একজন মাহমুদ হোসেনের চালচিত্র
প্রয়াত মাহমুদ হোসেন যখন রিকশায় বুক ব্যথায় ছটফট করছিল, তার সারা শরীর নীল হয়ে আসছিল। বন্ধু হামিদের বাসা থেকে
হৃদয় সংশ্লিষ্ট সব কথাবার্তা, তার উপর করাচির পূর্ণ-যৌবনের দিনগুলো। আহা, এসব কথা সময়ের নিপুণ ঐশ্বর্য! তখন জীবন ছিল স্রোতস্বিনী ধারার মতো। আর মাহমুদ হোসেন সেই স্রোতশীল খাড়িতে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ভাসছিলো। কখনো ইরাবতি হতে বিয়াস, কখনো আঁড়িয়াল খা হতে বুড়িগঙ্গা। মাহমুদ হোসেন শৈশবে এতই ধী শক্তি সম্পন্ন ছিল যে, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়েই নিজের ভূত-ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিল। গ্রাম্য ছেলের দল যখন মাঠে
মাঠে মাটির ঢেলা নিয়ে কা-শালিক তাড়িয়ে বেড়াত,
নকশাদার প্রজাপতির পেছনে
ছুটত, তখন মাহমুদ স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা রবিনসন ক্রুশোতে নিমগ্ন। নির্জনতা ভালো লাগত। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে ধানের নৌকায় আকস্মিকভাবে পিতার মৃত্যু হলে মা সুন্দরী বেগম তাকে পড়া থেকে ছাড়িয়ে পিতার ধানের নৌকায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ধানের নৌকায় কিছুদিন ফরিদপুর-খুলনা করার পর মাহমুদ বুঝতে পারে, এরকম নৌকাবিহারে ধান-চালের কারবার করার জন্য তার জন্ম হয়নি। পিতা-মাতা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত
নিতে পারে না, তারা কখনো কখনো ছেলেমেয়েদের উপর এমন বোঝা চাপিয়ে দেয়, যা তাদের ভেতরকার আগ্নেয়গিরিকে নিভিয়ে দেয়। মাহমুদ চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র হলেও এ বিষয়টি খুব
তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছিল। একদিন রাতে নৌকা থেকে পালিয়ে সে ফরিদপুরের পথ ধরে। পঞ্চাশের দশকে মফস্বলে যাওয়ার জন্য কিছু পাকা সড়ক তৈরি হলেও
মাহমুদ সে পথ দিয়ে না গিয়ে গ্রামের
দুজন ফল ব্যবসায়ীর সঙ্গ নেয়। তারা প্রথমে মাহমুদকে সঙ্গী করতে চায়নি, কিন্তু মাহমুদের পিড়াপিড়িতে এবং বারেক মাস্টারের চিঠির কারণে শেষ পর্যন্ত ঢেকি গেলে। সারাপথ মাহমুদ একটি কথাও না
বলে তাদেরকে অনুসরণ করতে থাকে। পথে খিদে পেলে ফল
ব্যবসায়ীরা মাহমুদকে পোটলায় বেঁধে আনা চিড়া-মুড়ি খেতে দেয়।
তেষ্টায় গলা ফেটে এলে
মাহমুদ পথের ধারের পুকুর থেকে পানি খেয়ে নেয়। পথে রাত হয়ে গেলে তারা
গ্রামের ভেতর প্রবেশ করে এবং একটি জীর্ণ কুটিরে রাত্রি যাপন করে। গৃহস্থ অতি দরিদ্র বিধায়
রাতে তিনজন লোকের খাবার যোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায়। প্রায় মাঝরাতে ফেনা ওঠা গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা আর কোলই শাক ভাজি দিয়ে ভাত খেতে
দেয়। সেই খাবারই মাহমুদ হোসেনের কাছে অমৃতের মতো লাগে, সে থালার শেষ ভাতটি পর্যন্ত চেটেপুটে খা্য়। গৃহস্থের বাড়িতে মাহমুদ
সমবয়সী এক মেয়েকে দেখতে পায়, যে পাশের বাড়ির বৈঠকখানায় তাদের থাকার বন্দোবস্ত করে। মেয়েটির কথাবার্তা শুনে
মাহমুদ বুঝতে পারে, মেয়েটি লেখাপড়া জানে। মাহমুদ হোসেনের পুটলির দিকে তাকিয়ে মেয়েটি জানতে চায়, এর মধ্যে কী কিতাব আছে?
“আমি কিন্তু ঈশপের গল্প জানি!” মাহমুদ
হোসেন কূপির আলোয় দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকার উজ্জ্বল মুখখানার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। “এই পুটলির মধ্যে বই আছে, শ্লেট আছে, চক আছে। আমি তো বাড়ি থেকে পালিয়ে
ফরিদপুর যাইতেছি ইস্কুলে পড়ার জন্য”। “কী কন্! আপনার বাবা-মা মনে দুঃখ পাইব না?” মাহমুদ মুচকি হেসে বলে, “বাবাজান গেল বছর নৌকায় পড়ে
ইন্তেকাল করেছেন আর মা হয়তো আমার পড়াশোনার
কথা শুনে মনে মনে খুশিই হবেন”। কূপির আলোয় মেয়েটির কৃষ্ণাভ
চোখজোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করে, গালেও লালাভ চিহ্ন ফুঁটে ওঠে। মেয়েটি দ্রুত হাতে মাহমুদ ও ফল ব্যবসায়ীদের বিছানা করে দিয়ে
নিজেদের ঘরে চলে যায়! সারারাত মাহমুদ হোসেন টিনের
চালে শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ শুনতে থাকে,
মাঝে মাঝে বড়ই বা কোনো ফল
গাছ থেকে চালের উপর পড়ার শব্দ শোনা যায়। একরকম না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় মাহমুদ হোসেন। তার পাশেই হাঁটার ক্লান্তিতে ফল ব্যবসায়ীরা বেঘোরে নাক ডাকতে থাকে। একেবারে ফজরের অন্ধকারে ফল ব্যবসায়ীরা জেগে উঠে কাঁচাঘুম থেকে তাকে ডেকে তোলে। মাহমুদ চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে কোনোমতে তাদের পিছন পিছন চলতে শুরু করে। রাতের গ্রামটিকে মাহমুদের
কাছে আলেয়ার মতো মনে হয়। কুয়াশায় মোড়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে আল ধরে মাহমুদরা চলতে থাকে। ক্রমশ গ্রামটি ঝাপসা হয়ে
আসে আর মাহমুদ হোসেন রাতে দেখা
মেয়েটির চোখের আলো নিয়ে ফরিদপুরের পথ ধরে। গ্রামের পাশ দিয়ে হাঁটা পথ কতটুকু আগালো, মাহমুদ বুঝতে পারে না। এত পথ সে কোনোদিন হাঁটেনি। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের চামড়া
থেঁতলে যায়। নগ্ন পদে মাইলের পর মাইল চলতে চলতে মাহমুদ হোসেনের মনে হয়, পৃথিবীটা গোল আর তারই এক প্রান্ত থেকে কোমল নগ্ন পায়ে সে হেঁটে চলেছে অজানার পথে। এ পথ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, সে জানে না, কিন্তু যে পথ চলতে অনেক
ব্যথা পেতে হয় তার নিশ্চয়ই কোনো পরিণাম আছে। উহ্! একটা ছোট শামুক মাহমুদের বাম পায়ের পাতায় বিঁধে যায়। ফল ব্যবসায়ীরা পথের মধ্যে
কী করবে বুঝতে পারে না। ব্যথা বেড়ে গেলে পথ থেকে মাহমুদকে কোলে নিয়ে পাশের গ্রামের এক বাড়িতে যায়, সেখানে গরম পানি করে শন
দিয়ে টেনে পা থেকে শামুক বের করা হয়। অনেক রক্ত ঝরতে থাকে। ঐ বাড়ির বউ একটা মাটির
মালসায় করে কিছু কবিরাজি লতাপাতা ছেঁচে মাহমুদের পায়ে লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দেয়। এক ঘন্টার মতো বিশ্রাম নিয়ে
মাহমুদ খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফল ব্যবসায়ীদের সাথে আবার চলতে থাকে। ফল ব্যবসায়ীরা মাহমুদ
হোসেনকে অনুরোধ করে, একরাত ঐ বাড়িতে থেকে অন্য কোনো হাঁটুরের সাথে ফরিদপুর শহরে যেতে। কিন্তু মাহমুদ তাদেরকে
ছাড়তে রাজি হয় না, কষ্ট করেই তাদের সাথে চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দুজনের কাঁধে
ভর দিয়ে মাহমুদ ফরিদপুর শহরে এসে পৌঁছায়। ফরিদপুর শহরের একজন তরুণ
উকিলের ঠিকানা মাহমুদের হাতে। আনোয়ার উকিলের কাছে তার লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার অনুরোধ করে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন বারেক মাস্টার। এই চিঠিটাকে সম্বল করে
মাহমুদ গ্রামের দুজন ফল ব্যবসায়ীর সাথে ফরিদপুর শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, কিন্তু পথে দুর্ঘটনা ঘটাতে
তার মনটা দমে যায়। ফরিদপুর শহরের সারদা সুন্দরী গার্লস স্কুলের পাশেই আনোয়ার উকিলের বাড়ি। সহজেই মাহমুদরা উকিল সাহেবের
বৈঠকখানার সামনে উপস্থিত হয়। সেখানে পৌঁছে মাহমুদ হোসেনের বুক
দুরুদুরু করতে থাকে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসতে চায়, ফল ব্যবসায়ীরাও পথের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। উকিল সাহেবের মুহুরি সকলকে
বৈঠকখানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে আসতে বলে। বৈঠকখানায় লম্বা একটা
কারুকাজ করা কাঠের টেবিল, টেবিলের মাঝখানের কিছু অংশ সবুজ রঙের রেক্সিন দিয়ে মোড়া। দুপাশে টানা বেঞ্চি আর উকিল
সাহেব একটা সিংহের মুখের মতো হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে খুব সুন্দর একটা ফাউন্টেন পেন
দিয়ে লম্বা কাগজে কী সব লিখে চলেছে। মাহমুদ ঘরে ঢুকেই বলে ওঠে, “গুড মর্নিং স্যার!” উকিল সাহেব সোনালি ফ্রেমের
চশমার ফাঁক দিয়ে মাহমুদ হোসেনের চকচকে চোখের দিকে
তাকিয়ে চমকে ওঠে। মুহুরি সুযোগ পেয়ে বলে ওঠে, “উকিল সাহেব এরা আপনার কাছে আসছে, কিছু বলবে মনে হয়!” মাহমুদ
সামনে এগিয়ে যায়। উকিল সাহেব বলে, “এই ছেলে, তোমার নাম কি? খুব চমৎকার ইংরেজী উচ্চারণ!” “মাহমুদ হোসেন”। “বাহ্! খুব সুন্দর নাম। তা তোমরা সব কোথা থেকে?” ফল ব্যবসায়ীরা হাত কচলাতে
কচলাতে বলে,
“উকিল সাহেব আমরা আপনার গাঁ আদিতপুর থেকে আসছি। এই ছাওয়ালডারে আপনার হাতে
সঁপে দিতেছি,
এই যে চিঠি, বারেক মাস্টার সব বিস্তারিত
লেখছে”। আনোয়ার উকিল চশমার ভেতর থেকে খুব দ্রুত চিঠিটা
পড়ে নেয়। “তা তোমরাই কি ছেলেটাকে
এদ্দুর নিয়ে এলে?” ফল ব্যবসায়ীরা মাথা নিচু
করে থাকে। “যাক, খুব ভালো করেছ! ছওয়াবের কাজ করেছ!” আনোয়ার উকিল বলে, “বারেক মাস্টার যে চিঠি
দিয়েছেন তাতে জানলাম ছেলেটি ভীষণ মেধাবী। বৃত্তি পরীক্ষায় ফরিদপুরের মধ্যে প্রথম
হয়েছে, ওর দায়িত্ব আমি নিলাম”। মাহমুদ এতক্ষণ সবার মধ্যে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কথা শুনছিল, আনোয়ার উকিলের কথা শুনে ব্যথাসহ পা নিয়ে দৌড়ে এসে উকিল সাহেবের পা ধরে সালাম
করে। আনোয়ার উকিল মাহমুদকে বুকে টেনে নেয়। উপস্থিত সকলের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কোনো এক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে মাহমুদ ফরিদপুর শহরে পড়ালেখার
বন্দোবস্ত হওয়ার আশায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। আনোয়ার উকিলের তত্ত্বাবধানে
আসার পর থেকে মাহমুদের জীবন দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ফরিদপুর এতিমখানায় থাকার
ব্যবস্থা করে আনোয়ার উকিল মাহমুদকে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেয়। মাহমুদ হোসেনের স্মরণ শক্তি আর বিদ্যুৎ গতিতে
অংক করার প্রতিভা দেখে আনোয়ার উকিল মুগ্ধ হয়ে যায়, তার উপরে মাহমুদের ব্যবহার, কথা বলার স্টাইল দেখে আনোয়ার
উকিলের বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যায় যে, মাহমুদ এক অজ পাড়াগাঁ থেকে সদ্য এসেছে, যেখানে শুধু চারিদিকে বিল
আর বিল, এক হাঁটু কাদা পেরিয়ে স্কুলে যেতে
হয়। মাহমুদের চোখেমুখে অজানার প্রতি কৌতূহল। ছুটির দিনগুলোতে মাহমুদকে বাড়িতে
এনে ভালো-মন্দ খেতে দেয়। সে সময় মাহমুদ খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আসে, তার শরীর থেকে একটা অজানা
ফুলের গন্ধ আসতে থাকে। মাহমুদ সবসময় বৈঠকখানায় এসে চুপচাপ বসে থাকে। মুহুরি মাহমুদকে ঘরের ভেতর
নিয়ে গেলে আনোয়ার উকিলের স্ত্রী শিরিন আক্তার মাহমুদকে আদর করে বুকে টেনে নেয়, দস্তরখানা পেতে খেতে দেয়। শিরিন আক্তারের পিড়াপিড়ি সত্ত্বেও মাহমুদ খুব কম খাবার খেতো। আনোয়ার উকিল জানতে চায়, “মাহমুদ তুমি বড় হয়ে কী হতে
চাও?” মাহমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “স্যার আমি এ বিষয়ে এখনও
কিছু ভাবিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি
আপনার মতো আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়তে চাই, ব্যারিস্টার হতে চাই”। আনোয়ার উকিল শিরিন আক্তারের
দিকে তাকিয়ে বলে, “শিরিন দেখো, মাহমুদ ঠিক তাই হবে, আর না হলেও মস্ত কিছু হবে”।
মাহমুদের বাড়ির লোক, মা-ভাইরা খবর পেয়ে ফরিদপুর শহরে এসে মাহমুদকে দেখে অবাক হয়ে যায়। মাহমুদ স্কুলে রেকর্ড নম্বর
পেয়ে হৈ চৈ ফেলে দেয়। মেট্রিক পরীক্ষার পর আনোয়ার উকিলের পরামর্শে
ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হয়। তুখোড় ইংরেজী জানার কারণে সব ক্লাসে তার বেতন মওকুফ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ
করে মাহমুদ লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। মাহমুদ হোসেনের মা সুন্দরি
বেগম ছেলের লন্ডনে যাওয়ার জন্য ধার কর্জ করে অর্থ যোগাড় করে দেয়। লন্ডনে যাওয়ার পর মাহমুদ
হোসেনকে পকেট খরচ চালানোর জন্য কিছুদিন
কারখানায় কাজ করতে হয়। ব্যারিস্টারি ভর্তির সব প্রক্রিয়া যখন প্রায় সম্পন্ন, সে সময় শীতে মাহমুদ হোসেন
অত্যন্ত কাবু হয়ে পড়ে। ঠাণ্ডায় শরীর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধুদের সহায়তায় মাহমুদ
দিন চালাতে থাকে। কয়েক মাস অসুস্থ অবস্থায় কাটানোর সময় তার মনে হয়, আর বাঁচবে না,
ধানের নৌকা ছেড়ে এতোটা চড়াই-উৎড়াই পার হয়ে আসলেও শেষ রক্ষা
বোধহয় হলো না! মাকে চিঠি লেখে অসুস্থতার
খবর জানিয়ে। মাহমুদের মা ছেলেকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে যায়। লন্ডনের দুঃসহ আবহাওয়া ছেড়ে
শরীর বাঁচানোর আশায় মাহমুদ প্লেনে চড়ে ঢাকায় ফেরত আসে। ঢাকায় আসার পর সম্পূর্ণ
সুস্থ হয়ে ওঠে। ঢাকার মাটিতে পা রাখার সাথে
সাথে তার অসুখ ভালো হয়ে যায়,
মুখে রুচি ফিরে আসে। কিন্তু মনের মধ্যে
ব্যারিস্টারি পড়তে না পারার জন্য তীব্র কষ্ট হতে থাকে। দেশে মাহমুদ হোসেন নানা
উচ্চ পদে চাকরি করলেও তার মনে শৈশবের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কষ্ট রয়ে যায়। করাচী, রাওয়ালপিন্ডিতে মাহমুদ
হোসেনের উচ্চ পদ আর কোট-প্যান্টের সাজ-পোশাক দেখে অনেক পাঞ্জাবি পরিবার তার সাথে মেয়েদের বিয়ে
দিতে চান। কিন্তু মাহমুদ হোসেন
দীর্ঘদিন বিয়ে না করে সুটেড-বুটেড হয়ে সন্ধ্যার পার্টিগুলোতে যেতে থাকে। এক সময় পাকিস্তান সরকার
রাওয়ালপিন্ডি থেকে তাকে চট্রগ্রামে পোস্টিং দেয়। সেখানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকের সাথে
তার বন্ধুত্ব হয়। সে সময় মাহমুদ হোসেন ঘরে-বাইরে সর্বত্র পাকিস্তান সরকারের কড়া সমালোচনা করতে থাকে। অফিসে অনেকে তাকে সাবধান করলেও
মাহমুদ হোসেন কারো কথা শুনতো না এবং নিজের কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে যেত, কারো তোয়াক্কা করত না, ভয় পেতো না। চট্রগ্রাম কাব এবং অন্যান্য বৈঠকেও তার তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সকলকে উজ্জীবিত করত। ধর্ম সম্পর্কেও তার
বিশ্লেষণ অনেককে আকৃষ্ট করত। হিস্ট্রি অব সারাসিনস ছিল
তার নখদর্পণে। বিশ্ব ইতিহাস, বিপ্লবের ইতিহাস, দর্শন,
রাজনীতি, ধর্ম – মাহমুদের প্রিয় বিষয়। যুদ্ধের আগেই মাদারীপুরের
একজন উকিলের মেয়ের সাথে বিয়ে হয় মাহমুদ হোসেনের। মাহমুদ হোসেনের স্ত্রী
প্রথম দিকে তার চাল-চলন,
কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারত
না। একেক দিন একেক মুডে থাকে সে। কোনোদিন অফিস থেকে এসেই মোটা মোটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে দিতো, কারো সাথে কোনো কথাবার্তা নেই, কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর নেই; আবার পরের দিন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মশগুল, চায়ের পর চা। ইসলাম, ইহুদিজম,
খ্রীস্টানিজম, হিন্দুইজম, জায়নিজম, সুফিইজম, হু এ্যাম আই... কথা চলতেই থাকত। চায়ের পর ভাত, ভাতের পর চা, কফি চলতে থাকত রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত। মাহমুদ হোসেনকে যেন কথায় পেয়ে বসত, চোখে-মুখে আলোর ঝলকানি, হো হো হাসির শব্দ অনেকদূর
পর্যন্ত শোনা যেত। অনেক রাত হয়ে গেলে মাহমুদ হোসেনের স্ত্রী ঘুমে ঢুলতে থাকে, কিন্তু মাহমুদ হোসেনের যেন হুঁশ নাই। দিন দিন পড়ায় আরও মগ্ন হয়ে
পড়ে। যুদ্ধের মাঝামাঝি চাকরি ফেলে গ্রামে চলে যায়। তার বিপ্লবী সত্ত্বা দগ্ধ
হতে থাকে আর ফুঁসতে থাকে। যুদ্ধের পর ঢাকায় এসে নতুন
জীবন শুরু করে, কিন্তু ব্যারিস্টারি পড়তে না পারার দুঃখটা মনের মধ্যে আবার মাথা চাড়া
দিয়ে উঠলে মাহমুদ এলএল বি পড়তে শুরু করে এবং পরীক্ষায় প্রথম শ্রে্ণী পায়। কিন্তু আবার সংশয়। চাকরি ছেড়ে আইন পেশা আর শুরু করা হলো না। সরকারী চাকরিতে খুব দ্রুত
প্রমোশন হতে লাগল, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের নিয়ে জমকালো জীবন। কিন্তু মাহমুদ হোসেনের মনে
সারাক্ষণ একটা অস্থিরতা। সবাই, সব কিছুর সাথে থেকেও সে যেন
কোথাও নেই এমন অনুভূতি। একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা তাকে
মাঝে মাঝে গ্রাস করে ফেলত, তখন মাহমুদ হোসেন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত, মাইলের পর মাইল হাঁটত, বন্ধুদের কাছে যেত। সুফী-দরবেশদের আখড়ায়,
দার্শনিক আসরে, নাস্তিকদের বৈঠকে... কিন্তু কোথাও গিয়ে মাহমুদ
শান্তি পেতো না। তার মনের জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর সে কোথাও পেতো না। হু এ্যাম আই, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাব, কেন এলাম... সৃষ্টির রহস্য মাহমুদ
হোসেনকে পাগল করে ছাড়ত। বইয়ের পর বই, লাইব্রেরির পর লাইব্রেরি চষে ফেলতো মাহমুদ হোসেন। মাঝে মাঝে সন্তানদের মাঝে নিজের ছায়া খুঁজতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়তো মাহমুদ। নিজেকে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে পরিভ্রমণকারী আরব মুসাফিরের মতো মনে হতো।
২০০২ সালের ডিসেম্বর। প্রচণ্ড শীত। ঢাকা শহর কুয়াশায় মুড়ে আছে। লোকজন প্রয়োজন ছাড়া ঘরের
বাইরে যাচ্ছে না, সূর্যের মুখ দেখাই যাচ্ছে না। মাহমুদ হোসেন কয়েকদিন আগে
নতুন কোট বানিয়েছিল, কালো রঙের। পড়বে পড়বে করে আর পড়া হয়নি। ঐ দিন কী মনে করে সাদা
শার্ট দিয়ে কালো কোট, জুতো পায়ে ক্লিন্
শেভড হয়ে একেবারে সকাল নটার মধ্যে প্রস্তুত। সকালে স্কুলে যাবার সময়
মাহমুদ হোসেনকে চা দেবার সময় স্ত্রী দেখতে পায় মাহমুদ হোসেন পড়ায় নিমগ্ন। একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়। মেয়ে কলেজে যাবার জন্য
নাস্তা খাওয়ার সময় বাবার সাথে একটা-দুটো কথা হয়।
তারপর মাহমুদ হোসেন টেলিফোন
বিল দেয়ার জন্য যখন ঘর থেকে বের হয়, তখনও ছোট ছেলে-মেয়ে দুটি ঘুমিয়ে। বেরোবার পথে দোতলার আসমা পারভীন বলে, “বাহ! আপনাকে তো খুব সুন্দর লাগছে! পুরো সাহেবদের মতো!” মাহমুদ হোসেন মৃদু হেসে
বেরিয়ে পড়ে,
তারপর সমস্ত দিন নানা
জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ঝিকাতলা বাজারের এক দোকান থেকে ওষুধ কিনে ব্যাঙ্কে গিয়ে ফোনের বিল দেয়,
তারপর রায়ের বাজারের প্রিয় খালুর বাসায় যায়। সেখানে সারাদিন কথা বলতে
বলতে ক্লান্ত বোধ
করে, কিন্তু তাকে যেন কথায় পেয়ে বসেছিল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলেও করাচির জাকজমকপূর্ণ জীবনের গল্প
করতে থাকে। লন্ডনের সাদা বরফের গল্প, সাহেব-মেমদের গল্প। সেখান থেকে বেরিয়ে হামিদের কথা মনে পড়ে, হামিদের সাথে বহুদিন দেখা হয় না। তার বাসায় গিয়ে কিছু সময়
কাটায় মাহমুদ হোসেন। আর সেখানেই হঠাৎ বুকের বাম পাশে
চাপ চাপ ব্যথা অনুভব করে। হামিদ বলে, “সাথে ওষুধ নেই? খেয়ে নাও...!”
এনজিস্ট সবসময় পকেটে থাকে। লেবেল আটা ছোট কৌটোটা বের করে কয়েকটা সাদা ছোট
ট্যাবলেট হাতে ঢালে, আবার কী মনে করে কৌটোয় ভরে রেখে দেয়। হামিদ বলে, “কি মাহমুদ, খাইলা না?” “নাহ্ এখন মনে হচ্ছে ব্যথাটা
চলে গেছে। রাত তিনটা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখলাম, এজন্য মনে হয় একটু ক্লান্ত লাগছে”। তারপর হামিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছুদূর হাঁটার পর আবার ক্লান্ত লাগলে রিকশা নেয়। রিকশায় উঠেই অস্বস্তি লাগতে থাকে, বুকের ব্যথাটা বাড়তে থাকে। বাসার একদম কাছের মোড়ে চলে
এলে রিকশা থামাতে বলে। বুকে হাত দিয়ে রিকশাওয়ালাকে ধরতে চেষ্টা করে... রিকশাওয়ালা ধরতে ধরতে
মাহমুদ হোসেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রিকশাওয়ালা দ্রুত পাশের
সব্জির চৌকিতে তাকে শুইয়ে দেয়। চৌকির চারপাশে দু- চারজন লোক ভিড় করে দাঁড়ায়, চোখে-মুখে পানি ঢালতে থাকে,
মাহমুদ হোসেন অনেকটা নিথর
হয়ে পড়ে থাকে। রিকশাওয়ালা পকেট হাতড়ে ঠিকানা খুঁজতে গেলে একটা ছোট পকেট
ডায়রি পায় আর ফোনের বিলটা মাটিতে পড়ে যায়। লোকজন তাড়াতাড়ি ফোনের
দোকানে গিয়ে ফোন করতে থাকে, কিন্তু ঐ সময় মাহমুদ হোসেনের পরিবার একটা
অনুষ্ঠানে যাওয়াতে বাসায় গৃহকর্মী ছাড়া আর কেউ ছিল না। সে লোকজনের ফোনের কথা বুঝতে
না পেরে ফোন রেখে দেয়। রিকশাওয়ালা আর কোনো উপায় না দেখে আরেকজন পথচারীর সহায়তায়
তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে মাহমুদ হোসেনের বাম হাঁতটা একটু কেঁপে নিথর হয়ে
যায়। বাড়ির লোকজন খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যায়। হাসপাতালের করিডোরে মাহমুদ
হোসেনের নিথর শরীরটি পড়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রামের পথে শীতের সকালে
মাহমুদ যেমন করে একা কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে স্কুলে যেত, তেমনি তার শেষ যাত্রায়ও
শীতের নিঃস্তব্ধতা ছেয়ে থাকে। সকলের মাঝখানেও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে মাহমুদ হোসেন। উপস্থিত সকলে ঘটনার আকস্মিকতায়
এতটা বিমূঢ় হয়ে পড়ে যে, কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে যায়। শুধু তার কফিনের উপর কোথা
থেকে যেন দুটো চড়াই এসে বসে,
আর তাদের কফিন ঠোকরানের শব্দ শীতের রাতে একটানা শোনা যেতে থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন