পথের শেষ নাহি যে পথ কোথা
যে কোনো উপন্যাসের গঠনে পথের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। কারণ উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা পথকে
অবলম্বন করেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়। আবার কখনো সেই পথেই প্রত্যাবর্তন করে। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন -- “মানুষ জীবনের পথে পা বাড়ায় নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য”। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে
বিভূতিভূষণ অপুর অনির্দেশ্য চরণের অকারণ পথ চলার ক্ষেত্রে পথকে মহাকালের সঙ্গে তুলনা
করে ‘পথের দেবতা’ আখ্যা দিয়েছেন।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পথের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘গৌড়মল্লার’
উপন্যাসে। এই উপন্যাসের চরিত্ররা নিজেদের খুঁজে পাওয়ার উদ্দেশ্যে জীবনের
পথে পা বাড়িয়েছিল। তাদের সেই অকারণ পথ চলার অলিখিত ইতিহাসই আমাদের আলোচ্য বিষয়।
‘গৌড়মল্লার’
উপন্যাসে বজ্র নিজেকে খুঁজে পাওয়ার উদ্দেশ্যে, আত্মপরিচয়ের উদ্দেশ্যে পথে বেরিয়েছিল। গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সমন্বয়ে জীবনের প্রবাহ শরদিন্দু দেখিয়েছেন যে, প্রবাহ আবহমান। এই পথের কোথাও শেষ নেই। সে তো মহাকাল। উপন্যাসের পরিশেষে লেখক লিখেছেন -- “পতন অভ্যুদ্দয় বন্ধুর পন্থা”।
উপন্যাসে চরিত্রগুলিও মহাকালের অঙ্গুলি হেলনে যাত্রা করেছে পতন অভ্যুদ্দয় বন্ধুর
পথে। এই যাত্রার মধ্যে দিয়ে চরিত্রগুলি
আত্মান্বেষণ করেছে, অন্যদিকে এই যাত্রাপথের মধ্য দিয়ে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর মাৎস্যন্যায়
চলাকালীন রাজ্য ভাঙ্গা গড়ার সমসাময়িক ইতিহাসেরও পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রথমতঃ বজ্রের যাত্রাপথে পথের ভূমিকার আলোচনা করা যাক। বজ্রের জীবনের দুটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগ, বজ্রের জন্ম থেকে কুড়ি বছর প্রাপ্তি;
দ্বিতীয় ভাগ কুড়ি বছরে পা দিয়ে আত্মানুসন্ধান এবং পিতৃনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে
কর্ণসুবর্ণে যাত্রা। অনেক পতন অভ্যুদ্দয় হয়েছে এই যাত্রাপথে। এইখানে উপন্যাসের নবম পরিচ্ছেদে ‘বনপর্ব’
অংশে লেখক জানিয়েছেন, পার্বত্য নদী সোজা চলতে চলতে
হঠাৎ যেমন একসময় মোড় ঘুরে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলতে শুরু করে, তেমনি বজ্রের জীবনও একদিন বৈচিত্র্যহীন ঋজু পথে প্রবাহিত হবার পর হঠাৎ নতুন পথ নিল। এই পরিবর্তনের জন্য বজ্র প্রস্তুত ছিল না। বজ্র সম্পূর্ণ নিঃস্বভাবে নতুন পথে যাত্রা করল। বলা যায়, যেন বজ্রের সঙ্গে উপন্যাসটিও নতুন
পথে যাত্রা করল।
বজ্র বেতস গ্রাম ত্যাগ করে যখন বনপ্রান্তে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ভাগ্যের এক অদ্ভুত পরিহাসে এই
নির্জন বনপ্রান্তে বজ্রের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে তারই পিতা মানব দেবের। যদিও তারা একে অপরের পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। যে সময় মানুষ অকপটে নিজের পরিচয় গোপন করে, সেই সময়ের একটি পরিচয় দেন শরদিন্দু।
অতঃপর বজ্রদেবের যাত্রাপথে সাক্ষাৎ ঘটে অরণ্যচারী শবর-শবরীদের। বনের মধ্যে বজ্র শবরদের সাহায্য লাভ করে। সেখানেই রাত্রি যাপন করে। সহৃদয় শবর ও শবর পত্নীদ্বয়ের লোভলালসাহীন, ঈর্ষাবিহীন
সরল অনাড়ম্বর জীবন-যাপন বজ্রকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে,
বিশেষ করে নগর জীবনে প্রবেশের প্রাক্কালে। এই পর্বে একটি গোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায় তাদের জীবন প্রণালীর
মধ্য দিয়ে। ময়ূরের নৃত্যের সুন্দর ছবি, মৌচাক থেকে সরাসরি মধু পান করার চিত্র,
ময়ূরের ডানা দিয়ে দুল পরা এবং তাদের প্রণয়লীলার মধ্যে দশম শতাব্দীর ছবি
ফুটে উঠেছে। তাদের গ্রামীণ জীবনে নগরের জীবন স্পর্শ করেনি। বজ্র ভাবে, কী মধুর এদের জীবন! জীবনের
সংকীর্ণতা ও জটিলতা এদের স্পর্শ করেনি। এদের মধ্যে আছে শুধু অফুরন্ত প্রাণের প্রাচুর্য।
শবর দম্পতিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বজ্র রাজপথ ধরে দক্ষিণে চলতে আরম্ভ করে। যে রাজপথ – “উত্তরে মহাকোশল হইতে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত ইহা ভুজঙ্গের ন্যায়
বক্ররেখায় পড়িয়া আছে”।
কিছুদূর চলার পর দক্ষিণ তীরে এক উলঙ্গপ্রায় লোকের সঙ্গে বজ্রের সাক্ষাৎ ঘটে। বজ্রের ধারণা লোকটি হয়তো যাযাবর সম্প্রদায়ের ভিক্ষু। স্নান করে কটিবাস শুকাচ্ছিল। ক্রমে আরো কিছু লোকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। যারা নিজেদের নাগ সম্প্রদায়ের পরিব্রাজক বলে পরস্পর
কথা বলছিল। বজ্র এদের কথাবার্তা আচরণের মধ্য দিয়ে কুটিল রহস্যময়তার আভাস লক্ষ্য করছিল – “ইহারা ভণ্ড বৈরাগী, ইহাদের কোন গুপ্ত অভিসন্ধি আছে,… সে পথ চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিল নগর এখনও অনেক
দূরে কিন্তু ইহারই মধ্যে নগরের দীর্ঘ প্রলম্বিত ছায়া তাহার যাত্রাপথের উপর পড়িয়াছে।… গঙ্গাতীরের এই রহস্যময় ঘটনা যেন তাহারই ইঙ্গিত
দিয়া গেল”।
একাদশ পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘জয়নাগ’। উপন্যাসে পথ বারবার ফিরে এসেছে। রাজপথে সাধারণ মানুষের অপেক্ষা সৈনিকের সংখ্যাই বেশি। ঘাটে ঘাটে ছোট ছোট ডিঙ্গির
উল্লেখ আছে, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নৌবাণিজ্যের ছবি ফুটে উঠেছে। জয়নাগ নামটি সাংকেতিক। তাদের আচরণের মধ্যে দিয়ে পরস্পর বিরোধী রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব
ও ষড়যন্ত্রের ছবি পাওয়া যায়। পরিচয়ের আড়ালে পরিচয়, নগরের কৃত্রিমতা চাতুর্য কৌশল বজ্রকে ইঙ্গিত
দিতে থাকে -- “গ্রাম ও বনের অকপট ঋজুতা আর নাই। জনসমুদ্রে কুটিল নক্রসংকুল আবর্ত তাহাকে টানিতে আরম্ভ করিয়াছে”।
কর্ণসুবর্ণ ক্রমশঃই বজ্রের নিকটবর্তী হতে থাকল। বজ্র বিশাল সংঘারামে এসে পৌঁছল। সংঘভূমির দৃশ্য তার চিত্ত আকর্ষণ করে। বৌদ্ধবহার সংঘারামে বজ্র সাক্ষাৎ লাভ করে বৌদ্ধবিহারের মহাধ্যক্ষ
শীলভদ্রের সঙ্গে। যার সঙ্গে কথপোকথন কালে বজ্র যেমন একদিকে জানতে পারে তার পিতামহ শশাঙ্কের সমকাল
ও অব্যবহিত পরবর্তীকালের গৌড়বঙ্গের রাজ্য ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাস; অন্যদিকে শীলভদ্রের
উপদেশ লাভ করে লোভলালসাহীন যথার্থমানব ধর্মের পরিচয় পায়। গ্রাম থেকে অরণ্যজীবন থেকে নগরজীবনে প্রবেশে ত্যাগভূত জীবন দেখানো
হয়েছে।
এরপরেই বজ্র প্রবেশ করে বিলাসিতাপূর্ণ নগর জীবনে, চাতুর্যময় নাগরিক
জীবনে। তার চোখের সামনে গ্রাম, অরণ্য,
জয়নাগের মতো ধূর্ত মানুষ, কচ্ছুর মতো সহজ জীবনের প্রতিনিধি, মণিপদ্মের মতো ত্যাগদৃপ্ত মানুষ প্রভৃতি বিচিত্র
জীবনের রহস্য অভিনীত হচ্ছে যেন। সে শুধু দেখছে। এই কারণেই বৌদ্ধমঠকে রাখা হয়েছে নাগরিক ও রাজকীয় জীবনের মধ্যবর্তী
অবস্থায়। শীলভদ্রের কাছ থেকে বিদায়কালে শ্রমন মণিপদ্মের উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে বজ্রের
মনে হয়েছে – “মণিপদ্ম
যে পথে চলিয়াছে তাহা কেমন পথ, কোন আনন্দ ঘন শান্তিনিকেতনে তাহার
শেষ? আর বজ্র যে পথে পা বাড়াইয়াছে তাহারই বা সমাপ্তি কোথায়”।
বলা যায় লোভ কামনা বাসনা চক্রান্তে আবর্তিত পঙ্কিল ক্লেদাক্তময় জীবনের যে রূপ, রাজধানীতে তার বিপরীতে বিগতকাম প্রশান্তির সন্ধান এই বৌদ্ধবিহার, যা উপন্যাসের নায়ক বজ্রের নগর জীবনে প্রবেশের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে-
“আমার এ পথ তোমার পথের থেকে
অনেক দূরে গেছে বেঁকে,
গেছে বেঁকে
আমার এ পথ”।
অবশেষে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বজ্রদেব রাজধানীতে এসে উপবিষ্ট হয়েছে। এই রাজধানীর পথে বটেশ্বর ও রঙ্গরসপ্রিয় কবি বিম্বাধরের মতো খল অর্থলোলুপ চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছে। রতিরস নিপুণা কামনালোলুপ রাণী শিখরিণী ও সহচরী কুহুও এসেছে বজ্রের
চলার পথে। সুখে দুঃখে বিগতস্পৃহ বজ্র নাগরিক জীবনে স্রোতের ফুলের মতো ভেসে গেছে।
বজ্রর চরিত্র নির্মাণে পথের ভূমিকাই শেষ কথা। শীলভদ্রের সঙ্গে দু’বার মিলিত হয়েছে বজ্র। শীলভদ্র তাকে উপদেশ দেন – “সংসারকে ভয় কোরো না, জয় কর”। পথের একদিক যেমন খোলা, তেমনি একদিক
বন্ধ। নাগের কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় মুখ ও লেজ মেলে না। মহাকালের ক্ষেত্রে কালনাগ কথাটি আসে। সময়েরও প্রথম ও শেষ মেলে না। চলমানতা থেকেই যায়। ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে। রাজা রাজরাজড়ার তাণ্ডবও একদিন শেষ হয়। জীবনচক্র কালচক্রের আবর্তনে ঘোরে। পিছনের দিক থেকে পা ফেলে নতুন পা ফেলতে হয়। মানুষ মরে গেলেও মানব থেকে যায়। বজ্রের মনে হয়েছে -- “কি বিচিত্র এই জীবন! কখনও নিষ্কম্প নিস্তরঙ্গ, কখনও তরঙ্গসংকুল”।
অনন্তকালের পটে অভিনীত হয় যে জীবন, তারই চিত্র -- “পতন অভ্যুদ্দয় বন্ধুর পন্থা, পথ এখনও শেষ হয় নাই। হে চির-সারথি যে পথে তোমার রথ চলিয়াছে কোথাও কি তাহার শেষ আছে?”
রাজছত্র ভেঙে পড়ে, ডঙ্কার শব্দ শোনা যায় না। সাধারণ মানুষের জীবনের ইতিহাস চলমান। ইতিহাসের অন্তরালে প্রবাহিত হয় মানবজীবন। নিজেকে খুঁজে পেতে বজ্র জীবনের পথে পা বাড়িয়েছিল। পথের দেবতা তাকে আশ্রয় দিয়ে নিজেকে চিনিয়েছে –
“সবারে দিয়েছ ঘর
আমারে দিয়েছ শুধু পথ”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন