দিবালোক সংরক্ষণ
পৃথিবীতে দিনের আলো ক্রমেই কমে আসছে। মানুষ বিভিন্ন দেশের আলাদা আলাদা দিবারাত্রির চক্রে আন্তর্জাতিক সময়ের বিচিত্র ভেরিয়েশনের মধ্যেও এক মুঠো আলো ধরে রাখার চেষ্টা করছে। দেশে দেশে রাষ্ট্র ও প্রশাসন দিবালোক সংরক্ষণের নানাবিধ উপায় বের করেছে এবং তাদের বাস্তবায়িত করে চলেছে নানাভাবে। এইসব খুজলিতে সময়ের বুকে যেসব বড় বড় ফাটল তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে, তার ভেতর থেকে অন্য অন্যান্য কয়েকটা নতুন অজানা সময় গজিয়ে উঠছে। কাজের সময় বাড়ানোর জন্য ঘড়ি অদল বদল করে শ্রমসময় বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এতে করে মার্কস সাহেবের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে কী রকমের হেরফের হয়ে যাচ্ছে বা হচ্ছে না, তা গ্রিনিচ সময় ধরে নির্দিষ্ট করে এখনো বলা যাচ্ছে না।
সিডনি শহর, শীতেশ এখন যেখানে থাকে, সেখানেও দিবালোক সংরক্ষণ বা ডে লাইট সেভিংস বলে একটা ব্যাপার হয়। শীতকালে তাড়াতাড়ি অন্ধকার ঘনিয়ে আসে বলে কাজের সময় বাড়ানোর জন্য সময় একঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। গরম পড়লে সময় আবার এক ঘন্টা এগিয়ে আসে। ভারতে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহ, অস্ট্রেলিয়ায় তখন শীত আর ডিসেম্বরে যখন কলকাতায় শীতের একটা আমেজ আসে, হেথায় তখন তাবড় রোদ। সিডনিতে তাপমাত্রা ৪০ ছোঁয়। যদিও ড্রাই হিটে বিশেষ ঘাম হয় না, তাও এসময় শীতেশের কেমন যেন স্বদেশ স্বদেশ ভাব হয়। ২০১৪র ৬ই এপ্রিল, শীত তখন পড়বে পড়বে করছে, দুপুর ৩টে নাগাদ নিউ সাউথ ওয়েল্সের ঘড়িগুলোকে এক ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ দুপুর দুটো।
শীতেশ তার ল্যাপটপে সময় দেখে নেয়, দুপুর তিনটে। অনেকক্ষণ ডেস্কে বসে কম্পিউটারে কাজ করছে। একটা সিগারেট খাওয়া খুবই দরকার হয়ে পড়ায় সে তার কাচে মোড়া অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে পেছনে ওভালের দিকে হাঁটতে থাকে। হাওয়ায় হাল্কা ঠান্ডা ভাবটা আর আভোয়েড করার মতো নয়। ওভালের সামনের সবুজ অংশটায় বসে শীতেশ দেখে মাঠে খেলা হচ্ছে। ক্রিকেট। এই মাঠে সে এর আগে ফুটবল হতে দেখেছে, কিন্তু না, ক্রিকেট কখনো দেখেনি। ইনফ্যাক্ট এদেশে আসার আগে তার যে ধারণা ছিল যে, অস্ট্রেলিয়া ইজ বিগ অন ক্রিকেট, তা অচিরেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ক্রমেই শীতেশ বুঝতে পেরেছে, ভারতের মতো দেশে ক্রিকেট কত বড় একটা ডিষ্ট্রাকশনের কাজ করে... ক্রিকেট দিয়ে দেশবাসীকে কত কিছু ভুলিয়ে রাখা হয়! এখানে অভাব কম বলেই কি ক্রিকেট নামক পর্দার প্রয়োজনও কম? যাক, অনেকদিন পর ক্রিকেট খেলা দেখতে পেয়ে শীতেশ গুছিয়ে বসে।
খেলা দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ কেটে যায়। শীতেশ উঠে পড়ে। প্যাকেটের পড়ে থাকা ৪টে সিগারেটই ধোঁয়া হয়ে গেছে ফুসফুসের ভেতরে বাইরে। ওভাল ছেড়ে ব্যাকইয়ার্ড বরাবর নিজের অফিসের দিকে হাঁটতে থাকে শীতেশ। মনে মনে ভাবে, অনেকটা দেরী করে ফেললো। এখনো ঘন্টা দুয়েকের কাজ বাকি, তবে অফিস ছাড়ার প্রশ্ন। যত শীত পড়ছে, দিনগুলোও ক্রমশ মিইয়ে ছোট হয়ে আসছে। নাহ, এতক্ষণ ক্রিকেটটা বোধ হয় না দেখলেই হতো! অফিসের কাছাকাছি এসে ভুরু কুঁচকে তাকায় শীতেশ। এখান থেকে কাচের ওপারে তার ডেস্কটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একি? কেউ একটা বসে আছে না ওখানে? কিন্তু কেই বা এসে বসবে তার ডেস্কে? এদেশে অফিসের ফর্মাল স্পেসে এহেন রসিকতা তো কেউ করে না! শীতেশ আরেকটু পা চালায়। এবার তার ডেস্কে তার ল্যাপটপের সামনে বসে থাকা লোকটাকে আরো স্পষ্টাস্পষ্টি দেখতে পায় শীতেশ। লোকটাও এবার তার দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু এ কেমন করে হয়! কাচটা কি তবে আয়না হয়ে গেল? তার ম্যাকবুক থেকে যে লোকটা মাথা তুলে জানালা দিয়ে ব্যাকইয়ার্ড বরাবর হনহনিয়ে হেঁটে আসা শীতেশকে পা থেকে মাথা অব্দি মেপে নিচ্ছে, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং শীতেশ।
ম্যাকবুক ডে লাইট সেভিংস ধরে নিতে পারে। সেখানে এখনো একজাক্টলি ৩টেই বেজে রয়েছে। শীতেশের এবার একটা স্মোকিং ব্রেইক নিতে ইচ্ছে করছে। অনেকক্ষণ টানা কাজ করেছে সে।
এটা এপ্রিল মাস। সাল ২০১৪। এখনো জুলাই আসতে মাস তিনেক বাকি। এখনো গাজায় ইজরায়েলি আক্রমণে ১,৯৭৫ জন পালেস্তিনিয়ান মারা যাননি, যাদের ১,৪১৭ জন সিভিলিয়ান, ৪৫৯টি বাচ্চা এবং ২৩৯ জন মহিলা। আজ থেকে ৬ দিন আগে অর্থাৎ ২৮শে মার্চ ২০১৪র মাঝরাত থেকে গাজায় ডে লাইট সেভিংস শুরু হয়েছে। তবে সেখানে সময় এক ঘন্টা পেছোয়নি, বরং ততটাই এগিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর যখন গাজা আবার ওই হারানো এক ঘন্টা সময় ফিরে পাবে ঠিক মধ্যরাতে, ততদিনে শ্রমসময়ের উর্দ্ধে সেখানকার মৃত্যুসংখ্যা হয়তো দু’হাজার ছাপিয়ে যাবে।
২৮শে মার্চের মধ্যরাত থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বরের মধ্যরাত পর্যন্ত ওই হারানো এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে আটকে থাকবে আমাদের শীতেশ... ঠায় বসে থাকবে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আর মাঝে মাঝে কাচ দিয়ে বাইরে ব্যাকইয়ার্ডে ধূমপানরত অচেনা যুবককে দেখে নেবে আড়চোখে। গাজায় সময় এগিয়ে গেছে, পিছিয়ে আসার জন্য আর শীতেশ চড়চড় করে এগিয়ে যেতে গিয়ে, পিছিয়ে পড়েছে থমক খাওয়া দুপুর ৩টেয়।
গাজায় দিনের আলো ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সূর্যের থেকে বিস্ফোরণের আলোর তেজ বেশি, আফটার অল! ব্যাড লাইট নয়, বরং এই টু গুড লাইটের কারণেই এবারকার মতো ক্রিকেট খেলা পরিত্যক্ত হয়েছে।
(উৎসর্গ : নবারুণ ভট্টাচার্য)
পৃথিবীতে দিনের আলো ক্রমেই কমে আসছে। মানুষ বিভিন্ন দেশের আলাদা আলাদা দিবারাত্রির চক্রে আন্তর্জাতিক সময়ের বিচিত্র ভেরিয়েশনের মধ্যেও এক মুঠো আলো ধরে রাখার চেষ্টা করছে। দেশে দেশে রাষ্ট্র ও প্রশাসন দিবালোক সংরক্ষণের নানাবিধ উপায় বের করেছে এবং তাদের বাস্তবায়িত করে চলেছে নানাভাবে। এইসব খুজলিতে সময়ের বুকে যেসব বড় বড় ফাটল তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে, তার ভেতর থেকে অন্য অন্যান্য কয়েকটা নতুন অজানা সময় গজিয়ে উঠছে। কাজের সময় বাড়ানোর জন্য ঘড়ি অদল বদল করে শ্রমসময় বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এতে করে মার্কস সাহেবের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে কী রকমের হেরফের হয়ে যাচ্ছে বা হচ্ছে না, তা গ্রিনিচ সময় ধরে নির্দিষ্ট করে এখনো বলা যাচ্ছে না।
সিডনি শহর, শীতেশ এখন যেখানে থাকে, সেখানেও দিবালোক সংরক্ষণ বা ডে লাইট সেভিংস বলে একটা ব্যাপার হয়। শীতকালে তাড়াতাড়ি অন্ধকার ঘনিয়ে আসে বলে কাজের সময় বাড়ানোর জন্য সময় একঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। গরম পড়লে সময় আবার এক ঘন্টা এগিয়ে আসে। ভারতে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহ, অস্ট্রেলিয়ায় তখন শীত আর ডিসেম্বরে যখন কলকাতায় শীতের একটা আমেজ আসে, হেথায় তখন তাবড় রোদ। সিডনিতে তাপমাত্রা ৪০ ছোঁয়। যদিও ড্রাই হিটে বিশেষ ঘাম হয় না, তাও এসময় শীতেশের কেমন যেন স্বদেশ স্বদেশ ভাব হয়। ২০১৪র ৬ই এপ্রিল, শীত তখন পড়বে পড়বে করছে, দুপুর ৩টে নাগাদ নিউ সাউথ ওয়েল্সের ঘড়িগুলোকে এক ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ দুপুর দুটো।
শীতেশ তার ল্যাপটপে সময় দেখে নেয়, দুপুর তিনটে। অনেকক্ষণ ডেস্কে বসে কম্পিউটারে কাজ করছে। একটা সিগারেট খাওয়া খুবই দরকার হয়ে পড়ায় সে তার কাচে মোড়া অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে পেছনে ওভালের দিকে হাঁটতে থাকে। হাওয়ায় হাল্কা ঠান্ডা ভাবটা আর আভোয়েড করার মতো নয়। ওভালের সামনের সবুজ অংশটায় বসে শীতেশ দেখে মাঠে খেলা হচ্ছে। ক্রিকেট। এই মাঠে সে এর আগে ফুটবল হতে দেখেছে, কিন্তু না, ক্রিকেট কখনো দেখেনি। ইনফ্যাক্ট এদেশে আসার আগে তার যে ধারণা ছিল যে, অস্ট্রেলিয়া ইজ বিগ অন ক্রিকেট, তা অচিরেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ক্রমেই শীতেশ বুঝতে পেরেছে, ভারতের মতো দেশে ক্রিকেট কত বড় একটা ডিষ্ট্রাকশনের কাজ করে... ক্রিকেট দিয়ে দেশবাসীকে কত কিছু ভুলিয়ে রাখা হয়! এখানে অভাব কম বলেই কি ক্রিকেট নামক পর্দার প্রয়োজনও কম? যাক, অনেকদিন পর ক্রিকেট খেলা দেখতে পেয়ে শীতেশ গুছিয়ে বসে।
খেলা দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ কেটে যায়। শীতেশ উঠে পড়ে। প্যাকেটের পড়ে থাকা ৪টে সিগারেটই ধোঁয়া হয়ে গেছে ফুসফুসের ভেতরে বাইরে। ওভাল ছেড়ে ব্যাকইয়ার্ড বরাবর নিজের অফিসের দিকে হাঁটতে থাকে শীতেশ। মনে মনে ভাবে, অনেকটা দেরী করে ফেললো। এখনো ঘন্টা দুয়েকের কাজ বাকি, তবে অফিস ছাড়ার প্রশ্ন। যত শীত পড়ছে, দিনগুলোও ক্রমশ মিইয়ে ছোট হয়ে আসছে। নাহ, এতক্ষণ ক্রিকেটটা বোধ হয় না দেখলেই হতো! অফিসের কাছাকাছি এসে ভুরু কুঁচকে তাকায় শীতেশ। এখান থেকে কাচের ওপারে তার ডেস্কটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একি? কেউ একটা বসে আছে না ওখানে? কিন্তু কেই বা এসে বসবে তার ডেস্কে? এদেশে অফিসের ফর্মাল স্পেসে এহেন রসিকতা তো কেউ করে না! শীতেশ আরেকটু পা চালায়। এবার তার ডেস্কে তার ল্যাপটপের সামনে বসে থাকা লোকটাকে আরো স্পষ্টাস্পষ্টি দেখতে পায় শীতেশ। লোকটাও এবার তার দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু এ কেমন করে হয়! কাচটা কি তবে আয়না হয়ে গেল? তার ম্যাকবুক থেকে যে লোকটা মাথা তুলে জানালা দিয়ে ব্যাকইয়ার্ড বরাবর হনহনিয়ে হেঁটে আসা শীতেশকে পা থেকে মাথা অব্দি মেপে নিচ্ছে, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং শীতেশ।
ম্যাকবুক ডে লাইট সেভিংস ধরে নিতে পারে। সেখানে এখনো একজাক্টলি ৩টেই বেজে রয়েছে। শীতেশের এবার একটা স্মোকিং ব্রেইক নিতে ইচ্ছে করছে। অনেকক্ষণ টানা কাজ করেছে সে।
এটা এপ্রিল মাস। সাল ২০১৪। এখনো জুলাই আসতে মাস তিনেক বাকি। এখনো গাজায় ইজরায়েলি আক্রমণে ১,৯৭৫ জন পালেস্তিনিয়ান মারা যাননি, যাদের ১,৪১৭ জন সিভিলিয়ান, ৪৫৯টি বাচ্চা এবং ২৩৯ জন মহিলা। আজ থেকে ৬ দিন আগে অর্থাৎ ২৮শে মার্চ ২০১৪র মাঝরাত থেকে গাজায় ডে লাইট সেভিংস শুরু হয়েছে। তবে সেখানে সময় এক ঘন্টা পেছোয়নি, বরং ততটাই এগিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর যখন গাজা আবার ওই হারানো এক ঘন্টা সময় ফিরে পাবে ঠিক মধ্যরাতে, ততদিনে শ্রমসময়ের উর্দ্ধে সেখানকার মৃত্যুসংখ্যা হয়তো দু’হাজার ছাপিয়ে যাবে।
২৮শে মার্চের মধ্যরাত থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বরের মধ্যরাত পর্যন্ত ওই হারানো এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে আটকে থাকবে আমাদের শীতেশ... ঠায় বসে থাকবে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আর মাঝে মাঝে কাচ দিয়ে বাইরে ব্যাকইয়ার্ডে ধূমপানরত অচেনা যুবককে দেখে নেবে আড়চোখে। গাজায় সময় এগিয়ে গেছে, পিছিয়ে আসার জন্য আর শীতেশ চড়চড় করে এগিয়ে যেতে গিয়ে, পিছিয়ে পড়েছে থমক খাওয়া দুপুর ৩টেয়।
গাজায় দিনের আলো ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সূর্যের থেকে বিস্ফোরণের আলোর তেজ বেশি, আফটার অল! ব্যাড লাইট নয়, বরং এই টু গুড লাইটের কারণেই এবারকার মতো ক্রিকেট খেলা পরিত্যক্ত হয়েছে।
(উৎসর্গ : নবারুণ ভট্টাচার্য)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন