বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৪

০২) শ্রাবণী দাশগুপ্ত


জয়লক্ষ্মী হোটেল

বংশীধর বেরা দুহাত জোড় করে, দুফরে আসুন দাদাবাবু আজ আমার  হোটেলে... বলে ডেকেছিল।
বালিতে পাতা প্লাস্টিকের তিনখানা চৌপায়া, পাশে পাশে নীলকমল চেয়ার। যেমন তেমন ছাউনিতে রান্না, থাকাও। বাবু, সরু চালের ভাত, মুগের ডাল, আলুভাজা। মাছ না চিকেন?
কষে মাছ খাচ্ছে সত্রাজিৎ... বাড়ি ফিরে ধরাবাঁধা চিকেন স্টুর হবিষ্যি। কুকারে চিকেন আর আগড়ম বাগড়ম আনাজ ফেলে তিনটে সিটি, ওঁ নমস্তস্যৈ মাখন, গোলকি ছিটিয়ে... বাঙালের নোলা এই খেয়ে রোজ! ডায়েটিশিয়ান বউয়ের পথ্যি।
চিংড়ি খাবেন বড়দা? চোকলা ছাড়ালে এরম পুরনো পাঁচ টাকার কয়েন... আঙুলের মুদ্রায় লোভ উসকে দিচ্ছে যে!
গ্র্যাণ্ড! কোত্থেকে আনবেন? টাটকা হবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ খু-ব। খেয়ে বলবেন। আগাম দিয়ে দ্যান, একখুনি ভেড়িতে চলে যাব।
খাই, এখানে? সত্রাজিৎ ঘাড় কাৎ করে অনুমতি খুঁজছে, অম্বালিকার চোখে ঢাউস সানগ্লাস, কানে ঝাড়লণ্ঠন।
পম্ফেট ভাজা খাবেন?
ভাজা? বাঃ ফাইন..., ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, অম্বালিকা উঠে হাঁটা দিয়েছে বিচের দিকে। সে ভুঁড়ি উথলে আরও একটু ধেসকে বসল।
বেরাবাবু, আর একটা জিনিস খাওয়াতে পারবেন?
কী বড়দা? না না, ওসব রাখি না যে ঘরে পুজো-আচ্চি...! হাত  কচলা বেরা।
হ্যা হ্যা করে হাসল সত্রাজিৎ, না না, সে সব নয়। বলছি, আগে এক কাপ  কড়া চা খাওয়ান দেখি!
দূর থেকে হাতছানি দিচ্ছে অম্বালিকা। সে আয়েশ করে এস-এল-আর ক্যামেরা জুম করে। অম্বালিকার মুখটা অবিকল রাগী বেড়ালের মতো, ফোটোটা পরে দেখাবে। সত্রাজিৎ এডভান্সের টাকা দিয়ে দিল।


থার্মোকলের থালা, কাগজের গেলাস, মাজা-ধোয়ার ঝঞ্ঝাট নেই। নুন লেবু কাঁচালঙ্কা সাজিয়ে, মানে যতটা পেরেছে। স্টিলের বাটিতে দুপ্লেট কষকষে প্র  মশলা। গোলাপি রঙের বো-এর মতো মাছ। অম্বালিকার গরম ভাত-ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। বেরা বলে, খেয়ে বলবেন মেডাম... ভাত-ডাল লাগলে দোবো আবার।
অম্বালিকা একটা চামচ চেয়ে নিয়ে বসেছে। বলল, কী মশলা দিয়েছেন? কে রাঁধল?
শুধু প্যাঁজ, হলুদ আর বাটা লঙ্কা। আমার বউ রাঁধছে মেডা-ম, ওই যে  দেখেন ঘরে, বেরা কৃতার্থ।
সত্রাজিৎ জুলজুল করে দেখছে, বাড়ি গিয়ে রাঁধবে না কি? তোমার কুকিং ক্লাসে লঙ্কা বেটে দেখাবে? ওরকম উনুনে কাঠ জ্বেলে?
পাগল! মুখ বেঁকালো অম্বালিকা, তোমার কী ওটা?
পান্তো পান্তাভাত... স্পেশাল অর্ডারে। অবশ্য ভাতটা টাটকা, শুধু জল ঢেলে... চাখবে একটু চিংড়ি দিয়ে?
থাবা বাগিয়ে হুপুস হুপুস খাচ্ছে সত্রাজিৎ, কচকচ করে পেঁয়াজ, লঙ্কা।


পাশের টেবিলে অবাঙালি পরিবার ঝিঙা মচ্ছীর অর্ডারটা অনেক কষ্টে বোঝাতে  পেরেছে - প্রণ প্রণ বলে। তার মজা লাগছিল।
তিন নম্বর টেবিলে সবে এলো আর এক দল। ঘাড় ঘোরাতেই ঝাং করে চাবুক  - রামাশিস! কলেজে তারা ডাকত রামেসিস। তার বিয়ের পরে হরদম আসত খুব ঝুঁকেছিল অম্বালিকার দিকে। বালিকে বালিকে বলে গায়ে ঢলে পড়ত। রামাশিসই তাদের ছেলের নাম অভিকর্ষ রেখেছিল। তার বৌয়ের উচ্ছ্বাস কে দেখে, কী আনকমন আশিসদা... তুমিই ভাবতে পারো! সত্রাজিতের থার্ডক্লাস সন্দেহটা আজও দংশায় মাঝে সাঝে। একই অফিসে ছিল, প্রমোশন আগে পিছে, দলাদলি, কাঁকড়াবাজি। সত্রাজিৎ ধানবাদে বদলি নিয়ে চলে গিয়েছিল। দেখতে দেখতে বছর আষ্টেক পার।
অম্বালিকার নরম স্বর, এই, দেখেছো? সঙ্গে মিসেস? সত্রাজিৎ চোখ মারল, তোমার চেয়ে স্টাইলিশ কিন্তু!

দাম চুকিয়ে দিয়ে সত্রাজিৎ বলল, আপনার হোটেল ফুলে ফেঁপে উঠুক। নামডাক হোক। কার নামে এই হোটেল? আপনার তো নয়!
বংশীধর হাসল, ওই যে আমার লক্ষ্মী, যার হাতের রান্না খেয়ে ধন্যি করচেন। আর... ওর ছেলে বিজয়। টাউনে থেকে পড়ে।
ও! তা-?
লম্বা গল্প বড়দা। বিজয়ের বাপ আমার বন্ধু ছিল এককালে। এখন আর বেঁচে নেই। হ্যাঁ, বিজয় আমারই ছেলে, বড্ড ভালোবাসি।
সটান চোখাচুখি হলো রামাশিসের সঙ্গে সত্রাজিতের। খানিকটা দূরে বালিতে  গাড়ি পার্ক করা, অম্বালিকা এগিয়ে যাচ্ছিল। পেছনে পেছনে সত্রাজিৎও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন