ভঙ্গাস্বনের সত্য
এই লেখাটা বেরোনর ক’দিন পরেই ২রা অক্টোবর এসে যাবে। আর এবারের ২রা অক্টোবরকে ঈদ, দুর্গাপুজো ইত্যাদি ঢেকে দেবে না। তাই এবারে ভঙ্গাস্বনের সত্যর কথা বলা যায়! মহাভারতের অনুশাসন
পর্বে ভঙ্গাস্বনের কথা আছে। তিনি এক রাজা, যিনি পুত্রকামনায় অগ্নিষ্টুত যজ্ঞ করে
শতপুত্র পান। কিন্তু যজ্ঞে অগ্নিকে বেশি তুষ্ট করে ফেলায় ইন্দ্রাভিশাপের মায়াজালে
আচ্ছন্ন হন। ফলে শিকারকালে মায়াহরিণের ব্যর্থ পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে পিপাসার্ত হয়ে
এক কাকচক্ষু সরোবরে স্নান করে, জলপান করে সেই ‘অচ্ছোদসরসীনীরে’ প্রতিবিম্বে দেখেন
তিনি সুন্দরী রমণী হয়ে গেছেন। সত্তার সঙ্কটে আকুল ভঙ্গাস্বন স্ত্রী-পুত্রদের হাতে
রাজ্যভার সমর্পণ করে এক ঋষির তপোবনে এসে বাস করতে থাকেন (মতান্তরে অন্য এক
রূপক্লিষ্ট রাজার পাণিগৃহীতা হন)। আর সেই ঋষির (মতান্তরে রাজার) আরেক শতপুত্রের
জননী হন। পরে তাঁর দুই পুত্রগোষ্ঠী তাঁর কথায় মিলিতভাবে রাজ্যভোগ করতে থাকে। অভিশাপ
আশীর্বাদে রূপান্তরিত হচ্ছে দেখে ইন্দ্র তাঁদের মধ্যে বিবাদ আর পৃথকবুদ্ধি সৃষ্টি
করেন। তারা একে অন্যকে, পরস্পরকে যুদ্ধে বিনষ্ট করতে থাকলে রোরুদ্যমাণ/ণা
ভঙ্গাস্বন তপস্যায় বসেন। তপঃক্লিষ্ট ভঙ্গাস্বনের দশায় বিচলিত ইন্দ্র ভঙ্গাস্বনের
কাছে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে তাঁর অন্যায়ের কথা জানান, আর ক্ষমাপ্রার্থী ভঙ্গাস্বনকে
বেছে নিতে বলেন কোন পুত্রগোষ্ঠীকে তিনি বাঁচাবেন, কারণ উভয়কে বাঁচানো যাবে না।
ভঙ্গাস্বন বেছে নেন ঔরসজাত পুত্রগোষ্ঠীকে নয়, গর্ভজাত পুত্রগোষ্ঠীকে, যেহেতু
গর্ভধারণপোষ্ণাভ্যাম্ জননী পিতুরপি অধিকা। ভঙ্গাস্বনের এই সত্যে সম্মত হয়ে ইন্দ্র
তাঁকে ঔরসজাত ও গর্ভজাত উভয় পুত্রগোষ্ঠীর পুনরুজ্জীবনের তথা জীবন লাভের বর দেন। আর
ভঙ্গাস্বন ইন্দ্রের দেওয়া দ্বিতীয় স্বরূপলাভের ও রাজ্যলাভের বর না নিয়েই তপস্যায়
প্রাণত্যাগ করে স্বর্গে যান।
বন্ধু পাঠক, অনেক ভাষ্যের মধ্যে ভঙ্গাস্বনের কাহিনী এখানেই শেষ। আমার কাহিনীর
নয়, কারণ গত একচল্লিশ বছরে ক্লাসে ক্লাসে, সেমিনারে, পত্রপত্রিকায় আমি বলেছি ও
লিখেছি যে ভারতে গান্ধীই ভঙ্গাস্বন। তাঁরও দুই পুত্রগোষ্ঠী ছিল। একদল নেহরু, প্যাটেল আর আজাদের নেতৃত্বে ক্ষমতার উচ্চ রাজনীতিতে আসীন। তাঁদের আমি
ভঙ্গাস্বন গান্ধীর ঔরসজাত পুত্রগোষ্ঠী ভাবতে ভালোবাসি। আরেকদল বিনোবা ভাবে, মীরা বেন, সতীশচন্দ্র সামন্ত ইত্যাদির নেতৃত্বে অ-ক্ষমতার
নিম্ন রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত। তাঁরা আমার কাছে ভঙ্গাস্বনের গর্ভজাত পুত্রগোষ্ঠী। গান্ধীর উৎকর্ষ হলো ভঙ্গাস্বনের মতো তিনি কোনো পুত্রগোষ্ঠীকে
বেছে নেননি। ফলে যখন দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রস্তুতিমূলক ভাগবাঁটোয়ারার
কথাবার্তা চলছে, সেই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার দিনে গান্ধী ১৯৪৬-এর নভেম্বর থেকে ১৯৪৭-এর
জানুয়ারি চারমাস নোয়াখালিতে। আর যখন স্বাধীনতার উদযাপনের পুরোভাগে দিল্লিতে থাকার
কথা গান্ধীর, তখন তিনি বিহার হয়ে আবার পুববাংলা যাওয়ার পথে আটকে গেলেন কলকাতায়। সব
জায়গায়ই এক কাজ, সৌভ্রাত্র ফেরানো। নির্মলকুমার বোসের My Days with Gandhi in
Noakhali আর হোরেস অ্যালেকজান্ডার-এর Gandhi
through Western Eyes বইতে এর মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে। এর চেয়ে ভালো আর কী করতে পারতেন ইন্দ্রের অভিশাপক্লিষ্ট
ভঙ্গাস্বন! নবীন ভারতে দু’ দশকে জবাহরলাদের উন্নয়নবাদী রাষ্ট্র যত ফাঁকফোকর রাখলো, তাঁর গর্ভজরা সব বুজিয়ে দিতে লাগলো যে!
গান্ধিয়ান সব সংস্থা, ‘লোকায়ন’ ইত্যাদির দাপটে এনজিও পর্যন্ত গড়ে উঠতে পারলো না!
আপশোস!
আর কী কী সত্যের সন্ধান দিয়ে গিয়েছিলেন ভঙ্গাস্বন? গান্ধীর বিখ্যাত আত্মজীবনী An Autobiography Or The
Story of My Experiments with Truth পড়লে অজস্র সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে যার খোঁজে
জীবন কাটে তাঁর। কিন্তু আমি যে কটায় সব চেয়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম, তাদের প্রায় সব কটাই আহার
থেকে আসা। তাদের কথা বলি। লন্ডনপ্রবাস
কালে মা’র কাছে দেওয়া অমদ্যপতা এবং নিরামিষ আহারের প্রতিশ্রুতি ও শপথ রাখতে
একের পর এক খাবার বদলে যখন মশলা ছাড়া
পালংসেদ্ধতেও স্বাদ পেলেন, তখন কেবল এই প্রথম সত্য বোঝেননি যে স্বাদের আসল বাসা জিভ
নয়, মন। পশুপক্ষীর মাংস ছাড়াও ডিম,
মাছ, ডিমথাকা পুডিং বা কেক আমিষ না নিরামিষ এই
হিসাব থেকে রেস্তোরাঁ বাছার ঝকমারি ছেড়ে দিয়ে বুঝেছিলেন আরো দুটি সত্য। একটি
শপথরক্ষা সম্পর্কে নির্দিষ্ট (স্পেসিফিক)। সেটি হলো এই যে ‘পৃথিবী জুড়েই শপথের
ব্যাখ্যা দ্বন্দ্বের একটা বড় কারণ। শপথ যত স্পষ্টই হোক না কেন, মানুষ সেটাকে
নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে বাঁকিয়ে চুরিয়ে নেবেই। এইসব মানুষকে দেখা যাবে ধনী থেকে দরিদ্র
অবধি, রাজা থেকে চাষা অবধি সমাজের সব শ্রেণীতে। স্বার্থপরতা তাদের অন্ধ
করে দেয়, আর একটা দ্যর্থক মধ্যপন্থা নিয়ে তারা
নিজেদেরকে এবং ঈশ্বরকে ঠকায়। তাই একটা সুবর্ণনিয়ম হলো যে [শপথের] সে ব্যাখ্যা
নেওয়া যেটি শপথদানকালে সেই পক্ষ দিচ্ছে। আরেকটি হলো যেখানে দুটি ব্যাখ্যা সম্ভব,
সেখানে দুর্বলতর পক্ষের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করা। এই দুই নিয়মের প্রত্যাখ্যান দ্বন্দ্ব
ও অন্যায়ের জন্ম দেয়, আর তাদের শিকড় অসত্যে।’ দ্বিতীয়, জেনেরিক যে সত্যে যিনি
গান্ধী এর থেকে পৌঁছেছিলেন তা হলো এই যে, যিনি সত্যকে খোঁজেন সহজে তিনিই কেবল
সুবর্ণনিয়মকে অনুসরণ করেন, বিদ্বান উপদেশ অথবা ব্যাখ্যার স্মরণ
নেন না। ভঙ্গাস্বন তাই মাংস বিষয়ে মা’র ব্যাখ্যাকেই অনুসরণ করেছিলেন, সেটিকে নয় যেটি
তাঁর ব্যাপকতর জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছিল।
প্রকৃত নিরামিষ আহারে ব্রতী হওয়ার পর ভঙ্গাস্বন অনেক নিরামিষাশের প্রতিষ্ঠান
খুললেন। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক, ধাত-নির্দিষ্ট মুখচোরামির কারণে একটিতেও মৌখিক বা
লিখিত বক্তৃতা দিতে পারলেন না। এর থেকে আসা অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপ সয়ে, শেষে তাঁর
উপলব্ধি হলো যে, এই স্বাভাবিক মুখচোরামি তাঁর ঢাল, আর সেটা কোনো অসুবিধাই করেনি তাঁর জীবনে। বরং অনেক উপকারে এসেছে। তিনি বুঝলেন, ‘আমার বক্তৃতার
দ্বিধা, যা এক সময়ে বিরক্তির কারণ ছিল তা এখন আনন্দ। এর সব চেয়ে উপকার হয়েছে যে এ
আমাকে কথার পরিমিতি শিখিয়েছে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই আমার চিন্তাকে সংযত
করতে শিখিয়েছে। ... আমাকে অনেক বিপদ আর সময়ের অপচয় থেকে বাঁচিয়েছে। অভিজ্ঞতা আমায়
শিখিয়েছে যে সত্যের উপাসকের আত্মিক শৃঙ্খলার একটি অংশ হলো নীরবতা। অতিশয়োক্তির
প্রবণতা, সত্যকে অবদমিত করার অথবা বাঁকানো চোরানোর প্রবণতা মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা, আর
তাকে অতিক্রম করতে নীরবতা প্রয়োজন। কম কথার মানুষ খুব কমই বাচনে চিন্তাহীন হবেন।’
অজস্র সভায় পরে এই বাচনোন্মুখ মানুষদের সভা পণ্ড করতে আর পৃথিবীর অশেষ ক্ষতি
করতে দেখেছেন ভঙ্গাস্বন। আর নিজের মিতভাষিতা থেকে উপহার দিয়েছেন অজস্র জীবন পাল্টানো কথা, স্লোগান,
আহ্বান— ‘করেঙ্গে, ইয়ে মরেঙ্গে’, ‘কুইট ইণ্ডিয়া’।
লোকে অবাক হয়, আমি মার্ক্সবাদী অথচ গান্ধীভক্ত। আমি অবাক হই তাঁদের বিস্ময়
দেখে। বুদ্ধ, মার্ক্স, গান্ধী, জ্যোতি বা এঁরা সিস্টেম-বিল্ডার। সকলেই আলাদা আলাদা সত্যের
সন্ধানী। কিন্তু কারো বইয়ের নাম সত্যকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা নয়। তায় জীবনের
নিরিখে ছোট ছোট সত্য থেকে বড় বড় সত্যে যাওয়ার জার্নি। ভাবছেন এসব ভ্যান্তারা কেন?
এই বেশ কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে ঘুরছে ফিরছে গান্ধীকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ের রিভিউএর
পোস্ট। Ashwin Desai এবং Goolam H. Vahed-এর The South African Gandhi: Stretcher-Bearer of Empire (Stanford, California: Stanford University
Press, 2015) । তাতে আবার নাকি গান্ধীকে ‘রেসিস্ট’ দেখানো হয়েছে, যেহেতু তিনি ‘ইণ্ডিয়ানদের’
অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন, ‘অ্যাফ্রিকানদের’ জন্য নয়। পড়ছি বইটা। তাতে এই কারণে
এমন কথাও বলা আছে যে ‘This book shows that Gandhi sought to ingratiate himself
with Empire and his mission during his years in South Africa. In doing so, he
not only rendered African exploitation and oppression invisible, but was, on
occasion, a willing part of their subjugation and racist stereotyping’ (পৃঃ ২২)। ভালো ভালো! ১৮৯৩-এ ভঙ্গাস্বন গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, মাত্র
২৪ বছর বয়সে, দাদা আবদুল্লা অ্যান্ড কোং-এর একটি মামলার তদ্বির করতে। কিন্তু সেখানে জড়িয়ে গেলেন ভারতীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে, তাদের
সমানাধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে। আস্তে আস্তে সেখানেই করমদাস মহাত্মা হয়ে উঠছেন। ভঙ্গাস্বন
বেছে নিয়েছেন নিজের দেশের লোকদের। তাদের সমস্যা চেনা ছিল যে! কিন্তু তবুও যদি প্রশ্ন ওঠে
নাটালে ১৯০৬-এর জুলু বিদ্রোহে গান্ধীর স্ট্রেচার কেন কম আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের
জন্যই আটকে থাকলো, নিহত ৩৫০০ জুলুদের জন্য নয়, প্রশ্ন উঠতে পারে বৈকি! গান্ধী যে!
এতো আর বাঙালি রোয়াকবাজির গান্ধী-বনাম-নেতাজী-ত্রিপুরীর চেনা তর্ক নয়! চব্বিশ বছরের
সীমিত জ্ঞানের যুক্তি খাটবে না! আজ যদি কেউ বুদ্ধকে প্রশ্ন করে, তিনি কেন কেবল
ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে মধ্যশ্রেণীর জাতগুলির অধিকারের উচ্চারণ
করলেন, আরো নিচু জাতগুলির নয়, উত্তর দিতে হবে না তাঁকে? ২৬০০ হাজার বছর আগের সমাজে
দোহাই খাটবে? পুত্রস্নেহে জননী অধিকা, আর সঙ্গমে নারীর সুখ বেশি, এই সত্য
উচ্চারণে ভঙ্গাস্বন পার পেতে পারেন! গান্ধী পাবেন? নৈব নৈব চ! আরো অনেক বড় বড়
সত্যকথন করতে হবে তাঁকে। নইলে আইনস্টাইনের কথা কেমন করে সত্য হবে যে, ‘Generations
to come it may will be, will scarcely believe that such a man as this ever in
flesh and blood walked upon this earth.’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন