রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত






আত্মপরিচয়

ইতিমধ্যে দু’দশ বনভূমি পেরিয়ে আসে হেরম্ব। এই পেরিয়ে আসা অতিক্রমণ মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে। মহাশূন্যতাকেই সম্ভবত অস্তিত্বহীন করে তোলার প্রয়াস চালাতে থাকে  সে। বন্ধ হয়ে যাওয়া চা-ফ্যাক্টারীর সামনে দিয়ে এগোতে গিয়ে সে কিন্তু প্রকৃত অর্থেই এক ধরনের শূন্যতাকে অনুভব করে। এক্কা মিনজ ওঁরাও খেড়িয়াদের সাথে কোনো কো্নো  সাপ্তাহান্তিক হাটে তাকে নাচতে হয়। ভাষা অচেনা, কিন্তু কান্না-অনুভূতির অন্তর্গত এক  আবেগে মহাজীবনের মহাশূন্যতাই এক অনুধাবনযোগ্য ভাষাসূত্র খুঁজে পেতে পারে। খুঁজে  পেলেই জনজাতির গোষ্ঠীজীবনের যূথবদ্ধ কৌমতায় সে লীন হতে থাকে। আত্মপরিচয় হারানো একজন মানুষ এইভাবে নিঃসঙ্গতার ভেতর রোদ হাওয়ার আমন্ত্রণের স্বাছ্যন্দের স্বাদ পায়। আত্মপরিচয়ের জরুরী প্রয়োজনীয়তার দোলাচলে থেকেও এমন এক মহাশূন্যতার মাদকতা ঘিরে ধরে যার ভেতর হেরম্ব নিজেকে সমর্পণ করতে  চায়, আবাল্যের সারল্য ও সহজিয়া দর্শনের ব্যাকুলতায় এসে নিজস্ব ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রগুলি  পুনরুদ্ধারের প্রাণপণ প্রয়াস চালায়। লোকজীবনের ব্যপ্তি পরিব্যপ্তি পরীসীমা অতিক্রম  করে অন্তর্বয়নের নিখুঁত নৈপুণ্যে মহাজীবনের শূন্যতাকে মহাজগৎকথার প্রধানতম  অনুষঙ্গ হিসাবে বারবার পুনঃস্থাপিত করতে থাকে। এই স্থাপন প্রতিস্থাপন পুনঃস্থাপনের অনন্য নকসার খুব গভীর সমান্তরালে প্রবাহিত হতে থাকে এক শূন্যপুরাণ। শূন্যপুরাণের  প্রাকৃতিক হয়ে ওঠা শক্তির কাছে হেরম্ব তো আর হেরে যেতে পারে না! সে বরং হাঁটতে থাকুক। হাঁটতে হাঁটতে তার দু’পায়ে ধুলো কাদা লাগুক, আকাশ মাটির  মধ্যবর্তীতে মাঝে মাঝে সে উড়িয়ে দিতে থাকুক গাছের শুকনো পাতা। শূন্যপুরাণ থেকে তো আর যথাযথ শূন্যতা উঠে আসতে পারে না, বরং মহাশূন্যতার দিকেই যাত্রা করুক শূন্যপুরাণ! মেঘ নদীর অন্তঃস্থলে বাজনা বাজুক; বাজনার আবহে চুপি চুপি জমাট বাঁধতে থাকুক মন্ত্রতন্ত্র, সাপের ওঝ্‌ পেয়ারাকাঠের ডাল, পরিচয়হীন সব মানুষেরা; আর এইরকম এক মহাশূন্যতায় ডুবে যাক হেরম্বর চলাচল, যাত্রাপথ।




দৃশ্য ও দৃশ্যান্তর

হেরম্ব কি হারিয়ে যাবে মাঝে মাঝে! দৃশ্যের আড়ালে দৃশ্যান্তরের দৃশ্য হয়ে সে কি তার হারিয়ে যাওয়াটাকে শৈল্পিকতার পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারবে! পৌঁছনো বলে আপাত অর্থে কিছুই হয় না, কেননা জীবনের সামগ্রিক অস্তিত্ব অনস্তিত্ব জুড়ে  গন্তব্যহীনতায় প্রবল এক সত্যতার ছাপিয়ে ওঠা চিরসত্য হয়ে ওঠে। হেরম্ব হারিয়ে যেতে পারে লুকিয়ে পড়তে পারে আবডাল রচনা করতে পারে, কেননা এসবই তার জীবনের আবশ্যিক অঙ্গ। আমরা কেবল তাকে তার আবডাল ও হারিয়ে যাওয়া থেকে খুঁজে আনতে পারি, পুনরুদ্ধার করতে পারি স্বাভাবিক অস্বাভাবিক সব পরিস্থিতি পটভূমির ভিতর; পুনঃস্থাপন করতে পারি যাতে তার অতিক্রমণটুকু চলতে পারে। যে  ফাঁদ জীবন পেতে রাখে, যে মায়াময়তা জীবন ছড়িয়ে রাখে, তার ভিতর হাঁটতে  হাঁটতে বসে থাকতে থাকতে কেমন এক দুলুনি ঝিমঝিম এসে যায়। তবে কি হেরম্ব হারিয়ে যাওয়া শূন্যতারই মতো! কার্যকারণ সংযোগহীন ছন্নছাড়া জীবনের মূল কেন্দ্র  থেকে অবগাহনের এক দৃশ্যান্তর খেলা করে যায়! নদীনালা টপকে টপকে যে যাওয়া,   ঝোপজঙ্গলের দূর্গমতার মধ্য দিয়ে যে যাওয়া, তারই সমোচ্চারিত আবিষ্টতায় জীবনের  নিজস্ব পথঘাট নির্মিত হতে থাকে। আবডাল হোক আড়াল হোক ভয়াবহতার অনুভূতি যাই হোক না কেন, সবই কিন্তু লোকাচারে এসে মিশে যায়। স্তব্ধতার অনুভূতিটুকরোর জারকে জারিত হবার প্রাণপণ প্রয়াসে অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি আড়ালে আবডালে আলগোছে অবলুপ্ত স্মৃতির মতো ডেকে উঠতে চায়; অগ্রসরমান স্মৃতির বর্ধিতাংশ অন্যধারার দৃশ্যকাতরতায় অসহ্য সব দৃশ্যায়ন দৃশ্যান্তর হয়ে যেন দৃশ্য দৃশ্য দিয়ে সেজে ওঠা দৃশ্যপটের শংসা ও স্বীকৃতি দাবি করতে থাকে। এইসব ঘটতে থাকে হেরম্বর হারিয়ে যাওয়া আবডালে লুকিয়ে পড়বার মতো।





তন্ত্রমন্ত্র

যদি চলাচলটাকে থাকিয়ে দেওয়া যায়, যদি নদীর প্রচন্ডতাকে অগ্রাহ্য করা যায়, তবে  তো বনভূমির যে কোনো অংশ থেকেই বাঘের ডাক ভেসে আসতে পারে। বাঘের ডাকের প্রতিধ্বনি ধবনি ভয়াবহতার অনুভূতি হয়ে ফিরিয়ে আনতে পারে অস্তিত্বহীন কোনো অনুভূতি, যাকে মান্যতা দেবার জন্য নিজস্ব ভাষাযুক্তি যুক্তিফাটলের  চোরাগলিতে পথ হারিয়ে ফেলবার অসীমতাকে মনে করিয়ে দিতে চাওয়া এক যুক্তিহীন যুক্তিপরম্পরাই হয়তো প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারে। প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগ্রহটুকু থাকে বলেই প্রবলতর শারীরিক প্রতিরোধে সকল ভয়াবহতার বিরুদ্ধে সংগঠিত ঘুরে দাঁড়ানো, সকল ছড়ানো রোদের ভ্রম ও বিভ্রমে। ভয়াবহতা থাকে কোথাও না কোথাও। জীবনের কোথাও ভয়াবহতা থাকে, এই বাস্তবতাটুকু মেনে নিতে হয়; মেনে নেবার ফলশ্রুতিতে হয়তো দিকে দিকে চলাচলগুলিকে প্রসারিত হতে দেবার সুযোগটুকু থাকেআর থাকে বলেই চলাচলটুকু থেকে গেলেও বাঘের ডাক কিন্তু থেকেই যায়। তখন চারপাশের সবটুকুই গুরুত্বপূর্ণ এক সম্মোহনগাথা বিস্তার করতে থাকে। বিস্তৃতির আশ্চর্য সেই আবেষ্টনীর কুহককেলি চলাচলটুকুকে স্বাচ্ছন্দ ও গতিময়তা দেয় একথা কিঞ্চিৎ সত্যি,  তবুও নদীর নিজস্ব নিভৃতির ভিতর ব্যক্তিগত সব আকাশ মেঘ বনাঞ্চল চরভূমি খুব বেশি তৎপরতা অর্জন করে অর্জিত সব অভিজ্ঞতাটুকরোকে সংগঠিত করে জীবনের ধারাভাষ্যে যদি সংযোজন করা যায়, তবে সমগ্র সংযোজনটাই একমাত্র বাস্তব হয়ে  উঠবে। যদিও বাস্তবতার স্বভাবত এক দোলাচল থাকে; অনিশ্চয়তাও। তবু বনভূমি ও বাঘের ডাকের যৌথতায় যে ভয়াবহতা তার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়াটা যুক্তিসঙ্গত যুক্তিযুক্ত কিনা সেইসব নিয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্তে আসবার প্রয়োজনীয়াতে প্রাজ্ঞ সব বনভূমি মাথা তুলে দাঁড়ায়। এইসব ঘটে যায় অজ্ঞাতে অজান্তে কিংবা বাঘের ডাকের ভয়াবহতার মতো অবশ্যম্ভাবী আবশ্যিকতায়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন