যার কোনো রাজা নেই
হঠাৎ ফোন - হ্যালো,
একটা গল্প বল্।
-তোর মাথাটা গেছে?
অফিস নেই?
-না, জ্বর হয়েছে।
বিছানায় শুয়ে। আমার এখন খুব গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে। গল্প বল্।
-একটা রাজার দুটো
রানি, সুয়োরানি আর দুয়োরানি।
-এটা মোটেও ভালো গল্প
নয়। আমার কোনো রাজা নেই। অন্য গল্প বল্।
সত্যিই তো, তোর কোনো রাজা নেই। তুই একা। ধারাবাহিক গল্প পড়তে পড়তে দেখা যায় ‘পূর্ব পাঠের পর...’। তোর পূর্বপাঠ সব চুকেবুকে গেছে। শ্বেতপাথরে পা, সোনার পালঙ্কে গা, দুজনে মিলে বাথরুমের ঝরনায়
স্নান – কোনো সত্যযুগের আখ্যান। মালপত্র, ঠাসা বই, ভ্যাপসা আলো নিয়ে তুই এখন একা।
অফিস থেকে ফেরার পর
কখনো ভালো লাগলে কিছু একটা বানিয়ে নিস। নইলে টিভিটা চলতে থাকে আর তুই জানালা দিয়ে
বাইরে দেখিস একটার পর একটা গাড়ি যেতে যেতে রাস্তাটা কেমন শুনশান হয়ে যায়। মুড়ি
চিবাতে চিবাতে তুই ঘুমিয়ে পড়িস। কাজের মেয়েটার কথা মনে থাকে না।
এখন তোর জানালার
বাইরে হেমন্তের গাছটা থেকে পাতা ঝরে পড়ছে নিঃশব্দ সংগোপনে। জ্যোৎস্না রাতে শহরে
একমাত্র ছাদে উঠলেই বোঝা যায়। তরাইয়ের জঙ্গলে গেছিস কত যুগ আগে। তোর মাঝরাতে কোনো
টেলিফোন অশালীন ইশারার মতো বেজে ওঠে না। তোর ঠোঁটের নিচে এখন আর কালো দাগ
থাকে না। এসব ভেবে থমকে গেলাম। হঠাৎ মনে
হতে বললাম, তোর পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা মনে আছে?
তুই চুপ করে গেলি।
বললি, বইমেলা থেকে ও কিনেছিল। বইটা হারিয়ে গেছে। নামটা যেন কী ছিল?
তোর সাথে আমিও
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর অবলীলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম –
অনেকদিন আগে জঙ্গলের একধারে ছোট্ট নদীটার পাশে ভাঙ্গা কুঠিতে একটা ডাইনি বুড়ি
থাকত।
কী বললি? দেখা হলে তোর মুণ্ডুটা কাঁচা চিবিয়ে খাব। বুঝলাম, তুই নিজেকে সামলে
নিয়েছিস।
কেন তোর মনে নেই, বাবু অসুস্থ হয়ে যখন নার্সিং হোমে, মাঝরাতে আয়ার সাথে
ঋত্বিক ঘটক মার্কা ডায়লগের যে গল্পটা বলেছিলি? নেহাতই তোদের ফ্ল্যাটের কেউ কাউকে
নিয়ে মাথা ঘামায় না, না হলে কবে তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলত।
শুনে তুই চুপ করে থাকলি। বেফাঁস কথা বলে ফেলার জন্য নিজের অস্বস্তি হলো। চুপচাপ থাকাটাও বড় বেমানান। তুই একটু বেশি সময় নিচ্ছিস বলে আমি অকারণ বলে
চললাম – কতদিন সিনেমা দেখি না!
অনেক দূর থেকেও বুঝতে পারলাম, তুই উদাস হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে নিচের ডায়লগগুলো ভাবছিস।
ছাওয়ালের বাপ কোন হানে আছে দিদি?
জানি না।
বলি মইরা তো যায় নাই?
জানি না।
আমি কই বিয়া তো একডা হইছিল দিদি?
জানি না।
পোড়া কপাল, বলি এই ছাওয়ালডা আইছে একটা বিয়া অইয়াতো?
জানি না।
খালি জানি না জানি না জানি না। তুমি দিদি কিছুই জান না।
হ্যাঁ রে, আমি কত কিছু জানি না। তুই জানিস? বয়স্ক হলে কেউ স্নেহ
চায় কিনা, শরীর উত্তাপ চায় কিনা?
আমি চুপচাপ থাকলাম আর
তুই বলে চললি - জ্যোৎস্না থেকে তাপ চাই। কিন্তু শরীর বাঁধতে পারি না। কাজের মেয়েটা
বলে পুরুষমানুষ মন্ত্র পড়ে শরীর বেঁধে রাখতে পারে, তাই তারা যেখানে ইচ্ছে যেতে
পারে, কিন্তু মেয়েমানুষকে ঘরের মধ্যে বেঁধে রাখতে হয়। নইলে জীন অপদেবতা শরীরের আঁজ
খাঁজের দখল নেয়।
চুপচাপ সময় বয়ে
যাচ্ছে। তুই বলে চললি – তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? নিজেকে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখেছি,
তবু দেখ্ কেমন শীত করছে।
-ডাক্তার দেখিয়েছিস?
ওষুধ খাচ্ছিস?
-জ্বরের ওষুধ কী
জানিস? গা ঠোঁট আগুনে পুড়ে যাবে, আর শুধু চুমু, চুমু, চুমু।
তুই সর্দি জড়ানো গলায়
হেসে উঠলি। - কীরে বউ শুনতে পেল না তো?
আমি চুপ করে রইলাম।
তুই খুব আস্তে করে উচ্চারণ করলি – বৃহস্পতিবারে আয়, প্লিজ।
-তারপর?
-তারপর, আমার কপালের পাকা চুলটা কাঁচি দিয়ে কেটে
দিবি। বলে তুই অকারণ খিলখিল করে হেসে উঠলি। - কী রে, পারবি না?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন