বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৪

০১) অমিতাভ প্রামাণিক


চারানা আটানা

১৭ হোক চুম্বন



বঙ্গযুবসমাজ যেন জরায়ুর ন্যায় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রচ্ছন্নাবস্থায় নিমজ্জিত ছিল, অকস্মাৎ কেরলপ্রদেশীয় মেঘদূতের গুপ্তপত্রপ্রাপ্ত হইয়া আর্দ্র মার্জারের ন্যায় গাত্র ঝাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল ও হক্কলে মিলিয়া হোক্কলোরব ধ্বনি আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত করতঃ ছাত্রসমাজের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও সংঘটিত প্রভূত অন্যায়ের প্রতিবাদে রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে আলিঙ্গনাবদ্ধ হইয়া চুম্বনে রত হইল।

ফলে মুহূর্তে কলিকাতা কল্লোলিনী তিলোত্তমা হইয়া গেল। বঙ্গরাজকোষ ধনাদিসমাগমে স্ফীত হইয়া উঠিল। ভারত পুনরায় জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করিল। যাদবপুরের ভিসি ভিসিয়াস সাইকেলে আরোহণ করিয়া ভিসুভিয়াস-অভিমুখে অবিলম্বে বাণপ্রস্থে গমন করিলেন ও রাজ্যের পিসি চাক্কি পিষিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতে লাগিলেন।

নৃতত্ত্ববিদ্‌গণ ঘোষণা করিলেন – চুম্বনের অভাব হেতু এই নববঙ্গরেনেশাঁ এতাবদ্‌কাল স্তিমিত হইয়া ছিল। যুবা-যুবী অলমোস্ট ভাইবোন হইয়া পারস্পরিক যমদুয়ারের কাঁটা  বাছিতেছিল যে মুহূর্তে তাহারা চুম্বনের স্বাদ লভি’ সিক্ত ও যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইল, সেইক্ষণে সকলেই পরস্পর হ্যান্ড ও অন্যান্য অঙ্গাদি শেক করিয়া পরিপূর্ণ অভিষেক হইয়া উঠিল। যাইবার পূর্বে সকলকেই রাঙাইয়া দিয়া যাইবার মহামন্ত্রে দীক্ষিত হইল।


পূর্বে বাংলার নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটিয়াছিল সতী-দাহ নিবারণের মাধ্যমেএবারের নবজাগরণের সূত্রপাতের কারণ পোতি-বাদ।

নিন্দুকেরা পূর্বের ন্যায় এবারেও ছিছিক্কার করিয়া উঠিল। ছ্যা ছ্যা লাজলজ্জা শিকেয়  উঠ্‌লো গা! ভদ্দুপুরে রাস্তায় জড়াজড়ি করে চুমচুমাচ্ছে সেয়ানা ছোঁড়া-ছুঁড়ির দল, কোনো রাক্‌ঢাক্‌ নেই, বাপের জম্মে দেকিনি গা! দেশ, সমাজ, আমাদের ঐতিঝ্যো, আমাদের সঙোস্কিতি, সব রসাতলে গেল যা!”

ছোঁড়াছুঁড়ি বলিয়া উঠিল, রাখো আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি! বাপের জন্মে দেখ নাই সত্য, কিন্তু বাপস্য বাপ, তস্য পিতামহ, তস্য প্রপিতামহ ইত্যাদি করিয়া ঊর্ধতন পুরুষাদিক্রমে গমন করিয়া অবলোকন করো, খাজুরাহো-কোনারকের আমলে প্রকাশ্যে ইহা অপেক্ষা গুরুতর কার্যাদি সম্পন্ন হইত। পাশ্চাত্যে হইতেছে বহুকাল ধরিয়া, আমরাই বা ইহার স্বাদে বঞ্চিত থাকিব কেন? ইচ্ছুক ব্যক্তিকে চুম্বন আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা, আমরা তাহা খাইলে তোমার বাপের কী!

নিউট্রাল প্রকৃতির কিছু প্রৌঢ় মনুষ্য, যাহারা এই কার্যের সমর্থকও নহে বিপক্ষেও নহে, আধা গোপনে আধা প্রকাশ্যে বলিয়া উঠিল, আহা, এই সকল কলরব আরো ত্রিশ- চল্লিশ বৎসর পূর্বে কেন শুরু হয় নাই? তাহা হইলে আমরাও...”

‘পড়ে-পাওয়া চোদ্দ-আনা’ ঈদৃশ চুম্বনের সুযোগ মিস হওয়ায় এই নিউট্রাল মনুষ্যদিগের কী ধরনের নিউট্রিশনাল ডেফিসিয়েন্সি হইয়াছে, তাহার কিঞ্চিৎ চর্চা তো আবশ্যক!   চুম্বন বস্তুটি আদতে কী? ইহা যে শুধুমাত্র খাইবার এবং শিশু ব্যতীত অন্যের মস্তকে প্রয়োগের নহে, তাহা তো সকলেই জ্ঞাত। পরন্তু শাস্ত্রসম্মত ব্যাকরণ ও প্রকরণ না জানিয়া প্রকাশ্য দিবালোকে নরনারী চুম্বনাবদ্ধ হইলে তাহা অসম্পূর্ণতাদোষে দুষ্ট হইতে পারে

যে বহুশ্রুত অথচ সম্ভাব্য অপঠিত গ্রন্থে এই বিষয় প্রথম সম্যক্‌রূপে সন্নিবিষ্ট হইয়াছিল, মহর্ষি মল্লনাগ বাৎস্যায়ন বিরচিত সেই কামসূত্রম্‌ গ্রন্থ মতে চুম্বন হইল রতিপ্রকরণের অন্তর্গত সম্প্রয়োগের অষ্ট অবয়বের একটি।

আলিঙ্গনচুম্বননখচ্ছেদ্যদশনচ্ছেদ্যসম্বেশনসীৎকৃতপুরুষায়িতৌপরিষ্টকানাম্‌।
অষ্টানাং অষ্টধাবিকল্পভেদাদ্‌ অষ্টাবষ্টাকাশ চতুঃষষ্টিরিতি বাভ্রব্যাঃ।।

বাভ্রব্যগণের (ঋগ্বেদানুসারী বহবৃচ ব্রাহ্মণগণ, যাহারা এই কলায় পারদর্শী ছিলেন, তাহাদের শিষ্যগণের) মতানুসারে এই অষ্ট অবয়ব হইল – আলিঙ্গন, চুম্বন, নখচ্ছেদ্য, দশনচ্ছেদ্য, সম্বেশন, সীৎকৃত, পুরুষায়িত ও ঔপরিষ্টকইহাদিগের প্রত্যেকটির অষ্টপ্রকার বিকল্প-ভেদ থাকায় “আট-আট্টা” চৌষট্টি কলা! চুম্বনশাস্ত্রে পারঙ্গমতা সুতরাং এই চতুঃষষ্টিকলার অন্তর্গত অষ্টটির উপর পি এইচ ডি!

অন্যান্যগুলি এইস্থলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে, তবে চুম্বনের পূর্বে আলিঙ্গনের প্রয়োজন বলিয়া উহার উপর দুই-চারি বাক্য লিপিবদ্ধ করা আবশ্যক। নায়ক-নায়িকার অভিজ্ঞতাভেদে আলিঙ্গন দুই প্রকার হয় – যাহাদিগের সমাগমের অভিজ্ঞতা নাই এবং যাহাদিগের আছে। এক্ষেত্রে সমাগম শব্দের অর্থ সেই মিলন, যাহার জন্য উপযুক্ত শয্যা আবশ্যক। যেহেতু আমাদের আলোচ্য জনচক্ষুর সম্মুখে রাজপথস্থ আলিঙ্গন, আমরা অনভিজ্ঞ -সমাগম আলিঙ্গনেই আমাদের আলোচনা সীমিত রাখি

সমাগমরহিত যুগলের প্রীতিচিহ্ন প্রকাশার্থ আলিঙ্গন চারিপ্রকার – স্পৃষ্টক, বিন্ধক, উদ্‌ঘৃষ্টক এবং পীড়িতক

স্পৃষ্টক আলিঙ্গনের উদ্দেশ্য স্পর্শ করানায়িকা সম্মুখে আসিতে থাকিলে যদি সাধারণভাবে তাহাকে বেষ্টনপূর্বক আলিঙ্গন করিতে না পারা যায় অথচ তাহাকে অনুরাগ জানাইবার বিশেষ প্রয়োজন হয়, তবে অন্য কর্ম করিবার ছলে তাহার পার্শ্ব দিয়া যাইবার সময় – গাত্রেণ গাত্রস্য স্পর্শনং – গাত্রে গাত্র স্পর্শ করানোকে স্পৃষ্টক  বলে। নায়ক কোনো বিজনপ্রদেশে স্থিত বা উপবিষ্ট দেখিলে – কিঞ্চিদ্‌ গৃহ্ণতি  পয়োধরেণ বিদ্ধ্যেৎ – কিছু গ্রহণ করিবার ছলে নায়িকা পয়োধর দ্বারা নায়ককে বিদ্ধ করিলে ও নায়কও বহুপাশ দ্বারা তাহাকে অবপীড়িত করিয়া ধরিলে উহাকে বিদ্ধক বলে। অন্ধকারে, বহুজনের যে স্থলে ভিড় ও ঠেলাঠেলি সেখানে অথবা বিজনপ্রদেশে –  নাতিহ্রস্বকালং উদ্‌ঘর্ষণং পরস্পরস্য গাত্রাণামুদ্‌ঘৃষ্টকম্‌ – ধীরে ধীরে বহুক্ষণ ধরিয়া নায়িকার গাত্রে ও নায়কের গাত্রে যে ঘর্ষণ, তাহাকে উদ্‌ঘর্ষণ বা উদ্‌ঘৃষ্টক বলে। সেই উদ্‌ঘৃষ্টকভাবে একটি কুড্য অর্থাৎ দেওয়াল বা স্তম্ভ অর্থাৎ থামকে দুই বাহু দ্বারা জড়াইয়া ধরিয়া – স্ফুটকমবপীড়য়েৎ – স্পষ্টই আপীড়িত করিলে ইহাকে পীড়িতক আলিঙ্গন বলা হয়

রাজপথিমধ্যে দেওয়াল বা স্তম্ভপ্রাপ্তির সম্ভাবনা কম। মরাল-মরালী চুম্বনাবদ্ধ দেখিয়া ‘মরাল পুলিশ’ তাহাদিগকে ধরিয়া হাজতে পুরিয়া না দিলে আন্দোলনকামী যুবক-যুবতী বরং স্পৃষ্টক, বিদ্ধক ও উদ্‌ঘর্ষণ বা উদ্‌ঘৃষ্টক আলিঙ্গনেই নিজদিগকে সীমাবদ্ধ রাখুক।

পূর্বোক্ত প্রকারে আলিঙ্গনাবদ্ধ হইবার পরক্ষণে আসে চুম্বনাদির প্রয়োগতাহার মধ্যে প্রথমেই চুম্বন, কি নখচ্ছেদ্য, কিংবা দশনচ্ছেদ্য  – ন পৌর্বাপর্যামস্তি – উহার মধ্যে অগ্রপশ্চাৎ কর্তব্যতা নাই, অনুরাগবশে ইহার যে কোনোটি প্রযোজ্যতবে যন্ত্রযোগের পূর্বেই এগুলির প্রয়োগ করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে ‘যন্ত্র’ শব্দটির অর্থ নিশ্চয় বলিয়া দিবার প্রয়োজন নাই।

মুকুলীকৃত বক্ত্র অর্থাৎ মুখে-মুখে সংযোজনকে চুম্বন বলা হয়। চুম্বন কয় প্রকার ও কোন কোন স্থানে প্রযোজ্য? ললাটালককপোলনয়নবক্ষঃস্তনৌষ্ঠান্তর্মুখেষু চুম্বনম্‌। ললাট, অলক, কপোল, নয়ন, বক্ষ, স্তন, ওষ্ঠ এবং অন্তর্মুখ – এই অষ্টপ্রদেশে চুম্বন কর্তব্য। ঊরুসন্ধিবাহুনাভিমূলায়োঃ লাটানাম্‌ - ঐ অষ্টপ্রদেশ ব্যতীত ঊরুসন্ধি, বাহুমূল ও নাভিমূলেও চুম্বন করা লাটদিগের মত আছে। ইহা সর্বজনপ্রযোজ্য নহে, কারণ সকলে এই তিনস্থলে চুম্বন করিতে সমর্থ হয় না। শিষ্টগণ ইহাদিগকে অশুচি গণ্য করেন, তাহাদিগের পক্ষে ঐ অষ্টবিধ স্থানই বিধেয়

স্থানবিশেষে চুম্বনের যে গ্রহণকর্ম, তাহার ভেদেই চুম্বনের ভেদ হয়। উত্তর, অধর, সম্পুটক-ভেদে চুম্বন ত্রিবিধ। অপ্রাপ্তসঙ্গমা অজাতবিশ্রম্ভা কন্যার জন্য চুম্বন তিন প্রকার – নিমিতকং স্ফুরিতকং ঘট্টিতকং ইতি ত্রীণি কন্যাচুম্বনানি – অর্থাৎ এদের নাম নিমিতক, স্ফুরিতক এবং ঘট্টিতক।

চুম্বনে নিযুক্ত হইয়া মুখে মুখ স্থাপিত করিয়া – ন তু বিচেষ্টত – চুম্বন করিতে বিশেষ চেষ্টা না করিবার নাম নিমিতক, অর্থাৎ পরিমিত চুম্বন। নায়িকার মুখে নায়ক নিজের অধর প্রবেশিত করিলে নায়িকা যদি নিজের ওষ্ঠ ছাড়াইয়া লইবার চেষ্টা করে ও নায়কের অধরও নিজস্থানে রাখিতে দেয় না, কিন্তু নায়ক যদি স্বয়ং নিজ অধর বাহির করিয়া লইবার চেষ্টা করে, তখন – ওষ্ঠং ন উত্তরমুৎসাহতা – নিজের ওষ্ঠ দিয়া চাপিয়া রাখিবার চেষ্টা যে চুম্বনে, তাহাকে স্ফুরিতক-চুম্বন কহে। ঈষৎ পরিগৃহ্য বিনীমিলিতনয়না – করদ্বারা নায়কের নয়ন আচ্ছাদিত করিয়া নিজেও বিনিমীলিতনয়ন হইয়া – জিহ্বাগ্রেণ ঘট্টয়তি – নায়কের অধরপ্রান্ত অল্পভাবে ধরিয়া জিহ্বাগ্রহ দ্বারা চারিদিকে ঘুরাইয়া দেখিবার নাম ঘট্টিতক।

সমং তির্যগুদ্‌ভ্রান্তমবপীড়িতকং ইতি চতুর্বিধমপরে। অপর পণ্ডিতগণ বলেন, চুম্বন চারি প্রকার – সম, তির্যক,  উদ্‌ভ্রান্ত এবং অবপীড়িতক। সমান সমান মুখ রাখিয়া যে অধরোষ্ঠ গ্রহণ, তাহাকে সম; মুখ ঘুরাইয়া অধরোষ্ঠ বর্তুলাকার করিয়া যে গ্রহণ, তাহাকে তির্যক; চিবুক ও মস্তকে ধরিয়া মুখ ঘুরাইয়া যে অধরোষ্ঠগ্রহণ, তাহাকে উদভ্রান্ত; আর সেই অবস্থায় যদি অত্যন্ত অবপীড়িত করিয়া চুম্বন করা যায়, তবে তাহাকে অবপীড়িতক বলা হয়

অঙ্গুলিসম্পুটেন পিণ্ডীকৃত্য নির্দেশনমোষ্ঠপুটেনাবপীড়ায়েদিতি অবপীড়িতকং পঞ্চমমপিকরণম্‌। অঙ্গুলিসম্পুটকদ্বারা অধরোষ্ঠকে পিণ্ডীকৃত করিয়া, না কামড়াইয়া ওষ্ঠপুটদ্বারা অবপীড়িত করিলে উহাকে পঞ্চম অবপীড়িতক বলা হয়। এইরূপে কর্মভেদে চুম্বন অষ্টবিধপ্রকারতন্মধ্যে তিনটি কন্যা-চুম্বন ও পাঁচটি গ্রহণচুম্বন।

চুম্বন বিষয়ে এই মহাগ্রন্থ হইতে অধিক কিছু উদ্ধৃত করিতে চাহি না। কামসূত্রমস্থ চুম্বন-বিকল্প অধ্যায়ে যতগুলি শ্লোক আছে, আমি তাহার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে বলিয়াছি। ইহা ব্যতীত অতিশয় জ্ঞান বিতরণ করা আছে অধরচুম্বনে দ্যুতক্রীড়া, জিহ্বাযুদ্ধ, শরীরের অন্যান্য বৈধ স্থানে চুম্বনের প্রকরণ, এমনকী অবৈধস্থলে চুম্বনও কীরূপে বৈধকরণ সম্ভব, তাহার উপরে। আমাদের এই আলোচনায় তাহা যথেষ্ট  প্রাসঙ্গিক নহে। যাহার প্রয়োজন, আকরগ্রন্থ দেখিয়া লহ।
চুম্বন সুতরাং এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ। চুম্বনের অধিকার যে মানবসমাজে মৌলিক অধিকার রূপে গণ্য হওয়া উচিত, এ বিষয়ে সন্দেহের অবধি নাই। সকল শিশুই বৈধরূপে – এবং হে কলঙ্কিত সমাজ, বিশেষ ক্ষেত্রে এমন কী অবৈধরূপে – চুম্বিত হয়, এবং সকল নরনারীরই – এলজিবিটির অন্তর্ভুক্ত না হইলে – বিপরীতলিঙ্গের মনুষ্যের প্রতি চুম্বনের এলিজিবিলিটি ও আকাঙ্ক্ষা জন্মে। কবিতা, গল্প, উপন্যাসাদিতে তাহার বর্ণনাও প্রাপ্ত হওয়া যায়।

বঙ্গকুলতিলক কবি রবীন্দ্রনাথও, যাহার সম্বন্ধে বলা হইয়া থাকে যে তিনি মানবজীবনের প্রায় সমস্ত অনুভূতিই আপন রচনায় লিপিবদ্ধ করিয়া গেছেন, চুম্বন বিষয়ে নীরব থাকেন নি। তাঁহার একটি কবিতার শীর্ষকই ‘চুম্বন’কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত সেই কবিতায় তিনি চুম্বনের সংজ্ঞা লিখিয়াছেন –
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা।
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সংগমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে... ইত্যাদি

আধুনিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের অবশ্য রবীন্দ্রের এই চুম্বন-ডেফিনিশন যথোপযুক্ত প্রীতিপ্রদ বোধ হয় নাই। চুম্বন যে একটি স্বতস্ফূর্ত ও সেনসুয়াস ব্যাপার, দোঁহা-ফোঁহা-জাতীয় শব্দচয়নে তাহা যেন কবীরের দোহা-র ন্যায় ভগবদ্‌পুজ্য কার্যে পরিণত হইয়াছে বলিয়া তিনি মতপ্রকাশ করিয়াছেন। চুম্বনের সহিত তীর্থযাত্রার রূপক তিনি হজম করিতে পারেন নাই।

রবীন্দ্র অবশ্য ইহাতেই নিরস্ত হন নাই। তিনি ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টা ছিলেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ  পরে’ কী কী হওয়া কর্তব্য, তাহার উপর তাঁর সুবিশাল আশা বিন্যস্ত ছিল। সার্ধ- শতবর্ষ লইয়া তিনি কিছু লিপিবদ্ধ করেন নাই সত্য, তবে চৈতালি কাব্যগ্রন্থে স্থান   দিয়াছেন তাঁহার স্বপ্নের প্রথম চুম্বনের অভিব্যক্তির। ‘প্রথম চুম্বন’ শীর্ষক সেই কবিতার কয়েকটি চরণ এই রূপ –
নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে
নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়
নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্‌ ধরায়।
সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন
আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।
দিক্‌-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি
দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি। ... ইত্যাদি।

সন্ধ্যাকালে নির্জনে লোকচক্ষুর অন্তরালে এই কার্যটির অভিজ্ঞতা লাভের প্রত্যাশী ছিলেন তিনি। পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হইবার পূর্বেই শৈশবসঙ্গীত কাব্যগ্রন্থে গোলাপবালা শীর্ষক   একটি কবিতায়ও তাহারই ছায়া। লিখিয়াছিলেন – তবে মুখানি তুলিয়া চাও! / সুধীরে মুখানি তুলিয়া চাও! / সখি, একটি চুম্বন দাও! / গোপনে একটি চুম্বন দাও!

সময় বদলাইয়া গিয়াছে। সে রবিও নাই, সে জোড়াসাঁকোও বিজোড় হইয়া গিয়াছেযাদবপুর থানার সম্মুখে জাপটাজাপটি করিয়া যুবক-যুবতী এক্ষণে পারস্পরিক  অ্যাফেকশন ডিসপ্লে করিতে ব্যস্ত। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনুষ্যের বিভিন্ন দুর্বিপাকে তাহাদিগকে ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ প্রদানের প্রেস্ক্রিপশন দিয়াছিলেন বিধু বিনোদ চোপড়া। যাদবপুরের এই গণ-আন্দোলন অবশ্য সমাজের বিভিন্ন স্তরে অনৈতিক কার্যকলাপ ও  দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

এক্ষণে আপনি জানেন, পুলিশ ঘুষ খাইলে, পরিবারে নবোঢ়া তরুণী নিগৃহীতা হইলে, পথিমধ্যে যুবতী ধর্ষিতা হইলে, রাজনৈতিক নেতা প্রকাশ্য সভায় হুমকি দিলে, পাড়াস্থ মস্তানের হস্তে যুবক খুন হইলে, ছাত্র বিদ্যালয়ে আপন শিক্ষককে নিগ্রহ করিলে, এমেলে এম্পি সরকারী অর্থ পকেটস্থ করিলে এবং এবম্বিধ অন্যান্য সহস্রাদি অপকর্মাদি আপনার চক্ষুর সম্মুখে সংঘটিত হইতে থাকিলে আপনার কী করণীয়।

প্রকাশ্য রাজপথে ইচ্ছুক একজনকে উদ্‌ঘৃষ্টক আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়া ঘট্টিতক চুম্বনে রত হউন। প্রব্লেম সল্ভ্‌ড্‌।

1 টি মন্তব্য:

  1. ...দাদা, বয়স আপনার যাহাই হৌক, একটু পদরেণু ই-মেইল যোগে প্রেরণ করিবেন। আমার মতো 'যন্ত্র'-বিযুক্ত ব্যক্তি মাথায় ঠেকাইয়া উহা ফ্রেমবদ্ধ করিয়া রাখিবার অভিলাষ করি। ধন্য...

    উত্তরমুছুন