রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

জয়ন্ত দেবব্রত চৌধুরী

সোহমস্মি


ওই আলপথে খালি পায়ে পথ হাঁটা বড়ই ঝক্কির কাজ হে, সে তোমার সাধ্যে কুলোবে না। তার জন্য ঢের ঢের সাধনা লাগে। যেমন ধর, তুমি কি পারবে স্বর্ণাভ গরল আপন কণ্ঠে ধারণ করতে, নীরের পরিবর্তে অনর্গল অমৃত পান করতে? হেমন্তের গোধূলি আলোয় যদি দেখ একটা বুকে-হাঁটা শহুরে সরীসৃপ  তোমাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে মুখে হিসহিস শব্দ নিয়ে, একছুটে পালাবে না তো? চাঁদের রাতে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে পিছু হটার চেষ্টা, চিতাকাঠে শুয়ে আবার উঠে পড়ার চেষ্টা করা চলবে না কিন্তু। আচ্ছা, কলকাতা শহরের চোখে চোখ রেখে কখনো উচ্চারণ করেছ শীতল সতর্কতাবাণী? বিগত  তেত্রিশ বছরে কখনো আলজিভে চুমু খেয়েছ, উদাসীন সঙ্গম শিখেছ? গণতান্ত্রিক প্রস্রাবখানায় নগ্ন শুয়ে তারা গোনা আছে কি? কাটানো আছে বৎসরব্যাপী বসন্ত? কিম্বা সৈকতবেলায় বালিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে অনুভব করেছ কাঁকড়ার দাঁড়ার বিষ? কথা বলেছ জিরাফের ভাষায়? কখনো কলকাতার পথেঘাটে কোনো পাগলকে দেখে মনে হয়েছে এক্কেবারে বিনয়ের অবতার? বেনামী কোনো বন্দরে গিয়ে মুটে-মজুরের ধুলিমাখা পদদ্বয় দুধে ধুইয়ে দিয়েছ কি? চুলের মুঠি ধরে হিন্দুকে মুসলিমের বুকে ফিরিয়েছ একবারও? কোনো এক নশ্বরের কানে মুখ রেখে উচ্চারণ করেছ চিরকালীন আশ্বাস? পুজোর মাঝপথে পুরুতমশাইকে থামিয়ে দিয়ে, নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলেছ, ‘আমিই সে’? অথবা ভাঙা এক মন্দিরের অর্ধলুপ্ত  বিগ্রহকে উপহার দিয়েছ নবীন বটচারা? এসব কিছুই করো নি!  তবে কী করেছ? বিপ্লব করেছ? কোকিলের দিকে কান ফিরিয়েছ? সূর্যকে চোখ রাঙিয়েছ? ফুল হয়ে ঝরে গেছ? জলে ডুবেছ? গোরে গিয়েছ? আগুনে পুড়েছ? ছাই হয়ে উড়েছ? বেঁচে থাকতে চেয়েছ? সকল নরকযন্ত্রণা ভোগ করলে তবেই এই স্বর্গে প্রবেশাধিকার। বরং সেদিন উচ্চারণ কোরো সেই অমোঘ ওঙ্কারধ্বনি, আমি একমনে শুনব তোমার উন্মুখ ঘোষণা, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’!


উৎসবের রাতে

স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে আজই শেষ। পূর্বেও উত্তরদিক হতে দানবের অশুভ আর্তনাদ ভেসে এসেছে বহুবার; আমরা শান্তি স্বস্ত্যয়ন করেছি, লাল ঝুঁটি মোরগ বলি দিয়েছি, তারপর রাতে নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রা গিয়েছি। আজ সকালে উৎসব ছিল, আদি পুরুষদের আত্মার সম্মানে; মুণ্ডহীন পশুদের স্তূপ পড়েছিল একপাশে, আর আমরা সকলে হৈ হুল্লোড়ে মত্ত, তখনই মাটি কাঁপল প্রথমবার। আমরা হতচকিত হলাম কিছুক্ষণের জন্য, কিন্তু আজ বিপদ কিছু হবার নয়; আসন্ন বিপদ রোধ করবার উদ্দেশ্যেই তো এত যাগযজ্ঞ, তুকতাক, আনুষ্ঠানিক বিধি। শুধু আমার পিতৃব্য, প্রগাঢ় জ্ঞানী, চিন্তিত মুখে শৈলচূড়া অভিমুখে এগিয়ে গেলেন লাঠির ভরে; আমরা বিশাল তাম্রকটাহে প্রসাদী মাংস চাপালাম। দিবসব্যাপী চলল পূজার্চনা, থেকে থেকে কূর্মের পিঠটা নড়ে উঠছিল, কথকঠাকুর সমুদ্রমন্থন কাহিনী সুর করে পাঠ  করলেন। রাতে আকাশ ঝলসে উঠেছিল হঠাৎ, গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনির সতর্কবাণীতে উদ্বিগ্ন হয়ে আমরা দলে দলে রাজপথে নামলাম। সকলে তখন পথে; তস্কর আর লম্পট, কামুক আর উন্মাদ; ইঁদুরেরা গর্ত হতে বেড়িয়ে পথে ভিড় করছে, ঘুণপোকার দল কপাটের অবাধ প্রশ্রয় ছেড়ে পিলপিল করে পর্বতপাদের অরণ্যে প্রবেশ করছে। চতুর্দিক বায়সপক্ষের ন্যায় কৃষ্ণকায়, মাঝে মধ্যে অগ্নিগোলক উড়ে আসছে এদিক ওদিক হতে। উত্তরের আগুনপাহাড় বহু যুগ বাদে আজ জেগেছে; আজ মহাপ্রলয়ের প্রারম্ভকাল। পুরনারীদের সাথে শিশুর ক্রন্দনধ্বনি মিলেমিশে দুর্বোধ্য এক চিৎকার সৃষ্টি করছে, এমনকি পুরুষদের মুখমণ্ডলও আলোকহীন মোমবাতির ন্যায় অন্ধকার, বন্য শ্বাপদের চক্ষুই শুধু খদ্যোতিকার ন্যায় জ্বলছে। রাজপথের মধ্যে মধ্যে গহ্বর সৃষ্ট হয়েছে, অভ্রভেদী শিখর মন্দিরের উদ্ধত চূড়ো আচমকা খসে পড়ল পথের ওপর। ‘হা ঈশ্বর, রক্ষা কর আমার সন্তানেরে...’।  আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে ঘর্ঘরধ্বনিতে, স্বর্গ ভূলুণ্ঠিত হলে ঈশ্বর আর রইবে কোথায়? আমরা গুটিকয়েক সাবধানী জঙ্গলের পথে দৌড়লাম। জঙ্গলের ভেতর খুল্লতাত শুয়েছিলেন, অক্ষত, দেহে শুধু প্রাণ নেই। যুগান্তের প্রাক্কালে প্রাজ্ঞের প্রাণই প্রথমে নাশ হয়। আমার চোখের সামনে সকালবেলার দৃশ্য ভেসে উঠল হঠা। উৎসব চলছে, পশুর মাথা যূপকাষ্ঠে, ওদের গাঢ় কালচে তাজা রক্ত হাতে মুখে মাখছে সকলে, অপরের গাল রাঙিয়ে দিচ্ছে সোল্লাসে। সুরাপান, জুয়াখেলা, অনুমদিত সঙ্গম অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রকাশ্যে। এ সকলই আবশ্যিক উপচার, পূজার অঙ্গ। ষোড়শী কুমারীর সিক্ত যোনিস্রাব গড়িয়ে গড়িয়ে নালিপথে ক্রমশ মিশে যাচ্ছে উৎসর্গিত বরাহের শুষ্ক শোণিতধারায়। অপরপ্রান্তে কুবেরমূর্তির সম্মুখে পোড়ানো হচ্ছে প্রাচীন পুঁথি; দক্ষিণে যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় শূলে চাপানো সারি সারি নরদেহ। দণ্ডপ্রাপ্ত প্রতিবাদী ডাকিনীদের, যারা আমাদের হতে পৃথক অতঃপর অমঙ্গলকারী; কেউ কেউ নড়ছে শেষবারের মতোন, একটানা গোঙানি। আজ  আমাদের বার্ষিক উৎসব। যা কিছু উদ্বৃত্ত আর অবাঞ্ছিত, তা সরাবার উৎসব; ক্রুর দেবতাকে তুষ্ট করবার উৎসব; অঘটনের পূর্বে দৈবাদেশ পাবার উৎসব। জঙ্গলের পথে একটা গৃধ্রশাবক শিশুর স্বরে কেঁদে উঠেছিল, আমার মন্দিরপ্রান্তে রজ্জুবদ্ধ ছাগশিশুর কথা স্মরণে এলো। আর একটু এগোলেই নদীতট, নদীর ওপারে মুক্তি। কিছুক্ষণ বাদে অনভ্যস্ত হাতে তরী বাইতে বাইতে মনশ্চক্ষে দেখতে পেলাম  আমার আপদকালে বিস্মৃতা প্রিয়তমা একটু একটু করে ছাইচাপা পড়ছে ওই মৃত নগরে আর আমি তখন নিরাপদ আশ্রয়ে বসে আমার নতুন কবিতার ছক কাটছি নিবিষ্ট মনে।
                                                        


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন