প্রতিবেশী সাহিত্য
পাবলো নেরুদার কবিতা
(অনুবাদ : জয়া চৌধুরী)
লেখক পরিচিতিঃ
চিলের বিংশ
শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি পাবলো নেরুদা ১৯০৪ সালে চিলের পাররাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। গার্সিয়া মার্কেসের মতে, বিশ শতকের
যে কোনো ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। আর প্রখ্যাত
সাহিত্য সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম বলেছিলেন,
পশ্চিম গোলার্ধের বিশ শতকের কোনো
কবিকেই তাঁর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ
২৬ জন পশ্চিমী সাহিত্যিকদের অন্যতম তিনি। তাঁর রাজনৈতিক ‘কেরিয়ার’ও যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল। ফ্রান্সে তিনি
চিলের রাষ্ট্রদূত ছিলেন কয়েক বছর। সাহিত্যে ‘মোদেরনিস্মো’ বা ‘আধুনিকতা’র
প্রভাব দেখা যায় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসার একশ কবিতা ও একটি বেপরোয়া
সঙ্গীত’এ। স্পেনে
তিনি ‘কনসাল’ হয়ে কাজ করেছিলেন কয়েক বছর। বন্ধু কবি গার্সিয়া লোরকার স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়
মৃত্যু হলে, তিনি চিলে
ফিরে যান এবং ‘হৃদয়ে স্পেন’ বইটি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির সঙ্গে
তাঁর পরিচয় ঘটলে তিনি অনুরক্ত হন বিশ্বকবির
প্রতি। “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা” গানটির মতো একটি কবিতাও তিনি রচনা করেছিলেন। আর্জেন্টিনার
প্রখ্যাত কবি খোরখে লুইস বোরখেস অবশ্য, ‘তাঁর
কবিতা অনবদ্য
হলেও মানুষ হিসেবে তিনি
ভালো নন’, এই কথা বলেছিলেন। পাবলো
নেরুদার
বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের
মধ্যে ‘পৃথিবীতে একটি
ঠিকানা’, ‘ক্যাপ্টেনের কিছু কথা’, ‘সাধারণ
সঙ্গীত’, ‘স্বীকার করি যে আমি বেঁচেছি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে নোবেল পদক লাভ করার দু’ বছর পরে প্রয়াণ ঘটে অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের স্রষ্টা
এই মহান সাহিত্যিকের।
যৌন জল
বৃত্তাকারে একাকী ফোঁটারা
ফোঁটায় পতনরত দাঁত যেন সব
যেন মার্মালেড আর রক্তে গড়া
পুরু ফোঁটা
চক্রাকারে ঘুরছে ফোঁটায়
ফোঁটায়,
জল পতনরত,
যেন ফোঁটায় পেতে রাখা পিঠ,
যেন কাচ ফুঁড়ে যাওয়া নদী,
কামড়াতে কামড়াতে,
প্রতিসাম্যের অক্ষকে আঘাত
করতে করতে, আত্মার বুননের
গায়ে লেপটে থাকতে থাকতে,
পরিত্যক্ত সব ভাঙতে ভাঙতে,
অন্ধকার মুড়তে মুড়তে পড়ে চলেছে।
এটা কেবল এক ঝাপট, কান্নার
চেয়েও বেশি ভেজা,
এক তরল, এক স্বেদ, নাম না
জানা কোনো তেল,
এক সুতীক্ষ্ণ,
নড়াচড়া করতে করতে, পুরু হতে
হতে,
পড়তে থাকে জল, ধীর ফোঁটায়
ফোঁটায়,
তার সমুদ্র পর্যন্ত, তার
শুখা সাগর তক
তার নেইজল ঢেউ তক।
বিস্তারী দুঃখ দেখি আমি, দেখি
শস্যাগার থেকে আসা এক মৃত্যুশ্বাস ধ্বনি,
শুঁড়িখানা, উচ্চিংড়ে পোকা,
জনপদ, অনুপ্রেরণা,
সব গৃহ, সব বালিকা
বুকে হাত দিয়ে ঘুমন্ত
শয়তানের সঙ্গে স্বপ্নরত,
আগুনের সঙ্গেও,
আমি জাহাজ দেখি,
মজ্জায় আমি গাছেদের দেখি
অমসৃণ ক্রুদ্ধ ফোঁটা যেন,
আমি রক্ত দেখি, ছোরা দেখি,
আর অর্ধেক নারী,
আর পুরুষের চুল,
আমি বিছানা দেখি, বারান্দা
দেখি যেখানে কোনো কুমারী চিৎকার
করে
আমি কম্বল দেখি অঙ্গ দেখি
আর সব হোটেলও দেখি।
আমি লুকোনো স্বপ্ন দেখি,
আমি স্বীকার করি শেষের দিন,
উৎসমুখ, আর স্মৃতিসব,
নৃশংস শক্তির উত্থিত চোখের
পাতার মতো
আমি দেখতে থাকি।
আর তারপর এই শব্দ –
হাড়ের লালরঙা আওয়াজ,
লেগে থাকা কোনো মাংস,
আর আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকা
কানের মতো হলুদ পা দুটোকে।
চুম্বনের গুলিবৃষ্টির মধ্যে
আমি শুনি
শুনতে থাকি, শ্বাসাঘাতে
মাঝে মাঝে নাড়া খেতে খেতে ফোঁপানোর শব্দ।
আমি দেখছি, শুনছি,
আত্মার অর্ধেক সমুদ্রে আর
দুনিয়ায়
বাকী অর্ধেক
আর আত্মার দুখন্ড নিয়ে আমি
দেখি মহিমময় পৃথিবী।
চোখেরা যদিও বুজে যায় আর
পূর্ণ ভাবে ঢেকে দেয় আমার হৃদয়,
আমি দেখি বোবা জল পতনরত
বোবা কোন ফোঁটায় ফোঁটায়।
যেন এক শিরীষ আঠার
হ্যারিকেন ঝড়,
যেন বীর্যের আর জেলিফিশের
ছানি।
আমি দেখি দৌড়ায় কাদা কাদা
রামধনু খিলান
আমি দেখি হাড়ের ফাঁক গলে
বয়ে চলা তার পানি।
আমার অধীনতারা
আমার অফিস পুরো করতে করতে
পাথরের ওপর পাথর; কলম আর
কলম,
কেটে যায় তুহিনকাল আর ফেলে
রেখে যায়
পরিত্যক্ত জায়গায়।
মৃত ঘরগুলিতে—
আমি কাজ করে যাই এবং কর্মও,
এত সব বিস্মরণে
আমায় আনতে হবে বদল
এইসব বিস্মৃতেরা,
রুটি ভরা ধ্বংসাবশেষরা
আর একবার স্থাপন করাই
প্রত্যাশা।
আমার জন্য এটা কেবল
বালিরাশি,
সিজনের কঠিন বৃষ্টি নয় তা,
আমি কিছুই সংরক্ষিত রাখি না
শুধু সব অবকাশ
আর সেখানে কাজ করা, কাজ
করতে থাকা,
প্রতিভাত হয়ে থাকা বসন্ত।
আমার সবাইকে কিছু দিতে হবে।
প্রতি সপ্তাহে হর দিনে,
নীল আকাশের এক উপহার,
জঙ্গলের শীতল পাপড়ি,
আমি গতকাল থেকে জীবিত আছি
আর সেই ফাঁকে অন্য যারা ডুবে যায়
আলস্যে, ভালোবাসায়,
প্রক্ষালন করছি আমি আমার
ঘন্টা,
আমার হৃদয়, আমার
যন্ত্রপাতি।
সবার জন্যই তো আমার শিশির
রয়েছে।
কবিতা
ইয়ে, সে এক সময় ছিল... কবিতা খুঁজতে এসেছিল আমাকে।
জানি না, আমি জানি না শীত না নদী,
কোথা থেকে উদয় হয়েছিল সে।
না, না না না, সেগুলো কন্ঠ ছিল না, শব্দও নয়, নয়
নিস্তব্ধতাও,
কিন্তু পথ থেকে ও আমায় ডাকছিল,
ডেকে যাচ্ছিল রাতের শাখা থেকেও,
অন্য সবার মাঝখান থেকেও আচম্বিতে ডেকে উঠছিল সে,
ভয়ংকর অগ্নিকুন্ডের ভেতর
কিংবা একাকী প্রত্যাবর্তনের সময়
অবয়বহীন সে ছিল সেখানেই
আর আমাকে সে ছুঁয়েছিল।
তাকে কী বলব তা জানতাম না, কী নাম দেব তাকে
আমার মুখ জানত না সেকথা
আমার চোখ ছিল অন্ধ,
আর কী যেন সজোরে ধাক্কা দিল আমার আত্মায়,
আমার তন্তু কিংবা হারানো ডানায় সে ধাক্কা দিল,
আমি একা হয়ে যাচ্ছিলাম।
সেই পোড়া ক্ষতের সংকেতলিপি উদ্ধার করছিলাম,
আমি আমার প্রথম ভুলভাল পঙক্তিটা লিখে ফেললাম,
ভুলভাল, কায়াহীন, পুরো পাগলামি সেটা,
বিশুদ্ধ জ্ঞান
যে ব্যাপারটায় কিচ্ছু জানা নেই
আর দ্রুত দেখলাম খোলা ছাড়ানো আকাশ
নগ্ন, উপগ্রহেরা,
স্পন্দিত আবাদ,
তুরপুন চালানো বিকেল,
ফুল, আগুন আর শরে এফোঁড় ওফোঁড় হওয়া বিকেল,
উপচানো রাত, বিশ্বচরাচর।
আর আমি এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীব,
করপুটে জমাটবাঁধা বিপুল শূন্যতা,
প্রতিচ্ছায়া, রহস্যের প্রতিবিম্ব,
নিজেকে অনুভব করলাম অতলস্পর্শী গহ্বরের শুদ্ধ অংশভাগ,
নক্ষত্র চাকায় ঘুরলাম,
ঝোড়ো বুকে আমার হৃদয় উন্মুক্ত হয়ে
আগলহীন হয়ে গেল।
তুই আমার কাছ থেকে দূরে নেই রে
তুই আমার কাছ থেকে দূরে থাকিস না একদিনও, কেন কী ভাবে,
কী জন্য, সেকথা তোকে বলতে জানি না, দিনটা লম্বা,
আর আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব স্টেশনে যেমন
কোনো এক পাশে ঘুমিয়েছিল রেলগাড়িরা।
এক ঘন্টার জন্যও কোথাও যাস না তুই কারণ তখন
সেই একটি ঘন্টায় অনিদ্রা ফোঁটারা জড় হয় একত্রে
আর হয়তো সব কুয়াশারা বাড়ি খুঁজতে হাঁটতে থাকে
আর তখনো হারিয়ে থাকা আমার হৃদয় আমায় হত্যা করতে আসে।
ওহ্ সেটা তোর সিল্যুয়েট বালিতে ভেঙে দেয় না
ওহ্ তোর অনুপস্থিতি তোর চোখের পাতায় ভাঙে না তা
দিল কি প্যেয়ারী, তুই এক মুহূর্তের জন্যও আমার কাছ থেকে
দূরে যাস না।
কেননা সেই মুহূর্তটাতে তুই কত দূরে চলে গিয়ে থাকবি
সে কথা পুরো দুনিয়াকে জিজ্ঞেস করতে করতে পার হয়ে যাব আমি
তুই ফিরেই আসবি, না কি আমাকে আদর করা ফেলে
রেখে দিবি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন