মৌ-মিতালি
মোবাইলে অন্যমনস্ক রাস্তায়, অনেক জীবনের মরণকথা
জানা আছে মৌ-এর। তাই থেকেই পাকাপাকি
সিদ্ধান্ত ওর, রাস্তায় থাকলে কিছুতেই ফোনাফুনি নয়। তবু দেরি দেখলে ভাবনাও। ভুলো মনের
ব্যপার স্যাপারে কিছুটা অভ্যস্থ হলেও, ফিকিরবাজ চিন্তারা ঠিক পিঁপড়েসদৃশ। কুটকুটে। কুটুশ কামড়ে সিদ্ধমুখ।
সবজি-বাস্কেটটা আজ মধ্যবয়সিনী বিধবার সিঁথি। মনে
মনে লাল সবুজ গোলাপীতে সাজাচ্ছে তাকে মৌ। বাঃ! ভিবজিওরি না হোক, দু'তিন রঙেই বেশ
সুন্দরী দেখাচ্ছে সাদা
বাস্কেটটাকে। ছোটপিসি যখন সাদা সিঁথি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এলো, মৌ সেই থেকে সেই
সুন্দরী বিদূষীকে রাঙিয়ে দেবার জিদে। কিছুদিন সময় দিয়েছিল শুধু। না, কোনো শোকের হৈহল্লা বাজায়নি ছোটপিসি।
মাতামাতি উচ্ছ্বাসও নেই। দেখামোপনা বা সহানুভুতির আস্কারা... একদম নেই। এলো গেল তো
জীবনেরই অঙ্গ! তার মধ্যে একরাশ কান্নাকাটির
হৈরব কতদিন মনোটনি বাজাবে! লোককে বিরক্ত ব্যতিব্যস্ত করা।
নিজের কাজেই ঢুকে পড়েছিল ছোটপিসি। সারাদিন বই খাতা ল্যাপটপ বিছানা জুড়ে বসে থাকে তার ঘরে। সেই
সাদা বাস্কেটটাকে মৌ অনেক চেষ্টায় আবার রাঙিয়ে দিতে পেরেছিল মাইকেল অনুপমের সাথে।।
পিসিকে বড্ড ভালোবাসতো, দুজনেই। একটা টিপ পিসির মুখটাকে কী সুন্দর যে করে দেয়!
ডোরবেলে গান বাজতে মৌ অতীত ভেঙে দরজা খুললো।
বাজারের অনভ্যস্ত থলি হাতে টিপু। চোখে
চোখে হেসে ফেললো দুজনে। গ্রীলের গেট হাঁ করিয়ে মৌ — কাম ইন। ডাইনিং টেবিলের ওপর
রাখা সাদা বাস্কেটে উপুড় খুলে দিল টিপু বাজারের থলি। একটা ছোট্ট সাদা বিল্লি। মিউ
মিউ সবজি বাস্কেটে। খানিক থমকে দুজনেই হো
হো হাসিতে ডাইনিং কিচেন ভরিয়ে দেয়। মিউকে দুধ খাওয়ানো, পুরনো নাইটির তোষক পেতে
শোয়ানো। বড় ব্যস্ত মৌ। বেলা কাবার হাসতে হাসতে। মিউ থেকে একটু সময় পেয়ে মৌ বলে, আজ দুপুরে হরিমটর তবে। ওয়ালেট হারানোর শাস্তি। এরকম হরিমটরের ব্যাখ্যানা ওদের প্রায়ই। কোনোদিন পার্স হারিয়ে, কোনোদিন ফাঁকা পার্সের ভুলে। মাঝে
মাঝেই গড়িয়া যেতে বেহালা পৌছে যাওয়া, সন্ধ্যেয় কোনো কবিবন্ধুর বাড়ি থেকে নিজেকে
আবিষ্কার। হামেশাই। হো হো হাসিতে এসব নস্যাৎ করে দেবার প্রক্রিয়া শিখে নিয়েছে এখন মৌ। বেলা পেরিয়ে খাতা-বই-পেন-পেন্সিলের সিলসিলার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া টিপুকে খুঁজে বের
করে মৌ সোনালি খিচুড়ি আর আলুভাজার প্লেট
হাতে দিলে টিপু কাঁটা-চামচে একেবারে সুলতান হয়ে ওঠে। এই তো কী সুন্দর রঙিন রঙিন!
মৌ আর টিপু সুলতান হাত ধরাধরি করে যেন প্রেসিডেন্সি কলেজের লনের দিকে পা বাড়ায়। সঙ্গে মিউ মিউ। কৃষ্ণচূড়া
গাছটাও খুঁজে পেয়ে যায়। ট্রাফিক-কন্ট্রোল
চোখ লালে রাঙালে, ছোটপিসি মৌ-এর চোখে এসে গান বাজায়, মুখে আবির ছেটায়। বড্ড ভালো ছোটপিসিটা।
ঠিক সুলতানের মতো। মৌ-এর মনে হয়, আল্পসের পায়ের কাছে লেমাঁ হ্রদের তীর ঘেঁষে ঢেউ
ঢেউ নীল জলের ঠিকানায় জীবনভর দাঁড়িয়ে আছে।
হাতে সোনালি সোনালি খিচুড়ি-আলুভাজার ডিশ নিয়ে।
-শ্বেতা মানে রাজহংসী। জানো? হাঁটে যেন ধবধবে গর্ব ঝরে পড়ে। রানির মতো।
-তো?
-তোমাকে সর্বশ্বেতার মতো লাগে মৌ।
মৌ ঝলমল করে ওঠে।
-সর্বশ্বেতা মানে কিন্তু বকি, মানে বকবকি। টিপু প্রশস্ত হাসে।
-কী? আমি বকবকি?
-তারাও কিন্তু কম গরবিনী নয়।
-আমি সবসময় বকবক?
-আরে সেইজন্যই তো আমি টিপু সুলতান...
আবার হাসির ঢেউয়ে প্রহর রঙিন হয়ে উঠছে। রুমাল
খুলে টিপু হাসিমুখ মোছে। কীভাবে যে
রুমালের আড়াল সরিয়ে টিপুর ছাত্রী মৌসুমীর উদ্ধত শরীরী ফটোখানা টুপ করে মাটিতে...! ফটোটা হাতে নিয়ে মৌ হা হা হাসির
বন্যা বইয়ে দেয়। হাসতে খুব ভালোবাসে মৌ নামের মেয়েটা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন