হাইডগোরের চিন্তাজগত : কবিতা কীভাবে সৃষ্টির দরোজা উন্মোচন করে
মার্টিন হাইডেগারের সারা জীবনের দর্শন -- প্লেটোর সেই যুক্তি নির্ভর ও নিশ্চয়তা-সন্ধানী জ্ঞানের জালে আটকা পড়া পশ্চিমা দর্শনের ভ্রান্ত পদ্ধতির বাইরে, বিয়িং(Being)এর স্বরূপ আবিষ্কারের সাথে সাথে, নতুন ভাষার এক গোপন দরোজা উন্মোচনের (uncovering) দর্শন। তিনি প্লেটোর ধারার দার্শনিক যেমন দেকার্ত, কান্ট, নিটসের পাগল করা সত্য-খোঁজার পরিবর্তে- সত্যর অর্থ আসলে যুক্তি তর্ক করে কোনোকিছু পাওয়া নয় বরং সত্য বলতে তিনি সত্তার (Being) এক রকম প্রকাশ - যার মাধ্যমে একটি গোপন 'উন্মোচনকে' আবিষ্কার করা যায় - এ বিশ্বাসে চিন্তা করেছেন। তাঁর সেই ম্যাগনাম ওপাস - ‘বিয়িং অ্যাণ্ড টাইম’এ আসলে আমাদের সেই ‘আমি’কে পৃথিবীর সব কিছুর সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যা মনে করি সেখানে এই বিচ্ছিন্ন ‘আমি’ নয়, সমস্ত পৃথিবীর ‘আমি’ মানে সবার 'আমি'। কারণ তিনি বলেছেন ‘Being with’ মানে আমার পৃথিবী আমারই সত্তার(পরম!) অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই সবারই সাথে আমার ‘আমি’কে এলিনিয়েটেড, ব্যাধিগ্রস্ত একা হয়ে চলার কোনো কায়দা নাই। দর্শন আমার বিষয় নয়, কিন্তু এই দার্শনিকের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে, কারণ তিনিই প্রথম(কবি ও দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দের পরে) কবিতার যাদুময় অপার সম্ভাবনার ভাষার প্রতি আস্থা রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দার্শনিকের ভাষা সীমাবদ্ধ, এই ভাষা দিয়ে 'Being’কে আর ব্যাখা করা সম্ভব নয়। কেননা, কবিতার অবাধ, শক্তিশালি, সম্ভাবনাময় ভাষা দিয়ে ‘সত্তা’কে যেভাবে উন্মোচন করা যায়, দর্শনের ভাষা দিয়ে তা করা যায় না।
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দার্শনিক আলোচনাই প্লাটোর সেই ‘সত্য’ খোঁজার জন্য অস্থির। এই পদ্ধতিতে আমরা সাধারণত একটি হাইপোথিসিস দিয়ে কাজ করা শুরু করি, তারপর অনেকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ, অ-প্রমাণ বাছ বিচারের মধ্য দিয়ে সত্য আবিষ্কারের দিকে যাই। হাইডেগারের মতে এই পচা সিস্টেমটাই দীর্ঘদিন ধরে জ্ঞান বিজ্ঞান তথা অভিজ্ঞতা আহরণের বিভিন্ন জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এর কোনো পরিবর্তন নেই। হাইডেগার এ বিষয়টি অস্বীকার করেন না, বরং তিনি এই সিস্টেমটাকে সন্দেহ করেন। তিনি গুরুত্ব দেন হৃদয় দিয়ে বোঝার ব্যাপারটিকে, তিনি গুরুত্ব দেন বিয়িং-এর মাঝে ‘থাকা’ প্রকৃত গুপ্তধন খোঁজার। তিনি মনে করেন, যখন আমরা বস্তুর বস্তুত্বকে শুধু প্রমাণ করার চেষ্টা করি, এর সত্য বলতে চাই, তখনই আমরা এর সাথে জড়িত অন্য সব সত্তার কথা ভুলে যাই।
তিনি এইসব কাজে বিরক্ত হয়ে কবিতার ভাষার দিকে চোখ রাখেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, কবির প্রথম কাজ হলো পৃথিবীর লুকানো সত্তার উন্মোচন, বস্তু আর বস্তুর সাথে জড়িত অন্যান্য সব বস্তুর সম্পর্ক আবিষ্কার। হাইডেগার মনে করেন, আমরা যুক্তি তর্কের বেড়াজালে আটকে থেকে আমাদের সামনে থাকা রহস্য-দরোজাটিকে এড়িয়ে গিয়েই প্রথম ভুলটি করে বসি। এভাবে দর্শনের একটি সহজ তৈরি-পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, যেখানে মনে করা হয় সব কিছুর সহজ উত্তর দেওয়া আছে। মানুষের কাজ হলো শুধু ক্রস আর টিক চিহ্ন দিয়ে পাতা ভরে রাখা। তারপর বইটাকে বন্ধ করে ফেলা। কিন্তু কবিরা কোনো বই বন্ধ করে না। আমাদের বুঝতে হবে - এই কোটি কোটি মানুষের পৃথিবীতে প্রতিটি ব্যক্তি ভিন্নভাবে অস্তিত্ব সর্ম্পকিত কাজে জড়িয়ে পড়ে। সেখানে শুধুমাত্র একটি পাওয়া সত্য -- বস্তু সম্পর্কে বা মানুষ সম্পর্কে সব কিছু বলা শেষ করে দিতে পারে না। আসলে ‘হাইডেগেরিয় আনকভারিং’এর মাধ্যমে কবিরা আরও বেশি করে সৃষ্টিসত্তার কাছে আসতে পারে। প্লেটো শেখানো যান্ত্রিক সত্য খোঁজার মাধ্যমে নয়।
কবিতা যেভাবে সৃষ্টির দরোজা উন্মোচন করে
তাঁর ‘চিন্তা’ সম্পকির্ত আলোচনায় হাইডেগার আসবাবপত্রের একজন শিক্ষানবিশের উদাহরণ আনেন। শুধুমাত্র চর্চার কারণে এই শিক্ষানবিশ মিস্ত্রি আসবাবপত্র তৈরি করে না অথবা কাজটি জানার জন্য সে মিস্ত্রি হয় না। একজন সত্যিকারের মিস্ত্রি বনে গিয়ে প্রথমে কাঠের মর্ম উপলদ্ধি করে, এর সত্তাকে বোঝার চেষ্টা করে। কবিতার জগতটাও ঠিক তাই। পৃথিবী আর সত্তা - সেই বনে থাকা কাঠের মতো যাকে পেড়ে আনা হয় -- একেবারে তাজা নতুন গাছ থেকে। তার প্রতিটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন মনোযোগ দাবী করে। যদি মিস্ত্রি প্রতিটি অংশকে এক মনে করে, তাহলে সে হয়তো একটি কাজ চালানোর মতো টেবিল চেয়ার তৈরি করে। কিন্ত তাকে কাঠে থাকা বনের সেই ‘রহস্য’ বা ‘সৌন্দর্যকে’ বাদ দিতে হয়। যে রূপ বনে ঘুমিয়ে থাকে তার সাথে বোঝাপড়ার জন্য সত্তাকে নিবিড়ভাবে জানার দরকার পড়ে, খালি কাজের ধান্দা করলে চলবে না। উন্মোচন চায় মিস্ত্রি বনে যাক, বনে গিয়ে এর রূপ রস গন্ধ বুঝুক। শুধু কাটাকাটি হলে বিষয়টি একটি মেকানিক্যাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এটি একটি সম্পর্ক, প্রাণের সাথে বনের কাঠের। যদি না হয়, তাহলে এই ক্রাফ্ট(শিল্প) হয়ে পড়বে একটি যান্ত্রিক কাজ মাত্র। একটি কাঠের টুকরোকে বুঝতে হলে মিস্ত্রিকে স্পর্শকাতর হতে হয়, তখনই তার গোপন দরোজা খোলার অভিজ্ঞতাটি ঘটে। একইভাবে পৃথিবীর সকল অস্তিত্বকে কবিতা সাড়া দেয় তার স্পর্শকাতর, নমনীয় ভাষা দিয়ে। কবি যুক্তি নির্ভর, প্রমাণ নির্ভর ‘সত্য’ খোঁজার পরিবর্তে বস্তুকে তথা তার চারপাশকে প্রাণ দিয়ে উপলব্ধ করার চেষ্টা করে। পৃথিবীর প্রতিভাবান কবিরা তাই করেন।
হাইডেগারের চিন্তায় ভাষার কাজ হলো যা কিছু অব্যক্ত, গুপ্ত ও সম্ভাবনাময় - তাকে ভাষা দেওয়া। তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে আবার ভাষার একটি সমস্যাও আছে। প্রথমত ভাষা প্রতিদিনের কাজ করতে সহায়তা করে। আবার সে সত্তার গভীর, স্বাভাবিক সত্যকেও প্রকাশ করে। আমরা আমাদের অস্তিত্বকে বোঝার জন্য যে ভাষা ব্যবহার করি, ঠিক সেই ভাষাতেই আবার একজন নরসুন্দেরর সাথে কথাও বলি। সুবিধা হলো, যারা শুধু কথা বলতে শিখেছে তারাও কখনো কখনো পৃথিবীর অনেক কিছুর ওপর আলোকপাত করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সাধারণ ভাষা সহজভাবে ব্যবহার করে বক্তা আর শ্রোতার সিদ্ধান্তকে হালকা করে ফেলা হয়। তখন কবিতা এই সমস্যা দূর করতে পারে। এটি সাধারণ বোঝার ভাষা আর দূরের রহস্যময় ভাষা বোঝার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। আমাদেরকে বুঝতে হবে কবিতার ভাষা গড়ে ওঠে ‘আনকমন’ কথা দিয়ে। ভাষার রহস্য ঘুমিয়ে থাকে এই ‘আনকমন কথাতেই’। এই সূত্রে হাইডেগারের পছন্দের কবি হলেন হোলডারলিন। কারণ এই কবি তাঁর কবিতায় ‘আনকমন কথা’ ব্যবহার করেছেন, যা প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা।
হাইডেগার আমাদেরকে নিয়ে যান সেখানে যেখানে আমরা তদন্ত আর কবিতার ভাষার মধ্যে পার্থক্য রচনা করতে পারি। তিনি মনে করেন, দর্শন কোনো অসাড় ক্ষেত্র নয়। হাইডেগার অনুসন্ধানের ভাষাও ত্যাগ করেন না। তিনি শুধু সত্তার গোপন দরোজাটি খোলার জন্য একটি নতুন ভাষা-পদ্ধতি আবিষ্কারের ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, আমরা সব জায়গাতেই দার্শনিক প্লেটোর এই সত্য-মিথ্যা জাহিরের সীমাবদ্ধ কেজো ভাষা ব্যবহার করি। প্লেটোর পদ্ধতি আমাদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, একটি যান্ত্রিক চক্রে বেঁধে ফেলে। কিন্ত অন্য দিকে কবিতার ভাষা যেহেতু ‘আনকমন’ কথাকে ধরে রাখে, সেখানে ভাষা এই যুক্তি তর্কের কাঠামো ত্যাগ করে সত্তার আরও গভীরে যায়। তাই ভাষা হয় আরও গভীর। ভাষা ‘আনকভার’ করে আমাদের সত্তার গোপান স্তর।
ছায়া: পোয়েটিক আনকাভারিং ইন হাইডেগার। বেন রজার্স।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন