বাগান
সারাদিন খুরপি হাতে নিড়েন দেয় রূপচাঁদ। উবু হয়ে বসে মুখ নিচু করে একমনে। মাঝে
মাঝে গাছগুলোর গায়ে মাথায় হাত বুলোয়। লোকে ব্যঙ্গ করে বলে ‘চাঁদের বাগান’। রপচাঁদ চোখ ছোট করে মিটি মিটি চায়,
মুখ টিপে হাসে। ওকে দেখতে ঠিক কেমন, বোঝা যায় না। মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল, বড় বড় মাথার চুল
উমনো ঝুমনো। তবে তামাটে দীর্ঘ শরীরের কাঠামটি বেশ শক্তপোক্ত।
চাঁদের বাগানই বটে! গাছের
চেয়ে আগাছা বেশি। ফুল ফলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যত বুনো আদারে-বাদারের গাছ।
রূপচাঁদের বড় মায়া। ‘আহা থাক না, গাছ-ই তো!’ যে গাছ-ই গজাক, সে খুরপি হাতে নিড়েন করবে, জল দেবে, গা’য়
মাথায় হাত বুলোবে।
ঘর সংসার নেই রূপচাঁদের? এমন মানুষের আবার ঘর সংসার! বৌ পাঁচবাড়ি রান্না করে দিব্যি
ভালো রোজগার করে। একটা ছেলে। তাকে নিয়ে রূপচাঁদের ঘর ছেড়ে পাশের পাড়ায় থাকে। নিজের
ঘর, জমি, সবই করেছে। ছেলেকে ভালো ইস্কুলে ভর্তি করেছে, ফর্সা কাপড়-জামা
পড়ায়।
রইল পড়ে ঝোপ-ঝাড়ের বাগান আগলে রূপচাঁদ। লাউটা কুমড়োটা গজালে পদ্মপিসি নিয়ে যায়। কিছু
বেচে, কিছু রাঁধে। প্রতিদিন গজর গজর করতে করতে এসে খাবার দিয়ে যায় -- ‘ব্যাটাচ্ছেলে মানুষ, দু-পয়সা রোজগার করলেই তো পারো বাপু, এমন
ফলন্ত বাগানখানা আগাছায় ভরে রেখেছো, আর বেশিদিন তোমার খ্যাটন জোগাতে পারবনে!’ মিটিমিটি চায় রূপচাঁদ, মিটিমিটি হাসে। ‘গাছ বলে তুচ্ছ করোনে গো পদ্মপিসি, ওরা বড় ভালোবাসে আমায়!’
‘গাছের আবার ভালোবাসা, হুঁহ, যত্তসব আগল-পাগল’। গজর গজর করতে করতে চলে যায় পদ্মপিসি।
রূপচাঁদ খুরপি হাতে ভাবে, এই পদ্মপিসিরও কত মায়া! যেন গাছ! রোজ তাকে খাবার জুগিয়ে যায়। সে একটা বুনো কাঁটাওয়ালা গাছের নাম রাখে
‘পদ্মপিসি’।
ভাবে, তার বৌ টা’রও কত মায়া! রূপচাঁদের কাছে থাকলে ছেলেটা মানুষ হতো না। ছেলেকে ভালো ইস্কুলে পড়তে দিয়েছে। পাঁচবাড়ি খেটে দু-পয়সা করেছে। নতুন ইঁটের গাঁথনি দেওয়া ঘরে ঝকঝকে টিনের চালা। বড় মায়া বৌটা’রও! সে আরেকটা নীল ফুলওয়ালা বুনো গাছের নাম রাখে
‘বৌ’।
পথচলতি লোকজন। কত কী বলে। নীরেন খুড়ো জিগোয়, ‘তা বাবা রূপচাঁদ, তোমার চাঁদের হাটের
বিকিকিনি কেমন চলছে?’ রূপচাদ জবাব করে না। মিটিমিটি হাসে। নীরেন খুড়ো গজর গজর করতে করতে চলে যায়, ‘যত্তসব আগল-পাগল, মদ্দ-মানুষ বসে খায় কী করে কে জানে!’
রূপচাঁদের অগোছালো বাগান। কত গাছ, কত গাছড়া! বাতাসে যেন নেচে ওঠে! রূপচাঁদকে ঘিরে তাদের কত আহ্লাদ, কত অভিমান, কত সুখ, কত না রাগ!
রূপচাঁদ গাছগুলোকে বলে, ‘আমার মাথায় একখানি হীরকখন্ড দানা বেঁধেছে গো,
সে এক মস্ত অসুখ, বাঁচি কি মরি, কে বা তা জানে!’ গাছগুলো মুষড়ে পড়ে যেন। আহা! রূপচাঁদ গাছগুলোর গায়ে মাথায় হাত বুলোয়। বিশুডাক্তার আসে
মাঝে মাঝে। কেউ জানে না, রূপচাঁদের ঠিক কী অসুখ! বিশুডাক্তার জানে। যতটা পারে রূপচাঁদকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করে।
ওষুধপত্তর জোগান দেয়। গাছ-পাগল মানুষটা!
সারা দিনমান খুরপি হাতে বাগান করে রূপচাঁদ। দিন পেরিয়ে রাত
নামলে ঘরের দাওয়ায় বসে লন্ঠনের ঝাপসা আলোয় বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকে। পদ্মপিসি অনেক
দিনই রাতের
খাবার দিতে আসতে পারে না। রূপচাঁদকে বলেছে কতবার, ‘চাড্ডি খেয়ে এলেও তো পারো বাপু আমার দাওয়ায় বসে!’ রূপচাঁদ যাবে না। খিদে পেলে চুপিচুপি ‘পদ্মপিসি’ গাছটার দিকে চেয়ে বলবে, ‘ও পিসি খেতে দিবিনে?’ রাত বাড়ে। লন্ঠনের আলো
আরো কমিয়ে দিয়ে দাওয়াতেই তাল পাতার পাটি পেতে শোয়। তাকিয়ে থাকে অনেক্ষণ বাগানটার দিকে। তারপর যে
গাছটার নাম ‘বৌ’
রেখেছে তাকে বলে, ‘ও ব্ কাছে আসবিনে?’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন