শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৫

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

মৌল...বাদ এবং গল্পের মৃত্যু


বছর ঘুরতে না ঘুরতে বদলাচ্ছিল চামড়ার রং। ঘন হচ্ছিল। কালো হচ্ছিল। ঘনিয়ে আসছিল২০১৪র পাকিস্তান থেকে ২০১৫র কেনিয়া। স্কুল থেকে কলেজ, প্রগ্রেসের  উর্দ্ধগতি। পাকিস্তানিদের গায়ের রং খয়েরি আর কেনিয়ানরা মিশকালো। কেউ মিলিটারী তো কেউ খ্রিষ্টান। মহাহত্যার দুই হলঘরে রক্তের রং কিন্তু বদলায়নি। ভাঙা টেবিল চেয়ার ঘিরে ছিল ব্রাউনস্কিনে উজাগর আর ঘনকৃষ্ণ ত্বকে মিইয়ে আসা লাল রং। রক্তের মিলিটারী আর খ্রিষ্টীয় রংপাকিস্তানী আর কেনিয়ান রংধূসর আর নিকষ রং। সূক্ষ্ম বর্ণান্তরের চামড়ায় থিতিয়ে আসা একমেবদ্বিতীয়ম  মৌলিক লাল রক্ত যাকে আরো জমজমাট করে তুলেছিল মৌলিক ডিজিটাল ফটোগ্রাফি। পেশোয়ারের ছবিটায় শুধু রক্ত পড়েছিল সাদা ফ্লোরের ওপর। লাশগুলোকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলোঅপেক্ষা ছিলো ভিস্তির। কেনিয়ার ছবিতে রক্তের পাশাপশি শরীরগুলোও ছিলএকেকটা শরীর একেকভাবে দলা পাকিয়ে ছিল একেক দিকে। ধরপাকড়ের বক্রতাকে তাও ভঙ্গিমা বলা যাচ্ছিল না। ছবিদুটো বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কথা বলছিল একে অপরের সঙ্গে, যদিও তাকে আদৌ গল্প বলা  যাচ্ছিল না। তারা একে অপরকে ফিসফিসিয়ে বলছিলমানুষ তার মৃত্যুর সাথে   এখনো বোঝাপড়া করে উঠতে পারেনি বলেই ধর্মের এই রমরমা। আমাদেরই দ্যাখো না, মৃত্যুর পর শুধু আমরা থাকি, ভূতুড়ে এসব ছবি থাকে,  রক্ত থাকেমাংস থাকে আর তারপর রক্তও থাকে না, মাংসও থাকে না। মৃত্যুর পর কিছুই থাকে না। স্বর্গ-নরক, পাপ-পূণ্য, পূনর্জন্ম, কিচ্ছু না, খালি রক্ত থাকেমাংস থাকে আর তারপর রক্তও থাকে না, মাংসও থাকে না” ছবিদুটোর   এই মৌলিক ডিজিটাল ফিসফিস শেষ হতে না হতেই লাল রক্তের ওপর জমে উঠেছিল ধুলোর পাহাড়। ঘাতকের পায়ের ধুলো থেকে শুরু করে পুলিশের বিলম্বিত পদচারণায়। ধুলো মাখা রক্তমাংসের ওপর অশরীরী রাত নামার আগে শেষ সূর্যের আলো নেমে এলো। গোধূলির মলিন আভায় চকচক করে উঠল ধূলিধূসর রক্ত,  যার প্রতিটা কণার ভেতর হাজার হাজার গল্প মরে যাচ্ছিল  ঘন হচ্ছিল। কালো হচ্ছিল। ঘনিয়ে আসছিল      

বিকেলের পড়ন্ত রোদের ভেতর গল্পগুলো ভাসছিলগোধূলির বিচ্ছুরিত ধূলিকণার মতো অন্তিম দৃশ্যমানতায় ভাসমান ভাসমান হয়েও অপ্রতুল। ঐ অপ্রতুলতার ভেতর থেকেই সেদিন বিকেলে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার আর তার হেল্পার বলে উঠল—

-- কিরেমালটা বাঁচবে মনে হয়?
-- কী করে বলব বলআমাদের কাজ তো ব্যস এইটুকুপৌঁছে দেওয়াতারপর  কে যে কোথায় পৌঁছবে, সবই তেনার হাতে!
-- যা বলেছিস মাইরিআমাদের গল্প এখানেই শেষহাসপাতালের গেটে।
-- আমাদের সব গল্পগুলোই কেমন ঠুনকো বল তো! কোনোটাই শেষ হয় না!  
-- শেষ হয় না, নাকি বল্‌, আমরা শেষ অব্দি থাকতে পারি না!
-- শেষ অব্দি থাকা যায় না বলেই তো তাকে শেষ বলে! থাকতে পারলে কি আর শেষ বলতো?
-- এই যে এত এত বুড়ো বাচ্চা মাগি-মিনসেদের নিয়ে আসিকখনো ভেবে  দেখেছিসএদের কজন বাঁচে আর কজন মরে যায়?
-- হিসেব করতে গিয়ে চাপ খেয়ে কী হবেরেজাল্ট যদি খারাপ বেরোয় তখন  মনে হবে রাতদুপুরে এই পুরোটাই ফালতু খাটনিসবটাই কি পয়সার জন্যসত্যি করে বল তো?
-- ফোল্ডিং খাটে কুঁকড়ে থাকা একেকটা লোককে খেয়াল করেছিসমরার আগেই  কেমন বডি বডি ভাব খেয়ে থাকেমুখের মোচড়ঠিকরে ওঠা চোখদেখেছিস  তো?
-- গোটা মুখ কেমন সিকে আধুলি হয়ে যায়!
-- সব কি আর পয়সার জন্য?
-- কিন্তু শেষটাই যে আমরা জানতে পারি না! রোজ রোজ এতো এতো গল্পের  ভেতর মামদো হয়ে সেঁধিয়ে যাই, কিন্তু কে যেন ঠিক গল্পের মাঝ বরাবর তার কেটে দেয়!
-- তারপর আবার এই মালের ধুনকিএরও কোনো শেষ হয় না!
-- কী আর শেষ হয় বল তো?
-- কেনএই যে আরেকটা পাঁইটকেমন ঝপ করে শেষ হয়ে গেল!
-- মাল ফুরোতে পারে বাওয়াধুনকি ফুরোয় না কখনো!

এই বলে ওরা দুজন আরেকটা পেগ বানিয়ে ফেলেআর ঠিক তখনই ওদের  বাংলার গ্লাসে, ঠেকের আকাশে পারাপারকারী আখাম্বা চিল অচল সময়ের কড়ির মতো একটা করে আধুলি ফেলে দিয়ে যায়। দ্রব্যগুণ পায় ধাতুগুণ। আধুলি দুটো  গলে যেতে থাকে আর তাদের ভেতর থেকে সদ্যমৃত কয়েকটা গল্প বেরিয়ে এসে গ্লাসটাকে টকটকে লাল করে দেয়  লোকদুটো অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে মদের  শেষে আধুলির ঐ রক্তাক্ত তলানি। কুঁকড়ে মুচড়ে যাওয়া তলানি শরীর ধাতুর। শেষ রোদে গল্পটাও গলে যায় এখানে। চিকচিকে মিলিয়ে যায় আবার। রক্তপাতের পর বাংলার গ্লাস তখন ব্রাউনস্কিন পেরিয়ে মিশকালোর দিকে চলেছে।  




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন