আমাকে
আশ্রয় দাও
প্রীতিময় পালাচ্ছে।
পালাতে পালাতে পালাতে পালাতে হাত-পা দাপাচ্ছে। প্রীতিময় আলমারির কোণা খুঁজছে। পুরনো
আলমারি – বাবা-মায়ের স্মৃতির
আলমারি – কালো ভার্নিশমাখা সেগুনের আলমারি – পোকার আর ন্যাপথালিনের গন্ধমাখা ভারি আলমারি। প্রীতিময় আলমারির কাছ থেকে পালিয়ে
লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।
প্রীতিময় টেলিভিশন খুলে
বসে পালাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদে বিশাল ছাতিওলা, বুকের পাটাওলা হোমড়াচোমড়া মন্ত্রী
হাতের পাতা নাড়িয়ে ভারি ভারি যাত্রার সংলাপ বলে যাচ্ছে। তার চুলদাড়ি সব সাদা। প্রীতিময়
যাত্রা বোঝে না, অতএব পালাচ্ছে। রাজ্যসংবাদ খুলে দেখল হাওয়াই চটি-পরা মন্ত্রী গলার
রগ ফুলিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করছে। কিছু লোক হাততালি আর
বাকিরা পতাকা টতাকা উড়িয়ে... প্রীতিময় আবার পালাল।
কারা যেন মারামারি করে চলেছে...
প্রীতিময় তারপর পালাতেই
লাগল – লালটিপ চওড়া সিঁদুর ঘোমটা বুড়িকে দেখাচ্ছিল
তার মরা মায়ের মতো – দু’মিনিটে দু’শো ফুচকা গিলে একজন কুড়ি হাজার পেল – হনুমান চালিশা
জপে একজন সেন্ট্রাল গরমেন্টের চাকরি – প্রীতিময় অতঃপর
পালাচ্ছিল...
একজন বিষাদিত ‘কোলিগ’ ফোন করে কাজের লোক না এলে তার বৌয়ের কষ্ট যন্ত্রণার ফিরিস্তি দিতে থাকল। পঞ্চাশ না পেরিয়েই তার প্রেমিকা-কাম-বৌয়ের আন্ত্রিক ও মাসিক গোলযোগ এবং বাতের কাতরানি – আঃ উঃ! প্রীতিময় পালাল। তার বৌ বা টৌ কিছুই নেই।
একজন চনমনে অত্যাধুনিক
কবি ফোন করে অধুনান্তিক কবিতার গুণগান করতে লাগল। প্রীতিময় ইস্কুলে
পাঠ্যবইয়ের বাইরে কবিতা পড়েনি। কলেজে একটু-আধটু রবিঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ
পড়েছিল। তাও ভালো মতো বুঝতে পারত না। কবি বলতে লাগল, কেন পুরনো কবিতা আজকাল কেউ পড়ছে না, কেন
পড়া উচিতও না। তাতে চিন্তার শক্তি কেস খেয়ে যায় - কথাবার্তা বোদাবোদা হয়ে যায়। প্রীতিময়
পালিয়ে গেল।
একজন বিস্বাদ রাজনীতি-বিশারদ
ফোন করে শোনাতে লাগল, জাতির পিতা কতটা শঠ, ধূর্ত আর নীচ হলে দেশ নিচে নামতে পারে।
তাকে মহাত্মা উপাধি দেওয়ার মতো উৎকট ভুল আর কিছু হতেই পারে না! ফোন চার্জে ছিল, ক্রমাগত
গরম হতে লাগল। প্রীতিময় ডান-বাঁ ডান-বাঁ করে কান থেকে নামিয়ে টেবিলে রেখে বাডস
দিয়ে কান খোঁচাতে লাগল। প্রীতিময় পালাল।
একজন গেঁতো পুরাণ-বিশেষজ্ঞ
ফোন করে মহাকাব্যে রাবণের পৌরুষ আর সত্যনিষ্ঠার কত নিম্নে রামের অবস্থান হওয়া
উচিত, বোঝাতে লাগল। রামকে তবু কেন পুজো করা হচ্ছে, সীতাকে এতখানি অবহেলা ও
হতচ্ছেদার পরেও – সেটা যে সাঙ্ঘাতিক অন্যায় – বলতে লাগল। প্রীতিময় পালাচ্ছিল।
রাত্তিরে হেলেদুলে ঝড়
উঠল। দু’চারটে খুচরো গাছের মুণ্ডু
দুলতে লাগল। বাজ কান-ফাটা ঝলক দিখলাতে থাকল। ঘরের মধ্যে মশারির চালা দোলদোল – পর্দা উতরোল। প্রীতিময়ের ঘরের
সিলিং পাহাড়ের চূড়া হয়ে গেল। মেঝেটা বানভাসি নদী। দেওয়ালগুলো প্রকাণ্ড গাছের জঙ্গল
হয়ে চেপে দিতে লাগল। প্রীতিময় বিছানা নামের কাদামাখা চড়ায় শুয়ে অন্ধকারে ছায়াপথ
খুঁজতে খুঁজতে পালাতে লাগল... একপা, দু’পা, তিনপা, চারপা...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন