দিলীপ ফৌজদার
রণ-পা
(উৎসর্গ : শ্রীসমীর রায়চৌধুরী)
(১)
চনমনে ছুটন্ত ঘোড়াদের বলীয়ান ছবিতে,
ঘাসের গল্পে বর্ষাকাল যেমন সবুজ, মেদুর
তেমনিই শীত ফুরিয়ে এলে গ্রীষ্ম যেন রোষ।
ঘাসবন শুকিয়ে আসার বিষাদ আর
তৃষ্ণাকাতর পাখিদের উদ্ভ্রান্ত ওড়াউড়ি
এমন একটা সময়ও ফিকে
নিস্তরঙ্গ বৃদ্ধাদের ক্যাটকেটে রাঙা শাড়ির রোদহাঁটায়
বা জগঝম্প ব্যাণ্ডবাজনার হাটখোলা কলরবে।
ঘাসের সঙ্গে মিশে মিলিয়ে থাকা ঘাসবীজ
ছেঁড়া বৃদ্ধাদের নীরবতার সঙ্গে ঘর করে নিরবধিকাল
বলীয়ান অস্তিত্বের এই চনমনে দৈনন্দিনতা
মোছে না – দলিত শব্দের, রং-এর, প্রবল বেমানানকে
মানিয়ে নিয়ে।
(২)
ঘোড়াদের চনমনে কথার মাঝখানে
খোঁড়া ঘোড়াদের বেরসিক কথা কেউ ওঠালে
একে একে আড্ডার জোড়নগুলি খুলে খুলে
ক্ষণিক ছুটির যা-মন-তাই, দু’দণ্ড এলোপাথাড়ি
শব্দ ছোঁড়াছুঁড়ি
নেমে এসে মিশে যায় জ্যাম লাগা অপার রাস্তায়
রাস্তা ভালো। যতক্ষণ দৌড়।
যানবাহনের রাস্তা চাকার মেজাজে ভালো
আরো ভালো হয়ে উঠছে। দিন দিন
ত্বরা ত্বরা ব্যস্ততার ছটফটে জীন্স টপ্স
লড়াকু লড়াকু জুতো
সাবলীল মেট্রো বাস্-এ।
কাচ অবরোধের ওপারে
ফুলগুলি ফুটে থাকলে চোখ চলে যায়
অজান্তেই। অবসরের ঘাসফুলও ফুটে থাকলে
দৃষ্টি বেশি নোয়াতে হয় না।
এইসব মগ্নতা কাড়ার আয়োজনগুলি
ফেলনা নয় যুদ্ধ মাঠে।
(৩)
সর্বত্রই বন্যা হচ্ছে। মেঘভাঙা প্রবলতা
তার সঙ্গে জলের দৌরাত্মি -
এটা কি সংবাদ!
যার ভেতরে সকলেই আছি
এই যে এই নিয়ে কাগজে বা পর্দায়
ঘ্যানর প্যানর সর্বক্ষণ আর
খরা বা বন্যাকে নিয়ে একই রকমের সেই
হীনযান কথকতা
কি লিখছে আদিখ্যেতার বাচালেরা!
কি বলছে অস্পষ্ট দেখা
প্রকৃতির বিরূপতা নিয়ে!
যে খবর উড়ে আসে ঈথারে ভাসতে ভাসতে
যে সব খবর শুধু ফটো
শুধু কথা সে খবর
যোগসূত্রহীন মানুষের জন্য
আমোদের জানাজানি
(৪)
থাকার কথার ওপরে না থাকার এই কথাগুলো
উড়ে এসে জুড়ে বসছে।
কে কীভাবে দ্যাখে! আরাম খুঁজতে খুঁজতে
হাওয়ার নিরপেক্ষতা কুঁকড়ে যায়,
জলের বদলে চিনিসোডার সরবতে বিকৃতি
নজর এড়ায় না,
যে বিকৃতিগুলি স্বরচিত ছবিগান
সম্মানে কবিতাও বা।
কবিদের অন্ধকার ঝলমলেপনা, পতঙ্গ উড়ান
বা ধরো আরবান যাপন, দারিদ্রে অথবা বৈভবেও
টানেলের নির্দেশ
যেরকম কম্পূটারে আছি-নেই-আছি-নেই পথ
বেয়ে বেয়ে গন্তব্যে পোঁছানো
ঝিঁঝিঁধরা ঘরানার কলাসংগঠনে নামখোদাই
(৫)
কাচদেওয়াল--
কাচদেওয়াল বাধা দেয় না
দৃষ্টি চলে যায় অন্য পারে
এপারে গ্রীষ্মের শীত শীত কিম্বা
শীতকালীন উষ্ণ আবাহন
বাইরের রোদহাওয়া বা তাদের
মেজাজকে না বুঝেই কল্পলোক
আপন মেজাজে বোনে - বুনে যায়
যাবতীয় প্রয়োজন-বিনোদন-
অভিনন্দনের নান্দনিক প্রকল্প ও গল্পগাথাদের
কেউ ভেঙে বেরোবে না
ঐভাবেই সত্যতা যাচাই এবং আস্বাদন ও
ঐভাবেই দারিদ্র্য এবং খুশহালির
মাপকাঠি
ঐভাবেই গড়া হচ্ছে সবকটি
মুশকিল আসান সফটওয়্যার
(৬)
তাও এই কাচ দেওয়াল বাধা
যেটা কেউ দেখে না
সে সময় সকলে ওপার দেখে
সেই রকমেরই বার্তা তরল স্ফটিকে ফোটে
যা থেকে সত্বর ছোটাছুটি
সময় ও টেলিফোন এবং সংবাদ যন্ত্রগুলি
ক্রমশই ছোট ছোটতর
এইমতো সঙ্কোচে পীড়ায়
একদিন
যেদিন হিংস্র প্রতিবাদে মুক্তি চাইবে
অদৃশ্য দেওয়ালগুলি
সেইদিন যেদিন সময়
আপনা আপনিই এসে সব কাচ ভেঙ্গে দেবে
হাওয়া চাইতে তাপ চাইতে
(৭)
সমস্ত খবর ইন্টারনেট থেকে পাওয়া যায়
তাতে চেপে চাঁদে যাওয়া, মঙ্গলগ্রহেও। এইসব
পরম সত্যকে টপকে ল্যণ্ডিং দুর্গম হেলিপ্যাডে
নিরিবিলি। ঘাস, ঝোপ, স্রোত, গুল্ম,
ক্বচিৎ পাখি বা সরীসৃপ
ওদের দেখতে না এসেও দেখা হয়ে যায়
ক্যামেরার ঢাকনা খুলতে
মন চায় না
দেখাগুলি অন্যকে দেখালে
কতটুকু পৌঁছায় সেখানে
কবিতা আমার মতো কবিতা তোমার মতো
সুতোগুলি অদৃশ্য থাকারই কথা ছিল
কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিশ্বপৃথিবীর পরিস্থিতি
পরিবেশ বায়ু মাটি জল।
তোমার আমার সূতো
তাও
(৮)
পাথরের ভেতর থেকে স্ফটিক কণার আলোরা
যেরকম বেরিয়ে আসতে চায়
পাতার ভেতর থেকে সেলুলোজ শিরাদের
জীর্ণ প্রয়াসে যেরকম স্কেচ
কিম্বা প্রজাপতি যেরকম
জীবন্ত উড্ডীন পাখা বাতাসে ভাসিয়ে
আলো বিকীরণ করতে করতে
কোথা চলে যায়
কেউ বা কিছুই কারো
ধরা থাকে না
বদলে বদলে এইরকমই খেলা নিরন্তর
খেলার ভেতরে বেঁচে থাকার এ অদ্ভুত প্রক্রিয়া
কীভাবে কীভাবেই যে আসে যায়
এই অস্পষ্টতাকেও
স্পষ্টতার কোনো এক ভেজা ন্যাকড়া
মুছতে চলে আসে
অনর্গল এই দ্বন্দে স্বচ্ছন্দ বেলুনগুলি ওড়ে
(৯)
সেখানে বিদ্ধ পাখিরা প্রার্থনায় বসে
জরদ্গব, গড়ুর ও গড়ুরপুত্র জটায়ু, এমন কি
ফিনিক্স এবং ইউনিকর্ন
সকলে সর্বতোভাবে বিস্মৃতির অতল
কবল থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠা
যেন কত বিশ্বাসী বা যুদ্ধবাজ কিম্বা
যেন কোথাও ঘুমিয়ে আছে রাজত্ব ও রাজকন্যা
শতাব্দীকালের
গণতন্ত্রে আরো কটা বছর জুড়বে এই ভেবে
জানে না যে গল্প্ কবে শেষ হয়ে গেছে
সে গল্পদের মিথ্ কণারাও এতদিনে
উবে গেছে হাওয়ায় হাওয়ায়
এখনো সকলে রূপকথা ভাবে
এখনো সকলে ভাবে
প্রাসাদের আড়াল আরাম আচ্ছাদন দেওয়া
দিন আসবে দিন
কল্পনা ও স্মৃতি মিলে গড়ে নেয়
দিবাস্বপ্ন
যুদ্ধ, গোলাগুলি, রক্তপাত নয়
রাজত্ব দখল হয় পণ্য বেচা কেনার শিক্ষায়
কিছু কিছু পরিবর্তনের অঙ্গীকারে
কিছু, বাকীটুকু,
ছেড়ে রাখা অঙ্গীকারে পরিবর্তনের কথামুখ
খোলা খামে ঢেকে রাখে সুযোগের মহরতে
(১০)
এইভাবেই জাতক গল্পের সরলতা
উঠে আসে ঝকঝকে মন কাড়া
মলাটের অভয় সোফায়
ছবিতে ছবিতে গল্পগুলি ক্রমাগত ছুঁড়ে যাওয়া
হাওয়া একটু নড়ে ওঠে তারপরেই
মাথার ভেতরে প্রশান্তির কাতরতা
কাক ছবি বক ছবি কুমীর বা বাঘেদের মতো
যারা ঠিক ছবি হয়ে যায়নি এখনো
তারা সকলেই
ডোডোদের পিছনে দাঁড়িয়ে
অপেক্ষার স্লো মোশনে
(১১)
আস্তীর্ণ সৈকত ত্রস্ত বুক
একটুও কোথাও কোনো
দেওয়াল আড়াল নেই,
জড়োসড়ো
ঝড় আসছে ঝড়
বালির চত্ত্বরে কেউ দুদ্দাড় বুলিয়ে গেছে
হাওয়ার চিরুনি
পায়ের আওয়াজ নেই তবুও সকলে জানে
আঘাতের প্রাবল্য ও দিনক্ষণ
এ এক নতুন খেলা
কিসে যে কি হয় সেটা জানো কিংবা জানোও না।
গতি জানো? চেহারা? নিয়ম? ক্ষণ?
কিচ্ছুটিও জানা নেই! – আবহাওয়া দপ্তরে
বিশাল বিশাল পর্দা দিনরাত খেলে যাচ্ছে
মেঘ বৃষ্টি রোদ
তাদের কোনোটা খেলছে শতেক যোজন দূরে
কেউ খেলছে কাছাকাছি
পর্দাময় তরলতা এবং এগিয়ে আসা
রোমাঞ্চ সিরিজ
ও এমনি দম ধরে বসে থাকা
(১২)
সকলেই যুদ্ধ চাইছে পতঙ্গেরা যেরকম
আলো দেখে আগুন দেখে না
তেমনি অযাচিত এই চাওয়াগুলি
কবে যে লেখাবে নাম প্রাপ্তবয়স্কদের খাতায়!
প্রৌঢ়ত্ব না পেলে
জানবে না খেলার অপর পরিণাম।
যুদ্ধে যদি একান্তই জড়িয়ে পড়তে হয়
আগে ভাগে জেনে নেওয়া ভালো সেটা
কার সঙ্গে কার
ক্ষেতের ফলন বাড়ছে
বহমান নদীরা শুকিয়ে আসছে
নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কত কন্যাভ্রুণ
কত মাথা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন
এইসব অঘটনে হাতে তুলে গড়া সব
নিহিত পদ্ধতি ভেবে দেখতে কেউ আর
পাতা উলটে ঘাঁটতে ঘাঁটাতে চায় না।
(১৩)
আজও কত সরল পাপীতাপীরা পুত্রকামনায়
তীর্থ দর্শনে যায়
যে সৈকত একদিনে ধুয়ে গেল সুনামিতে
সে তীর্থে সকল রৌপ্যবালি ও গীর্জাকে ঘিরে মেলা
বারোমাস এই চলা ট্রেকার লিমুওসিন পাশাপাশি
পাশাপাশি বিছানায় তুই আপনি সকলেই
আপন আপন
এই তীর্থ বিদ্ধ্বস্ত বিভ্রান্ত হয়ে
মাটিতে মিলিয়ে যায় তারপরেও
অনেক বছর গেলে ফিরে এসে আপন অনুপস্থিতি
সোচ্চার জানায়
ফিরে আসে মর্কট ও অঘোরী বিবাগী
ফেরে গাঁজা ও হাশিস
(১৪)
জলের তলার নুড়ি আর্গনের রোশনিতে খুলে যায়
আরো যেন বেড়ে ওঠে লোভাতুর মাছেদের
সাঁতার ও রেষারেষি, অসফল বিবাহ প্রস্তাব
মানুষ ও মানুষীরা চিহ্নগুলি ধুয়ে ফেলে স্রোতে
শাড়ি ও জামার রঙ মিলেমিশে যায়
কে কাহার সঙ্গে কিম্বা কোন পারম্পর্যে কিছু
ধরা যায় না। সব ভিড় ধুয়ে
আত্মসাৎ করে তীব্র বন্যাবাতি। কোন
সুঁড়িপথ ধরে ধরে কে কাহার ঘরে ফেরে
অজ্ঞাতবাসের শর্তে।
(১৫)
গভীর রাতের মতো পরিস্থিতি গড়ে উঠলেও
তখনো জগৎ জেগে
অন্ধকারে পুনরায় তিতকুটে দৃশ্যেরা আর পাহাড়ের
বিশালতা নীরব গর্জনে
ভাঙ্গে যাত্রীদের ভারসাম্য সেতুর ওপরে
দুলতে দুলতেই
দিন নিবে আসে মেলা ভেঙ্গে না গিয়েও
চেহারা বদলে নেয় সুঁড়িপথ ধরে
একের বদলে অন্য খেলুড়ির দল
একটি একটি পালটায়
সাজসারঞ্জাম, চেহারা, পোশাক, প্রসাধন
কি করেই বা বদলাবে আর
ঢাকে ঢোলে জগঝম্পে বদলাও এখনো আসে
তবুও সবাই
বদলেছে বদলেছে বলে মেতে ওঠে
তখনো জানে না বদলাও-এর
টান, সিঁড়ি, তাল, জেদ সম্পর্কের
কথা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন