কালো চশমা
চোখ থাকতেও আমরা কী সবকিছু দেখি? অন্তত দেখার মতো করে দেখি কি? কত কিছুই দেখা হয় না, খেয়াল বা
বেখেয়ালে কত কিছু ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাই আমরা। আমাদের চোখ আছে, চোখের চশমা
আছে। সেই চশমার কত বাহার আবার! যত না মানুষ দেখি, তার থেকে
বেশি দেখি চশমার রকম। এত চশমা কারা পরে? অবশ্যই যাদের চোখ আছে তারাই। আর কালো চশমা? সেও পরে
লোকে রোদের সময়ে, স্টাররা পরে ফোটো সেশনের সময়ে। কান্না আটকাতেও পরে স্টার
ও মন্ত্রীসান্ত্রীরা। আর পরে দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষরা। আমরা আড়ালে ওদের অন্ধ বলি। কানাকে কানা বলতে বারণ করা হয়েছে বলে কানা বলি না, এই যা! ওদের সামনে সবই তো কালো কালো অন্ধকার, তবে কেন
পরানো হয়ে ওদের কালো চশমা? খুব কাছ থেকে এদের কয়েকজনকে দেখে বারবার
এই প্রশ্ন জাগে মনে। যদিও সে প্রশ্ন উচ্চারণ করা
যায়নি।
চারজন অন্ধ ছেলে এক সাথে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। ব্লাইন্ড স্কুল থেকে ওরা
সন্ধ্যেবেলা ফেরে। কখনও দুজন দুজন করে, কখনও বা একসাথে সবাই মিলে। যে বাড়িতে ওরা থাকে স্টেশন
থেকে মিনিট দশেক দূর হবে। ওদের মধ্যে দুজনের বয়স আঠেরো-উনিশের
কাছাকাছি। অন্য দুজন চব্বিশ-পঁচিশ হবে। ওরা নির্ভুলভাবে স্টেশন চত্বরের
ভিড় ঠেলে, মেন
রোড পেরিয়ে, আঁকাবাঁকা গলির পথ ধরে, লাঠি
ঠুকে ঠুকে বাড়ি পৌঁছে যায়। ট্রেন ধরে ওরা যে বিশেষ স্কুলে
পড়তে বা হাতের কাজ শিখতে যায়, সেও কম করে আধ ঘন্টার পথ। আপ-ডাউন স্টেশন
ওরা গুলিয়ে ফেলে না, কোন স্টেশনে নামতে হবে সে খেয়ালও থাকে বেশ। অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতে না
পেলে, বড়
জোর আশপাশের লোককে জিজ্ঞেস করে নেয়, কি ট্রেন আসছে বা কোন স্টেশন
এলো।
ওদের পোশাক দেখলেই বোঝা যায়, অভাব ওদের সঙ্গী। ওদের সাথে বা ওদের কাছে কখনও
চক্ষুষ্মান কাউকে আসতে দেখিনি। সম্ভবত ওরা অনাথ। নিজেরাই রান্না করে নেয় যা
হোক। বাড়ি ফিরে ওদের মধ্যে যারা বয়সে ছোট, তাদের দায়িত্ব থাকে টুকিটাকি কিনে আনার। তবে ছোটদুটির মধ্যে একটি
বোধহয় বেজায় কুঁড়ে, তাকে আর বাড়ির বাইরে দেখি না। একটি ছোটই একা একা কেনাকাটি
করে আনে। যেদিন ওরা বাড়ি ফিরে রাঁধে না, রাতের রুটি
তরকারি কিনে ফেরে সেই ছোটটি। আটটা বাজলে বড় দুজন ঘুরতে
বেড়োয় রোজ। তখন একজনের হাতে লাঠি থাকে, অন্যজন আরেক
জনের কাঁধ জড়িয়ে খোশ মেজাজে গপ্প করতে করতে হাঁটে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে, আর সে সঁপে
দিয়েছে নিজেকে, নিশ্চিন্তের স্টিয়ারিঙয়ের হাতে! রাত নটা বাজলে ওদের চক্কর শেষ হয়। এই দুই বন্ধুর মুখে সবসময়
হাসি ছাড়া কিছু দেখিনি।
মাঝে মাঝে ভাবি, ওরা যখন রান্না করে, রান্নায় হলুদ দেয়?
রঙ থাকে ওদের সবজিতে? ঝাল, নুন, মিষ্টি সবই না
হয় জিভ বলে দেবে, কিন্তু হলুদের
কি প্রয়োজন ওদের? তার চেয়ে হলুদ বাদ থাক, শুধু শুধু দাগ ধরিয়ে বাসন নষ্ট করার মতলব ওর। আর আয়না কি দেখে ওদের? আয়না কি জিজ্ঞেস করে কখনও নিজেকে – বল্ তো আয়না,
কে বেশি সুন্দর? তেলমাখা ভিজেচুল হাতের আন্দাজে
আঁচড়ে নিয়ে ওরা আয়নাকে বলে – এবার তুমি নিজেকে দেখো! ঘরের কোণে
রাখা সাদা লাঠি উঠে আসে ওদের হাতে, সহায় হাতে বেড়িয়ে পড়ে ওরা
নির্ভয়ে।
এই যে আসে যায় ওরা, ওদের কি ভুল হয় না, হোঁচট খায় না ওরা,
নাকি ভুল ট্রেনে ওঠেনি একবারও? ধাক্কা খায়নি ওরা
রাস্তার মানুষ, রিক্সা, অটোর সাথে?
সবই হয়- ভুল হয়, হোঁচট খায়; যেমন ভুল আমরা করি, যেমন হোঁচট আমরা খাই। এই তো সেদিন এক ইয়া মুসকো
লোক, মাথায়
ঝুড়ি নিয়ে দৌড়োচ্ছিল প্রায়, ওদের লাঠি এবং ওরা একসাথে ধাক্কা
খেল লোকটির সঙ্গে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো – ‘শালা অন্ধা কঁহিকা!’ কয়েকদিন আগে এক ভদ্রমহিলা যেমন বলেছিলেন, ‘চোখের মাথা খেয়েছ নাকি?’ এসবে ওরা অভ্যস্ত। কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আমার হয়তো একটু বেশি লাগে। অন্ধকে অন্ধ বলা কী দোষের কিছু? ওদের চোখের মাথা নেই, ওদের বাপ-মা নেই, নিজের ঘর-বাড়ি নেই। নেই তো নেই, ওদের চলাটি তো আছে, মুখের হাসিটি তো আছে! আমি ওই থাকাটুকু দেখি, প্রাণভরে দেখি।
আরও দেখি এক পঞ্চাশ পেরনো মানুষ ও তাঁর হাড় জিরজিরে
স্ত্রীকে। মানুষটির চোখে কালো চশমা। না তাঁর হাতে লাঠি থাকে না। তাঁর স্ত্রীর কংকালসার শাঁখাপলা পরা হাত শক্ত করে ধরে থাকে স্বামীর হাত। ওই ব্লাইন্ড স্কুলের শিক্ষক
তিনি। তিনি পড়ান, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখান তাঁর ছাত্রদের। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একলা
চলার শিক্ষা তিনিও পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই একদিন। সে শিক্ষা শিকেয় তুলে রেখেছেন বহু বছর আগেই। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছেন
তার চক্ষুষ্মতী স্ত্রীর হাতে। রাস্তা পেরিয়ে তাঁর স্ত্রী
এপারে ওষুধের দোকানে আসেন, ওপারে অন্য কোনো
দোকানের শেডের নিচে যত্ন করে দাঁড় করিয়ে আসেন তাঁকে। রোজকার ওঁর এই ওষুধ কেনায় যতটুকু সময় লাগে, তারই মধ্যে বার দুয়েক ঘাড়
ঘুরিয়ে দেখে নেন ওঁর স্বামী ঠিক জায়গা মতো আছেন কিনা। সেই ভদ্রলোক তখন জনস্রোতের মাঝে একলা পাথর হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। কখন এসে আবার হাত ধরবেন তাঁর
স্ত্রী! এই বুঝি অপেক্ষার নাম! প্রেমের সাথে সমর্পণ মিশে তিনি
যেন আরও আরও বেশি করে অন্ধ হয়ে আছেন। তাঁর এই অন্ধত্ব এ জন্ম কেন, পরবর্তী
কয়েক জন্মের সঙ্গী হবে নিশ্চয়ই।
ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী।
ধন্যবাদ শ্রাবণীদি
মুছুন