রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

***** সম্পাদকীয় *****

কালিমাটি অনলাইন / ২৯


বাংলা ভাষায় একসময় মহৎ এবং প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের জীবনী লেখার খুব চল  ছিল। এখনও আছে এবং পৃথিবীর সব ভাষাতেই আছে। এছাড়া বিশিষ্ট মানুষদের  আত্মজীবনী লেখারও একটা ধারা আছে। এসবই সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষত জীবনী তথা আত্মজীবনী-সাহিত্যের যথেষ্ঠ মনোযোগী পাঠক-পাঠিকাও আছেন। এবং যাঁদের  হাতের কলম দক্ষ ও শক্তিশালী, লেখার গুণে তাঁদের সেইসব জীবনী ও আত্মজীবনী অনেকক্ষেত্রে গল্প ও উপন্যাসের মতোই প্রসাদগুণ ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইদানীং যেমন চলচ্চিত্রের জগতে ‘বায়োপিক’ ছবির নির্মাণ দর্শকদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষত সাহিত্যের দুনিয়ায় যেখানে ‘পজিটিভ ব্যক্তিত্বের’ জীবনী ও আত্মজীবনী লেখা হয়ে থাকে, চলচ্চিত্রের আঙিনায় সেখানে শুধুমাত্র ‘পজিটিভ ব্যক্তিত্ব’ই নয়, বরং আমাদের জানা-অজানা অনেক ‘নেগেটিভ ব্যক্তিত্বের’ চলচ্চিত্রায়নও হয়। এবং এখানে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে, সাহিত্যে সাধারণত কোনো ‘পজিটিভ চরিত্র’ কাব্য নাটক গল্প উপন্যাসে নায়ক ও নায়িকা চরিত্রের মর্যাদা লাভ করে থাকে, (ব্যতিক্রম মাইকেল মধুসূদন দত্তর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, যদিও মধুসূদন রাবণ চরিত্রকে তাঁর দৃষ্টিকোণে ‘পজিটিভ চরিত্র’ রূপেই নির্মাণ করেছেন ও নায়কের সিংহাসনে বসিয়েছেন।) চলচ্চিত্রে কিন্তু প্রচলিত ধারায় সৎ সুজন সুশীল সুন্দর সৌম্য সুকন্ঠ চরিত্রকে নায়কের আসন ও মর্যাদা দানের পাশাপাশি ইদানীং অসৎ কুজন দুঃশীল চরিত্রও অর্থাৎ ‘নেগেটিভ চরিত্র’ও নায়কের ভূমিকায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছে এবং দর্শকদের সমর্থন ও সহানুভূতি লাভ করছে। বলা বাহুল্য, প্রবহমান চলচ্চিত্রের ধারায় এই ব্যাপারটা একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

যাইহোক যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে আসি। প্রসঙ্গ ছিল জীবনী ও আত্মজীবনী। আমাদের মধ্যে অনেকেই ‘অসাধারণ’ আছেন, যদিও আমরা মূলত ‘সাধারণের’ দলে। আর সাধারণ হই বা অসাধারণ, আমরা যেহেতু নিজের ‘জীবনী’ নিজে লিখতে পারব না, অন্য কেউ লিখলেও লিখতে পারেন; কিন্তু ‘আত্মজীবনী’ লেখার তো কোনো বাধা নেই, আমরা তা লিখতেই পারি। না, লিখলেই  যে তা কোনো পত্র পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে বা বই প্রকাশ করতে হবে, তা নয়। তবে সেই লেখায় যদি সত্যি কোনো সাহিত্যগুণ থাকে, এমন কিছু ঘটনা ও অভিজ্ঞতার কথা থাকে যা অসাধারণের মাত্রা স্পর্শ করেছে, একটা নতুন ভাবনা চিন্তা দৃষ্টিভঙ্গি অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে, তবে সেই লেখাটি নিঃসংকোচে ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের জন্য পাঠাতে পারেন। আমাদের পছন্দ হলে অবশ্যই তা প্রকাশ করব। আসলে আপনারা তো সবাই জানেন যে, ‘সাহিত্য’ শব্দটি কোন্‌ শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। জীবনে জীবন যোগ না হলে জীবনের আর মূল্য কী? তাৎপর্যই বা কী?
সবাই ভালো থাকুন। আনন্দে থাকুন। আহ্লাদে থাকুন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :


দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675

                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India
     


     

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

ভঙ্গাস্বনের সত্য





এই লেখাটা বেরোনর কদিন পরেই ২রা অক্টোবর এসে যাবে। আর এবারের ২রা  অক্টোবরকে ঈদ, দুর্গাপুজো ইত্যাদি ঢেকে দেবে না তাই এবারে ভঙ্গাস্বনের সত্যর কথা বলা যায়! মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভঙ্গাস্বনের কথা আছে। তিনি এক রাজা, যিনি পুত্রকামনায় অগ্নিষ্টুত যজ্ঞ করে শতপুত্র পান। কিন্তু যজ্ঞে অগ্নিকে বেশি তুষ্ট করে ফেলায় ইন্দ্রাভিশাপের মায়াজালে আচ্ছন্ন হন। ফলে শিকারকালে মায়াহরিণের ব্যর্থ পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে পিপাসার্ত হয়ে এক কাকচক্ষু সরোবরে স্নান করে, জলপান করে সেই ‘অচ্ছোদসরসীনীরে’ প্রতিবিম্বে দেখেন তিনি সুন্দরী রমণী হয়ে গেছেন। সত্তার সঙ্কটে আকুল ভঙ্গাস্বন স্ত্রী-পুত্রদের হাতে রাজ্যভার সমর্পণ করে এক ঋষির তপোবনে এসে বাস করতে থাকেন (মতান্তরে অন্য এক রূপক্লিষ্ট রাজার পাণিগৃহীতা হন)। আর সেই ঋষির (মতান্তরে রাজার) আরেক শতপুত্রের জননী হন। পরে তাঁর দুই পুত্রগোষ্ঠী তাঁর কথায় মিলিতভাবে রাজ্যভোগ করতে থাকে। অভিশাপ আশীর্বাদে রূপান্তরিত হচ্ছে দেখে ইন্দ্র তাঁদের মধ্যে বিবাদ আর পৃথকবুদ্ধি সৃষ্টি করেন। তারা একে অন্যকে, পরস্পরকে যুদ্ধে বিনষ্ট করতে থাকলে রোরুদ্যমাণ/ণা ভঙ্গাস্বন তপস্যায় বসেন। তপঃক্লিষ্ট ভঙ্গাস্বনের দশায় বিচলিত ইন্দ্র ভঙ্গাস্বনের কাছে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে তাঁর অন্যায়ের কথা জানান, আর ক্ষমাপ্রার্থী ভঙ্গাস্বনকে বেছে নিতে বলেন কোন পুত্রগোষ্ঠীকে তিনি বাঁচাবেন, কারণ উভয়কে বাঁচানো যাবে না। ভঙ্গাস্বন বেছে নেন ঔরসজাত পুত্রগোষ্ঠীকে নয়, গর্ভজাত পুত্রগোষ্ঠীকে, যেহেতু গর্ভধারণপোষ্ণাভ্যাম্ জননী পিতুরপি অধিকা। ভঙ্গাস্বনের এই সত্যে সম্মত হয়ে ইন্দ্র তাঁকে ঔরসজাত ও গর্ভজাত উভয় পুত্রগোষ্ঠীর পুনরুজ্জীবনের তথা জীবন লাভের বর দেন। আর ভঙ্গাস্বন ইন্দ্রের দেওয়া দ্বিতীয় স্বরূপলাভের ও রাজ্যলাভের বর না নিয়েই তপস্যায় প্রাণত্যাগ করে স্বর্গে যান।



বন্ধু পাঠক, অনেক ভাষ্যের মধ্যে ভঙ্গাস্বনের কাহিনী এখানেই শেষ। আমার কাহিনীর নয়, কারণ গত একচল্লিশ বছরে ক্লাসে ক্লাসে, সেমিনারে, পত্রপত্রিকায় আমি বলেছি ও লিখেছি যে ভারতে গান্ধীই ভঙ্গাস্বন তাঁরও দুই পুত্রগোষ্ঠী ছিল একদল নেহরু, প্যাটেল আর আজাদের নেতৃত্বে ক্ষমতার উচ্চ রাজনীতিতে আসীন। তাঁদের আমি ভঙ্গাস্বন গান্ধীর ঔরসজাত পুত্রগোষ্ঠী ভাবতে ভালোবাসি। আরেকদল বিনোবা ভাবে,  মীরা বেন, সতীশচন্দ্র সামন্ত ইত্যাদির নেতৃত্বে অ-ক্ষমতার নিম্ন রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত। তাঁরা আমার কাছে ভঙ্গাস্বনের গর্ভজাত পুত্রগোষ্ঠী গান্ধীর উৎকর্ষ হলো ভঙ্গাস্বনের মতো তিনি কোনো পুত্রগোষ্ঠীকে বেছে নেননি। ফলে যখন দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রস্তুতিমূলক ভাগবাঁটোয়ারার কথাবার্তা চলছে, সেই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার দিনে গান্ধী ১৯৪৬-এর নভেম্বর থেকে ১৯৪৭-এর জানুয়ারি চারমাস নোয়াখালিতে। আর যখন স্বাধীনতার উদযাপনের পুরোভাগে দিল্লিতে থাকার কথা গান্ধীর, তখন তিনি বিহার হয়ে আবার পুববাংলা যাওয়ার পথে আটকে গেলেন কলকাতায়। সব জায়গায়ই এক কাজ, সৌভ্রাত্র ফেরানো। নির্মলকুমার বোসের My Days with Gandhi in Noakhali আর হোরেস অ্যালেকজান্ডার-এর Gandhi through Western Eyes বইতে এর মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে এর চেয়ে ভালো আর কী করতে পারতেন ইন্দ্রের অভিশাপক্লিষ্ট ভঙ্গাস্বন! নবীন ভারতে দু দশকে জবাহরলাদের উন্নয়নবাদী রাষ্ট্র যত  ফাঁকফোকর রাখলো, তাঁর গর্ভজরা সব বুজিয়ে দিতে লাগলো যে! গান্ধিয়ান সব সংস্থা, ‘লোকায়ন’ ইত্যাদির দাপটে এনজিও পর্যন্ত গড়ে উঠতে পারলো না! আপশোস!

     
আর কী কী সত্যের সন্ধান দিয়ে গিয়েছিলেন ভঙ্গাস্বন? গান্ধীর বিখ্যাত আত্মজীবনী An Autobiography Or The Story of My Experiments with Truth পড়লে অজস্র সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে যার খোঁজে জীবন কাটে তাঁর। কিন্তু আমি যে কটায় সব চেয়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম, তাদের প্রায় সব কটাই আহার থেকে আসা।  তাদের কথা বলি। লন্ডনপ্রবাস কালে মার কাছে দেওয়া অমদ্যপতা এবং নিরামিষ  আহারের প্রতিশ্রুতি ও শপথ রাখতে একের পর এক খাবার বদলে যখন  মশলা ছাড়া পালংসেদ্ধতেও স্বাদ পেলেন, তখন কেবল এই প্রথম সত্য বোঝেননি যে স্বাদের আসল বাসা জিভ নয়, মনপশুপক্ষীর মাংস ছাড়াও ডিম, মাছ, ডিমথাকা পুডিং বা  কেক আমিষ না নিরামিষ এই হিসাব থেকে রেস্তোরাঁ বাছার ঝকমারি ছেড়ে দিয়ে বুঝেছিলেন আরো দুটি সত্য। একটি শপথরক্ষা সম্পর্কে নির্দিষ্ট (স্পেসিফিক)। সেটি হলো এই যে ‘পৃথিবী জুড়েই শপথের ব্যাখ্যা দ্বন্দ্বের একটা বড় কারণ। শপথ যত স্পষ্টই হোক না কেন, মানুষ সেটাকে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে বাঁকিয়ে চুরিয়ে নেবেই। এইসব মানুষকে দেখা যাবে ধনী থেকে দরিদ্র অবধি, রাজা থেকে চাষা অবধি সমাজের সব শ্রেণীতে। স্বার্থপরতা তাদের অন্ধ করে দেয়, আর একটা দ্যর্থক  মধ্যপন্থা নিয়ে তারা নিজেদেরকে এবং ঈশ্বরকে ঠকায়। তাই একটা সুবর্ণনিয়ম হলো যে [শপথের] সে ব্যাখ্যা নেওয়া যেটি শপথদানকালে সেই পক্ষ দিচ্ছে। আরেকটি হলো যেখানে দুটি ব্যাখ্যা সম্ভব, সেখানে দুর্বলতর পক্ষের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করা। এই দুই নিয়মের প্রত্যাখ্যান দ্বন্দ্ব ও অন্যায়ের জন্ম দেয়, আর তাদের শিকড় অসত্যে।’ দ্বিতীয়, জেনেরিক যে সত্যে যিনি গান্ধী এর থেকে পৌঁছেছিলেন তা হলো এই যে, যিনি সত্যকে খোঁজেন সহজে তিনিই কেবল সুবর্ণনিয়মকে অনুসরণ করেন, বিদ্বান  উপদেশ অথবা ব্যাখ্যার স্মরণ নেন না। ভঙ্গাস্বন তাই মাংস বিষয়ে মার ব্যাখ্যাকেই অনুসরণ করেছিলেন, সেটিকে নয় যেটি তাঁর ব্যাপকতর জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছিল



প্রকৃত নিরামিষ আহারে ব্রতী হওয়ার পর ভঙ্গাস্বন অনেক নিরামিষাশের প্রতিষ্ঠান খুললেন। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক, ধাত-নির্দিষ্ট মুখচোরামির কারণে একটিতেও মৌখিক বা লিখিত বক্তৃতা দিতে পারলেন না। এর থেকে আসা অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপ সয়ে, শেষে তাঁর উপলব্ধি হলো যে, এই স্বাভাবিক মুখচোরামি তাঁর ঢাল, আর সেটা কোনো  অসুবিধাই করেনি তাঁর জীবনে বরং অনেক উপকারে এসেছে। তিনি বুঝলেন, ‘আমার বক্তৃতার দ্বিধা, যা এক সময়ে বিরক্তির কারণ ছিল তা এখন আনন্দ। এর সব চেয়ে উপকার হয়েছে যে এ আমাকে কথার পরিমিতি শিখিয়েছে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই আমার চিন্তাকে সংযত করতে শিখিয়েছে। ... আমাকে অনেক বিপদ আর সময়ের অপচয় থেকে বাঁচিয়েছে। অভিজ্ঞতা আমায় শিখিয়েছে যে সত্যের উপাসকের আত্মিক শৃঙ্খলার একটি অংশ হলো নীরবতা। অতিশয়োক্তির প্রবণতা, সত্যকে অবদমিত করার অথবা বাঁকানো চোরানোর প্রবণতা মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা, আর তাকে অতিক্রম করতে নীরবতা প্রয়োজন। কম কথার মানুষ খুব কমই বাচনে চিন্তাহীন হবেন।’

অজস্র সভায় পরে এই বাচনোন্মুখ মানুষদের সভা পণ্ড করতে আর পৃথিবীর অশেষ ক্ষতি করতে দেখেছেন ভঙ্গাস্বনআর নিজের মিতভাষিতা থেকে উপহার দিয়েছেন অজস্র জীবন পাল্টানো কথা, স্লোগান, আহ্বান— ‘করেঙ্গে, ইয়ে মরেঙ্গে’, ‘কুইট ইণ্ডিয়া’।



লোকে অবাক হয়, আমি মার্ক্সবাদী অথচ গান্ধীভক্ত। আমি অবাক হই তাঁদের বিস্ময় দেখে। বুদ্ধ, মার্ক্স, গান্ধী, জ্যোতি বা এঁরা সিস্টেম-বিল্ডার। সকলেই আলাদা আলাদা সত্যের সন্ধানী। কিন্তু কারো বইয়ের নাম সত্যকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা নয়। তায় জীবনের নিরিখে ছোট ছোট সত্য থেকে বড় বড় সত্যে যাওয়ার জার্নি। ভাবছেন এসব ভ্যান্তারা কেন? এই বেশ কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে ঘুরছে ফিরছে গান্ধীকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ের রিভিউএর পোস্ট। Ashwin Desai এবং  Goolam H. Vahed-এর The South African Gandhi: Stretcher-Bearer of Empire (Stanford, California: Stanford University Press, 2015) তাতে আবার নাকি গান্ধীকে ‘রেসিস্ট’ দেখানো হয়েছে, যেহেতু তিনি ‘ইণ্ডিয়ানদের’ অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন, ‘অ্যাফ্রিকানদের’ জন্য নয়। পড়ছি বইটা। তাতে এই কারণে এমন কথাও বলা আছে যে ‘This book shows that Gandhi sought to ingratiate himself with Empire and his mission during his years in South Africa. In doing so, he not only rendered African exploitation and oppression invisible, but was, on occasion, a willing part of their subjugation and racist stereotyping’ (পৃঃ ২২)ভালো ভালো! ১৮৯৩-এ ভঙ্গাস্বন গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, মাত্র ২৪ বছর বয়সে, দাদা আবদুল্লা অ্যান্ড কোং-এর একটি মামলার তদ্বির করতে কিন্তু সেখানে জড়িয়ে গেলেন ভারতীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে, তাদের সমানাধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে আস্তে আস্তে সেখানেই করমদাস মহাত্মা হয়ে উঠছেন। ভঙ্গাস্বন বেছে নিয়েছেন নিজের দেশের লোকদের। তাদের সমস্যা চেনা ছিল যে! কিন্তু তবুও যদি প্রশ্ন ওঠে নাটালে ১৯০৬-এর জুলু বিদ্রোহে গান্ধীর স্ট্রেচার কেন কম আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্যই আটকে থাকলো, নিহত ৩৫০০ জুলুদের জন্য নয়, প্রশ্ন উঠতে পারে বৈকি! গান্ধী যে! এতো আর বাঙালি রোয়াকবাজির গান্ধী-বনাম-নেতাজী-ত্রিপুরীর চেনা তর্ক নয়! চব্বিশ বছরের সীমিত জ্ঞানের যুক্তি খাটবে না! আজ যদি কেউ বুদ্ধকে প্রশ্ন করে, তিনি কেন কেবল ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে মধ্যশ্রেণী জাতগুলির অধিকারের উচ্চারণ করলেন, আরো নিচু জাতগুলির নয়, উত্তর দিতে হবে না তাঁকে? ২৬০০ হাজার বছর আগের সমাজে দোহাই খাটবে? পুত্রস্নেহে জননী অধিকা, আর সঙ্গমে নারীর সুখ বেশি, এই সত্য উচ্চারণে ভঙ্গাস্বন পার পেতে পারেন! গান্ধী পাবেন? নৈব নৈব চ! আরো অনেক বড় বড় সত্যকথন করতে হবে তাঁকে। নইলে আইনস্টাইনের কথা কেমন করে সত্য হবে যে, ‘Generations to come it may will be, will scarcely believe that such a man as this ever in flesh and blood walked upon this earth.’ 


                               

               

শিবাংশু দে

চাঁড়ালের হাত দিয়া...




(১)

মানুষ লেখালিখি শুরু করার ঢের আগে থেকে মৌখিক পরম্পরার শ্রুতিসাহিত্যের সঙ্গে  নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিল। পৃথিবীর সর্বদেশে প্রাচীন শাশ্বতসাহিত্যের বিভিন্ন ধারা কথকতার সূত্রেই লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলহোমারের ইলিয়াড থেকে ঋগবেদ, মহাভারত, রামায়ণ ইত্যাদি এই শ্রুতিপরম্পরারই অঙ্গ।

'সাহিত্য' শব্দটির শিকড় লুকিয়ে আছে 'সহিত' শব্দটির সঙ্গে। অর্থাৎ এই শিল্পটি একা মানুষের খেলাধূলা নয়। স্রষ্টা ও গ্রহীতার পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক সমীকরণের সঙ্গে তার সার্থকতা নিহিত আছে। যেমন শ্রদ্ধেয় সুধীর চক্রবর্তী মশায় রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নির্জন এককের গান বলেছিলেন। ব্যক্তি আমি এই ভাবনাটির পক্ষে ন'ই। কেন ন'?  কারণটি অতি সহজ। কোনও সামাজিক মানুষ কখনও নির্জন একক হতে পারে না। তার সামাজিক অস্তিত্ত্বই তাকে মনুষ্যত্ব দিয়েছে। মনুষ্যত্ব একটি সাপেক্ষ প্রেক্ষিত,  এককের নিঃসঙ্গতা তাকে ধরতে পারে না। মননে মনুষ্যত্ব না থাকলে সব শিল্পই বিফল। শিল্পের তাৎপর্য এককের চিত্তকন্ডূয়ন নয়, সমষ্টির পরিপ্রেক্ষিতেই তার মূল্যায়্ হয়ে থাকে। এককের শিল্পরুচি নির্ধার করে দেয় সমষ্টি, সমাজ ও ইতিহাসের প্রচলিত  টানাপোড়েনগুলি। তাই সাহিত্য শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে অন্যের সহিত বিনিময়যোগ্য  চিন্তাভাবনার খতিয়ান হিসেবে। এই অন্য বা অপর, স্রষ্টা বা গ্রহীতা দুইই হতে  পারেন। এভাবেই আমরা দেখি বেদ-উপনিষদ-দর্শন-পুরাণ-মহাকাব্য ইত্যাদি কোনও কালজয়ী সাহিত্যই এককের রচনা নয়। দীর্ঘসময় ধরে অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তার সারনির্যাস দিয়ে এই সব নথিবদ্ধ সাহিত্যসৃষ্টিকে পূর্ণতা দিয়ে এসেছেন। তাই এই সব ক্ল্যাসিক আর এককের রচনা থাকেনি, সমষ্টির সৃজন ও গ্রহণের সার্বভৌম নিদর্শন হয়ে থেকে গেছে। তার সাহিত্য নাম সার্থক হয়েছে।  

()

লিপি আবিষ্কারের পর থেকে সাহিত্যের শুধু শ্রাব্যরূপের সঙ্গে দৃশ্যরূপও গ্রহীতার কাছে পৌঁছতে থাকে। তবে এই সব লেখাজোখা যেসব মাধ্যমে করা হতো, তা ছিল ইতরজনের আয়ত্বের বাইরে। প্রথমে শিলালিপি, পরে ধাতবতক্ষণ এবং আরো পরে তালপত্র, ভূর্জপত্রে তাকে ধরে রাখা হতো। কোথাও কোথাও চামড়ার ব্যবহারও হতো। কিন্তু আমাদের দেশে তা ছিল অপবিত্রশ্রুতি সাহিত্যের মতোই এই সময় থেকেই ব্রাহ্মণ্যব্যবস্থা ইতরজনের নাগাল থেকে দৃশ্য সাহিত্যকেও দূরে নিয়ে যায়। বিধান দেওয়া হয়, শূদ্রজন যদি এই দৃশ্য বা লেখ্য সাহিত্যের চর্চা করে, তবে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। প্রকৃত অর্থে সাহিত্য শব্দটি একটি টার্ম বা পরিভাষা মাত্র হয়ে যায়,  তার আত্মা নির্বাসিত হয়ে যায় চিরতরে।

সেকালে সাহিত্য বলতে মানুষের সমগ্র অক্ষর ও শব্দভিত্তিক সৃজনশীল যাপনকে  চিহ্নিত করা হতো। তার মধ্যে কাব্য, নাট্য, দর্শন, পুরাণ, ইতিবৃত্ত ইত্যাদি সব ধরনের চর্চাই সমায়িত ছিলপরবর্তীকালে বিভিন্ন বর্গীকরণ করা হয় এবং সামূহিক জনমনে সাহিত্য বলতে মূলতঃ আখ্যানমূলক গদ্য, যাকে নতুন নাম দেওয়া হয়  কথাসাহিত্য ও কবিতা বা কাব্যসাহিত্যের অস্তিত্ত্বই মুখ্য হয়ে ওঠে। যে জনসমষ্টি ব্রাহ্মণ্য বলয়ের বাইরের অংশ ছিল, অর্থাৎ সংখ্যাগুরু ইতরজনের অনন্ত কাফিলা, সাহিত্য তাদের নীতিশিক্ষা ও মূল্যবোধের শিক্ষা দেবার জন্যই ব্যবহৃত হতে থাকে।  আমরা যদি শুধু আমাদের ভাষার ক্ষেত্রেই সংহত হই, তবে দেখব বৌদ্ধদোহা বা চর্যাপদের সময় থেকেই সন্ধা ভাষার কাব্য ক্রমাগত দুরূহ জটিলতাকে শৈলি হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে। সমান্তরালভাবে দেখতে পাবো, বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্যযুগের মহাকাব্য ও  লোকযানী মিথপুরাণকে সহজ ইতরজনবোধ্য ভাষায় সাধারণ মানুষের বিবেক ও বিনোদনের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা কৃত্তিবাস, কাশীরাম বা মুকুন্দরামের অনুরাগী গুণগ্রাহী ছিলেন, তাঁদের জন্য বেদ পুরাণ বা ভাগবতের জগত অজানা থেকে গিয়েছিলএস ওয়াজেদ আলির লেখার সেই রামায়ণ পাঠরত মানুষটির ট্র্যাডিশনটিও এ রকমই ছিল। এই পরম্পরায় আমাদের সংস্কৃতিতে বিশিষ্ট নিকৃষ্ট  পাঠকশ্রেণীর ধারণা জন্ম নেয়। লেখাপড়ার বিশ্বেও, আর্থ-সামাজিক সমীকরণের ভিত্তিতে পাঠকের গুণগ্রাহিতার মান বর্গীকৃত হতে থাকে। বর্গীকরণের এই ধারা আর বর্ণভিত্তিক সামাজিক স্তরবিভেদ প্রায় সমান্তরাল ছিল




()

দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বাতাবরণে এই ব্যবস্থাটি স্বীকৃত হয়ে যায় এবং বেশ  কয়েকশো বছর এ নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব প্রকট হয়নি। এই স্থিত ব্যবস্থাটির প্রতি প্রথম আঘাত আসে য়ুরোপীয় মনন ও যুক্তির ক্রমবিকশিত প্রভাবে ও বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহারের সূত্রে। সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও ছাপাখানা মানুষের মনোজগতে বিচার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তুমুল আলোড়ন নিয়ে আসে। নবজাগরণ শব্দটি প্রকৃত অর্থে  সফল হয়ে উঠতে থাকে। ঠাকুর আসনে নির্বাসিত সিঁদুরচন্দন মাখা তালপাতার পুথি  বা নৈয়ায়িক স্মার্ত অভিজাতবর্গের কুক্ষিগত মননগঙ্গোত্রী বিপুল উচ্ছ্বাসে জনসমুদ্রের তৃষ্ণা নিবারণ করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। বাংলা পাঠকও প্রাচীন, প্রচলিত ও স্থবির পাঠ অভ্যেসের থেকে নিশ্চিত মুক্তি খুঁজে পায়। ফারসি ও ইংরেজি ভাষার স্ট্রাকচার্ড   মেধাচর্চার একটা দেশজ বিকল্প তৈরি হলোএই মন্থনের ফলশ্রুতি হিসেবে কয়েকটি নতুন খেলার মাঠ সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্য মননব্যব্স্থা কৌলীন্য আহত হবার শংকায় প্রথম থেকেই অতি রক্ষণশীল অবস্থান গ্রহণ করেছিলঅন্য পক্ষে হিন্দু কলেজ বা সংস্কৃত কলেজকে কেন্দ্র করে পঠনপাঠনের এক নতুন প্রবণতা বিকশিত হতে দেখা যায়ভাটপাড়া মার্কা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অতিবাদী রক্ষণশীল বাধানিষেধের অন্যপ্রান্তে ইয়ং বেঙ্গল মার্কা যাবতীয় বিগ্রহবিনাশী উদ্দাম সেরিব্রাল উদ্যম মোকাম কলকাতায় কেন্দ্রিত হতে থাকে। এর মধ্যেই আবার হেয়ার সাহেব, ডাফ সাহেব বা আমাদের বিদ্যাসাগর মশায় একটা সমন্বিত পাঠপ্রকরণ প্রচলিত করতে মনোসংযোগ করেনপরবর্তীকালে এই ধারাটিই মূলস্রোতের স্বীকৃতি লাভ করে ছিলসেই সময় যাঁরা এই শিক্ষাব্যব্স্থার সুযোগ নিতে অগ্রণী হন তাঁরা ছিলেন একটি জায়মান শ্রেণী,  পরবর্তীকালে যাঁদের উত্তরসূরিরা মধ্যবিত্ত নামে চিহ্নিত হয়েছিলেন। তবে এই সব ক্রিয়াকান্ড মূলতঃ শহর কলকাতাতেই কেন্দ্রিত ছিল। যদিও গ্রাম বা মফঃসলের নানা   আর্থসামাজিক স্তর থেকে কলকাতায় আসা প্রথমপ্রজন্মের মানুষজনই এই মন্থনের ডাইনামিক্সগুলি স্থির করে দেন। উদাহরণ হিসেবে মাইকেল বা ভূদেব মুখো'র  বৈপরীত্য ও একাত্মতার কথা ভাবা যেতে পারে। নিত্য প্রকাশিত নানাদেশীয় প্রকাশনা আর আমদানিকৃত বিদেশী গ্রন্থসম্ভারের প্রাচুর্য আগ্রহী পাঠকদের সামনে বহুমুখী পঠনবিকল্প এনে দেয়। কিন্তু তখনও পাঠকের স্তরভেদে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা বেশ প্রকট ছিল

()

ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার কায়েমী স্বার্থ, স্থিতাবস্থাকে বিচলিত করার বিশেষ পক্ষপাতী  ছিল না। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল রাইটার্সের কাজ চালানো কেরানিকুলকে প্রস্তুত করা। তারা ছিল হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন, অ্যাসেটস নয়। তাই তাদের  মেধাজগতকে পূর্ণতা দেবার কোনও দায় সাহেবদের ছিল না। স্বদেশ থেকে গোরা সাহেবদের এনে রাইটারের চাকরি দেওয়া আর্থিক মুনাফার হিসেবে পোষাতো না। এদেশের ইতিহাসের প্রথম আউটসোর্সিং ইংরেজরাই এইভাবে শুরু করেছিলই ইতিহাসটির পুনরাবৃত্তি ঘটছে আজএই সময় আমাদের দেশে একটা সম্পূর্ণ প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার সূত্রে নব ঔপনিবেশিক হোয়াইট ম্যানস প্রসাদনির্ভর হয়ে পড়ছে, বিভিন্ন রুচি ও মূল্যবোধের নিরিখে তার নিদর্শন আজ বেশ প্রকট রূপেই দেখতে পাই। এক কালের রাইটার্স থেকে কেন্দ্রটি স্থানান্তরিত হয়ে গেছে ম্যানহাটান, সিলিকোন ভ্যালি, ফ্লরিডায়। বহুজাতিক বণিকেরা বডি শপিং জাতীয় দাসব্যবসায় আমাদের নতুন প্রজন্মের একটি বৃহৎ অংশকে অধিকার করে ফেলেছেঅনারেবল জন কোম্পানি ঊনবিংশ শতকে যেভাবে এদেশের নতুন প্রজন্মগুলিকে কেরানিপ্রজন্মে রূপান্তরিত করে ফেলতে পেরেছিল, স্যামচাচার কোম্পানিরাও আজ সেজাতীয় কাজেই লিপ্তআমাদের দেশে এই বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত একালের নাগরিক পাঠকদের একটা বড় অংশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী মানুষের রোদজ্যোৎস্নার ছন্দে জীবনযাপনের  সহজ বৃত্তটি বিড়ম্বিত হয়ে পড়েছে। পেশা বলতে সারা রাত বডিশপিং, সারা দিন আধোঘুম আধো জাগরণে পরের রাতে শাদা চামড়াদের থেকে প্রত্যাশিত ভৎসনা পরিপাক করার জন্য প্রস্তুত হওয়াএর ফলে সপ্তাহান্তে তাদের  শরীর মনে কোনও উচ্চকোটীর রসগ্রাহিতার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি আর অবশিষ্ট থাকছে না। মনে হচ্ছে, পানশালায় গিয়ে বন্ধহীন ব্যাকানালিয়ার পাপে আত্মসমর্পণ ভিন্ন তাদের একটা বড় অংশের কাছে কোনও বিকল্প নেই। পাঠক হিসেবে তারা কীভাবে রবীন্দ্রনাথের গদ্যপদ্যের কাছে এসে পৌঁছোবে? সেই উদ্বৃত্ত শক্তি বা নিবেদিত সংকল্পের তাড়না তারা আর ধারণ করতে পারছে না।  চেতন ভগতের অধিক কোনও মনোসংযোগ তাদের থেকে প্রত্যাশিত নয়। অথচ এই পাঠকগোষ্ঠীটিই আজকের প্রজন্মের নতুন লেখকদের বহুমুখী সৃজনচর্চার প্রধান গুণগ্রাহী হতে পারতো




()

এই বিপর্যস্ত মেধার নবপ্রজন্ম, যদি পাঠক হিসেবে শুশ্রূষা পেতে কখনও বইয়ের কাছে যাবার কথা ভাবেও, তবে সেই বইয়ের ভিতরে শাদা পাতায় কালো অক্ষরগুলির  প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে টিভি স্ক্রিনের মায়াবী দৃশ্যনাট্যের এইচ ডি সম্প্রচার। এই নিশিডাক এড়াতে পারা অত্যন্ত দুরূহ, প্রায় অসম্ভব কাজবই কখনও বিনোদনের বিকল্প হতে পারে না। এই পরিবেশে চেতন ভগত, শোভা দে এবং এই ক্লোনের লেখককূলই সফল হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ পারেন না। লেখক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ চিরকালই ব্যতিক্রমী পাঠকের জন্য সংরক্ষিত থেকে যাবেন। যদিও চিন্তা ও মননে মুক্ত স্বকীয়তার বিচারে এই ধারার লেখককুলকে আরো কয়েকজন্ম জাতকচক্রে পরিভ্রমণ করতে হবে, রবীন্দ্রনাথকে ছুঁতেI কিন্তু সংখ্যাগুরু পাঠকের প্রেয়, গভীরতর মনন থেকে দূরে থাকা লঘু স্মার্ট লিখনশৈলি এঁদের ইউ এস পি। মুদ্রিতমাধ্যমে জনরঞ্জনের জাদুটি এঁরা আয়ত্ব করে ফেলেছেন। রাইটার্সের কেরানিকুল ও গ্রামীণ ফড়েদের তেষ্টা মেটাতে তৈরি হয়েছিল বটতলার লিখনসাম্রাজ্য। জনরঞ্জনই তাদের লক্ষ্য, রঞ্জিতসাহিত্যই তাঁদের ফর্টেএকটি প্রজন্মের দীর্ঘস্থায়ী মূল্যবোধ তৈরি করার কন্টকসংকুল ক্ষুরস্যধারার চ্যালেঞ্জ তাঁরা নেবেন না এতো স্বাভাবিক। সফল বিজনেস ম্যানেজারেরা লেখাটেখার মাধ্যমে বিজনেস বোধেরই চর্চা করবেন। তাই তাঁদের বইবাণিজ্যের সাফল্য আকাশ ছোঁয়া। তাঁদের কোনও দায় পড়েনি রবীন্দ্রনাথ জাতীয় মানুষদের প্রথা অনুসরন  করার। পাঠ্য হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রহণযোগ্যতা আইটি প্রজন্মের কাছে, অথবা বৃহত্তর নতুন প্রজন্মের কাছে, শেষ হয়ে গেছে। হয়তো বৃহত্তর বঙ্গজ পাঠককুলের কাছে রবীন্দ্ররচনার কোনও আবেদন কখনও ছিল’ও নাবটতলার পাঠকদের একটা অংশ বঙ্কিমে এসে পৌঁছোতে পেরেছিলকিন্তু বটতলা থেকে সরাসরি রবীন্দ্রনাথে পৌঁছোতে পারা সম্ভব ন, মাঝখানে বঙ্কিমকে প্রয়োজন হয়। হৃদয়ের খাদ্যরুচি ও উদরের ভোজনতুষ্টি সময়ের প্রাথমিকতার সঙ্গে পাল্টে যায়। সেটাই কালের ধর্ম। তা বলে একালের মূল স্রোতের, অর্থাৎ বাণিজ্যলক্ষ্মীর প্রসাদপুষ্ট বঙ্গীয় লেখককুল  গতানুগতিকতার চোরাবালির কাছে বর্তমানে যে পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করছেন, সেটা কতটা স্বীকার্য? চেতন জাতীয় অ্যাকমপ্লিশড বটতলার লেখকদের কোনও লেখা কি তাঁদের মৃত্যুর এক বছর পরেও কারো মনে থাকবে? প্রকাশকেরা ওজন দরে বিক্রি করলেও খরিদ্দার পাওয়া যাবে কি? জানা নেইকারণ বিভিন্ন বইয়ের দোকানে দেখি বছর দুই আগে তাঁদের লেখা বইগুলো মুদিখানার সামগ্রীর মতো অন্য কিছুর সঙ্গে ফাউ হিসেবে বিতরিত হচ্ছে। অতএব সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের, ভিন্ন মননের লেখকদের মধ্যে এই জাতীয় তুলনামূলক সমীকরণ করতে চাওয়ার আবহমান প্রয়াস পাঠকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু আনবে না। এই মৌল বিভেদটিকে যদি স্বীকার না করা হয় তবে বিশিষ্ট বা নিকৃষ্ট পাঠকের মিথ ক্রমাগত বেড়েই চলবে।  

()

যখন কোনও নতুন ভাষা ক্রমশঃ সমর্থ হতে থাকে তখন তার পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন স্তরবিন্যাসও গড়ে ওঠেযেহেতু ভাষার এই এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নদীর তুলনা করা হয়, তাই উপমানটি নানা লক্ষণে অনস্বীকার্য। নদীর জল যেমন একই ঘাট দুবার স্পর্শ করে না, তেমনি ভাষাশৈলিও কখনও পুরনো শরীরে আবার ফিরে আসে না। নদী বয়ে যায় নিজের ছন্দে, নিজস্ব গরজে, কিন্তু যাবার পথে দুকূল ছড়ানো মাটির জগৎকে শস্যপর, ঋদ্ধতার আশীর্বাদে ধন্য করে দিয়ে যাভাষাকে জড়িয়ে  মানুষ যে মননজগৎ গড়ে তোলে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়ও তাকেই বহন করতে হয়। অথচ নদীর বয়ে আনা উর্বর পলিমাটি যদিও মানুষের জন্য পরম প্রাপ্তি, কিন্তু নদীর জন্য তা বিনাশী সঞ্চয়। ভাষানদীর জন্যও সেটা সত্যI পলিমাটিতে উর্বর এই মানবজমিন যদি সঠিক দিশানির্দেশ না পায় তবে তা ভাষার গতিরোধ করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। এই জায়গাটা থেকেই পাঠকের দায়িত্ব শুরু হয়। কী পড়লে, কীভাবে পড়লে ব্যক্তি পাঠক স্বতঃ প্রয়াসে ভাষার শ্রেয়ফলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে  রাখতে পারবে? পড়ার প্রক্রিয়াটি জীবনকে উপভোগ করার একটি সূচক। প্রাপ্তির নিরিখে দেখলে পঠনক্রিয়া থেকে মানুষ কী পায়? সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, তৃপ্তি, আরাম, আঘাত, উপলব্ধি, পরিপূর্ণতা থেকে মননসিদ্ধির অনুভূতি। কিন্তু সব পাঠক তো একই উদ্দেশ্য নিয়ে পড়তে বসেন না। যে পাঠক তাঁর উদ্বৃত্ত সময়ে নবকল্লোলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন, তিনি তো সচরাচর জিজ্ঞাসা বা এক্ষণের প্রতি আগ্রহী নাও হতে  পারেন। অথবা এমন পাঠকও আছেন যাঁরা এই দুদিকেই হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক।  তবে পাঠকের শ্রেণীবিভাগ কীভাবে করা যাবে! কোনও বইয়ের পঠন উৎকর্ষের মান  নির্ধারিত কীভাবে হবে? পাঠকের মান থেকে না অন্য কোনও মানদন্ডও রয়েছে?

()

যদি শুধু বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রেই কেন্দ্রিত থাকি, তবে দেখবো কলকাতা শহরের বার্ষিক বৃহৎ বইমেলাটি ব্যতিরেকে বিভিন্ন মফঃসল শহরের অন্যান্য বইমেলাতেই শুধু যথেষ্ট  বাংলা বই দেখতে পাওয়া যায়নয়তো কলেজ স্ট্রিট চৌহদ্দির বাইরে পছন্দ মতো বাংলা বই কলকাতা শহরেও পাওয়া যায় না আর্থিক বাণিজ্যের মাপকাঠিতে বাংলা বই পিছিয়ে রয়েছে বহুকালইপারমার্থিক বাণিজ্যেও আজ তারা হয়তো পশ্চাদ্পদ হয়ে পড়ছেবাংলাভাষা ও সাহিত্যের রোজ-এ-কয়ামত এসে গেছে এই তত্ত্বে আমি বিশ্বাসী নইতবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে, মান ও মাত্রার বিচারে বাংলা বইয়ের অধিকার ক্ষেত্রটি ক্রমশঃ ছোট হয়ে যাচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়।  বাংলা কথাশিল্পে কেরানিপোষা সাহিত্যের অনুপাত চিরকালই অত্যন্ত অধিককিন্তু অতীতে এটা দেখা যেত সেই অধস্তন সাহিত্যের থেকে অনেক উপরের স্তরের সৃষ্টিগুলিরও জনমনে বেশ বড় জায়গা ছিললিটল কাগজ বা অন্যতর ব্যতিক্রমী পত্র আয়োজন ছাড়াও পাঠকরুচির একটি ন্যূনতম স্তর ধরে রাখতে বাংলা লেখকরা সক্ষম হতেন। যেমন দেশ নামক পত্রিকাটির মান থেকে একসময় বাংলা পাঠকের রুচির হদিশ কিছুটা পাওয়া যেতবাণিজ্য হলেও, দেশ পত্রিকার কর্তারা  সাধারণ বাংলা পাঠকের গদ্যপদ্য তৃষ্ণা নিবারণের ক্ষেত্রে কিছু যত্ন নিশ্চয় নিতেন। আমাদের বাল্যকালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাজোখার মান স্থূল বিচারে বাংলা পাঠকের রুচিবোধের সূচক হিসেবে স্বীকৃত ছিলযদি সেই অভ্যেসকে আজও প্রশ্রয় দিতে চাই, তবে দেখবো রুচিসূচকের অধোগমন অতি স্পষ্ট। 




()
  
আমরা আবার ফিরে এলাম প্রশ্নমুখের উৎসে। যাঁরা বাংলায় লেখালেখি করেন, তাঁদের কাছে বাংলায় লিখে বৃহত্তর পাঠক ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটি এখন অনেক বেশি প্রকট হয়ে পড়েছেপাঠকচরিত্র বুঝে লেখকরা পণ্য সরবরাহ করবেন, না পাঠকরা পড়াশোনার মাধ্যমে লেখকচরিত্রকে খুঁজতে চাইবেন, পাঠকের সেই চিরকালীন  দ্বিধাসংকট এখনও সমানভাবে বহাল রয়েছে। প্রথম গোষ্ঠীর পাঠকদের এতদিন ধরে নিকৃষ্ট ভাবার পাপ আর দ্বিতীয় গোষ্ঠীর সতত নিজেদের পবিত্রতর মনে করার অভ্যেস কতটা প্রাসঙ্গিক, সে নিয়ে হয়তো একটু অন্যরকম ভাবা যেতেও পারেমূল স্রোতের পণ্যবাহী সাহিত্যের ভার কম করে কীভাবে আর একটু ধার আনা যায় বা  অন্য স্রোতের অতি ধারালো শব্দচর্চাকে অকারণ আপোস না করেও বৃহত্তর  জনগণেশের প্রেয় করে তোলা যায় কি না, সে বিষয়টিও আজকের কলম-নবীশদের চিন্তাভাবনায় খোরাক হতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, কালের দাবিতে পাঠকরা অনেক অধিক মাত্রায় নিজেদের উপভোক্তা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেনআমার ধারণায় এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেইকারণ এর ফলে বাংলা রচনার মান উন্নত করে তোলার পক্ষে নতুন প্রয়াস উঠে আসতে পারে। এর সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, গোলগাপ্পা-চানাচুরমার্কা লেখা লোকে তাৎক্ষণিক সাময়িকতায় গ্রহণ করলেও  পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিকে তার বিচারে মাপার চেষ্টা ভুল হবে। জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণ বা আরো অনেকে, একসময় মূল স্রোতের বাইরে সমান্তরাল স্রোতের আবহে থেকে সৃজনকর্ম করে গেছেন নিজেদের জোরে। বহুদিন হলো পাঠকসাধারণ, নিকৃষ্ট বা বিশিষ্ট, তাঁদের মূল স্রোতে সিংহাসন পেতে দিয়েছেন। লোকপ্রিয়তার বিচারে অমিয়ভূষণও একদিন বিভূতিভূষণ হয়ে উঠবেন, সে আশা কখনও ফিকে হবে না। বাংলাসাহিত্যে এ জাতীয় উদাহরণ কম নেই। লেখার গুণমান নিয়ে সতর্ক না হয়ে যদি আমরা এখনও পাঠকদের গুণমান নিয়ে অধিক তর্কমত্ত থাকি, আত্মবিজ্ঞাপনকেই সফলতার প্রধান সোপান মনে করে তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করি, তবে হয়তো সেদিন দূরে নয় যখন ভাবীকালের বাঙালি পাঠক, বিশিষ্ট’ বা নিকৃষ্ট নির্বিচারে, আবার মাইকেলের ভাষায় আমাদের বর্তমান ধুরন্ধর লোকপ্রিয় লেখকদের প্রত্যাখ্যান করবেন,
চাঁড়ালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তকে, 
ফেলো কীর্তিনাশা জলে...