রমাকান্তনামা -- শৈশবের সহজপাঠ
রমাকান্ত জানেন, বয়স বাড়তে বাড়তে এক জাগায় এসে স্থিরতা আসে। না, বয়সের নয়, মনের। মনের ভাবনাগুলিকে আর এগিয়ে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। যাকে বলে সময়ের ওপর ভেসে চলা জীবন! এ সময়ের ভাবনা জীবনে সংহার আনতে পারে। মৃত্যু ভয় তো অবক্ষয়ের নামান্তর! আতংক যেমন শ্বাসাঘাত আনতে পারে, আবার শ্বাসাঘাত জীবনে মৃত্যু আনতে পারে।
তাই মন চলো শ্রীনিকেতন। পবন নাওয়ে ভেসে চলো। ভেব না, বুকের ব্যথায় কারো মৃত্যু হয়। বরং সেই কথাগুলি, সেই দিনগুলি দেখ আবার যদি ফিরিয়ে আনতে পারো, তোমার সেই বালকবেলা!
রমাকান্ত ভাবেন, বালকবেলা অনেকটা হাওয়ার ঝোঁকার মতো, তরতর করে বয়ে যায়। সুখ দুঃখের খতিয়ান সে খতিয়ে দেখে না। শিশুদের গায়ে যন্ত্রণা ভেদ করতে পারে না। দুঃখ কাঁটা হয়ে তার গায়ে ফুটতে পারে না। আপন জনের মৃত্যুতে সে ধাক্কা খায় বটে, তবে তা কতখানি! পরক্ষণেই দেখ, সে বারান্দায় লাফ ঝাঁপ খেলে বেড়ায় অনায়াস। আমাদের মন নামক যন্ত্রটা বড় আন্তর্জালিক, যান্ত্রিকতায় তৈরি করা। ভাবনার তুলতুলে হার্টকে ধুঁকধুঁকিয়ে রাখার মাঝে সমস্ত কিছু ধরে রেখেছে। সমস্ত কার্যকলাপ আগেভাগে প্রোগ্রামিং করাই থাকে। তাই তো মহাপ্রলয়ের পরও তুমি বেঁচে থাকতে পারো। সময়ে অসময়ে তুমি হেসে ওঠো, কেঁদে ওঠো -- জাগতিক ধর্মগুলি পালন করে যাও।
ভুলে থাকারও একটা সিস্টেম আছে। একটা লিমিট আছে। তারপর তুমি আর কিছুই সহ্য করতে পর না। মনের মাঝে অপসারণ ঘটে যায়। সে সব চিন্তাগুলি ভাবনার চিত্রপটে শূন্যতা এনে দেয়। যেমন বেদনার শেষ সহন, অজ্ঞানতা; অজ্ঞানতার শেষ অনাস্থা, মৃত্যু। রমাকান্ত যতটা পারেন মন থেকে দুঃখ যন্ত্রণা বিয়োগের কথাগুলি সরিয়ে দেন। সে সময় তিনি শৈশবের চিন্তায় ডুবে যান। তাঁর মনে পড়ে যায় সেই বৈশাখী ঝড়, ফুরফুরে উড়াল চুলের সেই মেয়েটির কথা। ঈষৎ ভীতসন্ত্রস্ত তখন ঘরের দিকে ছুটে চলেছিল সবাই। রমাকান্ত তখন আম কুড়োতে ব্যস্ত। বাধা বন্ধনহীন ছিল সে জীবন ধারাপাত। শৈশবকাল।
--রমাকান্তদা! সেই কালো মেয়েটি, যার মাঝে ছেলে মেয়ের আলাদা স্পর্ধা নেই। কী যেন নাম ছিল তার -- হ্যাঁ, মলি। বালক রমাকান্ত তাকিয়ে দেখলেন তাঁর পাশে এক বালিকা দাঁড়িয়ে, সে মলি, বলল, তুমি ঘরে যাবে না? কালো শুঁটকো রোগা পটকা চেহারায় মনে হতো, ছেলে মেয়ের ভাব তখনও সে ভালো ভাবে ধরতে পারে নি। কিম্বা এমনও হতে পারে, সে মেয়েটা সারা জীবন অমনটাই চেহারা ধরে থাকবে।
--যাব, কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে তুই কেন এখানে? রমাকান্ত ছেলে মেয়ের বুঝ নিয়ে বলে উঠেছিলেন।
--বা রে! তুমি আছ, আমি কেন থাকতে পারব না? মলির স্পষ্ট কথা ছিল।
ঠিক এমনি সময় বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়েছিল। শুরুতে সামান্য ঝিলিক, তারপর সশব্দে আকাশ ফাটার শব্দ। মেয়ের ধর্মে নয়, বয়সের ধর্মে মলি ভয় পেয়ে গেল, আর শুধু মলি কেন, রমাকান্ত আম কুড়োনো থেকে ক্ষান্ত হলেন। আমগাছের গোড়ায় আড়াল হয়ে দাঁড়ালেন। মলি ভয় পেয়ে রমাকান্তর গায়ে গা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
কাহিনীর ধারাবহগুলি বোধহয় এমনি হয়! সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যে রাত -- তেমনি বৈশাখী ঝড়, আম কুড়োনো, বিদ্যুৎ চমক, বজ্রপাত আর তার আগে পরে বৃষ্টি নামে ঝেঁপে। তবে স্বাভাবিক ভাবে পরিণত নায়ক নায়িকারা এমন ভাবে আমবাগান নিয়ে থাকে না। কিন্তু রমাকান্ত বালক, মলি বালিকা। ওদের শৈশবকাল, শরীর পাকেনি তখনও, মনও অপরিপক্ব। কোনো দ্বিধা নেই, জড়তা নেই। বৃষ্টির প্রবল ঝাপটায় উভয়ে দিশেহারা। মলি সাপটে ধরে আছে রমাকান্তকে। আর রমাকান্তও বেড় দিয়ে আছেন মলিকে।
মনে হয় ঘণ্টা খানেক এমনি চলেছিল। ঝড়, জল, বজ্র, বিদ্যুৎ, মলি ও রমাকান্তর ভয়ে কেঁপে ওঠা -- পরস্পরকে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে রাখা। সে বালকবেলায় তাতা উষ্ণতার ছোঁয়া তাদের কারো মাঝেই ছিল না। ছিল না মানসিক কাঁপ, সহজ পাঠের সরল রেখার মতো সামনে বিছানো ছিল শৈশবের সোজা পথ। ব্যাস, আর কিছু মনে নেই। সেদিনের মলির কথা আর মনে করতে পারছেন না রমাকান্ত। হ্যাঁ, মেয়েটাকে অনেকবার পথে ঘাটে দেখেছেন। দু’একদিন কথাও হয়েছে। তারপর জীবনের স্রোতে তিনি বেড়ে গেছেন অনেক আগে। কৈশোর তার চুম্বক ঘূর্ণন আওতায় টেনে নিয়েছিল তাঁর মন ও দেহ। বেশ কিছু মুখের মাঝে কখন যেন মলি হারিয়ে গিয়েছিল। স্মৃতিতে শুধু বাঁধা ছিল কৈশোর ও যৌবনের স্পর্শকাতরতা।
আনন্দঘন দিনগুলি বড় ক্ষণস্মৃতি হয়ে থাকে -- তাকে নিয়ে সময় জোড়া যায় না। তার প্রবহমানতার দাগ বড় তাড়াতাড়ি মুছে যায়। পা পা এগিয়ে যাওয়া জীবনের ছাপগুলি মনের মানচিত্র রেখে যায়। সেখানেও দুর্বোধ্য আঁকিবুঁকি ভরে থাকে। কী চিহ্ন দিয়ে তার সুখ দুঃখকে সনাক্ত করবেন রমাকান্ত? সূর্য ওঠা, ডুবে যাওয়া, তার মাঝের বিনিদ্রিত রাত্রিগুলো কি জীবনের অনেকখানি সময় কেড়ে নেয়? এখন প্রতিদিন প্রতিদিনের মতো -- এক ছাঁচে তৈরি রাত্রিদিনগুলি শুধু উল্টে পাল্টে যাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন