এচিং
রেহানের পরপর তিনরাত ঘুম হচ্ছে না। বছর ছাব্বিশের ছেলে রেহানের জীবনে অশান্তি বলতে শুধুমাত্র তার ছটফটে আদুরে বান্ধবীটি। যাকে নিয়ে শপিং করতে যাওয়ার মতো বোরিং কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু সে তো সামান্য একটা ব্যাপার মাত্র। তাদের দুর্দান্ত প্রেমের কাছে এই না ভালো লাগার সামান্য একতরফা সময়টুকু কখনোই রেহানের খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। কিন্তু পরপর তিনদিন একদৃষ্টে ঘরের এ.সি-র দিকে তাকিয়ে রাত ভোর করে দেওয়ার পর অফিসেও রেহানের আজ কিছুতেই চোখের পাতা পড়ছে না। মাথার ভেতরটা ফাঁকা, চারপাশের কোনো শব্দ কান নেওয়ার আগেই যেন ফেলে দিচ্ছে তাচ্ছিল্যে। না মাথা ঘোরানো বা ঘাম এসব কোনো শারিরীক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সামনা তাকে এখনো করতে হয়নি। অফিস করছে, বাকি রোজকার কাজ যেমন করে, নিয়ম মেনে করে যাচ্ছে। এই উইকেন্ডে বান্ধবীর সঙ্গে মলের আদ্যপ্রান্ত ঘুরে শপিং–এ সাহায্য করে, রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেয়ে বেড়িয়ে, ড্রাইভ করে বাড়িতে বান্ধবীকে নামিয়ে, নিজে একটু একলা ঘুরে বাড়ি এসেছে রাত দুটো নাগাদ। না! কোথাও কোনো গন্ডোগোল তো নেই! কিন্তু একটা ছন্দ যেন তবু মিলছে না, ছন্দপতন যে ঘটেছে, এমনটাও মনে হচ্ছে না রেহানের।
পনের দিন হতে চলেছে, রেহানের রাতে ঘুম হয়নি। আর দু-একদিন দেখে নিজেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, কিন্তু বিশেষ সুরাহা কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না। কিন্তু ঘুমের ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে সামান্য অ্যান্টিস্ট্রেসের ওষুধ আর ভালোমন্দ কথা বলে ডাক্তারের ক্লিনিক থেকে বেড়িয়ে আসার সময় রেহান লোকটাকে দ্বিতীয়বার দেখল আর দেখেই একবারে চিনে নিয়েছিল। এখন প্রায় দু'মাস হয়ে গিয়েছে রেহানের ঘুম হচ্ছে না। কবে থেকে হচ্ছে না কী কারণে হচ্ছে না এসব শুয়ে শুয়ে রাতে ভাবার অতিরিক্ত আর কিছুই করার থাকে না এখন তার। প্রথম প্রথম রাত জেগে ছোটবেলার মতো ভিডিয়ো গেম খেলত, কিন্তু এবয়সে সেসব কিছুতে বেশিদিন মন লাগে না। পাঁচ-সাত দিন টানা সেক্স চ্যাট-ও ট্রাই করেছে। কিন্তু না, কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। ডাক্তারের ক্লিনিকের কালো মাঝারি উচ্চতার বলিষ্ঠ চেহারার লোকটাকে, তার আগে আর কোথায় দেখেছিল মনে করার অনেক চেষ্টা করেছে। মনে আসছে আসছে করেও পুরোটা যখন স্পষ্ট হয় না, আক্রোশ জমে; তীব্র ভয় চেপে বসে আজকাল। দু' একদিন ভয়ের দাপটে ঘর ছেড়ে বন্ধুর বাড়ি অব্দি কাটিয়ে এসেছে রাতে। বারবার খালি লোকটার মুখ মনে পড়েছে, আজ আরো বেশি করে মুখটা পিছু নিয়েছে। ডাক্তারের ক্লিনিকে যেদিন দেখেছিল সেদিন সাদা ইউনিফর্মে নিপাটভাবে আঁচড়ানো চুলে কালো লোকটাকে আরো যেন একটু বেশি মোটা আর কর্কশ দেখতে লাগছিল। ডানহাতে একটা বালা আর বাঁহাতে সিলভার মেটাল ঘড়ি। অনেক মনে করার চেষ্টা করেও, কিছুতেই যখন মনে আসছিল না রেহানের, অথচ মাথায় চেপে বসেছে লোকটিকে কোথায় প্রথমবার দেখেছে এই বিষয়টি, তখনই প্রায় চার মাসের নিদ্রাহীনতার একরাতে টি.ভি দেখছিল রেহান ঘরের আলো নিভিয়ে। ব্রাভিয়ার আলোটা বারবার বদলে যাওয়ার ফলে ঘরের মধ্যে বেশ একটা রংমশাল যেন কার্যকরী হয়ে উঠেছে, যদিও প্রাণবন্ত নয় কখনই, রেহানের অনিদ্রাজনিত চোখের ক্লান্তিকর ডার্কসার্কেলের জন্য পুরোটা কেমন ঘোলাটে। রিমোট টিপে টিপে একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে এক নিউজ চ্যানেলে এসে থমকে গেল বুড়ো আঙুল। নিজের অজান্তেই বিদ্যুৎ বেগে মাথায় চলে এলো প্রথম কোথায় কালো লোকটিকে দেখেছিল রেহান। একাই বিছানায় উত্তেজিতভাবে উঠে বসে সে। পাঁচমাস তিন দিন আগে রেহানের ফ্রিংগার প্রিন্টস্ নেওয়ার সময় এই দীঘল চোখের লোকটি প্রথম তার হাত ছুঁয়ে দেখেছিল। কম্পিউটার স্ক্রীনের ওই পাশ থেকে ভারী গমকের সঙ্গে টানটান পাল্লা দিয়ে রেহানের চোখের রেটিনা যখন প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হচ্ছিল, তখন যে স্বর বেড়িয়ে আসছিল মুখ হতে, সেই ঠোঁট ছুঁয়ে দেখার তীব্র বাসনায়, উত্তেজনায় চোখের পলক দু-তিনবার পড়ে যাওয়ায় আবারও রেহানকে নির্দেশমতো লিপিবদ্ধ করতে হলো রেটিনার সংকোচন ও প্রসারণ, রঙ, মাপ পরিমাপ সহ চোখের আকার, সব কিছুই। কিন্তু রাষ্ট্র কি পারে চোখের চাহুনির কোনো নথিপত্র জমা রাখতে? রাষ্ট্র কেন হাতের ছাপ সংগ্রহ করছে আর রেটিনার প্রসারণের দস্তাবেজে বারো নম্বরের পরিচিতি রেহানের মতো সাধারণ নাগরিককে এ কোন্ জগতের সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করালো, কে বা তা জানে! এই সব চলনের ব্যাখ্যা কোনো রাষ্ট্র কীভাবে জমা করে রাখবে? এই যে একটা প্রশাসনিক নিয়মাবলির যাত্রাপথে দুটো মানুষ কাছাকাছি এলো আর তারপর থেকে রেহান এখন প্রায় সাত মাস ঘুমোতে পারছে না, ওষুধ খেয়েও না, কেবল লোকটিকে মনে মনে খুঁজছে বলে। রাষ্ট্র তার নথি রাখা তো দূরের কথা মাড়িয়ে যে যাবে এটাই চরম সত্যি আর তাতে রেহানের মতো প্রাণজ্জ্বোল ছেলেটির মনের গভীরে দানা বাঁধবে যে ক্ষোভ, কামনার জোয়ার, তাকেই হয়তো ঐ নম্বর ধরে এরপর ডাকা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে!
রেহানের বিভ্রান্তি দিন দিন বাড়ছে। যে কখনো একাগ্রভাবে লোকটির আদল বানাতে ব্যস্ত থেকেছে মনে মনে, পথে ঘাটে খুঁজেছেও অনেক, আবার কখনও এক তীব্র ভয় তাকে জাপটে ধরেছে… যখনই তন্দ্রা আসে, সেই লোকটি নিরুদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরে কেবল বলে ওঠে… অল দ্য ইনফরমেশন ট্র্যাপড… মিস্টার, ইউ ক্যান গো নাউ…। রাগে আক্রোশে রেহান ফুঁসতে থাকে তন্দ্রাটা কেটে যেতেই, কেন প্রথমবারই বলে বসেনি সে, কান্ডজ্ঞানহীনভাবে, আমার আপাতত কোথাও যাওয়ার নেই, এই কন্ঠস্বর শোনার অতিরিক্ত, এ ঠোঁট দুটোতে জিভ জড়ানোর অধিক আর কোনো কামনা আমাকে চালনা করছে না এই মুহূর্তে। যে হাত দুটো দিয়ে ছুঁয়ে আমার হাতের ছবি নিলেন, তার বেশি অন্য কো্নো হাত ধরতে চাইছি না আর।
-আচ্ছা কী হবে বলুন তো আমার ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে?
-আমার কী! কন্ট্রাক্ট পেয়েছি, বিকেলে মালিককে বুঝিয়ে দেব।
-আর আপনার মালিক কী করবে সেসব দিয়ে?
-তা কে জানে! বিকেলে আমার অন্য সিফটের কাজ…
-আপনাকে কবে দেখব আবার?
-আমি তো আছিই, ঠিক দেখা হয়ে যাবে।
-আপনি আমাকে চেনেন?
-কেন চিনব না… ন'মাস ছ'দিন হলো ঘুম হচ্ছে না যে…
বিকেলে অফিস থেকে বেড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই দেখেছে পাশেই দাঁড়িয়ে দীঘল লালচে শিরা ওঠা চোখের কালো বুনোট চেহারার মাঝবয়সী লোকটা। যার ডানহাতে একটি বালা ও বাঁহাতে সিলভার মেটালিক ঘড়ি। আজ কোনো সাদা এপ্রোনে নেই সে, একটা এমারল্ড গ্রীন ফুলশার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্টে লোকটিকে দেখতে অনেকটাই রেহানের ছোট খালার মতো। ছোটবেলায় যে খালার সঙ্গে রেহান গোসল করত আর বয়ঃসন্ধিকে নিংড়ে মেখে নিত চোখে-মুখে-ঘাড়ে-বুকে। গাড়িতে পাশাপাশি বসে বাড়ি অব্দি আসার মাঝে একটি কথাও হয়নি লোকটির সঙ্গে, এমনকি নামটি পর্যন্ত জানে না রেহান এখনও। ঘরে ঢুকে ব্রাভিয়ায় এনিম্যাল প্ল্যানেটটা চালিয়ে দিয়ে ঘুরে তাকাতেই, খসখসে্ দু'হাতের দশটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিশে যেতে শুরু করল একে অপরের নিশানে। স্বর থেকে শব্দ ছুঁয়ে শ্বাসক্রিয়া রাষ্ট্রীয় নথিদলিলকে অস্বীকার করে আছড়ে পড়তে থাকল বিছানা-বালিশে-চাদরে। কোনো আইরিশের স্ক্যানিং থামিয়ে দিতে পারেনি রেহানকে সেদিন ঘুমের অতলে ডুবে যাওয়া থেকে বিমুখ রাখতে। এমনকি সাইলেন্ট মোডে রাখা সেলে বান্ধবীর পর্যাপ্ত মিসকল আর মেসেজ-ও বাহুল্যের মতো পড়ে থেকেছে ঘুমের এই পাড়ে।
গভীর ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে কতদিন পর নিশিন্তে ঘুম ভেঙে কখন রেহান উঠেছে, রাষ্ট্র তার খবর রাখেনি। বহু রাত জাগার পর যে ঘুম আসে সেই ঘুম ভেঙে উঠে ব্রাভিয়ার আলো-আঁধারে একলা ঘরে ধড়ফড় করে উঠে বসে কান্ডজ্ঞানহীনভাবে বসে থেকেছে খানেক; ঘোরটা কাটতেই পায়ের দিক থেকে চাদরটা টেনে নিয়ে ঢাকা দিয়েছে কোমর অব্দি, নিজেকে আয়নায় দেখে মায়া হয়েছে, খুব মায়া। এ.সি কমিয়ে দেওয়ালে বালিশ দিয়ে আধশোওয়া হয়ে শূন্য দষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে ব্রাভিয়ার দিকে। অ্যানিমেল প্লানেটে তখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখাচ্ছে কীভাবে দক্ষিণ আমেরিকার সাইডউইন্ডার রেটেলস্নেক তপ্ত বালুর ওপর নিজের দেহের প্রায় পুরোটা ছুঁড়ে দিয়ে সমকোণে দ্রুত বাকি দেহটিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে জানে হাওয়ায় ভর করে। প্রায় পুরো শরীরটাই থাকে বাতাসে আর তপ্ত বালুর সামান্য অংশ দেহকে ছুঁয়ে একটা নির্দিষ্ট পথ গড়তে সাহায্য করে। যা দেখে শনাক্ত করা যায় দূর থেকে রেটেলস্নেকের গমনপথ। জায়েন্ট স্ক্রীনে হলুদের মোহময় জগত রেহানের চোখগুলোকে করে তোলে আরো তীক্ষ্ণ; হাঁ-মুখ থেকে লালাটা পরার আগেই টেনে নেয় জিভ ভাঁজ করে আর ঘুমের অনেক গভীরে ডুবে যেতে থাকে। ঘুমের গভীরে রেহানও বালিহীন প্রান্তরে আস্তে করে কখন যেন কোনো কিছুকে সহসা স্পর্শ না করেই, এঁকেবেঁকে চলতে শিখে নেয়, শরীরকে সমকোণে সামান্য জমি ছুঁয়ে বাকি প্রায় পুরোটাই বাতাসে ভাসিয়ে রেখে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন