শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

০২) অন্তরা চৌধুরী

লাল মাটির আড্ডা



-এই রিক্সা কান্‌কাটা যাবে?

-হ্যঁ, যাবক্‌। তিরিশ টাকা পয়সা লাগবেক্‌।

-একা যাব তাও তিরিশ?

-সে ইকাই যান আর দুকাই যান, ইয়ার চ্যেয়ে কম হবেক্‌ নাই।

কান্‌কাটার মতো এরকম বহু পিলে চমকানো নাম আছে বাঁকুড়ায়। যেমন ভূতশহর, তেঁতুলমুড়ি, হাড়মাসড়া, ছাগুলিয়া, বাদুল্লাড়া, ঝগড়াপুর, ছেঁদাপাথর, তালড্যাংরা প্রভৃতি। এই সমস্ত জায়গায় আসতে হলে বাসেই আসতে হবে। ট্রেন এখনো এই সব দিকে চালু হয়নি। বাসে আসতে অবশ্য একটু কষ্ট হবে আপনাদের, কারণ নামেই এখানে সুপারবাস চলে বটে, কিন্তু গরুরগাড়ির গতিবেগও বাসকে হার মানিয়ে দেয়। প্রথমত রাস্তার ছাল চামড়া নেই। অসংখ্য ছোট বড় গর্তের মধ্যে দিয়ে বাস যখন আপনাকে নিয়ে যাবে, তখন আপনার শরীরের ২০৬টি হাড়ের মেলবন্ধন পারস্পরিক divorce চাইতে পারে। তার ওপর অসংখ্য নামহীন স্টপেজ। বাসের কন্ডাক্টর যখনি কাউকে দেখতে পায়, তখনি বাসের গায়ে কষে একখানা চড় দেয়, আর বাসও দুম্‌ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। এসব সহ্য করেও হয়তো আপনি বসে রইলেন বাসের সিট আঁকড়ে, হঠাৎ দেখলেন আপনার হাতে পড়ল কয়েক বিন্দু জল জাতীয় কিছু। ভাবছেন আপনার কষ্টে বরুণ দেব বৃষ্টি শুরু করেছে, ভুল। বাসের ছাদেই বাঁধা আছে বেশ কিছু লম্বকর্ণ। তারাই ছোট বাইরে করে ফেলেছে।

সকালে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় শ্যাম্পু ও কন্ডিশনারের যুগ্ম সম্মেলনে আপনার চুল ছিল বেশ ফুরফুরে। কিন্তু বাঁকুড়ায় নামার পর দেখলেন, চুলে ডাই করার প্রয়োজন নেই। লাল মাটির ধুলোয় চুল স্বাভাবিক বার্গেন্ডি বর্ণ ধারণ করেছে।

-সেই কুন সকালে ঘরটো থিক্যা ব্যারাইচেন, ইবার তো খাত্যে হবেক্‌। ল্যান, ই শালপাতার খোলায় মুড়ি, সরষিয়ার ত্যাল, চপ আর একটো গেঁড়া পিঁয়াজ। শুকনা খেচেন্‌ ক্যানে? জল দিয়ে মাখ্যে খান। আর লঙ্কাটো মুড়িতে চকুটে ল্যান্‌- ইটোই বাঁকুড়ার মুড়ি খাবার নিয়ম বট্যে।

-আপনি ভাবেছিলেন বাঁকুড়ার নদীটোতে চান্‌ কইরবেন, কিন্তু একটো নদীতেও জল নাই। শুধু বর্ষাকালেই নদীতে অল্প জল হয়। আবার পোখোরটোতে যে ডুব দিবেন সিখানেও তো হাঁটু তক্ক জল। তাও ঘোলা। তাইলে ইঁদারার জলটোতেই চান কর‌্যে ল্যান। হ্যঁ, তিরিশ ফুট তল থিক্যে গতর খাটাইয়্যে জলটো তুলতে হবেক ঠিক্যেই, কিন্তু জলটো বড় পাতলা আর মিষ্টি বটে।

-গামছা আনতে ভুল্যে গ্যাছেন তো আই ল্যান- ইটো রাজগাঁয়ের বিখ্যাত তাঁতের গামছা বটে। চানটো করার পর শরীরে অল্প টানটো লাগবেক্‌। কারণ বাঁকুড়া বড় রুখা শুখা জায়গা বটে।

শান্তিনিকেতনের খোয়াই দেখে আপনারা তো খুব কবিত্ব করেন, কিন্তু মালভূমি ও সমভূমির মিলনস্থল এই বাঁকুড়ায় আছে অসংখ্য লাল মাটির খোয়াই, যা একেবারে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। পাথরের টিলা, ডুংরির বুকে মহুয়া, পিয়াশালের ঘন সবুজ বন দেখতে আপনারা কেউ আসেন না। ছোট বড় পাহাড়ের পাশাপাশি আছে ঝর্ণার স্নিগ্ধতা। মাটিতে লোহার পরিমাণ বেশি থাকায় বারোমাস চাষও এখানে হয় না। জলেরও একান্ত অভাব। কিন্তু এখানকার মাটি বন্ধুর হলেও বন্ধ্যা নয়। সাধারণ মানুষ তাই কৃষিকার্যের পাশাপাশি কুটির শিল্পকেও জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছে।

-গপ্প করত্যে করত্যে বেলাটো গড়াই গ্যালো, ইবার ভাতটো খাবেন চলেন।

আপনারা জিরো ফিগারের সুন্দরী পালিশ করা ধবধবে ফর্সা চাল খেয়ে অভ্যস্ত। তাই এখানকার ভাত খেতে একটু অসুবিধে হতে পারে।

-আজ বেশি কিছু রাঁধ্‌নাটো হয় নাই। শুধু কালো বিরির ডাল, আলুপোস্ত, আর পুকুরের টাটকা চারাপোনার ঝালটো হইছ্যে। অল্প কষ্ট করে খাইল্যান। অন্ধ্রের উ পাকা মাছ গুল্যান আমরা খাই নাই। ইখন যে চালের ভাতটো খ্যেছেন, উট্যা হল্য ভুতমুড়ি চাল। কালো রং-এর ধানটো হয় আর ভাতের ফ্যানটো হয় লাল। চালটো যেমন গ্যাঁড়া আর তেমনি মোটা হয়। আবার পোষপাবণে উ ঢেঁকিছাঁটা চালের গ্যাড়গেড়া পিঠাটো খাল্যে ভুলতে লারবেন।

আপনারা যারা সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে বসবাস করেন, তারা না জেনে আমাদের ‘বাঁকড়ী’ বলে বড্ড ঠাট্টা করেন। আমরা নাকি জঙ্গলমহলে বাস করি, ইলেকট্রিসিটিও নেই। কিন্তু ভাবেন না যে, ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ যেমন বাঁকুড়া, তেমন মালভূমিজ লোক-সংস্কৃতির অংশও তো বাঁকুড়া। যেমন ভাদর মাসে ভাদুপুজা উপলক্ষ্যে বিশাল মেলা বসে। মেলাতে তৈরি হয় বিশাল আকারের জিলিপি। খাবার ইচ্ছে হলে আসতে পারেন। তাছাড়াও টুসু, ঝুমুর, জাওয়াগান, মনসার ভাসান ঝাঁপান, হারুগান, পাতানাচ, রাবণকাটা নৃত্য, নাটুয়াগান এবং আদিবাসীদের করম সহরাই, বাহা, বাহাডহর প্রভৃতি নাচ-গান উপভোগ করতে হলে আপনাদের বারবার এই লাল মাটির দেশে আসতেই হবে।

‘নবান্ন’ এই শব্দটির সঙ্গে আপনারা সকলেই পরিচিত। কিন্তু রাঢ়বঙ্গে নতুন ধান উঠলে ‘নবান্ন’ উৎসব হয় না। পালিত হয় ‘ডেনি’। ধান কাটার পর যেদিন মাঠ থেকে সমস্ত ধান আনা হয়ে যাবে, আর একটু ধানও মাঠে অবশিষ্ট থাকবে না, সেই দিনটিতে যে উৎসব পালিত হয়, তাকে বলা হয় ‘ডেনি’। নতুন ধান দিয়ে ‘ডেনি’কে পুজা করে ভালোমন্দ খাওয়া - এই উৎসবের মূল অঙ্গ।

এখানকার গ্রামগুলোতে ঢোকার মুখে দেখতে পাবেন ভৈরব স্থান। স্থানীয় লোকেরা এগুলোকে মনসার থান বা ধর্মঠাকুরের থান বলে। এখানে দেবতা রূপে পূজিত হয় পোড়ামাটির হাতি ও ঘোড়া। আবার যে সব গ্রামে শিব মন্দির নেই, সেখানকার মহিলারা এই হাতি ঘোড়াগুলিকে শিব জ্ঞানে পুজা করে। বোঙ্গা হাতি তৈরির জন্য বিখ্যাত বাঁকুড়ার স্যাঁদরা। আর ঘোড়ার জন্য পাঁচমুড়া। এদেশে হাতি হলো ঐশ্বর্য আর ঘোড়া হলো শক্তি ও গতির প্রতীক। বাঁকুড়ার কাঠের ঘোড়া যতই আপনার ড্রয়িং রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করুক, পোড়ামাটির সামগ্রীর অবদানেও কিন্তু বাঁকুড়া পিছিয়ে নেই। পাথুরে এলাকায় যেখানে মাটির পরিমাণ অত্যন্ত কম, সেখানে মাটির তৈরি জিনিসের সম্ভারে বাঁকুড়া অনবদ্য। মনসার ঝাঁপি একমাত্র বাঁকুড়াতেই তৈরি হয়।

দিনের শেষে সূর্যের ম্লান আলোয় লালমাটির ধূলো উড়িয়ে, গরু-বাছুর নিয়ে রাখাল ঘরে ফেরে। ফসল হীন রিক্ত মাঠ দেখে আপনার মন যদি উদাসী হয়ে পড়ে, তবে চলুন কাঠিনাচ দেখে আসি। পড়ন্ত বেলায় গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাবেন গ্রামের লাজনম্রা বধূরা কত দূর দূরান্ত থেকে সান্ধ্য স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে কলসী কাঁকে জল নিয়ে চলেছে। তাদের দেখে আপনার ইচ্ছাকৃত কবিত্ব আসতেই পারে, কিন্তু তাতে তো এই সমস্ত গ্রামবাসীদের পানীয় জলের সমস্যা মিটবে না। চলুন, কাঠিনাচটা দেখি।

-বসেন্‌ বসেন্‌। ইখন লাচটো শুরু হবেক্‌। দশ-বারোটা আদিবাসী ছিলা ই লাচটো লাচে। ইয়াদের মধ্যে দুটা লোক মাদল বাজায়। দু-তিনটা লোক গান করে আর করতালটো বাজায়। বাকি পাঁচটা লোক বিটিছ্যালার জামাটো পরে লাচ করে। মাদোল বাজার সঙ্গে গানটো শুরু হল্যে উর‌্যা লাচটো শুরু করে দেয়। ই লাচটো শুধু মরদ গুলানের লিগ্যে। কুনু বিটিছ্যালার ই লাচটো লাচার অধিকারটো নাই।


এই গানের বিষয়বস্তু হলো পৌরাণিক কাহিনী, সামাজিক সুখ-দুঃখের নানান কাহিনী কিংবা সদ্য ঘটিত কোনো কাহিনীর ওপর ওরা গান করে। রামায়ণ কাহিনী অবলম্বনে একটি গান হলো-

‘‘রাম কাঁদে হাটে বাটে

লক্ষণ কাঁদে মাঠে মাঠে

সীতা কাঁদে কদলী শহরে

আর হনুমান কাঁদে গাছের ডাল ধরি

ও ভাইরে হনুমান কাঁদে গাছের ডাল ধরি’’

এই গানের মাধ্যমে রাবণ কর্তৃক সীতা হরণের করুণ দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। নাচ দেখতে দেখতে রাত অনেক হয়ে গেছে। শীত এবং গ্রীষ্মে এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। পাথুরে জায়গা হওয়ায় শীতকালে এখানে উষ্ণতার পারদ তিন থেকে চার ডিগ্রীতে নেমে যায়। আবার গ্রীষ্মকালে পারদ পঞ্চাশের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে। হঠাৎ এলে আপনার হাতে পায়ে ফোস্কা পড়ে যেতে পারে। বেশি ভয় খাওয়াবো না, কিন্তু রাত্রে কি খাবেন?

গ্রীষ্মকালের রাতে পান্তা ভাত, তেলপোড়া আর ছাঁচী পিঁয়াজই খান। রাত্রিরে শেয়ালের ডাক, ঝিঁ ঝিঁ পোকা আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতেই পারে। তারপর... বাউলের এক তারার মিঠে সুরে আপনার ঘুম ভাঙ্গলে শুনতে পাবেন-

“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব

ছেড়ে দেব না

তোমায় হৃদয়ে রাখব

ছেড়ে দেব না

ছেড়ে দিলে সোনার গৌর

আর তো পাব না”

আলো ফুটেছে। ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ বেয়ে বাউল প্রভাতী গেয়ে চলেছে। প্রকৃতি প্রেমিক হলে গ্রামের মেঠো পথ ধরে বেরিয়ে পড়তে পারেন। শীতকাল হলে চায়ের বদলে পান করুন সদ্য গাছ থেকে পাড়া জিরান কাঠি খেজুর রস। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় জঙ্গলে পৌঁছে যাবেন। সবুজ প্রকৃতি আর বুনো ফুলের গন্ধে নিজেকে সত্যচরণ মনে হতে পারে। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা মিলতে পারে একদল বুনো হাতির সঙ্গে। ভয় পাবেন না! কারণ এই সমস্ত কিছু নিয়েই আমাদের সংগ্রামময় জীবন। শস্য শ্যামলা সবুজ দেশ প্রকৃতি আমাদের উপহার দেয়নি। যা পেয়েছি সেটুকুও আমাদের ছিনিয়ে নিতে হয়েছে। বন্যা নয়, আমরা ভুক্তভোগী চরম খরায়। তাই এখানকার মানুষগুলো আচরণেও ভীষণ রুক্ষ। মিষ্টভাষী নয় মোটেও।

অঞ্চলটার নাম রাঢ় বঙ্গ। এজন্যই কি আপনারা আমাদের রাঢ়ী বলে ব্যঙ্গ করেন? আচ্ছা, সত্যিই কি আমরা রাঢ়ী?

২টি মন্তব্য:

  1. সাবলীল ভঙ্গিতেও যে কোনও অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বর্ণনা পেশ করা যায় অন্তরার রচনা তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যারা উন্নয়ন তথা পরিবর্তনের রাজনীতি করেন হয়তো এই রচনাটি তাদের প্রভাবিত করবেনা। না করুক। তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। ধন্যবাদ অন্তরা। এই রচনাটি প্রমান করে দিয়েছে যে, সভ্যতা নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল এবং মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তা অসভ্যতারই নামান্তর।

    উত্তরমুছুন
  2. অলোক গোস্বামী৩০ মে, ২০১৪ এ ৯:৪৩ PM

    সাবলীল ভঙ্গিতেও যে কোনও অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বর্ণনা পেশ করা যায় অন্তরার রচনা তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যারা উন্নয়ন তথা পরিবর্তনের রাজনীতি করেন হয়তো এই রচনাটি তাদের প্রভাবিত করবেনা। না করুক। তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। ধন্যবাদ অন্তরা। এই রচনাটি প্রমান করে দিয়েছে যে, সভ্যতা নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল এবং মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তা অসভ্যতারই নামান্তর।
    উত্তর

    উত্তরমুছুন