চেয়ার
ঠিক এক তারিখে তিনি আসতেন। প্রতি মাসের প্রথম
দিনটিতে। আসতেন পেনশন নিতে। লাইনে দাঁড়িয়ে পেনশন নিতে তিনি ভালোবাসতেন। পুরনো
দিনের মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয়। কে আছেন
কে নেই, এই নিয়ে গল্প হয়। হারানো দিনের দুটো সুখ দুঃখের কথা বিনিময় হয়। যখন তাঁর বয়স কম ছিল,
রক্ত ছিল টগবগে, তিনি একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলেন ছয় তলাতে। কখনও ভাবেন নি এমনও দিন
আসবে, ওই ফ্ল্যাটে উঠতে নাভিশ্বাস উঠবে। ইদানীং আর দমে কুলোয় না। স্ত্রী ইতিমধ্যেই
চলে গেছেন। ছেলেমেয়েরা দূরে দূরে। এখন
তিনি একা। তাঁর জীবনের এইটাই গল্প। এইসব নানা কথা বলে কিছুটা সময় তিনি কাটিয়ে যান
পুরনো মানুষ জনের সঙ্গে। শরীর বেঁকে গেছে, হাতে লাঠি উঠেছে, তবু তিনি আসতেন, মাসের
ঠিক পয়লা তারিখে। আর এলে পরে আমার
অফিসঘরে অবশ্যই একবার আসতেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোলাটে চোখে সারা ঘরখানা চোখ দিয়ে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন। আমার নতুন চাকরি, প্রথম প্রথম চিনতে পারি নি ভদ্রলোককে। জানতাম না
কে তিনি, কী চান, কী দেখেন! বুঝতে পারতাম না, চোখ দুটো তাঁর কেন এত জ্বলজ্বল করে
এই অফিসে এলে!
এমনই একদিন। তিনি এসে দাঁড়ালেন আমার অফিস ঘরের
দরজায়। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলেন আমার টেবিলের কাছে। টেবিলে হাত রাখলেন। নাড়ির
স্পন্দন যেন অনুভব করার চেষ্টা করলেন। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "তুমি
আমাকে চিনবে না, বাবা! প্রায় তেইশ বছর আগে আমি অবসর নিয়েছি। যে চেয়ারটিতে তুমি বসে
আছ আজ, আমি ওই চেয়ারটিতে একচল্লিশ বছর বসেছি। ওই চেয়ারের প্রতিটি প্রত্যঙ্গ আমি চিনি। আমার আত্মা ওই
চেয়ারের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাকে একবার বসতে দেবে কি ওই চেয়ারে?" আমি
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াই। হাত ধরে বৃদ্ধকে বসাই চেয়ারে। চেয়ারে বসে বৃদ্ধ হঠাৎ যেন
যুবক হয়ে ওঠেন। চেয়ার টেবিলের সারা শরীর তিনি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকেন। হারানো
সময়কে তিনি যেন ধরতে চান। দু'চোখ তাঁর জলে ভরে ওঠে। একটু পরেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে
চলে যান চোখ মুছতে মুছতে।
পরের মাসের পয়লা তারিখ যথারীতি আসে। কিন্তু তিনি
আসেন না। মাসের প্রথম দিনটি তাঁকে ছাড়াই অস্ত যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন