধে? আপনি জানেন না এসবের কিছুই। আপনি কোনোদিনই শূন্যতা কি জানতেন না, আর আজও বুঝে উঠতে পারছেন না, এই বস্তুটি আসলে কী, খায় না মাখে। শূন্য মানে এতদিন অঙ্কের জিরো বুঝতেন। যে জিরো কোন সংখ্যার আগে বসলে বেকারকা মাল, আর পরে বসলে... উফফ্‌ হেব্বি ব্যাপার একেবারে! আর ঠিক এক্ষুনি আপনি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন আচমকাই। আপনি বুঝলেন, আপনি বাঁ দিকে বসা জিরোর মতো কোন সংখ্যার আগে ঝুলে আছেন! আর প্রশ্নকর্তারাও মোক্ষম ভাবে পেয়ে গেল উত্তরটা।

তিন নম্বর প্রশ্নটা খুব কনফিউসিং। কে ঝোলালো আবার কী! একজনই যে ঝোলাবে তার কোনো মানে নেই কিন্তু। আপনাকে এক দল ঝোলাতে পারে, দুই দলের বিবাদ ঝোলাতে পারে, দল ভেঙে বেরিয়ে আসা একজন কেউ, দল ছাড়া কেউ, সেও ঝোলাতে পারে। আবার আপনাকে আপনি নিজেও ঝোলাতে পারেন। এবার ভাবুন কোন কায়দায় উত্তর দেবেন আপনি। এমন উত্তর চাই, যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে। সাপের নাম শুনে আঁতকে উঠলেন কেন মশাই? আপনাকে তো আর সত্যি সত্যি সাপ মারতে হচ্ছে না! এই মেরুদন্ডের জোর আপনার! এক মেরু থেকে আর এক মেরুতে যাওয়ার নাম আপনি জীবন ভেবেছিলেন, আর এখন ভাবছেন, দুই বা তিন বা চার যাই হোক না কেন, মেরুগুলো গোল্লায় যাক! ওরা গেলে আপনি বাঁচবেন আবার শান্তি করে। কিন্তু তাই কী কখনো হতে দিয়েছে জীবনবাবু! যা যা করেছেন এতদিন ধরে, তার ভার, তার দায় আপনাকেই সামলাতে হবে। আর সামলাতে না পারলেই এই ঝুলে থাকা জীবন আপনার কাছে জবাব চাওয়ার জন্য হাজির। এইবার ভাবুন আপনাকে ঝোলালো কে?


আপনি আমতা আমতা করে বললেন, এই জীবনই আমাকে ঝুলিয়েছে। বেশ, মেনে নিলাম আমরা। তাহলে তো আপনার ঝুলে থাকার হাত থেকে নিষ্কৃতি আপনি পেয়ে গেলেন বলে! আরে বুঝলেন না? এই জীবনকেই বিসর্জন করুন। ব্যাস্‌, সব ল্যাঠা চুকে যাবে। আপনি আর ঝুলে থাকবেন না, পুরো মাটিতে শুয়ে থেকে মাটি হয়ে যাবেন, কিম্বা ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিশে যাবেন। আপনার পরম আকাঙ্ক্ষিত মাটি, আকাশ আপনি পেয়ে যাবেন। আরে কাঁপছেন কেন মশাই? ভয় পেলেন? ভয়ের কী আছে? আরে আবার কাঁদে! বুঝেছি বুঝেছি, ও আপনার দ্বারা হবে না। সে কলজের জোর আপনার নেই। তাহলে আর কী! ঝুলতে থাকুন। উইশ ইউ হ্যাপি ঝোলাঝুলি! লেটস্‌ সেলিব্রেট নাও। 



৩টি মন্তব্য: