মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

০৫) সুবীর সরকার



সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত



আবহমান

বদলে যাওয়া নদী কিংবা বদলানো নদীখাত সংযোগসূত্র হিসাবে যুক্ত হতে পারে, সংযুক্তির অধঃক্ষেপটুকু দোলাচলে থেকে যায়; এমনটা হয়, হতে থাকে, তবু আকাশের  নেমে আসা নদীবুকে আশ্চর্য এক সুবর্ণ ক্যানভাস। নদীখাতের উর্বরতায় পলিসঞ্চিত শস্যহিন্দোল নদী, নদী দিয়ে বয়ে যাওয়া আবহমানের ইতিহাস হয়ে কিংবা ইতিহাসের  গর্ভ থেকে নতুনতর নবীকৃত স্তরে স্তরে সাজানো আঞ্চলিকতায় ডুবে যেতে চায়। খাত বদলানো নদী হাট ঘাট বদলে দেয়। মানুষের চলাচল থেকে জেগে ওঠা চরাঞ্চল আদি ও অন্তের অদ্ভূত এক সহাবস্থানই রচিত হয় হয়তো। গোপন গানের মতো নিজস্ব মন্ত্রের মতো গতিহীন হয়ে যাওয়া না যাওয়ার প্রাসঙ্গিকতায় আলোআধাঁরি কুয়াশাকুহক কেটে হেঁটে যেতে থাকে খুটুরাম প্রধানী আব্রাহাম মিনজ এতোয়ারী এক্কা জঙ্গলে পাতা কুড়োতে থাকা পুষনী রাভার দল। এক খাত ছেড়ে নতুনতর সদ্যরচিত নদীখাতে নাব্যতায় দাঁড়িয়ে অপলক দেখে যাওয়া নতুন নতুন জনপদ চা-খেত গরু মোষ হাঁস মুরগি উঠোনের কইতর এত সবের সাবলীল গার্হস্থ্য যাপনচিত্র। ছবির মধ্য দিয়ে হাসি হুল্লোড় ও শব্দাবলী গড়িয়ে নামে, স্থিরতর না হতে পেরে দৈনন্দিনতায় মিলিয়ে যায়। রহস্যমতার বিন্যাসটুকু জমে যাওয়ার অবকাশই হয়তো পায় না, কেবল সর্টকাটে ঝাড় ঝোপ জঙ্গল পেরোয়। নদীর ব্যপ্ততার গড়ানে আবশ্যিক এক ভবিতব্যের অমোঘ সম্ভাবনা স্ফূরিত হতে থাকলেও নদীর দু’পাশে তাল নারকেল সুপারীর অন্তরঙ্গতায় জনপদটাই প্রাধান্য পেয়ে যেতে থাকে। এরকমভাবে হয় না, হবে না জেনেও  সাহেববাড়ির প্রাচীনতায় প্রবীণ কোনো গ্রন্থের মতো জাপটে ধরতে চায়। অথবা মাইল  মাইল বেত বাঁশবন থেকে অপ্রাকৃত সব সুর ও স্বর ধেয়ে আসতে চায় সম্ভাবনাকে  উস্কে দিতে চেয়ে। সমূহতার ধারাবর্ষণে যুক্ত হতে গিয়ে শেষপর্যন্ত বদলে যাওয়া নদীখাতগুলিই অনিবার্য হয়ে জেগে থাকে দূরবর্তীতায় চেয়ে থেকে থেকে।


গামছাবান্ধা দই

কান্না কি গানের মতো! মহিষের দুলুনি সওয়ারী চালের বিষণ্ণ এক গান অনেক অনেক গানটুকরোর ছড়িয়ে পড়া চারপাশের নৈঃশব্দে। নিশি পাওয়া ভূতগ্রস্থ মতো গান প্রসারিত হয়, আবর্তিত হয়, পাক খায় আর ধুলো ওড়াতে ওড়াতে প্রবল ঢুকে পড়ে জমজমাট হাটের বৃত্তে। হেরম্ব দাঁড়িয়ে থাকে সবজিহাটা ও গরুহাটির সংযোগরেখায়। তার সাথে খুটুরাম প্রধানীর দেখা হয়। খানিক কথাবার্তা, মুচকি হাসির বিনিময়ও  হয়। বিনিময়পর্ব সমাপ্তির আগেই ঘটনাস্থলে দলবল সহ এসে পড়ে খড়ম জোতদার,   তার অতিকায় মাথা কচুপাতের মাথাল কাঁঠালকাঠের সর্পমুখী জোড়া খড়ম সমেত। এখন জোতদারী নেই, তবু খড়ম জোতদারের জোতজমি ও পঞ্চায়েতি আছে। আছে  কুষাণ লোকগানের দল। হাটগুলোতে জনসংযোগ, লোকসংস্কৃতি ও বিনোদন সবই একযোগে সেরে নেওয়া যায়। দোতারার ডোল ডোল ডোল ডং সুরটুকু আবহবিস্তারকারী উপকরণ হয়ে তীব্রভাবে থেকে যায় গোটা হাটেই; কুশাণের সুর ভাসে, হাটকে জড়িয়ে রাখে, জমজমাটও! এভাবে হাটে হাটে আলোড়ন জাগে। হাটের শ্রেণীচরিত্র বিভাজিত হতে গিয়েও নতুন এক কার্যকারণের পাকেচক্রে অস্থির প্রতিপন্ন হয়, হয়ে পড়ে। হাটের পাশে হাট। হাটের মধ্যে কত রকমের হাট! সবজিহাটির  কোণাকুণি হেরম্ব ও খুটুরাম দাঁড়িয়ে থাকতে না চাইলেও ঘটনাক্রমের প্রাসঙ্গিকতায়   তাদেরকে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়, যতক্ষণ না জলধোয়া বসুনিয়া গামছাবান্ধা দই শালিধানের চিড়া নদীখাতের খই নিয়ে হাজির না হয়। বিকেলের আকাশ সমস্ত প্রাকৃত রঙ মুছে ফেলতে ফেলতে সমূহ সম্ভাবনার সম্ভাব্যতায় অপরূপ নশ্বরতাময় সকরুণ এক দিনাবসান চিরকালীন জলছবির মহার্ঘ ও সংরক্ষণযোগ্য এক স্মৃতিজাগানিয়া মহাজগৎকথার আলিসায় হাটের বিষাদের পরতে পরতে গানের মতো মহামহিম হয়ে উঠতে থাকে।

হাটের নির্মাণ ও বিনির্মাণ

সব হাটই কি একই রকম! বর্ণ গন্ধ রূপ রস আলাদা আলাদা হলেও আসলে একেক হাট একেক রকম। কিছু কিছু বড় গাঙ অতিক্রম করে যেতে হয়। অথবা বড় বড় নদী ঘেরা সেই সব হাট। ছোট নদী বাঁশের সাঁকোই ডিঙিয়েও কোনো কো্নো হাট।  চা-বাগান বনাঞ্চল চরাঞ্চল সর্বত্রই হাট আর হাট। আবার পাট তামাকের নির্দিষ্ট হাট ভাঙতেই, সবজিহাটা বসে যায়। সবজিহাটা দুপুর গড়িয়ে বিকেল অব্দি চললেও সন্ধ্যেবেলাগুলি অবশ্যই গরু ছাগল হাঁস মুরগির। দোদুল্যমানতার ফোঁকড়ে অসামান্যে এক নিশ্চিন্ততায় নির্দিষ্ট গন্তব্যহীন মহাজীবনের দোলায় দূরন্ততর গতিময় রংবেরং মানুষেরা হেঁটে যেতে থাকে। তখন নাথুয়ার হাটে মথুরার হাটে আব্রাহাম কিসকু মোহন দেউনিয়া হাড়িয়ার তালে ধামসা মাদলের বোলে সুনিশ্চিত নাচতে থাকে, গাইতে থাকে গান_ ‘হাওয়া লাগাই দে/সাইয়া হাওয়া লাগাই দে’। নাচগানের সমস্বরে অপার্থিব এক জীবন তার যাবতীয় আহ্বান আমন্ত্রণ মেলে ধরে, ছড়িয়ে দেয় দিক ও দিগরের অথৈ শূন্যতায়। জড়িবুটি বিক্রি করতে এসে হাড়িয়াহাটার দিকে আকুলি বিকুলি এক হাঁটা   শুরু করে নাথুরাম পাইকার। হাঁটাটা একসময় মান্যতা পেয়ে যায় জাড্য ভেঙ্গে ফেলে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে যখন একে একে জড়ো হয় বিলপুক নার্জিনারি, খোকা বর্মন, মন্দাদর মল্লিক, জার্মান রাভার দল। হাট থাকবে হাট গড়াবে, হাট হাটেরই বৃহত্তর সীমানাপ্রহর টপকে অন্যরকম হাটবাজার নির্মাণ বিনির্মাণ করবে না, এটা তো হতে  পারে না! যে কোনো হাট থেকে গান ভেসে আসতে পারে। গানের পর গান। গানের  পিঠে গান। গানের ভিতর গান। গানের মন্দমন্থরতায় সুর তাল লহরের খুব গহন থেকে জীবনের সব বিচিত্রতর নকসা গাঁথা তত্বমোড়কে হাজির হতে থাকে। যে কোনো  হাটেই এমনটা হয়, হতে পারেসে নাথুয়া হোক মরিচবাড়ি হোক গোঁসাইহাট হোক, টাকোয়ামারি নিশিগঞ্জ ভবেরটাড়ি প্রেমচাঁদ যে কোনো হাটেই। সব হাটই কি একই রকম!  
   
         
(চলবে)

1 টি মন্তব্য:

  1. ‘কান্না কি গানের মতো! মহিষের দুলুনি সওয়ারী চালের বিষণ্ণ এক গান অনেক অনেক গানটুকরোর ছড়িয়ে পড়া চারপাশের নৈঃশব্দে। নিশি পাওয়া ভূতগ্রস্থ মতো গান প্রসারিত হয়, আবর্তিত হয়, পাক খায় আর ধুলো ওড়াতে ওড়াতে প্রবল ঢুকে পড়ে জমজমাট হাটের বৃত্তে।’

    উত্তরমুছুন