মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

০১) খোরখে বুকাই


খোরখে বুকাই-এর গল্প
(অনুবাদ : জয়া চৌধুরী)

লেখক পরিচিতিঃ

১৯৪৯ সালে আর্জেন্টিনায় জন্ম হয় প্রথিতযশা লেখক খোরখে বুকাই-এর।  একজন সাইকো থেরাপিস্ট হিসাবে মানুষের মনের অন্ধিসন্ধি তাঁর নখদর্পণে। তাই তাঁর সৃষ্টির ভেতরেও এত অসাধারণ ভাবে মিশে থাকে সরলতা ও প্রজ্ঞা। তাঁর লেখা সম্পর্কে সমালোচকেরা দ্বিধাবিভক্ত। ওসভালদো কিরোগা বলেন,  তিনি একজন প্রাথমিক শ্রেণীর ও মাঝারি মাপের লেখক। বিপরীতে অন্যরা বলেন, এই কথাসাহিত্যিক মানুষের মুখের ভাষাকে ঝরঝরে ভাবে তাঁর  কলমের ডগায় আনেন। জীবনকে বোঝার জন্য, শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য,  তাঁদের চিন্তার আকাশ বাড়ানোর জন্যই তাঁর লেখা।  অত্যন্ত জনপ্রিয় এই লেখক বর্তমানে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেস শহরে থাকেন।



কীভাবে এগোনো যায়?
এক রাজা তার বাগানে গেলেন। সেখানে গিয়ে গাছগাছালি ঝোপঝাড় আর  ফুলগাছগুলো দেখলেন মর মর হয়ে আছে। ওক গাছ তাঁকে বলল যে, সে মারা যাচ্ছে, কেননা তার চেহারা পাইন গাছের মতো অত লম্বা নয়।
পাইন গাছের দিকে এগিয়ে গেলেন রাজা।
শেষমেশ তাকে খুঁজে পেলেন মাটিতে পড়ে আছে। কারণ সে আঙুর ক্ষেতের মতো আঙুর জন্ম দিতে পারে না।
আঙুর ক্ষেতে শুকিয়ে মরতে বসেছিল, কারণ সে গোলাপের মতো ফুটে উঠতে  পারে নি। গোলাপ কাঁদছিল, কেননা সে অতটা দীর্ঘাঙ্গী হতে পারে নি আর ওক গাছের মতো দৃঢ়ও নয়।
তারপর এক গাছালির সঙ্গে রাজামশাইয়ের দেখা। নাম তার ফ্রেসিয়া, ফুটে আছে এত বেশি শীতল যেন কখনো এর চেয়ে শীতল ছিল না। রাজা জিজ্ঞেস  করলেন, এই ছায়াছায়া শুকনো বাগানো তুমি এত সুন্দর স্বাস্থ্যবান হাসিখুশি  হয়ে ফুটে উঠলে কী করে ফ্রেসিয়া? –জানি না হুজুর! মনে হয় আমি    জানতাম যে, আপনি যখন আমাকে পুঁতেছিলেন, ফ্রেসিয়াকেই চেয়েছিলেন।  আপনি যদি ওক বা গোলাপকে চাইতেন তাহলে তাদেরই পুঁততেন। আর যখন আমায় পুঁতলেন মাটিতে আমি নিজেকে সেইদিন বলেছিলাম সবচেয়ে সুন্দর ফ্রেসিয়া হয়ে ফুটে উঠে আপনাকে দেখাবো রাজামশাই’। এইবার বিষয়টা  আপনার হাতে। এখানে আপনি আপনার নিজের সুগন্ধ ছড়াতেই তো এসেছেন!  নিজের দিকে আপনি একবার চেয়ে দেখুন, আপনি, আপনি না হয়ে যে অন্য কেউ হয়ে যাবেন, তারও তো কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি আনন্দ করুন।  আমাদের জন্য আপনার ভালোবাসা দিয়ে জল ঢালবেন, নাকি বাগানটাকে  নিজেদের ফাঁক ফোকর নিয়ে নিন্দে মন্দ দিয়ে আলুবোখরার চাটনি বানিয়ে তুলবেন, সেইটা ঠিক করুন!”  




উড়তে শেখার আনন্দ
যখন সে বড় হলো, ওর বাবা তাকে বলেছিলঃ
- বাবা, সব্বাই ডানা নিয়ে জন্মায় না। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে উড়তে পারা   তোমার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আমার মত হলো এই যে, যদি তুমি ঈশ্বরের  দেওয়া ডানার ব্যবহার না করো, তোমার পক্ষে হাঁটাটা খুব পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
- কিন্তু আমি তো উড়তে জানি না - ছেলে বলল।
- এসো! তার বাবা তাকে ডাকল। তারপরে তার হাত ধরে নিয়ে গেল হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের একেবারে চূড়োয়, খাদের কিনারে।
- দেখ বাবা, এই হলো শূন্যতা। যখন উড়তে চাইবে, তোমাকে তখন শুধু এখানে এসে থামতে হবে। প্রথমে একবুক শ্বাস টেনে নেবে, তারপর ঝাঁপ দেবে রসাতলে। বাতাসে একবার তোমার ডানা খুললেই তুমি উড়তে থাকবে...
ছেলে সন্দেহ করল। - আর আমি যদি পড়ে যাই?
- তুমি পড়ে গেলেও মরে যাবে না। শুধু সামান্য দু চারটে জায়গায় ছড়ে   যেতে পারে আর সেটা আসলে তোমাকে পরের বারের জন্য শক্তপোক্ত বানিয়ে দেবে।
ছেলে গ্রামে ফিরে গেল, তার বন্ধুদের কাছে। বান্ধবীর কাছে। তার সঙ্গী সাথীদের কাছে যাদের সঙ্গে জন্ম থেকে সে হেঁটেছে। যাদের মন ছোট, তারা বললঃ
-   তুই কি পাগল?
-   কেন?
-   তোর বাবা মজা করছে।
-   তুই উড়ে কী খুঁজতে যাবি?
-   আচ্ছা তুই ফালতু বকবক ছাড়তে পারিস না?
-   আর তার ওপর এইসব কী দরকার?
 অন্য সব ভালো ছেলেরা বলল,
-   এটা ঠিক হয়ে গেছে?
-   এটায় বিপদ হবে না তো?
-   আচ্ছা আসতে আসতে ব্যাপারটা শুরু করলে হয় না?
-   যাই হোক না কেন, একটা সিঁড়িতে উঠে নিচে ঝাঁপ দিস।
-   কিংবা গাছের শামিয়ানা থেকে। কিন্তু... এক্কেবারে মাঝ আকাশ থেকে কেন?
ছেলেটা যে যা বললো, সবার সব উপদেশ শুনলো। তারপর গাছের  মাথায় চড়ল, আর সাহস করে ঝাঁপ দিল... ওর ডানা ছড়িয়ে গেল।
সর্বশক্তি দিয়ে আকাশে নড়ল... কিন্তু একই ব্যাপার... মাটিতে ধপ করে পড়ল... বেশ বড় আলুর মতো ফোলা নিয়ে বাবার কাছে সে এলো।
-   তুমি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলে আমি উড়তে পারব না। আমি  চেষ্টা করেছিলাম। দেখ কী ব্যথা পেয়েছি আমি! আমি তোমার মতো  নই বাবা। আমার ডানা দুটো শুধু সাজিয়ে রাখার জন্য...! কাঁদতে কাঁদতে তার শিকনি বেরিয়ে গেল।
-   সোনাবাবা, উড়বার জন্য খোলা আকাশ চাই। ডানা দুটো যাতে ভালো করে মেলবার জায়গা পায়। এটা অনেকটা প্যারাশ্যুটের মতো... উড়বার  জন্য একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় যেতে হয়। উড়তে শিখতে হলে সব সময় ঝুঁকি নিতে হয়। কেউ যদি ঝুঁকি নিতে চায়, তাহলে সবচেয়ে ভালো হলো নিজেকে সমর্পণ করা। আর মহাজনেরা যা করে গেছে, সেইটাই  করে যাওয়া।




অনুসন্ধানী
এটা একজন মানুষের গল্প, আমি তাকে অনুসন্ধানী বলেই ডাকব।
একজন অনুসন্ধানী হলেন তিনি, যিনি সবসময় অন্বেষণ করে যান। এটা  জরুরী নয় যে তিনি সবসময় তা খুঁজেই পান। এমনও নয় যে তিনি জানেন তিনি কী খুঁজছেন। এই বিশেষণটা তাদেরই জন্য যাদের সারা জীবনটাই   অন্বেষণ।
একদিন সেই অনুসন্ধানী মানুষটি ভাবলেন, তাঁকে কাম্মির শহরে যেতে হবে। তিনি তো আগেই শিখেছেন যে ঐসব চেনা উৎস থেকে আসা অনুভূতিগুলোকে  কঠিন ও জটিল বিষয় হিসেবে ভেবে তোলার জন্য, আর তাই তিনি সব ছেড়ে চলে গেছিলেন। দুদিন হাঁটার পর তিনি কাম্মির শহরে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে  ধুলোমাখা পথটা দুই ভাগে ভাগ করে কোন্‌ সুদূরে চলে গিয়েছিল। গ্রামে  ঢোকার একটু আগে পথের ডানদিকে থাকা একটা পাহাড় তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করল। পাহাড়টা একটা দুর্দান্ত সবুজ আপহোলস্ট্রি দিয়ে মোড়া। সেখানে গাছের পাহাড়, পাখির পাহাড় আর সুন্দর সুন্দর ফুলগাছে ঢাকা। আর সেটার চারপাশটা সবুজ বনানী দিয়ে ঘেরা।... একটা ব্রোঞ্জের দরজা তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অনুসন্ধানী সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেন। তারপর ইতস্তত ছড়ানো  সাদা পাথর দেখতে পেলেন গাছের ফাঁকে ফাঁকে, যার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে  শুরু করলেন। তাঁর যে অনুসন্ধানীর চোখ দুটো, তা দিয়ে তিনি দেখতে থাকলেন। হয়তো সেই জন্যই আবিষ্কার করলেন, পাথরের ওপর খোদাই করা...আবেদুল তারে, ৮ বছর ৬ মাস, ২ সপ্তাহ, ৩ দিন। এটা দেখে তিনি চমকে  গেলেন যে, ওটা কোনো সাধারণ পাথর নয়। ওটা একটা সমাধিফলক। মনে   মনে ভেবে কষ্ট পেলেন যে, এত ছোট একটা ছেলে ওই জায়গায় সমাধিস্থ রয়েছে...! চারপাশটা দেখতে দেখতে লোকটার পাশের একটা পাথরের দিকে  চোখ পড়ল। সেখানেও খোদাই করা। কাছে এগিয়ে গেলেন কী লেখা আছে  দেখতে। কালিব নামের এই মানুষটি আয়ু ৫ বছর ৮ মাস, ৩ সপ্তাহ অনুসন্ধানীর খুব বিভ্রান্ত লাগতে লাগলো। এই সুন্দর জায়গাটি, এটা একটা কবরখানা, আর প্রতিটা পাথর এক একটা স্মারক। সবকটা একই রকম ভাবে খোদাই করা একটা নাম আর ঠিক কত বছর কত মাস কত দিন। সবাই কম সময় বেঁচেছে। সবচেয়ে বেশি সময় হলো বড়জোর ১১ বছর। খুব মনো কষ্টে তিনি বসে পড়লেন। ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কবরখানার প্রহরী সেখান দিয়ে যেতে যেতে তাঁকে কাঁদতে দেখে বৃদ্ধ হেসে উত্তর দিলেন - আপনি শান্ত হতে পারেন। কোনো খারাপ কিছু ঘটে নি।  আসলে এখানে একটা প্রাচীন প্রথা চালু আছে। আপনাকে বলছি - এখানে যখন কোনো ছেলে ১৫ বছর পূর্ণ করে, তার বাপ মা তাকে একটা নোটবই উপহার  দেন। এই যে আমারও একটা আছে, গলায় ঝুলছে। আমাদের মধ্যে প্রথা আছে  যে, প্রতিবার যখন কেউ কিছু বিষয়ে আনন্দ করে, তখন এই নোটবই খোলে  আর তাতে তা লিখে রাখে। বাঁদিকে লেখে কতটা সময় আনন্দ করেছে, আর ডান দিকে লেখে কী আনন্দ সে করেছে। সে কি তার প্রিয়তমার সঙ্গে  প্রথমবার দেখা হবার মুহূর্ত, নাকি তাকে ভালোবাসার মুহূর্ত? এই সাংঘাতিক  প্যাশনটা কত বার ছিল? নাকি তাকে চেনার আনন্দ? এক সপ্তাহ? তিন সপ্তাহ? ছয় মাস?... আর তারপর প্রথম চুমু খাবার মুহূর্ত? কতক্ষ ধরে  খেয়েছে সে চুমু? দেড় মিনিট? দু দি? এক সপ্তাহ? প্রথমবার স্ত্রীর গর্ভ  হবার আনন্দ, নাকি প্রথম ছেলে হবার আনন্দ? বন্ধুরা মিলে ভীষ চাওয়ার  এক ভ্রমণ? এইসব মুহূর্তগুলো কতক্ষ স্থায়ী ছিলো? ঘন্টাভর? দিনের পর দিন? এইভাবে আমরা খাতায় লিখে রাখি। যখন কেউ মারা যায়, আমাদের   ঠিক উলটো রীতি। আমরা নোটবইটা খুলি। সময়গুলো যোগ করি। তারপর তার সমাধির ওপরে লিখে রাখি। তার বেচে থাকার ওটাই তো মোট পরিমা

--------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন