নীল গ্রহের ছায়া
Where have all the flowers
gone? / Long time passing. / Where have all the flowers gone? / Long time ago. (পিট সীগার)
বহুদিন, অনেক অনেকদিন হয়ে গেল, ফুলগুলো নেই। শুকনো হলুদ হওয়া ঘাস, ধূসর পাথর আর ধুলো রাস্তায়। ঘরে। উঠোনে। বাড়িগুলো ফাঁকা মনে হয় সেই দেশে। অনেক অনেকদিন হয়ে গেল এখন আর কান্নার শব্দও আসে না দরজার ওপার থেকে। ঘর থেকে বেরোলে বারুদের ধ্বকধ্বকে গন্ধ। জোয়ান জোয়ান
সব ছেলেগুলো যুদ্ধে গেছে। ফেরেনি। অনেক অনেক দিন হয়ে গেল। কতজনের খবর নেই। কতজন কবরে। কবরে ফুলগুলোও শুকিয়ে মরে গেছে অনেক অনেক দিন। তাদের প্রেমিকারা, তাদের বুড়ো বাপ আর আধ পাগল মায়েরা সেই দেশে তাদের না-ফেরা ছেলেদের অপেক্ষা আর করে না এখন। বোমা যখন পড়ে, গ্রেনেড যখন নেমে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে, তখন ওরা কেউ ঘর ছেড়ে এখন পালায় না আর। বাড়ির পেছনের জায়গাটুকুতে যেটুকু ঘরোয়া চাষ হয়, তাই দিয়ে রান্না। স্কুলগুলোতে এখন আর্মি থাকে। খেলার মাঠে আর্মি থাকে। ট্যাঙ্ক, বন্দুক থাকে। পৃথিবীর যে দেশগুলোতে যুদ্ধ হয়, এই দেশ পৃথিবীর বাইরে হলেও, সব যেন এক। একরকম। মাটি থেকে অনেক অনেক ওপরে, স্বর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এই দেশ। পৃথিবী থেকে মরে গিয়ে যে মানুষগুলো এখানে এসেছে, তারাই যুদ্ধ করছে। এখানে এসেই তারা প্যালেস্টাইন-ইসরায়েলে ভাগ হয়ে গেছে, কেউ রাশিয়া-চীনে, কেউ আমেরিকা-ভিয়েতনাম-সিরিয়া-বাঙলাদেশ-জামাতী। পারিজাত উদ্যানে এখন আর্মি ক্যাম্প পাতা আছে। একটা বাচ্চা ছেলে আর একটা বাচ্চা মেয়ে এসেছে কিছুদিন আগে। ওদের কথা এখন খুব হচ্ছে এই যুদ্ধের খবরের মাঝে। ছেলেটা সিরিয়ার। মেয়েটা বাঙলাদেশ। বোমার স্প্রিন্টারে ক্ষতবিক্ষত সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা ছেলেটা
সুদানের রেড ক্রসের একটা ক্যাম্পে প’ড়ে কাতরাচ্ছিল। মরার আগে নাকি বাচ্চা ছেলেটা বলছিল, I’m gonna tell God everything. বাচ্চাটা জানতো না ও যেখানে যাচ্ছে, সেখানেও মরে ভূত হয়ে যাওয়া লোকগুলো একই কান্ড বাধিয়ে রেখেছে। আর বাঙলাদেশের বাচ্চা মেয়েটা, ফুটপাথে থাকত, ওরই মতো আরো দশ-পনেরোটা বাচ্চার সাথে, চাটাই বিছিয়ে। ট্রাফিকে গাড়ি এসে থামলে কাচের বাইরে থেকে হাত পাততো। একদিন ঢাকার রাস্তায় ওকে দেখা যায়, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে, বাঁ হাতের পেতে রাখা শূন্য তালুতে ডান হাতের মুঠি রেখে মুখে পুরে দিচ্ছে শূন্য মুঠি। অনেকেই ভাবছিল, মেয়েটা বোধয় খেলছে। কে একজন জিগ্যেস করে, কী করতাসো? মেয়েটা বলে, খিদা খাইতাসি। এর তিনদিন বাদে জামাতীর বোমায় মেয়েটা ভয় পেয়ে একটা খালি বাসে গিয়ে উঠে পড়ে, লুকিয়ে থাকে সীটের তলায়। আর পেট্রোল ঢেলে হৈ হৈ ক’রে ওরা বাসটাকেই জ্বালিয়ে দেয়। ইউনাইটেড নেশনস-এর যে হোমড়া-চোমড়া সদস্যেরা মরে গিয়ে এখানে এসেছেন, এবারে তাঁরা তোড়জোড় করছেন, এই যুদ্ধ পরিদর্শনে যাবেন। তাই নিয়ে, স্বর্গের দক্ষিণ-পূর্বের এই দেশ খুব চিন্তিত। তাঁরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত এই বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে। ‘পৃথিবীতে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু এখানে এসে আমরা খুব ভালো আছি’ এই সহজ সরল নিষ্পাপ কথাটুকু কিছুতেই ওদের শেখানো যাচ্ছে না। বাচ্চা ছেলেটা এখনও বলে যাচ্ছে I’m gonna tell God
everything, আর বাঙলাদেশের মেয়েটা, পারিজাত উদ্যানে দাঁড়িয়ে এখনও বাঁ হাতের পেতে রাখা শূন্য তালুতে ডান হাতের মুঠি রেখে মুখে পুরে দিচ্ছে শূন্য মুঠি। 'কি করতাসো' জিগ্যেস করলেই বলে উঠছে 'খিদা খাইতাসি'। U.N. এসে এসব দেখলে কী হবে?
.................................................................................................
[‘ঐহিক’
পত্রিকার ‘হওয়া না হওয়া’ সংখ্যায় প্রকাশিত]
†
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন