ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(৮)
আমাদের বংশে
কিছু মজার বিষয় আছে। আমার জ্যাঠা, জ্যাঠাও বলা উচিত
না, মানে এতটাই ছোট বয়সে গেছেন। আট বছর বয়সে মারা যান।
তিনি শুনেছি গাছের সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতেন, আর ঘন্টার পর ঘন্টা চুপ
করে বসে থাকতেন নদীর পাড়ে, মাঠের মধ্যে। এমন ভাবেই ঠাকুমার
সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন ঠাকুমার বাপের বাড়ি। বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সারারাত ছাদে একা
বসে ছিলেন। হিমের রাত ছিল। ঠান্ডা লেগে মারা গেলেন। কিন্তু কেউ তাঁকে কাঁদতে
দেখেনি কষ্টে। চুপচাপ চলে গেলেন। যাবার সময় হেসেওছিলেন শুনেছি। অবশ্য এ সব
গল্পকথা। কাহিনীতে ঘি ঢালতেও পারে কেউ। তার আগের কয়েক পুরুষে কেউ না কেউ সংসার
ছেড়েছেন। সন্ন্যাস ছিল সে কালে। আমার জন্মের পর আমার দিদার চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে।
পিতৃ-বংশে কী সব লক্ষণ আছে সে সব লক্ষণ আমার মধ্যে ছিল। তার দুটো ফল, হয় আমি পাগল হব নয় সন্ন্যাসী, সংসারে থাকব না। অথচ
আছি তো সংসারে এখনো, পাগলও হইনি তেমন। এ বংশে দু’ দু’জন বাকসিদ্ধ জন্মেছিলেন।
শেষজন আরেকটা কথা বলেছিলেন। যা সত্যিই মিলে যাচ্ছে বেশ। কাকতালীয়ই হয়তো। বলেছিলেন
বিশ শতকে এ বংশ লোপ পাবে। হা হা হা হা হা! আমিই এ বংশের শেষ পুরুষ। আর কেউ রইল না। আমিই এ
বংশের প্রেত পুরুষ।
-ভালো। কষ্ট হচ্ছে?
-সদ্যজাত শিশুর শরীর থেকে যখন দুধের অম্ল গন্ধ আসে, তখন মনে হয়
কী যেন বাকী থেকে গেল!
-হাজার লক্ষ বছরের সংস্কার। নিজের বীজ থেকে নিজস্ব উৎপাদন। তুমি যে ছিলে
তার একটা চিহ্ন রেখে গেলে। সাম্রাজ্য।
-তাই?
-নয়? সম্প্রসারণ তো!
-না হলে মানুষের বংশ তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
-গেলে কিই বা এসে যেত? অজস্র প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে
তো! আর মানুষ থেকেই বা কী লাভ হলো বল তো? এই যে পৃথিবী,
এ এত ভয়ঙ্কর সুন্দর, মানুষ তাকে কী ভীষণ কুৎসিত
করে রেখেছে দেখেছ?
আত্রেয়ীর
সঙ্গে আমি কোনো তর্ক করি না। করতে চাই না। চায়ের কাপটা রেখে আত্রেয়ী উঠে যায় জানালার কাছে। পর্দা সরায়। এক ঝলক আলো
লাফিয়ে ওর কোলে উঠে আসে। শিশুর দুই হাতের মতো আলো মাখায়
ওর সারা মুখে। আমি সোফায় বসে
দেখে যাই। বত্তিচেল্লির তুলি থেকে উঠেছে আত্রেয়ী।
-একদিকে ভালো হলো জান! এরপর থেকে এই বংশ ফিরে যাবে মাতৃতান্ত্রিকতায়।
-উম্?
মগ্নতা
আত্রেয়ীর সঙ্গে থাকে। তার ওম ভেঙে শব্দ আসে। আলতো করে ছোঁয়। সিগারেটটা হাতে নিই।
ধরাবো না এখানে। তার মধ্যেই আত্রেয়ী চলে এসেছে আমার দু’পায়ের ফাঁকে।
সোজা দাঁড়িয়ে। অনেকটা ঘাড় তুলতে হয় আমাকে।
-সিগারেট খাবে না।
-পুতুলের মেয়েটা আছে। বংশধারা বলতে ওর মধ্যেই যা থাকবে। ওর থেকে শুরু হবে
মাতৃতন্ত্র আবার।
আত্রেয়ীর
মাথা থেকে এক ঢাল চুল তরঙ্গে তরঙ্গে নেমে এসেছে, যেখানে আমি শান্তির স্থির ছবিটি দেখেছি। ক’দিন পরে এ সব থাকবে না। তেতো করে মুখ আমার। উঠে দাঁড়াব। কিন্তু এমনভাবে আত্রেয়ী দাঁড়িয়ে যে আমি ওঠার জায়গা
পাচ্ছি না। ওর কোমরে হাত দিই। আত্রেয়ীর চোখ ঝলকে ওঠে। বুঝতে পারি যে মতলব আঁটছে।
কিন্তু কিসে আটকাবে? আমি কি মৃত্যু
দেখিনি, করুণ, তীব্র মৃত্যু? পিজি-তে চিত্রিতার নব্বই শতাংশ পুড়ে যাওয়া মুখে চোখগুলো কেমন ফাঁদে আটকে
যাওয়া পাখির মতো, দেখিনি? ট্র্যাকিয়া,
ল্যারিংস, ফ্যারিংস সব পুড়ে গেছিল নিশ্চয়ই - কথাই বলতে পারছিল না। তার মধ্যেই বলেছিল
ফ্যাসফ্যাসে ঝগড়ায় আক্রান্ত বেড়ালের গলায়, অর্ণবকে ছেড়ে দেবার কথা। অর্ণবকে পুলিশের কাছে দোষী করেনি। বলেছে নিজেই
আগুন লাগিয়েছিল নিজের গায়ে। আমি কি দেখিনি আমার কোলের মধ্যে সেই শিশুটি...!
আত্রেয়ীর
পাশাপাশি যাদুঘরে যখন হাঁটতাম, মেঝেতে একটা
ফাঁপা শব্দ উঠত আত্রেয়ীর পা থেকে। প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা, তাকে যাদুঘর বলে কেন? কোন যাদু আছে সেখানে? ইতিহাস কি যাদু? বুঝতে পারিনি। আত্রেয়ীর সঙ্গে হাঁটা
কি যাদু ছিল? অশোকের স্তম্ভটা দিল্লীতে দেখে এসেছিলাম। অনেক
পরে একা একা গিয়ে। আত্রেয়ী তখন ইতিহাসে নেই, চলে গেছে ইউ এস এ-তে
তুষারের সংসারে। গ্রীষ্মের দেশে আজ এসেছে যখন এখন আত্রেয়ী কর্কটের ছায়া মেখে ঘোরে।
ওর সামনে
সিগারেট ধরাব না। দূরে যাব একটু। ওকে সরাতে হবে। ও আমাকে প্রতিদিন সরিয়ে দিত অশোক, বৌদ্ধধর্ম, পটুয়া এ
সবের মধ্যে। ও আমাকে সরিয়ে দিয়েছিল সুনীলের মধ্যে। ওদের ওই কলেজ স্ট্রীটের
বাড়িতে আমি সুনীলকে চিনেছি। ওর অধ্যাপক বাবার কাছে এসেছিল সুনীল। উনি এনেছিলেন।
সুনীল পটুয়া পট ছেড়ে তখন ছবি আঁকবে নাকি অন্য। কিছু আয়তক্ষেত্র আঁকত সুনীল। রম্বস
কয়েকটা। কিছু সংকেত থাকত। সঞ্জয় আসত সেখানে। আর্ট কলেজের সঞ্জয়। তুলে নিত ওর হাত
থেকে আঁকার লাইনগুলো। সঞ্জয় আঁকতে আঁকতে বৌদ্ধ হয়ে গেল। মালা ঘোরাতো লামাদের মতো। সঞ্জয়ের ছবি আর্ট গ্যালারিতে, প্রদর্শনী থেকে বিক্রি হচ্ছে মালকিনের পৃষ্ঠপোষকতায়। সঞ্জয় হাতের বরাভয় মুদ্রা তুলে বলতে পারত ‘ক্ষমা ক্ষমা’। আমি সঞ্জয়কে
আয়নার সামনে অনুশীলন করতে দেখেছি সে মুদ্রা। সুনীলকে নিয়ে আমি বা আমাকে নিয়ে সুনীল
চলে গেছিল মেদিনীপুর। মদ খেতে খেতে চলে যাওয়া। আত্রেয়ী প্লেন ধরে আটলান্টা সিটি।
আত্মীয়ের বাড়ি। সেখান থেকে সংসার, হরিৎ পাতার খেলায়।
অথচ আমার সঙ্গে আত্রেয়ীর কোনো প্রেম ছিল না। আমাকে আড়াল দেবার কিছু ছিল না। কিম্বা
ছিল, আমি জানতাম না।
-ওদের অঙ্কগুলো ওরা নিজেরাই সমাধান করতে পারে না। আজ আর কালের কথায় তাই মিল
থাকে না। ওরা আসলে সাধারণ।
-তুমি অসাধারণ?
-আমি অশোক। আমি সুনীল।
-সাধারণ অসাধারণের বাইরে?
-হ্যাঁ এবং না। যখন অশোক তখন আমি সাধারণ, সুনীল হলে
অসাধারণ।
-কী দিয়ে?
-অভ্যাস দিয়ে। কোনো অসাধারণই শুধু অসাধারণ হয় না। যখন হাগতে বসে তখন আর
সকলের মতো করেই হাগে।
-অশোক সাধারণ কেন?
-কেন না অশোক লোভী, ক্রোধী, সঞ্চয়শীল।
সুনীল এর কোনোটাই না। সুনীল একটা মেটামরফোসিস।
-কলিঙ্গ যুদ্ধ তোমার লোভের ফল!
-নিশ্চয়ই। মেয়েটিকে আমি চেয়েছিলাম। অথবা চাইনি তখন।
মেয়েটি চেয়েছিল আমাকে। জল
মেখে সারাটা শরীরে গর্ভিণী বাঘিনীর মৃত্যুতে অশোকের চওড়া বুকে মাথা রেখে জলস্রোত
বইয়ে দিচ্ছিল বড় কালো চোখদুটো থেকে। কেউ আমাকে জড়ালো। লতার মতো। সান্তনা দিতে গেলাম, চকিত চিতার মতো ফুঁসে
দাঁড়াল। তার জীবনের চেয়ে
বাঘিনীর মৃত্যু অসহনীয় তার কাছে। আমি প্রেমে পরে গেলাম।
-তুমি, না অশোক? প্রেমে কে পরল?
-অশোক। জড়াতে চেয়ে
ওর জীবন চলে যায় বলে কেউ জড়ালেই ওর প্রেম আসে। ওর প্রেম আশ্রয়ের স্থাপত্য, বর্ষার জলে বেড়ে যাওয়া গাছের ঘনিষ্ঠতা।
-বুঝলাম না।
-মহারাজ, আলাদা করে কোনোদিন অশোককে স্থান দেননি।
যোদ্ধা হিসেবে সব ভাইদের চেয়ে সে অনেক বেশি দক্ষ হয়েছে
মহারাজের নজরে বিশেষ হতে। পারেনি। সুষীম, তক্ষশিলাতে যখন বিদ্রোহের সঞ্চার ঘটালো
কুশাসনে, তাকে দমন করা এবং সুষ্ঠ প্রশাসন আনার কাজ করেছে
অশোক। প্রশাসনের দক্ষতা প্রমাণিত বলেই গুরু চাণক্যর মোকাবিলায় তাকেই পাঠানো। অথচ
রাজউত্তরাধিকারী সে না। কলিঙ্গের অরণ্যে সে তো গিয়েছিল সুষীমের ষড়যন্ত্র থেকে
বাঁচতে। এমন এক আশ্রয় বঞ্চিতের কাছে কেউ আশ্রয় চাইলে সে তার সত্ত্বাকে জাগিয়ে
তোলে। স্নেহ, বাৎসল্য, প্রেম
বয়সানুগ আসে।
-থাকে না কেন?
অসংখ্য
বাইকের শব্দে ডুবে গেল সুনীলের গলা। গড়বেতার রাস্তা ধরে ধুলো উড়িয়ে বাইকগুলো আসছে।
একের পর এক মাথায় ফেট্টি বাঁধা, মুখে ফেট্টি
জড়ানো যুবকের দল। কিছু প্রৌঢ়ও আছে, বাইকের পেছনে বসে। কেউ
প্যান্ট টি শার্ট, কেউ গেঞ্জী, কেউ
লুঙ্গি দু’ ফেত্তি গুটিয়ে। স্বরূপের দল ওরা। স্বরূপ হিন্দু মৌলবাদীদের
ফ্রন্টাল পলিটিক্যাল
পার্টির দ্বারা আশ্রিত। টাকা আসছে, অস্ত্র আসছে দিল্লী থেকে। মেদিনীপুর ফাঁকা করে চলে আসছে ছোট, মাঝারি, বড় নেতারা কলকাতায়। ক্যাডাররা মার খাচ্ছে,
নয় তুলে নিচ্ছে ওদের পতাকা।
টিলার একটু
উপরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ওদের প্যাটার্ণটা। একই থেকে গিয়েছে। প্রথমে গ্রাম ঘিরে
নেবে। তারপরে বাইরে থেকে বোমা ছুঁড়তে থাকবে। একটু একটু করে বৃত্তটা ছোট করবে।
সুনীলের দিকে তাকালাম। হাসল।
-হ্যাঁ, আমার পদাতিকরাও এমনই
করত।
তারপরে একদল
অশ্বারোহী সোজা মাঝ বরাবর ঢুকে আসবে গ্রামের ভেতর। চারপাশ ঘিরে পদাতিকরা।
প্রথমে মাস্কেট বাহিনী, তারপরে বাইক।
গ্রামের সব পুরুষ গ্রামের মাঝখানে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। যারা আগে পালিয়েছে তারা
বাদ দিয়ে সবাইকে টেনে বের করে এনেছে। একজন চিনিয়ে দিচ্ছে কোনটা কার ঘর। বেছে বেছে লাল পার্টির বেশি পরিচিত নেতা-কর্মীদের ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে ওরা।
-কলিঙ্গ কখনোই কারো অধীন হয়নি। সীমান্তের দিকে আমাদের সৈন্যরা অনেক সময়
লুঠতরাজ চালাত। কিন্তু ভেতরে যায়নি কখনো।
-কেন? সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত কি কলিঙ্গের শক্তিতে ভীত
ছিলেন?
-মনের কথা বলতে পারব না। তবে ভীতি তো সম্রাটের ছিল না।
-তাহলে?
-পশ্চিমে হিন্দুকুশ থেকে পূর্বে মগধ অবধি সব অঞ্চলে ছিল রাজার দাপট। একে
একে সে সব গিয়েছে। কলিঙ্গেও রাজা ছিল। কিন্তু সে রাজাকে চলতে হতো গণের পরামর্শে। কলিঙ্গে যেন সময় থমকে ছিল বহুকাল। বাকি অঞ্চলের
পরিবর্তন সেখানে প্রভাব ফেলেনি।
-ধর্মে ঠিক কী ছিল?
-বলা মুশকিল! বেশির ভাগই পাথর, গাছ এ সবের পুজো ছিল।
বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রভাব
ফেলেনি। বৌদ্ধ, জৈন কিছুই না
এরা। প্রকৃতি পূজক।
-মাহাতোদের মতো? মানে তোমাদের মতো?
-আমরা? নাহ! আমরা তো থাকতে থাকতে এ সব নিয়েছি। এখানে
এসেছি অনেক পরে।
-ওহ, হরপ্পা থেকে -
-হ্যাঁ। ওখান থেকেই সরতে সরতে এসেছিলাম। প্রথমে গঙ্গা যমুনা দোয়াবে। তারপরে
আরো দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে পূর্বে। আমাদের কী ছিল এখন বলা
মুশকিল! তবে এদের মতোই কিছু, যাগযজ্ঞ তো ছিল
না।
-সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এত জায়গা জয় করলেন, তোমার পিতা
মহারাজ বিন্দুসার আক্রমণ করলেন না, তুমি করলে! কেন?
-রাজনীতি। যদি ওঁরা করে যেতেন আমাকে করতে হতো না। তুমি
বুঝতে পারছ পশ্চিম থেকে
পূর্বে এতবড় একটা সাম্রাজ্যের ঠিক পাশেই একটি গণরাজ্যের অবস্থান সাম্রাজ্যের জন্য
কখনোই ভালো লক্ষণ হতে পারে না?
-কৌরবাকি তাহলে কারণ না?
-একদিকে কারণ, অন্যদিকে সে একাই কারণ না।
-মগধ ফেরার সময় তুমি তাকে নিয়ে যাওনি কেন?
-যেতে চায়নি।
-অন্য প্রেমিক?
-ভাবা উচিত ছিল। সিংহের মুখে হাত দেবার আগে ভাবা উচিত ছিল তার।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন