অবশেষে উপকূলে এসে নামলেন টোনি ভারসেতি
“অবশেষে তিনি উপকূলে আসিয়া নামিলেন” – এই পর্যন্ত পড়ে
ভারসেতি মাথা তুলল। তৃতীয় দিনের বিকেল প্রায় শেষ। অন্ধকার নামলেই
অসংখ্য সাদা ঢেউ জুড়ে উঠে আসবে মারমেড এবং ডল্ড্রামের উষ্ণতা। বুকের ওপর ঝুলে থাকা শীতল
ক্রুশ আঁকড়ে ধরে ভারসেতি। নির্জন
উপকূলে আজ তিন দিন হলো। হঠাৎ সকালে ঘুম
ভেঙ্গে আবিষ্কার করেছিল সে
নিজেকে এই জনশূন্য দ্বীপে। বাইবেল এবং আগের দিন জাহাজের নিচের তলার
ক্যাবিনের মেঝেতে কুড়িয়ে পাওয়া পারচমেন্ট তার পাশে। ভারসেতি কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করতে
পারেনি কীভাবে নিজের অজান্তেই সে এখানে এসে পৌঁছল। অথচ আগের রাতের
জৌলুস লেগে আছে চোখে মুখে ।
জাহাজের খোলে শেষ রাত যেদিন, পানীয়ের গ্লাসে বৃষ্টির
ফোঁটা এবং ভারসেতি নিচের ডেকে আবিষ্কার
করেছিল পুরনো এক পাণ্ডুলিপি, যা এই মুহূর্তে পড়ে আছে তার পাশে। ওপরের বৃষ্টি ভেজা
ডেক থেকে নেমে এসেছিল সে খালি পায়ে, ভারসেতির ঘরে। এই নারী যে আসলে কে ছিল, এই মুহূর্তে
ভারসেতি মনে করতে পারছে না। শুধু মনে পড়ছে ঘাড়ে গলায় যে মাদকতা, হাঁটছিল ভারসেতি, অলিগলি ছাড়িয়ে সুগন্ধের
দিকে, যেখানে ঈষৎ আর্দ্রতা – অক্ষরেখার ওপার থেকে যে
হাতছানি, অ্যালিসের মতো র্যাবিট হোলে ভাসতে
ভাসতে, জোন্স-এর লকারের গল্প যখন
সত্যি হয়ে ওঠে, দুরন্ত ঝড়ের গতিতে নিঃশেষ হতে হতে এই টোটেম দ্বীপে
ভারসেতি আবিষ্কার করে নিজেকে। র্যাবিট হোল
বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে অবশেষে হাতের লাল কাপড় উড়িয়ে দিয়েছিল। ওই দূরে সাদা জাহাজ। আশ্রয়
পায় ভারসেতি, লাল কাপড় উড়িয়ে। লাল মদ ও আপার ডেকে
মসলিন জড়িয়ে অভিবাদন জানায় ক্যাপ্টেন। ছেঁড়া ছেঁড়া
নেশায় রাত গভীরে গেলে ভারসেতি নিজেদের
আবিষ্কার করে আয়নায়। তাদের যৌথ ছায়ায় ক্যাবিন হয়ে উঠেছিল মহাসমুদ্র। আজও এক অচেনা নারী। এবং ভারসেতি বুঝতে
পারে, আগের দিন যে নারী এসেছিল তার ক্যাবিনে, সেও ছিল অচেনা, রহস্যময়ী।
রাতের মৃদু উষ্ণতার পরেই ভারসেতি নিজেকে আবার খুঁজে পায়
জনশূন্য ওই দ্বীপে। এই ধু ধু উপকূলে
দাঁড়িয়ে ভারসেতি ভাবছে কোনো এক কলেরা আক্রান্ত শহরের
সন্ধ্যেবেলা। জাদুকর অ্যালেক্স বলেছিল সমুদ্রের কথা। একটা দ্বীপ এবং অনন্ত স্বপ্ন, যেখানে সোনালি চুল মারমেড উঠে আসে। ভেজা ভেজা চুম্বনে
বছর ঘুরে যায়। কী এক জড়িবুটি আর যৌবন ছিল গল্পে, ভারসেতি সাদা জাহাজের নরমে
ঘুমিয়ে থাকে। নিবিড় আলোয়ে কেঁপে ওঠে চোখের
পাতা। ল্যাটিটিউড-লঙ্গিটিউড মাপা শেষ হলে বানায় একটা বোট। ভারসেতি পাড়ি দেয়
সমুদ্রে এই নিঃসঙ্গ দ্বীপকে পেছনে ফেলে। সাথে বাইবেল এবং
নিচের তলার ক্যাবিনের মেঝেতে কুড়িয়ে পাওয়া পাণ্ডুলিপি। এবার আর কোনো জাহাজের
ক্যাবিন নয়, নয় কোনো রহস্যময়ী নারী, যাদের
আলিঙ্গনের জাদুতে ভারসেতি
নিরাপদ জাহাজের আশ্রয় থেকে বার বার ফিরে গেছে এক অজানা দ্বীপে। এবার সে নিজে পাড়ি
দেবে সমুদ্রে। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ভারসেতি পড়ে ফেলবে পাণ্ডুলিপিটা।
ভারসেতি ভাবছে জাদুকর অ্যালেক্সের পর্দা মোড়া ঘর। ভারসেতির মনে পড়ে যায় তামাটে বৃদ্ধার চোখ, আবছা উচ্চারণে বৃদ্ধা
বলেছিল এক মসীহার কথা। ভারসেতি তার নাম মনে করতে পারছে না। চোখ আটকে গেছে
জৌলুসে। সামুদ্রিক মারমেডের ইঙ্গিত, কাছাকাছি ডল্ড্রামের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ক্রমশ মন্ত্রমুগ্ধ
হয়ে ওঠে বাতাস। ভারসেতি এখন জীবিত মানুষের কেউ নয়। মারমেডের শরীরের গন্ধ লেগে থাকে
তার শরীরে। কলার বোন ভিজে যায় মৃদু আস্কারায়। চারিদিকে যখন জল, ভারসেতি ক্রমশ হারিয়ে ফেলতে
থাকে নিজেকে, এই আপার ডেক, দূরে ভেসে আসছে কাদের গলার
ক্ষীণ আওয়াজ। আঙ্গুল ছোঁয়াতেই কেঁপে ওঠে গোটা শরীর। এইসব ভ্রম হয়ে যাবে কোনোদিন। শরীরে
লেগে থাকবে নিষ্ক্রিয় আঁশ। এখন সে এক মারমেডের কাছাকাছি, অনেক স্বপ্নের
মতো অথচ আগের দিনের রহস্যময়ীদের থেকেও বাস্তব।
ঘোর ভেঙ্গে গেলে ভারসেতি
ফিরে আসে দ্বীপে। অনন্ত হাতছানির বাইরে
সুমহান অট্টালিকা, মরীচিকার মতো দুটো কি একটা ইদারা, মোরগের লড়াই অস্পষ্ট হয় ধীরে। এখন আর কো্নো কাজ নেই। বালির ওপর
বিছিয়ে থাকা শরীর। হয়তো আর মুক্তি নেই এই দ্বীপ থেকে। অসহায়
ভারসেতি আকাশের দিকে তাকালে বেলা বাড়তে থাকে। বুকের ওপর শিথিল হয়ে থাকা ক্রুশ আঁকড়ে ধরে
হাত বাড়ায়। হাতের কাছে কুড়িয়ে পাওয়া পাণ্ডুলিপি। পাতা উল্টে ভারসেতি
পড়তে থাকে, “টোনি ভারসেতি পুনরায় উপকূলে আসিয়া নামিলেন”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন