শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
রাত্রি হলে আলো না
জ্বালালে তার কিছুই থাকে না
দেবোত্তর
সম্পত্তির মতোন বাংলা ভাষা পড়ে আছে। যার সম্পত্তি তার রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহ নেই। আবার কর জোটে না বলে প্রশাসনেরও কিছু যায় আসে
না। ব্যাঙের ছাতার মতোন মধ্যবিত্ত আর ইংরেজী মাধ্যম ইস্কুল বেড়ে চলেছে। ইস্কুলে
একবার ঢুকলে শেষ
অব্দি গাঁটের যথাসম্ভব কড়ি খরচ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার এই সব সংশাপত্র নিয়ে বেরোবার আয়োজনও সম্পূর্ণ। যাঁরাই মন্টেসারি
বা প্লে ইস্কুল খোলেন, তাঁরাই আবার অন্য
নামে ইঞ্জিনীয়ারিং বা ডাক্তারির বেসরকারী কলেজ খোলেন। কিছু না হলে শিক্ষক শিক্ষণের
কলেজ খোলেন। সব খোলে, কিছুই পরা হয় না,
পড়া হয় না। বাংলা ভাষার থেকে বাংলার ধন-সম্পদ অর্জনকারী সন্তানেরা
দূরে প্লেনে উড়ে-টুড়ে যায়।
মালদহের একটি
কলেজের অভিজ্ঞতা না বলেই পারছি না। বাংলার দিদিমণি প্রশ্ন করেছেন, পাশ্চাত্য সাহিত্যের সেরা ছোট-গল্পকার কে? প্রশ্নটি অত্যন্ত বোকা বোকা, পরীক্ষাগুলো যা
সারা বছর হয়ে থাকে চাকরি ইত্যাদির জন্য, তেমন বাইনারি স্বভাবের।
উত্তর অসামান্য। একঘর শিক্ষক-শিক্ষিকা। এঁরা একেকজন আট-নয় বছর প্রাথমিক শিক্ষা
দিচ্ছেন বিভিন্ন ইস্কুলে। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। সবশেষে একজন উঠলেন। তিনি অপেক্ষাকৃত তরুণ। সম্পন্ন কৃষক পরিবারের
সন্তান। বাইকে করে আসেন। ক্লাসের মধ্যে সব চাইতে তরুণী
হলেন যে শিক্ষিকা, ক্লাস নিচ্ছিলেন তিনি। তো সম্ভবত তাঁকে ইম্প্রেস করতে তাঁর ওঠা। খুব গম্ভীর
গলায় বললেন,
- সত্যজিৎ রায়!
অধম কলমচি সেই
ক্লাসে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পেশার সূত্রে কিছু কলেজ, ইস্কুল, সংস্থা অধমকে
ডেকে থাকে বিহেভিয়ার্যাল ব্যাপার স্যাপার শিক্ষা দিতে। তো সে সমস্ত শিক্ষা দিতে
গিয়ে যে শিক্ষা পেতে হয়, তা কম কিছু না। গ্রাম বাংলা ও মফঃস্বলের শিক্ষক সমাজে সকলেই এমন, তা অবশ্যই নয়।
কিন্তু এই মুহূর্তে যাঁরা পড়াচ্ছেন, তাঁদের হাল যে খুব উন্নত, তা বলতে সাহস হয় না।
কথা হচ্ছে ধান
ভাণতে শিবের গীত কেন! আজ্ঞে খুব সামান্য কারণে। সত্যজিৎ রায়, যাঁর উপরে প্রচারের আলো সর্বদাই রয়েছে,
বাঙালির দুষ্প্রাপ্য আইকনগুলোর মধ্যে সগৌরবে একজন যিনি, তিনিই যদি পাশ্চাত্য সাহিত্যের সেরা ছোটগল্পকার হয়ে যান, তাহলে স্বদেশ সম্পর্কে আমি কীই বা লিখি!
আলো-টালো খুব
তো পড়েনি। থাকতেন কলকাতা থেকে দূরে। ভূগোলে ও মননে। কলকাতার দাদা-দিদিদের ‘তিনি কত দরিদ্র’, তা বলে করুণা কুড়োননি। আহা, তিনি বঞ্চিত, তাই সংরক্ষণ দরকার বলেননি! তাহলে বহুল প্রচারিত কেন তাঁর
প্রচার করবে? একদা বাম ছাত্ররাজনীতির মানুষ। কবিতার
যাত্রাতেও কিছু অন্য সন্ধানে মগ্ন।
উপনিবেশের
দিন-কালের পর থেকেই একটা ভাবনা খুব বেশি মাত্রায়
প্রচলিত। যখনই কোনো মাধ্যমে কোনো নতুন কিছু ঘটে, তখনই ভাবনাটা
আসে, এটা তাহলে ইউরোপ থেকে নেওয়া। ভাবনাটা এত স্পষ্ট করে এসেছে এই ঔপনিবেশিক
যুগেই। নেওয়া-নেওয়ি তো সভ্যতারও আগের বিষয়। এটা না হলে তো অন্ধ-আতুর এক পৃথিবী হতো
মানুষের। তাছাড়া সময় তো কাউকে ছেড়ে যাচ্ছে না। সকলের পিঠে সমান চাবুকের দাগ আছে।
কেউ ব্যথা পায়, কেউ পেতেও ভুলেছে।
স্বদেশ সেনও
বরিশালের, সেই জীবনানন্দের মতোন। বাংলা কবিতায় ইউরোপের ধারার কথা বলেছেন সহজ করে। ইউরোপ এসেছে বিষ্ণু দে-র উল্লেখে। জীবনানন্দে চিন্তায় এবং রূপে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কিটস, বায়রণ, শেলী গুলে খেয়েও
ঔপনিষদিক রয়ে গেলেন। ভাবার মতোন কথা। বলেছেন, বাংলা কবিতা গড়ে
উঠেছে ছেলেমানুষী জাম্পকাট
সিস্টেমে। ইউরোপীয় কাব্য আন্দোলনের অনেকগুলো ধারা লাফিয়ে ধেবড়ে একটা জায়গায় পৌঁছতে
চেয়েছে। তাহলে ভেতর থেকে আসেনি বদল! এসেছে বাইরের চাপানো রঙে। তো সে রঙ তো খসে যাবেই। বোধহয় গিয়েওছে একরকম তাঁর চোখে।
অন্যত্র নতুন
কবিতার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, শব্দ সম্পর্কে,
বাক্য সম্পর্কে আরো চিন্তার
দরকার। বাক্যটাকে আমরা ভুলেই গেছি প্রায়! পরম্পরাগত কবিতায় বাক্য প্রধান, পংক্তি প্রধান একটা ব্যাপার ছিল। সব মিলিয়ে একটা ব্যাপার হতো, তা থেকে অনেক কিছুকে বাদ দিয়ে দিলেও বাক্যকে এত অবহেলা করা
চলে না। শব্দের দিকে এত বেশি নজর চলে যাচ্ছে, বাক্যর ভাবনা
ভাবা হচ্ছে না।
তবে কি চমকপ্রদ
পংক্তির কথা বলেছেন? হ্যাঁ এবং না। চমক
তো থাকবেই। ভালো লাগে বলেই
সেগুলো চমকপ্রদ। কিন্তু টোটালিটিও থাকবে। বলতে গিয়ে একটা ক্রাইসিসের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। চারপাশে তো এখন যে সময়, তাতে কোনো
কিছুই ডেফিনিট না।
চমৎকার বলেছিলেন বারীন ঘোষাল। একটি ছেলের দশটায় আসার কথা থাকলে সে একটাতে আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। বারীন ঘোষাল কিন্তু দশটা
বললে সোয়া দশটাতে অন্তত আসবেনই। অর্থাৎ একটা যাত্রা এবং তার গন্তব্য সম্পর্কে নির্দিষ্ট চেহারা স্বদেশ সেন বা বারীন ঘোষালের আছে। কিন্তু যাদের নেই? তাদের কবিতা তাহলে কী হবে? এমন অনির্দিষ্ট?
তা নয়! তা তো
হবার যো নেই। ছেলেটি এখানে এলো না, কিন্তু কোথাও গেল। কোথাও যদি না যায়, তাহলে যেখানে
ছিল সেখানেই রইলো। শারীরিক পথের বদলে সে একটা সময়
অতিক্রম করল। এবং সময়! এই কাঁটাটাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে
পারবে না। ক্ষমতার বাইরে তার। শৈশব, কৈশোর, যৌবন হ্যানো-ত্যানো হয়ে মৃত্যু। আছে তো
যাত্রা!
স্বদেশ সেনের কবিতায়
আছে। বিষয় এবং যাত্রার দু’চার কথন।
“...তোমার পুঁজি ভাঙা
আর দেনা শোধের কষ্টই এক
বিষয়
আমার বিষয় আমার
অঙ্গুলি হানি
শুকনো জলের
শুকিয়ে আসাই এক বিষয়
আমার বিষয়
মৃত্যু”।
-- বিষয়।
পুঁজি ভাঙার
গল্প যায় দেনা শোধের দিকে। আঙুল থাকার গল্প যায় না থাকার দিকে। জলের গল্প
শুকিয়ে যাওয়াতে যায়, জীবন মৃত্যুতে!
তাহলে যে ইনডেফিনিট সে চিনতে পারছে না বলে অমন। যে ডেফিনিট সেও যে সব চিনলো এমন নয়। যা চিনলো তাই।
কিন্তু যা চিনলো তাই কি শেষ?
না। স্বদেশ সেন, তাঁর কথা সূত্রেই সিরিয়াস লেখালিখি পঞ্চাশের মধ্যভাগে করছেন শুরু। তো সেই মাননীয় স্বদেশ সেন, অনুচ্চকিত স্বদেশ সেন ডিটারমিনিস্টের কোট
পরে ঘুরছেন না।
“না হওয়া মানুষ তার খোলা আয়নাতেও উঠে আসে না”
এখান থেকে শুরু
হয়েছিল।
“বৃষ্টিতে আগমন ক'রে এসে ফিরতে হয় কাদানো মাটিতে
কথা এই যদি
দুঃখের চাল তবে সুখের ভাত হয় না।
কেন রে দুলাল
হয়ে উঠিস না?...”
-- অভিমান।
কী এক উৎসবের মতোন বৃষ্টি এসেছিল, যে বৃষ্টিতে আগমন হয়, সাদা বাংলায় আসা হয় না। প্রতিদিন থেকে
বিশেষকে পৃথক করতে এই আগমন আর আসার রদবদল। অথচ তাতে যাওয়া তো হলো না। ফিরতে হয় কাদানো মাটিতে। উৎসব শেষ, উৎসব ব্যর্থ। “কেন রে দুলাল হয়ে উঠিস না?” মমতাময়, যে নিষ্ঠুরতা অপার, তাকে সহনীয় আটপৌরের ছাঁদে আপনিই বাঁধতে জানেন। স্বদেশ সেন, মায়ের মতোন স্পর্শ করে
যান।
-- অভিমান।
অথবা
“তা হ’লে বড় ক’রে হ’ল না - ভালো ক’রে হ’ল না কিছু?
বড় অভিমান হ’ল, কিছু অভিমান হ’ল বড়”।
-- অভিমান।
তাঁর অনেক বছর
পরে, সত্তর দশকের পরে
লেখা শুরু করা আদিলিয়া লোপেজ ‘Elizabeth
Doesn’t Work Here Anymore’-এ লিখেছিলেন,
“Once I was beautiful now I am
myself”।
গভীর অভিমান, পরিতাপের সঙ্গে মিশে কোবাল্ট ব্লু বানিয়ে
তোলে। স্বদেশ সেন কবিতায় নিজের ভাষা খুঁজেছিলেন। মৌলিক
ভাষা। নিজের মতোন লিখতে হবে এবং তার কোনো ব্যাকরণ নেই। পরম্পরাকে পাঠও করেছিলেন নিজেকেও
জানতে। বদল হয়েছে নিজের মধ্যে। পড়াগুলোর মধ্যে থেকেই কিছু কিছু পাওয়া এবং বদল। সে
চলা থামেনি সত্তর পার করেও। বলেছেন, লেখার সময় তরুণ কবিদের লেখাই পড়েন। বলেছেন, তিনি যে পরবর্তী প্রজন্মকে এতোটা খুঁটিয়ে দেখছেন এর মধ্যেও
চিরকালীন সেই আমার সময়ের
মতোন কিছু হয় না মানসিকতাও থাকতে পারে। নিজেকেও সন্দেহ করেছেন। কিন্তু সন্দেহ তো শুধু সন্দেহর জন্য নয়! তার আরো আরো কারণ আছে।
আনন্দে, দুঃখে, জীবনের নানা
মুহূর্তে গানের বা কবিতার একটা লাইন ঝিলিক দিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ঝিলিক দিয়ে যান। কিন্তু তেমন করে যদি লাইন ঝিলিক না দেয় আজকের
কবিদের, তাহলে কী করে হবে? কবিতা শুধু শব্দসম্ভার নয়। তার বেসিক চাই। যা শুধু একটা বক্তব্য নয়। একটা অনুভূতিও জাস্ট। কোনো কবিতা গায়ে এসে
লাগছে না, স্পষ্টতার অভাবের
জন্য চামড়ায় গিয়ে লাগছে না। লাগলে খুশি হতেন।
স্বদেশ সেনের
ভাবনা যদি ভাবায়, যাঁদের ভাবাবে,
তাঁদের যেন এ বাংলা ভাষা দেবোত্তর সম্পত্তি না হয়! তাহলে দিনের বেলা
শেষ হলেই অন্ধকার।
“অনেকের মনেই কথা সম্পদ, ব’লতে চাওয়া ফুল্লতা ও সুখ
রাত্রি হ’লে আলো না জ্বালালে তার কিছুই থাকে না”।
-ব্যান্ডেজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন