মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

০১) অর্ক চট্টোপাধ্যায়


টয় দ্য লেট : চিচিং ফাঁক এবং অটোমেটিক থিঙ্কিং 


এদেশে কর্পোরেট বিল্ডিংয়ের দরজাগুলো উইনিভার্সিটিতে চালান হয়ে গেছে। ইংরেজিতে  যারে কয় অটোমেটিক ডোরস, ঠিক যেন অটোমেটিক থিঙ্কিং-- কাছে আসলে আপনা আপনি খুলে যায় আর দূরে গেলে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। এই খোলা বন্ধ হতে থাকা দরজাগুলো দেখলেই কিংশুকের মন কেমন করে ওঠে। মনের কেমনটাকে খুলে পড়তে শুরু করলে সে অটোমেটিক ডোরস আর অটোমেটিক থিঙ্কিংয়ের ভেতর একটা জরুরী ফারাক করতে পারে। প্রথমটায় দরজাগুলো কাছে আসলে খুলে যায় আর দূরে গেলে বন্ধ হয় আর দ্বিতীয়টায় ঠিক তার উল্টোটা হয় আর কি! মনের ভেতর তড়িঘড়ি ভাবতে বসলে দরজাগুলো কাছে আসলে বন্ধ হয়ে যায় আর একটু তফাৎ গেলেই ইনগ্রিড বার্গম্যানের আলগা পাউটের মতো আলতো করে খুলে যায়বিলিতি বিশ্ব-বিদ্যার আলয়ে কিংশুক এখন থিসিস লিখে ভালোবাসে আর গল্প লিখে বেঁচে থাকে। দরজাগুলো খোলা-বন্ধ করতে থাকে ভেতর-বাইরে। কাচের ওপর দিন ফোটে, তারপর একদিন রাত নেমে আসে। প্রথম প্রথম দরজার কাচে নিজেকে ফিটফাট দেখে নেওয়া কিংশুক ক্রমেই কাচের ভেতর দিয়ে ওইপাশটা দেখতে শুরু করে। কাচে আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিসরণের মুহূর্তগুলোয়  নিজেকে ফাঁপা লাগে। আর একটু কাছে এলেই খুলে যায় বলে নিজেকে ভালো করে দেখে নেবার আগেই দরজার পার্টিশন অদৃশ্য হয়ে তাকে  ভেতর থেকে বাইরে বা বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকার আবদার জানায়। 

তার থেকে বরং বাথরুমের দরজাগুলো বেটার। সেগুলোকে ঠ্যালা মারতে হয় আর সাধারণভাবে সেগুলো কাচের হয় না বলে আয়নার ভনিতা থাকে নাএদেশে বাথরুমের আবার দুখান দরজা। একটা থেকে আরেকটায় যেতে গিয়ে ডাবল ঠ্যালা মারার সময় ভাবনা চিন্তার কথা মনে পড়ে। সেখানেও তো প্রায়ই একটা নয়, দু-দুটো ঠ্যালা মারতে হয় আর একটা দরজা খুলে ফেললে আরেকটা বন্ধ দরজার দেখা মেলে। সেদিন দ্বিতীয় দরজাটা খুলে বাথরুমে ঢুকতেই কিংশুক একটা অন্যরকম দৃশ্য দেখতে পেলো। উইনি লাইব্রেরীর এই বাথরুমটায় দেওয়ালে আটকানো  দুইখান ইউরিনাল। একটা একটু বেশি নিচু যেটা হয় বেঁটে নয়তো বাচ্চা মানুষদের জন্য আর আরেকটা যাকে বলে স্ট্যান্ডার্ড উচ্চতায়। আর এই দ্বিতীয় ইউরিনাল যা কিংশুকের উচ্চতায় মানানসই সেখানে একটা সাদা কাগজে ছাপা হরফে লেখা: OUT OF ORDER. PLEASE DO NOT ENTERকাগজটা সাদা প্যানের ভেতর সাঁটিয়ে দিয়ে গেছে  কে বা কারা!  এটা স্রেফ একটা খিল্লি অর্থাৎ কাগজটা কোনো ঘরের দরজা থেকে এনে এখানে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, নাকি সত্যি সত্যিই দ্য উইরিনাল ইজ আউট অফ অর্ডার এটা  কিংশুক ঠিক ভেবে পেলো না। এছাড়াও এন্টার শব্দটার অতিকায় ভার নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে ছ্যারছ্যার করে ওই কাগজের ওপরেই হিসি করে দিলো। কিন্তু একি আর মার্কার পেনে লেখা যে হিসি করলে মুছে যাবে? মুদ্রণ গেঁড়ে বসে রইলো খালি কিংশুকের চোখে মনে হলো 'ORDER' আর 'ENTER' শব্দদুটো যেন একটু ফিকে হয়ে গেছে 

যাক, ব্লাডারের আবেগ প্রকাশ করে কিংশুক বইপত্তর সহ নিজের অফিস বিল্ডিং-এর  সামনে এসে দাঁড়াতেই অটোমেটিক ডোর তাকে স্বাগত জানালো। সে দরজা পেরিয়ে বিল্ডিংয়ে ঢুকে একহাতে বইগুলো নিয়ে অন্য হাতে কব্জি ঘুরিয়ে সময়টা দেখে নিলো।  সন্ধ্যা ৬-৪৫ তার মানে আর ১৫ মিনিট বাদে দরজাগুলো আপনা আপনি লক হয়ে  যাবে। তখন পাশের সবুজ বোতাম টিপে খোলা বন্ধ করতে হবে। কিংশুকের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলতেই সে দরজাটার এক্কেবারে কাছে ধর্ণা দেবার মতো করে বসে  পড়লো আর কলেজ রাজনীতির ব্যারিকিংয়ের স্মৃতি উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো  এধার ওধার থেকে। কিংশুক বসে বসে বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলো মিইয়ে আসা আলোয়। বিল্ডিংয়ে এখন সে ছাড়া আর কেউ নেই। আর তার নৈকট্যের খেসারত হিসেবে দরজাটা ক্রমাগত খুলতে লাগলো আর বন্ধ হতে লাগলো। খুললো আর বন্ধ হলো। বন্ধ হতে না হতেই খুলে গেলো আর খুলতে না খুলতেই বন্ধ। কিংশুক ভাবতে লাগলো সন্ধ্যা সাতটার সময় দরজাটা কি খোলা অবস্থায় থামবে নাকি বন্ধ অবস্থায়? নাকি ইনগ্রিড বার্গম্যানের পাউটের মতো আধ-বোজা হয়ে থাকবে? নিরাপত্তার  মাকড়জালের এই সূক্ষ্ম ফাঁকটুকুর কথা ভেবে নিয়ে বিপ্লবী কিংশুক থিসিস আর গল্পের  দরজাগুলোর কথা ভাবতে শুরু করলসাতটা বাজতে তখনও মিনিট দশেক বাকি।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন