বাসবদত্তা ও আমি
চাঁদ ছিল না আকাশে।
কিন্তু চাঁদের আলো ছিল। চাঁদ না থাকলে চাঁদের আলো থাকে? হ্যাঁ, থাকে। বাসবদত্তা
আমাকে বলেছিল। বলেছিল, তুই ভালো করে চোখ মেলে দ্যাখ, চাঁদের আলোয় অন্ধকার কেমন
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে! তোর গায়ে কেমন জড়িয়ে গেছে চাঁদের আলোয় বোনা রূপোলী চাদর!
আমি নগ্ন ছিলাম। নিভাঁজ নগ্ন।
বাসবদত্তাও নগ্ন ছিল। তরতাজা নগ্ন। সেদিন ছিল আমাদের নগ্ন হবার দিন। চারিদিকে নির্ভেজাল অন্ধকার। সেদিন
ছিল আমাদের নিজস্ব নির্জন রাত। আমরা নগ্ন হয়েছিলাম সেই অনন্য সুন্দর রাতে। কিন্তু
আমার জানা ছিল না, সেই নির্ঘুম অন্ধকারে বাসবদত্তা কখন আহ্বান করবে চাঁদের আলোকে,
অন্ধকারকে আরও গভীর করে তুলবে সেই আলোয়, আমার নগ্ন দেহে জড়িয়ে দেবে চাঁদের আলোয়
বোনা রূপোলী চাদর!
অমলকাকুর সঙ্গে আমার
সখ্যতা সেই নিছক ছেলেবেলা থেকে। অমলকাকুর হাত ধরে আমি কতবার যে হারিয়ে গেছি
প্রকৃতির অন্তরমহলে! বিশাল ও ব্যাপক প্রকৃতির আঙিনায় আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে
অমলকাকু বলত, দ্যাখ শমীন্দ্র, তোর চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ, এই কাছের
গাছপালা বুনোঝোপ জলাভূমি আর ওই দূরের পাহাড়শ্রেণী নদী সমুদ্র, সবাই তাদের জন্মের
পর থেকে কোটি কোটি যুগ ধরে এইভাবে সটান নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তোর মাথার ওপর ওই
আকাশ আর তোর পায়ের তলার এই মাটি, সবাই আবরণহীন আভরণহীন উন্মুক্ত উদার। পৃথিবীতে
একমাত্র মানুষ ছাড়া যত প্রাণী সরীসৃপ কীট পতঙ্গ জীবাণু বীজাণু ব্যাকটেরিয়া, যা
কিছু আছে, সবাই নিখাদ নগ্ন। তুই এখন খুবই ছোট শমীন্দ্র, হয়তো ঠিক বুঝবি না, তবু
তোকে বলি, এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডের সব ঐশ্বর্য সব সৌন্দর্য মজুত করা আছে শুধুমাত্র
নগ্নতায়। আর সেই ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের মধ্যেই সেঁধিয়ে থাকে সব রহস্যময়তা।
বাসবদত্তা আমার
বন্ধু। আমরা স্কুল ও কলেজে একই ক্লাসে পড়েছি। আবার কর্মসূত্রে আছি একই কর্পোরেট
অফিসে। আমি সেই ছেলেবেলা থেকেই ছিলাম বাঁধনহারা। কিন্তু বাসবদত্তার অনেক বাঁধন আছে। ব্যক্তিক।
পারিবারিক। সামাজিক। যদিও বাসবদত্তা কোনো বাঁধনই মানে না। সে সব বাঁধনকে অগ্রাহ্য
করে আমার কাছে আসে। থাকে। নগ্ন হয়। আমাকেও নগ্ন করে। কিন্ত বাসবদত্তা, তুই
কেন এমন করিস! কেন আমাকে এভাবে নগ্ন নির্জনতায় নিমজ্জিত করিস! এই নির্মম সৌন্দর্য
যে আমার বাইরের ভেতরের সব কিছুকে তছনছ করে দেয়! আমাকে সটান দাঁড় করিয়ে দেয় বিশাল ও
ব্যাপক উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির ঠিক মাঝখানে!
অমলকাকুর কোল ঘেঁষে
বসে সেই ছেলেবেলায় আমি প্রথম দেখেছিলাম পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। আমি অবাক চোখে
দেখেছিলাম, চাঁদটা একটু একটু করে ঢাকা পড়তে পড়তে হঠাৎ যেন বেমালুম হারিয়ে গেল।
অমলকাকু আমাকে বুঝিয়েছিল, এই যে ঢাকা পড়ে চাঁদটা আড়ালে চলে গেল, এতে চাঁদেরই
সৌন্দর্যহানি হলো। আমরা চাঁদের সেই মনোরম সৌন্দর্যদর্শন থেকে বঞ্চিত হলাম। চাঁদকে
গ্রাস করেছে পৃথিবী, তাই আজ চাঁদের গ্রহণ।
বাসবদত্তা প্রায়ই
আমাকে বলে, তুই খুব ভালো রে শমীন্দ্র! আমি হাসি। বলি, তুইও তো খুব ভালো বাসবদত্তা!
আমরা হাতে হাত ধরে হেঁটে যাই কত লেন, বাই লেন, পথ, সরণি। বাসবদত্তাকে আমার চেনা,
খুব চেনা চেনা লাগে। মনে হয়, আমি ওকে জন্ম জন্মান্তর ধরে চিনি। জানি। বুঝি। অথচ
যেদিন আমরা আমাদের নিজস্ব নির্জন রাতে গভীর গভীরতর অন্ধকারে নিখুঁত নগ্ন হই, তখন
প্রতিবারই আমি আবিষ্কার করি এক অন্য অচেনা অজানা বাসবদত্তাকে। যেন শরীরের ভেতর
অন্য এক শরীর, যেন মনের ভেতর অন্য এক মন! কিন্তু সেই নতুন নতুন শরীর, সেই নতুন
নতুন মনকে আমি কতটুকু ছুঁতে পারি! চিনতে পারি! জানতে পারি! বুঝতে পারি! আর
বাসবদত্তাই বা কতটুকু স্পর্শ করতে পারে আমার নগ্ন শরীর মনের ভেতরের শরীর মনকে!
অমলকাকু বলত, জানিস
শমীন্দ্র, প্রকৃতির সপাট নগ্নতায় যে অপার সৌন্দর্য, তাতেই খুঁজে বেড়াতে হয় তার অতল
রহস্য।
সত্যিই অমলকাকু, আমি
আজ অনেক বড় হয়ে গেছি, কিন্তু কিছুতেই তল পাই না
কোনো রহস্যের। আমি বুঝতে পারি না, এই অনিমেষ অন্ধকারে চাঁদের আলোয় গাঁথা রূপোলী চাদরে জড়ানো আমার নগ্ন শরীরে নগ্ন
বাসবদত্তা কোন্ রহস্যের সন্ধানে বুঁদ হয়ে থাকে, আর আমিই বা বাসবদত্তার নগ্ন শরীরে
কোন্ রহস্যের সন্ধানে কোন্ বিদিশায়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন