অন্তরা
চৌধুরী
বিভূতিভূষণের উপন্যাসে লোকায়ত
অনুষঙ্গ
বিভূতিভূষণের উপন্যাসে লোকায়ত অনুষঙ্গ আলোচনার পূর্বে লৌকিক উপাদান সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা করে নেওয়া প্রয়োজন। ‘লোক’ বলতে কোনো একজন মানুষকে বোঝায় না। বোঝায় নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী এমন একদল মানুষকে, যাদের আর্থিক কাঠামো একই রকম, জন্ম থেকে মৃত্যু এবং বছরের শুরু
থেকে শেষ পর্যন্ত সকলে একই ধরনের বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি, উৎসব-অনুষ্ঠান
পালন করে থাকে। আর ‘সংস্কৃতি’ হলো সেটাই, যা মানুষের নান্দনিক চেতনার বিকাশ ঘটায়।
লোকায়ত অনুষঙ্গ হলো লোক সংস্কৃতিরই উপাদান। সেই উপাদানগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি-
ক)বাক্কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি -- ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, লোকসঙ্গীত, গীতিকা, লোকনাট্য প্রভৃতি।
খ)বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি -- আসবাবপত্র, বাসন, খাদ্যবস্তু, যানবাহন প্রভৃতি।
গ)আচার অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি -- ব্রতপালন।
ঘ)লিখন ও অঙ্কন কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি -- এপিটাফ বা কবর
গাত্রে কবিতা।
লোকসংস্কৃতি বা লোকায়ত অনুষঙ্গ মানব সভ্যতার অতি প্রাচীন অংশ। কিন্তু সাহিত্যে
এর প্রয়োগ সেই অর্থে আধুনিক। বাংলায় লোক সংস্কৃতির চর্চা অনেক অর্বাচীন সময়ের
ঘটনা। সচেতন ভাবে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি বাঙালির অনুরাগ
রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে; বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীই বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার
প্রারম্ভিক পর্ব।
প্রথম পর্বে লৌকিক উপাদান প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাড়তি সচেতনতা
দেখা যায় না। জীবনের স্বাভাবিক রূপকে ধরতে গিয়ে যতটা পরিমান আসা স্বাভাবিক ততটাই এসেছে
লোকঐতিহ্য। যেমন বঙ্কিমের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে কাপালিক, তন্ত্রসাধনা, শবসাধনা,
নরমুণ্ডমালা ধারণ, প্রভৃতি। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় লোকায়ত অনুষঙ্গের প্রয়োগ সচেতন
নয়, কিন্তু স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের
সূচনাতে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গান;
তাছাড়া পদ্মা, শিলাইদহ, সাজাদপুরের
প্রেক্ষাপটে ‘শাস্তি’, ‘মণিহারা’,
‘কঙ্কাল’ গল্পে গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে
এসেছে।
শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে ছিনাথ বহুরূপীর কার্যকলাপ অঙ্গভঙ্গীকেন্দ্রিক লোক সংস্কৃতির উদাহরণ। ভূতের ভয়, শাহজীর শাপের মন্ত্র, বিষপাথর প্রভৃতি লোক উপাদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু ‘শ্রীকান্ত’ই নয়, শরৎচন্দ্রের
‘পল্লীসমাজ’, ‘বিরাজবউ’, ‘দেবদাস’, ‘অরক্ষণীয়া’, ‘একাদশী
বৈরাগী’ ইত্যাদি অসংখ্য রচনায় লোক ঐতিহ্য বাড়তি বাহ্য কোনো উপকরণ হিসেবে নয়, জীবনের স্বাভাবিক ধর্মে প্রযোজ্য হয়েছে।
বঙ্কিমযুগের ঔপন্যাসিক রমেশ্চন্দ্র দত্তের ‘সংসার’ ও ‘সমাজ’ নামক দুই সামাজিক উপন্যাসে লৌকিক ঐতিহ্যের অজস্র প্রয়োগ দেখা যায়। গ্রাম্য প্রবাদ, প্রবচন, ছড়া, মেলা, উৎসব, পালা-পার্বণ সব কিছুই জীবনের সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত হয়ে উঠে
আসে তাঁর উপন্যাসে। ‘সমাজ’ উপন্যাসের
সূচনাতে মা ও শিশুর সংলাপের মধ্য দিয়ে গ্রাম্য জীবনের প্রচলিত ছড়া উঠে এসেছে –“তাই তাই তাই/মামার
বাড়ি যাই”।
আবার ত্রৈলোক্যনাথ এমন একজন কথাসাহিত্যিক, যিনি অবাধ কল্পনার সুবাদে ভৌতিক ও মানবীয় ঘটনার অপূর্ব মেলবন্ধন করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে অবাস্তব মনে হলেও তাঁর উপন্যাসে রয়েছে সমাজের
বিভিন্ন স্তরের মানুষের প্রতি ব্যঙ্গের তীব্র কষাঘাত। গাঁজাখুরি গল্প, আষাঢ়ে গল্পকে তিনি নিপুণ দক্ষতায় পরিবেশন করে
গেছেন। লোকায়ত অনুষঙ্গ রূপে
সেখানে উঠে এসেছে ভূত, প্রেত, জটে
বুড়ি, অলৌকিক বাঘ ইত্যাদি। এই সমস্ত অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হওয়ায় তাঁর উপন্যাসে রূপকথার স্রোত
বয়ে গেছে।
১৯১৯খ্রীঃ রচিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অভিজ্ঞতার গবেষণালব্ধ উপন্যাস ‘বেনের মেয়ে’। দশম শতাব্দীর বাংলা দেশের পটভূমি এই উপন্যাসের মূল বিষয়। এই উপন্যাসে রয়েছে লোকায়ত সমাজ, তার উৎপত্তি, বিচিত্র
সাজসজ্জা, শিল্পকলা, ধর্মীয় দর্শন এবং সে যুগের লোক উৎসব, ধর্ম, খাদ্যাভাস প্রভৃতির
নিখুঁত বর্ণনা।
মনীষ ঘটকের ‘পটল ডাঙ্গার পাঁচালী’তে উঠে এসেছে নিম্নবিত্ত বস্তিবাসী
মানুষদের জীবন চিত্র, শৈলজানন্দের ‘কয়লাকুঠীর দেশ’ উপন্যাসে
উঠে এসেছে কয়লার খনি ও সাঁওতাল কুলী মজুরদের জীবন যাপন পদ্ধতি। কথাসাহিত্য যদি মানুষের সামগ্রিক জীবন চর্চার লিখিত প্রতিচ্ছবি
হয়, তাতে লৌকিক ঐতিহ্য কোনো না কো্নো ভাবে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। বাংলা উপন্যাসও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। ফলে সামাজিক বা আঞ্চলিক উপন্যাসের মধ্যে হয়তো একটু বেশি ভাবে ধরা পড়ে লোকসংস্কৃতির
উপাদান। তাই বলে অন্যান্য
শ্রেণীর উপন্যাস যে একেবারে সংস্কৃতির লৌকিক বলয়মুক্ত, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
উদ্ভব থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তী কাল পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের লোকসংস্কৃতি
ব্যাপক নয় এবং সচেতনও নয়। পরিচিত পরিবেশ ও জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে লোক সংস্কৃতি উঠে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত পর্বে আঞ্চলিক সাহিত্যের
প্রতি আকর্ষণ, বৃত্তিধারী গোষ্ঠী ও সমাজকে গুরুত্ব
দানের ফলে লোকসংস্কৃতি নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির, বিশেষতঃ তারাশঙ্করের উপন্যাসে।
স্বাধীনতা পরবর্তী পর্বে গ্রাম জীবনের প্রতি বাড়তি নজরদান, তার ফলে লোকসংস্কৃতি নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির
হয়েছে এই পর্বে। নতুন ও অপরিচিত বিষয়ের
চমক দেওয়ার জন্য গ্রাম জীবন ও লোকসংস্কৃতির প্রতি অধিক জোর দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের বিচিত্র মানুষ এবং তার বিচিত্র পেশা ও সংস্কৃতি, বাংলা উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছে। বাংলা উপন্যাসে কাহিনীগত বিকেন্দ্রীকরণের
ফলে নতুন একটা দিগন্ত খুলে গেল। বাংলা কথাসাহিত্যে
নতুন একশ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটলো আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে। এই নতুন ধারার সূচনা হলো মাণিক, বিভূতি ও তারাশঙ্কর -- এই ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তারাশঙ্করের রচনায় উঠে এলো রুক্ষ রাঢ় বঙ্গ, ওপার বাংলা এলো মাণিকের রচনায়, আর উত্তর চব্বিশ পরগণা,
বিহারের লবটুলিয়া, বইহার, আজমাবাদ প্রভৃতি উঠে এলো বিভূতিভূষণের রচনায়।
প্রসঙ্গত আলোচনা করা যেতে পারে, বিভূতিভূষণের উপন্যাসে লোকায়ত অনুষঙ্গ কীভাবে উঠে এসেছে। সাহিত্যে আঞ্চলিকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কোনো কো্নো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিবেশ একটা ফ্রেমের কাজ করে মাত্র। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামীণ জীবনের কথাশিল্পী। প্রকৃতি তন্ময়তা তাঁর নিজস্ব ঘরাণা। তাঁর উপন্যাসে মানুষ ও অরণ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অথচ তাঁর উপন্যাসে পটভূমি কিন্তু একান্ত ভাবেই আঞ্চলিক নয়। নির্জনতা প্রিয় এই মানুষটি স্মৃতিমেদূর হয়ে অরণ্য ও মানুষের
নিবিড় বন্ধনে ইতিবৃত্ত শুনিয়েছেন।
তাঁর ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের
পটভূমিটি বিস্তৃত হয়ে গেছে উত্তরে আজমাবাদ থেকে দক্ষিণে কিষণপুর এবং পূর্বে ফুলকিয়া
বইহার থেকে পশ্চিমে লবটুলিয়া পর্যন্ত। সেখানকার সমাজজীবন ও সেই পরিবেশের ছবি আঁকতে গিয়ে তিনিও লৌকিক
সংস্কার মুক্ত হতে পারেননি। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি
কথক সত্যচরণের জবানিতে বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসের প্রথমেই আমরা পেয়েছি সত্যচরণের ওয়ার্ড সিক্সের বন্ধু
অবিনাশকে, যাঁদের একটা বিশ হাজার বিঘের জঙ্গল মহাল আছে পূর্ণিয়া জেলায়। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায়
সত্যচরণ ঐ মহালের ম্যানেজার রূপে নিযুক্ত হন। শুরু হয় নিবিড় অরণ্য জীবন।
কথক সত্যচরণ গণুর মুখে শোনেন উড়ুক্কু সাপের কথা, জীবন্ত পাথর ও আঁতুড়ে ছেলের হেঁটে বেড়াবার কথা, যা রূপকথা বা কল্পনা নয়। ঐ পরিবেশে বসবাসকারী গণুর একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা; যা পড়ে আমাদের কখনই অবাস্তব মনে হয় না। বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক লোকায়ত অনুষঙ্গের পরিচয় পাওয়া
যায় নন্দলাল ওঝার আতিথেয়তার মধ্যে। সে মৈথিলী ব্রাহ্মণ। বাড়ি সুংঠিয়াদিয়ারাতে।
পূর্ণিমার দিন সত্যচরণকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য
একটি হাতি পাঠিয়ে দেয়। গ্রামে ঢোকার সময় দেখা যায়, পথের দু’ধারে সার বন্দী মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা করার
জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে ঢোকার সময় অতিথি আপ্যায়নের রীতি অনুযায়ী দু’বার বন্দুকের ‘ফায়ার’ হয়। কথক বাড়ির ভেতর বসতেই দেখা গেল, দশ এগারো বছরের একটি বালিকা একটি থালায় গোটাকতক আস্ত পান, আস্ত
সুপারী, মধুপর্কের বাটিতে সামান্য আতর ও কয়েকটি শুষ্ক খেজুর এনে
রাখল। এটি ঐ দেশের আতিথেয়তার এক বিশেষ পরিচয় বহনকারী।
এদেশে খাদ্যাভ্যাসের উপকরণও সম্পূর্ণ আলাদা। প্রকাণ্ড কাঠের পিঁড়িতে খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বেশ বড় একখানা
থালায় হাতির কানের মতো পুরি, বাথুয়া শাক ভাজা, পাকা শশার রায়তা, কাঁচা তেঁতুলের ঝোল, মহিষের দুধ,
দই, পেঁড়া প্রভৃতি কথককে খেতে
দেওয়া হয়েছিল। এই তালিকার মধ্যে দিয়ে ঐ দেশের উচ্চবিত্ত সমাজের খাদ্যাভ্যাসের
চিত্রটি ফুটে উঠেছে। ফেরার সময় নন্দলাল ওঝা কর্তৃক কথককে পঞ্চাশটাকা নজর দিতে
চাওয়ার মাধ্যমে ঐ দেশের অতিথি আপ্যায়নের রীতিটিও ফুটে উঠেছে।
আষাঢ় মাসে কাছারীর পুণ্যাহ উৎসবের মধ্য দিয়ে ঐ দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের খাদ্যাভ্যাসের
একটি সুষ্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। মুষলধারে বৃষ্টি
হওয়া সত্ত্বেও এই গরীব মানুষগুলি খেতে আসে চীনা ঘাসের দানা, টকদই, ভেলিগুড় ও লাড্ডু। এই চীনার দানা নুন সহযোগে তারা পরমানন্দে খায়।
ঐ অঞ্চলের দুর্দান্ত রাজপুত মহাজন রাসবিহারী সিং-এর কাছ থেকে কথক
হোলির আমন্ত্রণ পান। সেখানেও এই দেশের
অতিথি আপ্যায়নের চিত্রটি ফুটে ওঠে। কথকের ঘোড়া উঠোনের
মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে দু’বার বন্দুক ‘ফায়ারিং’-এর মাধ্যমে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। কিন্তু গৃহস্বামী না এলে ঘোড়া থেকে
নামার প্রথা নেই। রাসবিহারী সিং-এর বড়ভাই রাস উল্লাস সিং তাঁকে করজোড়ে অভ্যর্থনা জানায়। কিছু পরে এক বালক একটি
বড় থালায় আবির, কিছু ফুল, কয়েকটি টাকা, গোতাকতক চিনির এলাচ দানা, মিছরিখণ্ড এবং একছড়া ফুলের মালা রেখে যায় কথকের নজর রূপে। এদেশের উচ্চবিত্ত রূপে সেই প্রতিপন্ন হয়, যে বিকানীর মিছরী খেয়ে জলযোগ করে। তার বাড়িতে কথককে
খেতে দেওয়া হয় বৃহতদাকার খান পনের পুরী, খুড়িতে নানা রকম তরকারী, দই, লাড্ডু, মালপোয়া, চাটনী, পাঁপর। হোলি উৎসব উপলক্ষ্যে নাটুয়া বালক ধাতুরিয়া সকলকে নাচ দেখায়। নাচ দেখানোর পুরস্কার স্বরূপ সে খেতে পায় মাঢ়া, দই, চিনি। গাঙ্গোতাদের বাড়িতে নাচ দেখালে পায়
আধসের মকাইয়ের ছাতু।
এদেশে চালের অভাব হেতু এখানকার লোকেরা ভাত খেতে পায় না। নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা ভাতের পরিবর্তে খায় ঘাটো অর্থাৎ মকাই সেদ্ধ। শ্রাবণ মাসে এখানকার লোকেরা জংলী হরিতকীর আচার তৈরি করে। সত্যচরণ অনার্য প্রাচীন
রাজা দোবরু পান্নার কাছে যাওয়ার সময় ভেট স্বরূপ নিয়ে যান কিছু ফলমূল,
গোটা দুই বড় মুরগী। প্রাচীন অরণ্যচারী রাজা কথককে স্বহস্তে রান্না করে খেতে বলেন।
খাদ্য স্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয় সজারুর মাংস, চাল, মেটেআলু, দুধ ও মধু। আতিথ্যের যাতে
কোনো ত্রুটি না ঘটে, সেজন্য রাজা দোবরু পান্না সারাক্ষণ রান্নার কাছটিতে বসে থাকেন। অনার্য রাজবংশের অতিথি আপ্যায়নের সরল অনাড়ম্বর
চিত্রটি এখানে ফুটে উঠেছে। এখানে জলের উৎস রূপে উল্লিখিত হয়েছে উনুই। পাথরের গর্তে
একটু একটু করে জল জমে। এক আধ ঘণ্টায় আধসের জল হয়, যা অত্যন্ত
পরিষ্কার ও ঠাণ্ডা।
এই উপন্যাসে বেশ কিছু গ্রাম্যমেলা ও অনুষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন শ্রাবণ মাসে কাছারীর পুণ্যহ উৎসবের কথা
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। জঙ্গল মহলের পূর্ব-দক্ষিণ সীমানা থেকে সাত-আট
মাইল ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে হোলির সময়ে একটা প্রসিদ্ধ গ্রাম্যমেলা বসে যা
‘মৈষণ্ডীর মেলা’ নামে পরিচিত। কড়ারি-তিনটাঙা, লছমনিয়াটোলা, ভীমদাসটোলা প্রভৃতি
জায়গা থেকে বিভিন্ন লোকজন বিশেষতঃ মেয়েরা আসে। তাদের মাথায় পিয়াল ফুল অথবা লাল
ধাতুপ ফুল গোঁজা থাকে। কারো বা মাথার বাঁকা খোঁপায় কাঠের চিরুনী আটকানো থাকে। তারা
পুঁতির দানার মালা, সস্তা জাপানী বা জার্মানির সাবানের
বাক্স, বাঁশী, আয়না, অতি বাজে এসেন্স ক্রয় করে। পুরুষেরা এক পয়সায় দশটা কালি সিগারেট কেনে। বাচ্ছারা তিলুয়া, রেউড়ি, রামদানার লাড্ডু ও তেলেভাজা কিনে খায়।
এদেশের একটি অদ্ভুত প্রথা হলো -- “গ্রামের মেয়ে বা কোনও প্রবাসিনী সখী,
কুটুম্বিনী বা আত্মীয়দের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হইলেই উভয়ে উভয়ের
গলা জড়াইয়া মড়াকান্না জুড়িয়া দিবে। অনভিজ্ঞ লোক ভাবিতে
পারে উহাদের কেহ মরিয়া গিয়াছে। আসলে ইহা আদর আপ্যায়নের
একটা অঙ্গ। না কাঁদিলে নিন্দা
হইবে। মেয়েরা বাপের বাড়ির মানুষ দেখিয়া কাঁদে না -- অর্থাৎ তাহা হইলে প্রমাণ হয় যে, স্বামীগৃহে বড় সুখেই আছে -- মেয়ে মানুষের পক্ষে ইহা নাকি বড়ই লজ্জার কথা।”
সাধারণ মেলার মতো এই মেলাতেও হিন্দী
গোলেবকাউলী, লয়লা মজনু, বেতাল পঁচিশী, প্রেমসাগর ইত্যাদি বই বিক্রি হয়। মেলার মধ্যে যারা রেঁধে খাচ্ছে, তাদের জন্য বিক্রি হয় কাঁচা
শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি, কুচো চিংড়ী ও নালসে পিঁপড়ের ডিম, যা ঐ অঞ্চলের একটি প্রিয় সুখাদ্য। তাছাড়া কাঁচা পেপে, শুকনো কুল, কেঁদ ফল, পেয়ারা ও বুনো সীম বিক্রি হয়।
আবার গণু মাহাতো কথিত ‘হরিহর ছত্র মেলা’র পরিচয়ও এই উপন্যাসে পাওয়া যায়, যেখান থেকে ছটু সিং ঘোড়া নিয়ে আসত। সেই ঘোড়াকে বেশি দামে বিক্রি করার
জন্য জমৈতি আর ফনৈতি – দু’রকমের নাচ শেখানো হতো।
অনার্য রাজা দোবরু পান্নাদের একটি বহু প্রাচীন অনুষ্ঠান হলো ঝুলন। এই উৎসবে বহু দূর থেকে আত্মীয়-স্বজন আসতো নাচতে। আড়াই মন চালের রান্না
হতো। পাহাড়ের পাদদেশের সমতলে প্রাচীন পিয়াল গাছের নিচে, জ্যোৎস্না রাত্রিতে ত্রিশজন কিশোরী
তরুণী ঐ গাছটিকে ঘিরে নাচতো। পাশে পাশে মাদল বাজিয়ে
একদল যুবকও নাচতো। মেয়েদের খোঁপায় থাকতো ফুলের মালা ও গায়ে ফুলের গহনা। এছাড়াও এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে পূর্ণিয়ার হো হো নাচ ও মুঙ্গেরের
গেঁয়ো নাচ।
‘আরণ্যক’
উপন্যাসে যে আঞ্চলিক ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়, তার নাম ‘ছিকাছিকি ভাষা’। বিশ্বাস-সংস্কার কেন্দ্রিক লোকউপাদানের পরিচয় পাওয়া যায়
এই অঞ্চলের জীন পরিদের প্রসঙ্গ অবলম্ববনে। আমীন রঘুবর প্রসাদের কাছে কথক হুরী
পরীদের কথা শুনেছিলেন। সরস্বতী কুণ্ডীতে জ্যোৎস্না রাতে তারা ডাঙায় পাথরের ওপর
কাপড় খুলে জলে নামে। সে সময় যে তাদের দেখতে পায়, তাকে ভুলিয়ে
জলে নামিয়ে ডুবিয়ে মারে। জ্যোৎস্নার মধ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায় পরীদের
মুখ জলের ওপর পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে। আবার বোমাইবুরুর জঙ্গলে বটতলায় একদল অল্পবয়সী মেয়ে হাত ধরাধরি করে জ্যোৎস্নার মধ্যে নাচে। এদেশে ওদের বলে
‘ডামাবানু’, এক ধরনের জীন পরী নির্জন জঙ্গলের মধ্যে থাকে। মানুষকে বেঘোরে পেলে মেরেও ফেলে।
ঐ অঞ্চলে এক অদ্ভুত ঘটনার পরিচয় পাওয়া যায়। রামচন্দ্র আমীন ও তার ছেলে দুজনেই গভীর রাত্রিরে একটি সাদা কুকুরকে দেখেছে তাদের ঘরে ঢুকতে। জেগে উঠলেই দেখা যায় কুকুরটা পালাচ্ছে এবং পরক্ষণেই সেটি একটি মেয়েতে পরিণত হয়। জানালার পাশ
দিয়ে পেছনের জঙ্গলে হারিয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই জানা যায়, বোমাইবুরুর জঙ্গলে সেই বৃদ্ধ
ইজারাদারের ছেলের মৃত্যু হয়েছে।
প্রাচীন লৌকিক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ অনার্য রাজপরিবারের দেবতা টাঁড়বারোর পরিচয়
পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। তিনি হলেন বুনো মহিষের দেবতা। তাঁর রূপের বর্ণনায় দেখা যায়, দীর্ঘাকৃতি কালো মতো পুরুষ নিঃশব্দে
হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক লম্বা সে মূর্তি। তিনি না থাকলে
শিকারীরা চামড়া আর শিঙের লোভে বুনো মহিষের বংশ নির্বংশ করে ছেড়ে দিত। তাই তিনি বুনো মহিষকে রক্ষা করেন। জঙ্গলের মধ্যে একটা খাড়া সিঁদুর মাখা পাথর। রাজবংশের কুলদেবতা। পূর্বে এখানে
নরবলী হতো। এখন পায়রা ও
মুর্গী বলি প্রদত্ত হয়।
এছাড়াও এই উপন্যাসে উঠে এসেছে অসংখ্য জাতির মানুষ ও তাদের বিচিত্র জীবন কাহিনী। মৈথিলী ব্রাহ্মণ
থেকে শুরু করে গাঙ্গোতা উপজাতি, রাজপুত কুন্তা থেকে সাঁওতাল রাজকন্যা ভানুমতী প্রভৃতি চরিত্রের নিটোল বুনটে এই
উপন্যাস হয়ে উঠেছে একটি অঞ্চলের জীবনযাত্রার ইতিহাস।
বিভূতিভূষণের অপর একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘ইছামতী’। ‘পথের পাঁচালী’তে পল্লীর প্রকৃতি ছিল মুখ্য। ‘ইছামতী’তে পল্লীর
মানুষই বিভূতিভূষণের মন বেশি করে কেড়ে নিয়েছে। একটি
পরিণত জীবন চেতনা উপন্যাসটির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে। সমস্ত নারী ও পুরুষ
চরিত্রের মধ্যে গ্রামীণ জীবনের সুর শোনা যায়। সেগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়
না থাকলেও এই চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে ইছামতী ও তার তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের বিচিত্র
জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস ও লোকাচার উঠে এসেছে।
সেই সময় সম্পন্ন গৃহস্থরা ব্রাহ্মণ ভোজন করাতো, তার পরিচয়
পাওয়া যায় নালুপাল যখন চন্দ্র
চাটুজ্জের বাড়িতে ব্রাহ্মণ ভোজনের ব্যবস্থা করে। গ্রামে গরীব ব্রাহ্মণেরা এই ধরনের ফলার গ্রহণ করে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করত। এছাড়া ‘তেরের পালুনী’- এই গ্রাম্য উৎসবের যে বর্ণনা দিয়েছেন বিভূতিভূষণ, এককথায় তা মনোহারী। নফর মুচি, আমীন প্রসন্ন
চক্রবর্তী, গয়ামেম, হলাপেকে, ফণি চক্কোত্তি, চন্দ্র চাটুজ্জে, রূপচাঁদ মুখুজ্জে, নীলমণি সমাদ্দার -- এইসব সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ, দুঃখ,
বাসনা কামনার ছবি ফুটে উঠেছে।
ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে পাঁচপোতা গ্রামের বৌ-ঝিরা নদীর ধারে সমবেত হতো। বহু পুরাতন জিউলী ও কদম গাছের তলায় তেরের পালুনী অনুষ্ঠিত হতো। এই অনুষ্ঠানে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ ভুলে সকলে একসঙ্গে এই অনুষ্ঠান পালন করত। সম্পন্ন নালুপালের বৌ তুলসী, দরিদ্র যতীনের বৌ-এর পাশে এসে
দাঁড়িয়েছে। তার কাছ থেকে ঘোল নিয়ে তাকে
দিয়েছে দু’খানি ফেণী বাতাসা আর চারটি মর্তমান কলা। তিলু বিলুও খেতে এসেছে। সকলে ওদের নানা খাবার জিনিস দিয়েছে। খাতির করে
মিষ্টি কথাও বলেছে। এইসব খাবার জিনিসের মধ্যে আছে চিনির মঠ, দুধ, আখের গুড়ের মুড়কি,
খই, কলা ও নানা খাবার। গ্রামের মধ্যে হীন অবস্থা যার, সেই
নীলমণি সমাদ্দারের পুত্রবধূর সাথে খাবার ভাগ করে নিয়েছে। তেরের পালুনীর দিন
মেলামেশা, ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার থাকে না।
ফণি চক্কোত্তির বিধবা বোন বিধুদিদি, তিলুর অনুরোধে হাত নেড়ে একসময় ছড়া কাটতে শুরু করেন। ছড়াটি হলো --“আজ বলেচে
যেতে/পান সুপারী খেতে/পানের ভিতর মৌরী
বাটা/ইস্কে বিস্কে ছবি আঁটা/কলকেতার মাথা ঘষা/মেদিনীপুরের চিরুনি/এমন খোঁপা বেঁধে
দেব/চাঁপা ফুলের গাঁথুনী/আমার নাম সরোবালা/গলায় দেব ফুলের মালা”। সরোবালা অর্থাৎ
বিলুর নামে ছড়া বানানোয় সেও রাগ দেখিয়ে ছড়া কেটেছে --“চালতে গাছে ভোমরার
বাসা/সব কোণ নেই তার এককোণ ঠাসা...”। এরপর তার অনুরোধে বিধুদিদি নিধুবাবুর টপ্পা গেয়েছে হাত নেড়ে
ঘুরে ঘুরে -- “ভালোবাসা কি কথার কথা সই, মন যার সনে গাঁথা/শুকাইলে তরুবর বাঁচে কি জড়িতা লতা/ মন যার সনে গাঁথা”। এরপর সকলের অনুরোধে
ভজগোবিন্দ বাঁড়ুজ্জের পুত্রবধূ অল্পবয়সী লাজুক শ্যামবর্ণা নিস্তারিণী মিষ্টি গলায়
গেয়েছে শ্যামা বিষয়ক একটি গান --“নীল বরণী নবীনা বরুণী নাগিনী জড়িত জটা বিভূষিণী...”। গান শেষ হতেই তিলু তার হাতে একটা আস্ত চিনির মঠ গুঁজে দিয়েছে। এতে সে বোধহয় একটু অপ্রতিভ হয়ে
পড়েছে অতগুলি বড় বড় মেয়ের সামনে। এরপর ঠাকুর
জামাই ভবানী এসে উপস্থিত হলে তার সঙ্গে রঙ্গ রসিকতায় মেতে উঠতে বাধেনি। ভবানীর
একটি কথায় হাসির বন্যা বয়ে গেছে তাদের মধ্যে। এই হাস্য পরিহাসের মধ্যে কদম ডালের
ঝাউরোদ কাশ ফুলের দুলুনি ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে ভাদ্রের এক অপরাহ্নে ইছামতী নদীর ধারে
জমে উঠেছে তেরের পালুনীর ব্রত উদ্যাপন
উৎসব।
বিভূতিভূষণ মুখ্যত পল্লীজীবনের রূপকার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী নীলকর
সাহেবদের আমল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কাল পর্যন্ত বাংলার, বিশেষত চব্বিশ
পরগণার গ্রামীণ জীবন, মানুষ ও তাদের প্রাত্যহিক জীবনচর্যা
বিভূতিভূষণের রচনায় অপরূপ রূপ পেয়েছে। আর সঙ্গত কারণেই তাঁর রচনায় গ্রামীণ মানুষের লোকায়ত
জীবন ফুটে উঠেছে অনাবিল ভাবে। এ বিষয়ে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘অশনি সংকেত’, ‘কেদার রাজা’ প্রভৃতি
উপন্যাস এবং গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনের দুঃখ দারিদ্র্য ভরা কাহিনী নিয়ে তাঁর উপন্যাস নতুন রূপ লাভ করেছে। হয়তো এক একটা রচনায়
সামগ্রিক লোক সংস্কৃতির পরিচয় নেই, তবু বিষয়টি বাংলা কথাসাহিত্যের পক্ষে শুভ শুধু
নয়, গতানুগতিক বিষয়ের ভিড় এড়িয়ে টাটকা বাতাস পাওয়ার আশ্বাসে ভরপুর। আর এখানেই তিনি কালজয়ী সাহিত্যিক।
kobitor.com
উত্তরমুছুনhttps://kobitor.com/savage-love/
উত্তরমুছুন