শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৫

শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’র প্রথম গল্প ‘ঘাটের কথা’ অবলম্বনে




ঘাটের কথা

নাট্যরূপ : শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁশিতে ভাবালু সুরে একটু দুঃখের ছোঁয়াএকসময় তা fade-out কোরে জলের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ শোনা যাবেতার সাথেই ভেসে আসবে বয়স্ক পুরুষ কন্ঠের গান –“জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে...”সে কণ্ঠ বৃদ্ধের তবে তিনি এত বৃদ্ধও নন যে, কণ্ঠে বয়সজনিত কম্পন থাকবেমাঝপথে গান থামিয়ে সে কন্ঠ বলে ওঠে –

বৃদ্ধ   -  পাথরে যদি ঘটনা আঁকা থাকত, তবে আমার ধাপে-ধাপে কতদিনকার  কত কথা পড়তে পারতেযদি পুরনো কথা শুনতে চাও, একটু বোসো নদীর উচ্ছলতায় কান পাতোবহুদিনের কত হারিয়ে যাওয়া কথা শুনতে পাবে অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়ছে। সেও আজকের মতোই একটা দিনভরা গঙ্গামাত্র চারটে ধাপ ছাড়া আমার সবটাই জলের তলায়দূরের ঐ আমবন পর্যন্ত সে জলের ব্যাপ্তিযেন জলের সঙ্গে স্থলের গলাগলিভরা গঙ্গার উপরে ঝিলমিল করে শরতের রোদ। কাঁচা সোনার মতো রোদ, চাঁপাফুলের মতো রোদপাখিরা যেমন আলোয় পাখা মেলে নীল আকাশে উড়ে চলে, ঠিক তেমনই ছোট-ছোট  নৌকাগুলো তাদের ছোট-ছোট পাল উড়িয়ে পাড়ি দিয়েছেএখান থেকে সেগুলোকে পাখি বলে ভুল হয়

আবহে বাঁশি বেজে উঠে fade-out করবে

আসলে আমার দিনগুলো গঙ্গার স্রোতের উপর খেলতে খেলতে ভেসে যায়দিনের পর দিন ধরে স্মৃতির আস্তরণে আমার সূর্যকিরণ ঢাকা পড়ে না্রোতের মুখে ভেসে আসা শ্যাওলার মতোই হয়তো বা কখনো  আমার গায়ে লেগে থাকে, আবার কোনো পরবর্তী ঢেউয়ের টানে ভেসেও যায়তা বলে যে আমার সঞ্চয়ের ঝুলি একেবারে শূন্য, এমন নয়কিছু এমন তো থাকেই – যা আজীবন ভোলা যায় না, যা ফেলে আসা দিনগুলোকে চিরদিন শ্যামল, মধুর, চিরদিন নতুন করে রাখে!

আবহে বাঁশি বেজে উঠে fade-out করবে

দেখেছো, যে কথাটা বলব মনে করি সে আর কিছুতেই বলা হয় নাএকটা কথা বলতে স্রোতের মুখে আর একটা কথা ভেসে আসে। যাইহোক, যদিও বয়েস অনেক হয়েছিল, তবু তখনও আমি সিধে ছিলাম তবে হ্যাঁ, আমার ঐ বাঁ-পাশের বাইরের দিকে দুটো ইটের অভাব ছিল সেই গর্তের মধ্যে একটা ফিঙে বাসা বেঁধেছিলভোরবেলা যখন সে উসখুস করে জেগে উঠত, দু-চারবার তার জোড়া লেজ নাচিয়ে শি দিয়ে যখন সে আকাশে উড়ে যেত, তখন বুঝতাম – এবার কুসুমের ঘাটে আসার সময় হয়েছে

বাঁশিতে ‘আহির ভৈঁরো’র সুর তার মধ্যেই জলের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দএকসময় মেয়েদের সম্মিলিত হাসির শব্দ আছড়ে পড়েএই বাঁশি, হাসি আর জলের শব্দের সাথে মিলিয়ে মিশিয়েই তিনটি ভিন্ন নারী কণ্ঠের ডাক শোনা যাবে –

-   কুসি
-   খুশি
-   রাক্কুসি

এ ডাকগুলি প্রতিধ্বনিত হবে ও অন্য এক অপেক্ষাকৃত ভারী মহিলা কণ্ঠের ডাক শোনা যাবে

নাঃ কণ্ঠ  -    কুসমি, আর জলে থাকিসনে মা – এবার উঠে আয়...

আবার বাঁশিতে নাটক শুরুর সেই বেদনা বিধুর সুর শোনা যাবে, সঙ্গে জলের শব্দএকসময় গোড়ার দিকে গানটা ঠিক যেখানে থামিয়ে সেই বৃদ্ধ কথা বলে উঠেছিল, সেখান থেকে আবার গেয়ে উঠবে এবং আবার একবার হঠেৎ আগের মতোই মাঝপথে  গান থামিয়ে কথা বলে উঠবে

বৃদ্ধ  -   জলের সঙ্গে কসুমের হৃদয়ের বিশেষ যেন কী মিল ছিল! সে জল বড় ভালোবাসতকিছুদিন পর হঠাৎই একদিন অনুভব করলাম – কই  কুসুমকে তো আর দেখতে পাই না! আমার বুকে শিহরণ তোলা সেই পায়ের স্পর্শ তো আর অনুভব করি না! অনেক পা রোজ আমার ধাপে-ধাপে ওঠে নামেতারা আমার বুক মাড়িয়ে দিয়ে যায়, ঝঙ্কার তোলে নাহঠাৎ একদিন ভুবন আর স্বর্ণ’র কথা কানে এলো...

মুহূর্তের জন্যে বাঁশি ও জলের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দের আবহ বেজে উঠেই fade-out করবে

ভুবন  -  হ্যাঁ ভাই সন্ন, কুসির শ্বশুরবাড়ি বুঝি অনেক দূর?
স্বর্ণ    -  অমলি তো তাই বললে
ভুবন  -  সে জানলে কী করে?
স্বর্ণ    -  তার খুড়োমশায়ের কাছে শুনেছে রেলের গাড়িতে তিনদিনের পথ
ভুবন  -  তিন দিন!!!
স্বর্ণ    -  অমলির খুড়োমশায় তো নাকি সে রকমই বলেচেনতার ওপর সে দেশে নাকি মা গঙ্গা নেই!
ভুবন  -  সন্ন...
স্বর্ণ    -  রাক্কুসির কেন যে মরতে বে হলো!!
ভুবন  -  কুসি জল বড় ভালোবাসে সন্ন...
স্বর্ণ    -  আমায় কাঁদাসনে ভুবন...
ভুবন  -  শ্বশুরবাড়িতে সব নতুন। ঘর, লোক... সব
স্বর্ণ    -  মরুক রাক্কুসি, আমাদের কী? আমরা কে? মর... মর...

        আছড়ে পড়া বাঁশিতে বুক মোচড়ান কান্না গুমরে গুমরে ওঠে। সঙ্গে জলের আবহ। সেই বৃদ্ধ কণ্ঠ আবার সেই একভাবে এক গান আবার গেয়ে ওঠে এবং আবার একই ভাবে হঠাৎ গান থামিয়ে কথা বলে ওঠে

বৃদ্ধ  -   আমার জলের পদ্মকে কে যেন ডাঙায় পোঁতার জন্যে তুলে নিয়ে গেছে

        ...মুহূর্তের জন্যে আবহ বেজেই fade-out করবে...

        তারপর প্রায় একবছর কেটে গেল। ফিঙের শিসের শব্দে রোজ তাকে মনে পড়ে, সে যেন সেই ফিঙের  দোষআমার মনের নয়সেই রাক্ষুসিরও নয়
        
         একদিন সন্ধ্যেবেলা চেনা পায়ের স্পর্শে হঠাৎ চমকে উঠলাম। মনে হলো সেই পা। হ্যাঁ, ঠিক তাই। ঠিক। কিন্তু এ কি! ও পায়ে আর মল বাজে না কেন!? সে সুর... সেই সুর কোথায় গেল?! আঃ... আমার বুকে শিহরণ জাগে না কেন?
        
         বৈধব্য যে মানুষকে এমন রিক্ত, এমন দীন করে তুলতে পারে, বহুদিন  পরে আবার তা অনুভব করলাম। রোজ সে আসে, দু-হাঁটুর উপর মাথা রেখে চুপ করে আমার সোপানে বসে থাকেআমার মনে হয়, যেন নদীর ঢেউগুলো সবাই মিলে হাত তুলে তাকে ডাকতে থাকে –

-   কুসি
-   খুশি
-   রাক্কুসি

        ডাকগুলি প্রতিধ্বনিত হতে থাকবেবাঁশিও উত্তালসে সব থামলে আবার সেই বৃদ্ধের সংলাপ শোনা যাবে

বৃদ্ধ -    দশটা বছর কেটে গেলবর্ষার গঙ্গার মতোই কুসুম তখন সৌন্দর্যে  পরিপূর্ণএক সকালে কোথা থেকে এক সন্ন্যাসী এসে আমার সামনের ঐ শিবমন্দিরে আশ্রয় নিলেন।
        ...মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠবে...

        র্সা  রঙ, দেবতুল্য চেহারাপ্রত্যেকদিন ভোরবেলা যখন তিনি জলে দাঁড়িয়ে সূর্যবন্দনা করতেন, তখন তাঁর সেই ধীর গম্ভীর স্বরে জলের কল্লোল চাপা পড়ে যেতগভীর প্রশান্তিতে ভোরে উঠত আমার মন...

        প্রথমে বাঁশিতে কোনো ভোরের রাগ বাজবে, ও পরে তা fade হয়ে  নেপথ্যে বাজার মধ্যে সন্ন্যাসীর মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাবে

সন্ন্যাসী-                ওঁ জবাকুসুমং সংকাস্যং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম
                      ধন্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্রনতস্মি দীবাকরম।।

        মন্ত্রোচ্চারণ শেষে বাঁশি আবার loud হয়েই fade-out করলে বৃদ্ধের কোথা শোনা যায়

বৃদ্ধ -    তাঁর সেই কণ্ঠস্বর শুনতে-শুনতে অন্ধকার যেন তার আবদ্ধ পাপড়িগুলো মেলে ধরত একে-একে, আর তার মধ্যে দিয়ে নতুন সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ত দিকে দিগন্তে

         এদিকে সন্ন্যাসীর আগমনকে কেন্দ্র করে ভিড় প্রতিদিনই বাড়তে থাকে। কেউ উপদেশ নিতে আসে, কেউ বা কোনো রোগ নিরাময়ের প্রার্থনা জানায়আবার কেউ বা আসে শুধুই তাঁর সেই উদাত্ত কণ্ঠে  ভাগবদ্‌গীতার ব্যাখ্যা শুনতে...

সন্ন্যাসী -              ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্য কর্ম্মকৃৎ
                      ধার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজ ঐর্গুনৈঃ।।
        
         কেউ কখনই নিস্কর্মা হয়ে থাকতে পারে না। কখনই না। কোনো না কো্নো কাজ, প্রত্যেকটি মানুষকে করতেই হবে। সে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছাকর্ম থেকে জীবজগতের নিস্তার নেপ্রকৃতি তার নিজের  তাগিদেই প্রয়োজনীয় কর্মটুকু করিয়ে নেপ্রকৃতির দাস এই জীবজগৎ সে অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্যবেদ বলে – আপনার মঙ্গল কামনায় দেবতার প্রসাদ পাবার জন্য যে যাগ-যজ্ঞ, তাই মানুষের কর্মগীতায় কর্মের মূল মন্ত্র কামনায় নয়, ত্যাগনিষ্কাম কর্ম 

                      কর্ম্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
                      মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত কর্ম্মনি।।
                      যোগস্থঃ কুরু কর্ম্মানি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়
                      সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।
                      যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবি পশ্চিতঃ
                      বেদবাদরতাঃ পার্থ্য নান্যদস্তীতি বাদিনঃ।।
                      কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্ম্ম ফলপ্রদাম
                      ক্রিয়া বিশেষ বহুলাং ভোগৈশ্বর্য গতিং প্রতি।।
                      ভোগৈশ্বর্য প্রসক্তানাং তয়াপ হৃত চেতসাম
                      ব্যাবসায়ত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।

        শ্লোকের মধ্যভাগেই সন্ন্যাসীর কন্ঠ fade-out করে বৃদ্ধের কন্ঠ ভেশে আসবেকিন্তু সন্ন্যাসীর কন্ঠ এত আস্তে-আস্তে fade-out করবে যাতে বৃদ্ধের কন্ঠ চলাকালীন বেশ খানিকটা সময় জুড়ে নেপথ্যে সেই গীতাপাঠ শোনা যায়

বৃদ্ধ -    প্রত্যেকদিন ভিড় বাড়তে লাগল। একে সন্ন্যাসী, তায় অনুপম রূপতারপর আবার তিনি কাউকেই অবহেলা করেন নাফলে খুব কম সময়ের মধ্যেই তাঁর প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হলোকয়েকটা মাস এভাবেই  গেল কেটে। চৈত্রমাসে সূর্যগ্রহণের সময় সেবার গঙ্গাস্নানের ভারী ধু মস্ত হাট বসেছে লোকে লোকারণ্য

        আবহ হিসেবে অনেক রকম শব্দ একসাথে বাজার প্রয়োজনীয়তা রয়েছেমন্দিরের ঘণ্টা, কাঁসর, ঢাক, তালপাতার ভেঁপু, Loud Speaker’এ গান

                 যা ছিল কালো ধল
                 তোমার রঙে রঙে রাঙা হলো
                 যেমন শ্যামল বরণ তোমার চর
                 তার সঙ্গে আর ভেদ না রইল...

         এ গান মেলায় বাউলের উপস্থিতি বোঝাবে। নাটকের পরবর্তী অংশের পুরোটা জুড়েই খুব আস্তে উপরিউক্ত শব্দ-সমন্বয়ের প্রয়োগ থাকবেতবে তা যেন কখনই সংলাপ ছাপিয়ে না যায়

বৃদ্ধ -    পুণ্যার্থী, দর্শনার্থী, হাটুরে – সব মিলে মিশে তো একাকারকুসুমের শ্বশুরবাড়ির দেশ থেকেও এসেছে অনেকে 

         পূর্ববর্তী আবহ বেজে উঠেই fade-out করবে

১ম নারী - আহা কী রূপ! মনে হয় যেন মহাদেব শরীরে নেমে এয়েচেন!
২য় নারী - ওলো, এ যে আমাদের কুসুমের বর!
১ম নারী -ওমা, বলিস কী গো... চাটুজ্জেদের ছোটকত্তা! তবে যে     শুনেছিলাম...
২য় নারী - শোনা তো অনেক কিছুই যায়, সে সবই কি আর সত্যি হয় দিদি?
১ম নারী - তা ঠিক... তবে কি না...
২য় নারী - আহা, তেমনই কপাল, তেমনই নাক... চোখদুটো দেকেচ দিদি, একেবারে ছোটকত্তা বসানোএ সন্ন্যেসী ছোটকত্তা ছাড়া আর কেউ নয়, এ আমি হলফ করে কইতে পারি
১ম নারী - কুসুমের কি তেমন কপাল...
৩য় নারী - থাম দেখি দিদি! গ্রহণ মেলায় পুন্নি করতে এয়েচিস, না কুসমির বর খুঁজতে? সে বেচারা নিজের জ্বালায় নিজে মরে, আর তোরা সন্নেসী ঠাকুরের মধ্যে তার বর খুঁজে পাচ্চিস সে শুনলে কি ভাববে বল তো? ছি... ছিঃ... ছিঃ...
২য় নারী - আ মোলো যা, সত্যি কথাটা মুখে বললেই দোষের?
৩য় নারী - কোনটা সত্যি শুনি! তোর বলাটা, না কুসমির বরের সন্নেসী হওয়াটা? বলি সে ছেরাদ্দে তো তোর কত্তাও বামুন ভোজে বসেছিলকোথায় একটু মিল পাওয়া গেল, তাতেই সে বেঁচে উঠল? ওলো মুখপুড়ি, পোড়াকপালি কুসুমকে কি সমাজে বাস করতে দিবিনে? সে তো তোর কোনো ক্ষেতি করেনি! আর যদি মিলের কথা বলিস, তো বুকে হাত রেখে বল তো – ছোটকত্তা এমন একহারা ছিল না এমন লম্বা ছিল? গায়ের রঙটাও যে আরও ঢের বাসি গৌর ছিল গো! তোদের দুটি পায়ে পড়ি, এমন করে অভাগীর সব্বনাস করিসনে...

         ৩য় নারীর সংলাপ সম্পূর্ণ শোনা যায় নাশেষ দিকে এসে তা fade-out করে বৃদ্ধের কণ্ঠে গান – ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু......’ Fade-in করে। বৃদ্ধ এতক্ষণ যেমন করে হঠাৎ গেয়ে উঠেছে, হঠাৎ গান থামিয়ে সংলাপে গেছে, সেভাবেই সে গান থামিয়ে কথা বলে ওঠে

বৃদ্ধ -    গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রায় সবাই সন্ন্যাসীকে দেখেছিল, শুধু কুসুম ছাড়া প্রথমদিকে তবু একটু সুযোগ ছিল, কিন্তু পরে ভিড় বাড়ার সাথে সাথে সে আমার কাছে আসা একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলএকদিন সন্ধ্যেবেলা, তখন নিস্তব্ধ, জনপ্রাণীহীন ঘাট। কিছুক্ষণ হলো মন্দিরের শেষ কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজও মিলিয়ে গেছেসন্ন্যাসী মন্দিরের বাইরে এসে  ঘাটের দু এক ধাপ নেমে একা এক নারীকে বসে থাকতে দেখে ফিরে  যাবেন মনে করছেন, এমন সময় সে হঠাৎ মুখ তুলে পেছন ফিরে চাইলে। আবরণ গেল ঘুচে। মনে হলো – কোথায় যেন একটা সম্বন্ধ রয়েছে। যেন আজন্ম চেনা!

সন্ন্যাসী - তোমার নাম কি?
নারী    - কুসুম...

         চকিতে সেতারের ঝালা আছড়ে পড়েই fade-out করবে...

বৃদ্ধ -    সে রাতে আর কোনো কথা হলো নাকুসুম চলে গেল, সন্ন্যাসী আমারই  সোপানে বসে রইলেনতারপর যখন পুবের চাঁদ পশ্চিমে ঢলে পড়ল, তখন প্রত্যেক দিনের মতো তিনি জলে নেমে তাঁর উদাত্ত গলায়  সূর্যবন্দনা শুরু করলেন –

সন্ন্যাসী -               ওঁ জবাকুসুমংসংকাসং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম
                      ধন্তারিং সর্ব পাপঘ্ন প্রনতস্মি দিবাকরম

         মন্ত্রোচ্চারণ fade-out করে আবার বৃদ্ধের সংলাপ শোনা যাবে

বৃদ্ধ -    তারপর দিন থেকে লক্ষ্য করলাম, কুসুম প্রত্যেকদিন স্নান সেরে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করে যায়গভীর মন দিয়ে তাঁর গীতাপাঠ শোনে। কখনো কখনো সন্ন্যাসীর সাথে নানান শাস্ত্র আলোচনা করেসন্ন্যাসী তাকে যেমন যেমন উপদেশ দেন, সে তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। মন্দিরের বিভিন্ন কাজ করেফুল তোলে, মালা গাঁথে, মন্দিরের মেঝে ধুয়ে দেয়। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলোতারপর একদিন প্রকৃতির খেয়ালে যখন হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে মাতাল বাতাস ছুটে আসে, গাছে-গাছে রঙের ছোঁয়ায় কে যেন বলে বেড়ায় – এখন বসন্ত! হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, কুসুম আমার কাছে আসা বন্ধ করেছে। বেশ কয়েকটা দিনতারপর আবার একদিন সন্ধ্যেবেলা আমারই সোপানে দেখা হলো তাদের  

        বাঁশিতে বসন্তের ছোঁয়াএকটুক্ষণ বেজে তা fade হয়ে পরবর্তী সংলাপের নেপথ্যে অত্যন্ত হালকা সুরে বাজতে থাকবে

কুসুম -   আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন?
সন্ন্যাসী - হ্যাঁ, ইদানীং তুমি দেবসেবায় অবহেলা করছ। তোমায় দেখতে পাইনে কেন? ... বল কুসুম, তুমি মন্দিরে আস না কেন?

         কুসুম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে

সন্ন্যাসী - কেঁদো নাতোমার অশান্তির কথা আমায় বল, আমি তোমায় শান্তির পথ দেখাব
কুসুম -   আমি একজনকে দেবতার মতো ভক্তি করতেমপূজা করতেম তাঁকে সেই আনন্দেই আমার মন ভরে ছিল। শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু কোনো কামনা ছিল নাতারপর একদিন তাঁকে স্বপ্নে দেখলামমানুষটাকে কতবার দেখেছি, তাঁকে দেখাটাই যেন আমার ঢের বেশি পাওয়াঅথচ সেই মানুষটাই যখন স্বপ্নে আমায় ভালোবেসেছেন, ভা্লোবাসার কথা বলেছেন, তখন এক নতুন ভালোবাসার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে আমার সর্বাঙ্গেসে এক অসহ্য তৃপ্তি, এক অদ্ভুত আনন্দঘুম ভাঙল, স্বপ্ন ভাঙল, কিন্তু সে স্বপ্নের ঘোর আর কিছুতেই ভাঙে নাআমি যতই ভুলতে চাই, সে ততই  শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরে। সে আর এক বিড়ম্বনাতারপর যখন তাঁকে দেখলেম, আর সেই আগের মতো করে দেখতে পারলেম নাআমার চোখে যে স্বপ্নের রঙ, তা এড়ানোর সাধ্য কই আমার! কাছে যেতে ইচ্ছে করে। স্পর্শ করে দেখতে সাধ হয়। ভয়ে দূরে দূরে রইলেমকিন্তু স্বপ্নের সে ছবি, সেও আমার সাথে সাথেই রইলসেও তাড়াতে পারিনে, তাঁর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতেও পারিনে। এ এক অদ্ভুত অশান্তি!

কুসুম আবার ফুঁপিয় ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে । জলের শব্দ আর তার কান্না ছাড়া আর কিছু শোনা যায় নাকয়েকটা মুহূর্ত এভাবেই কেটে যায়

সন্ন্যাসী - কে সে?
কুসুম -   নাই বা শুনলেন!
সন্ন্যাসী - তোমার মঙ্গলের জন্যই জানতে চাইছি। স্পষ্ট করে বল – সে কে?
কুসুম -   সে আমি বলতে পারিনে...
সন্ন্যাসী - কুসুম, আমার কাছে গোপন কোরোনা... বল
কুসুম -   তা কি বলতেই হবে?
সন্ন্যাসী - হ্যাঁ, বলতেই হবে
কুসুম -   সে আপনি প্রভু...
সন্ন্যাসী - কুসুম!

এবার কুসুম হাউ-হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েেপথ্যে করুণ সুরে বাঁশি বেজে ওঠেকয়েক মুহূর্ত পর তার কান্না খানিকটা প্রমিত হয়

সন্ন্যাসী - কুসুম, আজ পর্যন্ত আমার সব কথাই তুমি পালন করেছআমার এই কথাটাও তোমায় রাখতে হবে। আমি আজই এখান থেকে চলে যাবকোথায় জানি না। যেমন এখানে আসার আগে জানতাম না। তবে আমাদের আর সাক্ষাত হবে না। আমায় ভুলতে হবে। পারবে না?

কুসুম আবার কান্নায় ভেঙে পড়েতা fade-out হয়ে বাঁশি fade-in হয়বৃদ্ধের পরবর্তী সংলাপের সাথে বাঁশি fade-out হয়

বৃদ্ধ -    কুসুম ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে, সন্ন্যাসী ধীর পায়ে মন্দিরে ফিরে গেলেনকেন জানিনা, তাঁর পদক্ষেপ বড় সাবলীল মনে হলো নাকুসুম সেখানেই আমার সোপানে বসে রইলতারপর একসময় আস্তে আস্তে জলে নামলএতটুকু বেলা থেকে সে এই জলের ধারে কাটিয়েছেআজ শ্রান্তির সময় যদি এই জলই হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে আশ্রয় না দেয়, তাহলে তার আর শান্তি কোথায়?

বৃদ্ধের গলা ধরে আসেবাঁশি loud হয়কিছুটা সময় পর আবার বৃদ্ধের কণ্ঠ শোনা যায়

বৃদ্ধ -    শুধু যখন আকাশে খুব বড় করে চাঁদ ওঠে, জোয়ারের ঢেউ যখন দুরন্ত শিশুর মতো আমার সোপানে-সোপানে আছড়ে পড়ে, তখন জলের সেই শব্দের তালে তালে আমার বুকে সেই পুরনো ডাক বার বার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে -
-   কুসি
-   খুশি
-   রাক্কুসি
বৃদ্ধ আবার গেয়ে ওঠেন – ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে...’ এবার সে গান প্রায়  হাহাকারের মতো শোনায়, এবং তা একসময় fade-out হয়ে নাটক শেষ হয় 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন