চারানা আটানা
১৫) সাক্ষাৎকার
টুং করে একটা শব্দ হলো ল্যাপটপ থেকে।
ফেসবুক খোলা আছে, নির্ঘাৎ ইনবক্সে কোনো মেসেজ। খুলেই দেখি, হ্যাঁ, ঠিক তাই! কিন্তু প্রেরকের
সঙ্গে এ জীবনে কো্নো বাক্য-বিনিময় হয়েছে বলে
মনে পড়ছে না তো! মেসেজটি সংক্ষিপ্ত – ‘হাই ভাই, কেমন আসো?’ ইংরাজি অক্ষরে লেখা, ভাই বানান ভি আই।
আসো হচ্ছে এ এস ও। নিশ্চয়ই কেমন আছি জিজ্ঞেস
করছেন। প্রেরকের নাম বিডিপোক, সেটা আবার বাংলায় লেখা।
সৌজন্যমূলক প্রশ্নে
সৌজন্যমূলক উত্তর দেওয়াই দস্তুর। লিখলাম, ‘ভালো, আপনি?’
- ‘ভালো’।
এর পর বেশ কিছু
মিনিটের নীরবতা। তারপর এক সময় বিডিপোকের পাশের সবুজ বৃত্তটা ভ্যানিশ হয়ে গেল। এ
রকম তো হতেই পারে। বিডিপোক হয়তো আমার জীবনদেবতা। আমার
ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। যেই শুনলেন আমি ভালো আছি, উনি নিশ্চিন্ত হয়ে
নিদ্রা গেলেন। হয়তো ফেসবুক থেকে লগ অফ করলেন।
ও মা, না! প্রায় ঘন্টাখানেক
পরে আবার টুং! বিডিপোক এগেইন। এবারের প্রশ্ন, ‘আফনি কি ইন্ডিয়ায়
থাকেন?’
-
হ্যাঁ। আপনি?
-
ঢাকা। আমি আফনার প্রোফাইল সেক করতে সিলাম। আফনার কবিতা আমি পড়সি।
-
বেশ।
-
আমার ফ্রেন্ড্স্রা কইসিলো আফনার বেপারে। আমি তো নানান
কাজে বেস্তো থাকি।
-
স্যরি, কিছু যদি মনে না করেন, আমি আপনার ব্যাপারে কিছুই জানি না। নাম, কী করেন –
-
আমি ঢাকাতে একটা সাহিত্য এজেন্সি চালাই।
-
কী নাম তার?
-
বিডিপোকার এজেন্সি।
-
স্যরি! বিড়ি ফোঁকার এজেন্সি!
-
না ভাই। কী যে কন! বিডিপোকার। বিডি অইলো বাংলাদেশ। পোকার মানে আমরা পোক করি, ঠোকরাই। বোঝেনই তো। সাহিত্যিকদের লগে আমার কারবার।
-
আচ্ছা। এবার পরিষ্কার হলো। খুব ভালো কাজ আপনার।
-
আফনার একখান সাক্ষাৎকার যদি দ্যান –
-
আমার সাক্ষাৎকার! মানে, আমি তো –
-
আরে মশয়, আফনারে আমি ঠুকরামু না। এই কয়ডা কোশ্চেন করমু, আফনে টাইম লইয়া উত্তর দেবেন। আমরা হেডা সাপাইমু।
-
অ।
-
কখন আফনার সুবিধা হয় কয়েন? আমি সেই সময় –
-
কখন আর কী! বলে ফেলেন আপনার কী কোশ্চেন। উত্তর জানা থাকলে দিয়ে দিচ্ছি।
-
অ্যাখুনি! কন কী! ঠিক আসে, জিগাই?
-
জিগান।
প্রশ্ন আসতে লাগলো।
আমিও যথাসাধ্য উত্তর দিতে লাগলাম। প্রশ্নগুলো আর অরিজিন্যাল বানানে দিচ্ছি না, তার প্রয়োজন নেই।
-
আচ্ছা, এপার বাংলা আর ওপার বাংলার আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে আপনার কী
ধারণা?
-
আমার ধারণা? গুয়ের মতো।
-
মানে?
-
গুয়ের এপিঠ আর ওপিঠ থাকে, রাইট?
-
এত খারাপ?
-
খারাপ তো বলিনি। গু কি খারাপ? অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থ নয়?
-
মানে দু সাইডের কবিতাই প্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থ?
-
আমি তাও বলিনি।
-
তাই তো কইলেন! আচ্ছা, বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা আধুনিক কবিতার মান কেমন বলে আপনার মনে হয়?
-
সেটা বিশ্বসাহিত্য না পড়লে তো বলা মুশকিল। আদ্দিস আবাবার
প্রবন্ধ বা হনোলুলুর সনেট তো পাই না এখানকার লাইব্রেরিতে, ভিয়েৎনামীজ চর্যাপদও নয়। এক ইতালিয়ান ভদ্রমহিলার দ্বারা এক ইন্ডিয়ান অথরের লেখার
ইংরাজি অনুবাদ
দেখে চমকে উঠেছিলাম, বেশ দারুণ
রোমান্টিক কবিতা তো! তারপর বইটার কভারে
নাম দেখে মালুম হলো, ওটা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা।
-
কন কী! আপনি ফরাসী, রুশ, ইতালিয়ান, চেকোশ্লোভাকিয়ান সাহিত্য পড়েন নি?
-
না। বাংলাটাই পড়া হয়নি। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের পর রবিতে এসে আটকে গেছি।
-
জীবনানন্দরে কেমন লাগে আপনার?
-
ভীষণ জীবনানন্দীয়। জীবন নিয়ে দুর্ধর্ষ আনন্দ ছিল ভদ্রলোকের।
ট্রামে চাপা পড়ে মারা গেলেন সেই আনন্দে। নাটোরের বনলতা সেই খবর পেয়ে ইনসেন হয়ে
গেল।
-
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের খবর রাখেন?
-
না। তবে যে ভদ্রলোক অভ্র কীবোর্ড বানিয়েছেন, তার প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা। উনিই বাংলার
প্রকৃত আধুনিক ভাষা আন্দোলনকারী।
-
আরে না, সে কথা বলছি না। এই যে ভাষা নিয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে –
-
যার ফলে গালাগালি-খিস্তিখাস্তা সব সাহিত্যের জাতে উঠে যাচ্ছে, তাদের কথা?
-
আপনার কী মত? ভাষার কোনো স্বাধীনতা থাকবে না?
-
কেন থাকবে না? হাজার বার থাকবে। যত খুশি স্বাধীনতা থাকা উচিত। তবে যারা
লিখবে, তারাই যদি পড়ে আর শোনে, তবে সমস্যাটা প্রখর হয় না! এই যেমন আপনি আমাকে এরপর জিজ্ঞেস করবেন, সেই ধরনের লেখার ব্যাপারে আমার মত কী? আমার উত্তর, সব ব্যাপারে আমার মতের প্রয়োজনই বা কী? আপনার ইচ্ছা হয়, আপনি লিখুন। লিখে নিজে পড়ুন। পড়ে আনন্দ উপলব্ধি করুন। যাকে
গালাগালি দিতে চান, তার সামনে গিয়ে জোরে জোরে পড়ুন। সে যদি আপনাকে
ঠাস করে ডান গালে একটা চড় মারে, গান্ধীর মতো তার দিকে বাঁ গালটা এগিয়ে দিন। চান্সেজ আর, ও গালেও একটা থাপ্পড় পড়বে। পড়ুক। আপনি থামবেন না। লড়ে যান।
মারধর না খেলে আর কীসের আন্দোলন?
-
আপনি একটা সিরিয়াস আন্দোলনকে হাস্যকর পর্যায়ে নামিয়ে আনলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে তাহলে কী বলবেন?
-
একুশে ফেব্রুয়ারিই বলব। বাইশে শ্রাবণ বা বিশে ডাকাত হার্গিজ
বলব না।
-
আধুনিক কবিতায় এই যে শব্দকে, ভাবকে, ভাষাকে, ফর্মকে বিভিন্ন ভাবে ভাঙা হচ্ছে –
-
দারুণ ভাঙা হচ্ছে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে সাহিত্যের ন্যানোপার্টিক্ল্। কমলার কোয়ার মতো কোয়ান্টাম কবিতা।
-
আপনি কি বলতে চাইছেন কোয়ান্টাম কবিতা কবিতা নয়?
-
তাই বললাম? ইফ ইট ওয়াক্স্ লাইক এ ডাক, টক্স্ লাইক এ ডাক, কোয়াক্স্ লাইক এ ডাক – ইট মাস্ট বি এ ডাক। কোয়ালা বা গোয়ালা নয়। গোয়াতে বা
গোয়ালন্দতে থাকলেও নয়।
-
আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে আপনার এই রকম সার্কাস্টিক ভিউ কেন?
-
সার্কাস্টিক? তাই মনে হচ্ছে? ওয়েল, ইফ ইট্স্ এ সার্কাস –
-
আধুনিক কবিতা সার্কাস? তাহলে আপনার মতে বেস্ট কবি কে?
-
ডিপেন্ড্স্। কবি কে? যে কবিতা লেখে, সেই কবি। কবিতা কী? কবি যা লেখে, তাই কবিতা।
-
হাসালেন। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে, যার ইচ্ছা সে কবিতা লিখতে পারবে না? কবিতা কে লিখবে তাহলে?
-
লিখবে কবিতার ব্রাহ্মণরা। ‘বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার ব্রহ্মবিদ্যালাভে’।
-
আপনি কি ব্রাহ্মণ? আ্পনি যে কবিতা লেখেন –
-
আমি? কই, এমন বদনাম তো কেউ দেয়নি। অন্তত আমার কানে যায়নি, এই একটুক্ষণ আগে আপনি বাদে। অবশ্য আপনি তো পাঠক
বা পাঠিকা নন, পোকার।
-
হুম। কিন্তু আপনি তাহলে কী? আপনি লেখালিখি করেন না?
-
করি তো। সময় পেলেই করি। আমি জানি পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান
সোর্ড, মাউস ইজ ফাস্টার দ্যান ফোর্ড, ইন্টারনেট ইজ মোর ইন্টিমিডেটিং দ্যান বিটারগোর্ড
-
-
আপনি যা লেখেন, আপনার মতে সেগুলো কবিতা?
-
না।
-
তাহলে কী?
-
আন্দোলন। এত লোক দোলাচ্ছে, এত লোক দুলছে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলছে প্রতি ক্রিয়ারই
সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। দোলনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া আন-দোলন –
-
বুঝলাম না। সাহিত্যে নিউটনের সূত্র এটসেট্রা –
-
লুক, সাহিত্য আর বিজ্ঞান আলাদা কিছু নয়। সাহিত্যিক লুক্স্ ফর
বিউটি, বিজ্ঞানী লুক্স্ ফর ট্রুথ। বিউটি ইজ ট্রুথ, ট্রুথ ইজ বিউটি। কিন্তু, ঘটনা হচ্ছে, সাহিত্য অ্যান্ড শাহীত্ব মে সাউন্ড সিমিলার, বাট অ্যাকচুয়ালি আর অ্যাজ ডিফারেন্ট অ্যাজ আমরা
ভার্সাস আমড়া।
-
আই অ্যাম স্যরি ভাই, আমি আফনার একটা সাক্ষাৎকার ছাপতে চাইসিলাম। কিন্তু আফনি সব
কাচরা কইরা সাইরা দিলেন। এসব ছাপা যাবে না। আফনি এসব আপনার ওয়ালেই পোস্টান।
-
ওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তা ছাড়া আর উপায় কী?
-
পিঠ? কার পিঠ?
-
দু’ পক্ষেরই।
-
দু’ পক্ষ? মানে? কোন্ কোন্ পক্ষ?
-
এপিঠ আর ওপিঠ। ওই যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থ, তার!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন