চন্দন তেল
প্রথম গল্প লিখেই রিঙ্কু সেটা
নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসে। বলে, শীগগিরি একটা ভালো কাগজের নাম ঠিকানা দাও তো!
লেখাটা সম্পাদককে পাঠাব। গল্পটা ওর একজন উঠতি গায়কের সংকট
নিয়ে লেখা। দুটো সিনেমায় প্লে ব্যাক
করেও তার বাজার মন্দা। গায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার কণ্ঠস্বর সফট্ওয়ারে তৈরি। হারমোনিয়াম তবলায় নয়। অন্তরা মুখরা সব আলাদা আলাদা গেয়ে শেষে আবার সবটা এডিট করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রিঙ্কু লিখেছে, এটাই ঠিক। মানে এই এডিটিংটা। কারণ গোটা গান কে আর
বারবার শোনে! রিংটোনে তো শুধু মুখরাটাই সেট করা থাকবে। আসলে এইগুলো হচ্ছে
পাঠকের মনের অন্দরের কথা। সম্পাদকও পছন্দ করবে। একটু তেল মেরে না লিখলে
রিঙ্কুর ধারণা, যতই কালি কলম খরচ করো, কেবলই বাদ পড়ে যাওয়ার চান্স। ওকে বললাম, তুই কাকে
তেল মেরেছিস রে? গায়ক না সম্পাদক?
এদিকে নিজে সেটা করতে পারছি না
বলে তলে তলে মনখারাপ। রিঙ্কু প্রথমে হেসে কুটোকুটি, পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বলে, আন্টি তেল মারা
জিনিসটা তুমি এখনও শিখে উঠতেই পারলে না! কী সব গাদা গাদা আর্টিকেল লিখে পাতা নষ্ট করো!
-- সে কী রে! এসব না লিখলে সবাই সত্যিটা
জানবে কী করে?
-- সত্যি মিথ্যে অত কেউ যাচাই করে না, বুঝলে? সবাই পছন্দের সপক্ষে
সমর্থন চায়।
রিঙ্কুর সবে কুড়ি পেরিয়েছে। কোনো জিনিসই ওর দশ দিনের বেশি মনে ধরে না। সব সময়ই ভীষণ অস্থির। ঠিক আমার উল্টোটা। রিটারমেন্টের পর আমার যেমন এখন সব সময় মনে হয়, স্থবিরতাই পৃথিবীর সবচেয়ে আসল
খেলা। এখান থেকেই জীবন আরও একবার
শুরু। আরও একবার এবিসিডি শেখা। এ ফর অ্যালোন বি ফর বয়কট।
সারাদিন রিঙ্কুর লেখাটা নিয়ে
নাড়াচাড়া করি। আমার হাজব্যান্ড আমাকে
দোষারোপ করে। বলে, মেয়েটাকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না! শেষে কিছু হলে বাঁশ খাবে নিজে।
বাঁশ খাওয়া কাকে বলে জান?
-- জানব না কেন? কিন্তু বাঁশের যা
দাম ওটাও কেউ বিনি পয়সায় দেয় না।
-- বুঝেছি, রিঙ্কু বেশ দামি তেলই দিচ্ছে তোমাকে। একেবারে
কুয়েতের খাঁটি জিনিস। এরপর বাম্বু আসবে ব্রাজিল থেকে।
-- আমাকে ভালো জিনিস পেতে দেখলে তোমার তো চিরকালই
গা জ্বলে! এই বলে আমি গম্ভীর হয়ে যাই।
মঙ্গলবার দুপুরের দিকে
রিঙ্কুদের বাড়ি যাব বলে ওদের ফ্ল্যাটের বেসমেন্টে গাড়ি পার্ক করছি। রিঙ্কুকে দেখলাম উল্টোদিকের
সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে আসছে। সঙ্গে আমার হাজব্যান্ড। একসঙ্গে যাচ্ছে কোথাও দুজনে। দুজনেই নিশ্চুপ যেন অনেকদিনের বোঝাপড়া। রিঙ্কুর অচেনা মুখে আমার জন্য
আগেকার মতো রাখা চিরচেনা আস্থা বা পছন্দ কো্নোটাই নেই। মুহূর্তে আমার গোপন মনখারাপ
ছিঁড়ে একটা তেলতেলে আনন্দ চোখে ভেসে ওঠে।
আমার পরবর্তী আচরণ কেমন হওয়া
উচিত, ভেজা চোখে ভাবতে থাকি আমি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন