মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

০৮) প্রদীপ চক্রবর্তী


মশক-রা


মশককুলের সহিত আমার সম্পর্ক জন্মাবধি। মানে, আমার জন্মাবধি। এই দীর্ঘ সহাবস্থানের কারণে উহাদের সহিত আমার একপ্রকার সখ্যতা স্থাপিত হইয়াছে, যাহা আমি আমার অত্যন্ত নিকটজনদিগকেও বুঝাইতে ব্যর্থ হইয়াছি। সে যাহাই হউক, এইরূপ বহু ব্যর্থতার বোঝা বুকে বহিয়া বাঙালি বড় হয়, বুড়া হয়। ব্যর্থতার ব্যথাটি থাকিয়া যায় acidityর মতো।

আমার স্ত্রী ধর্মভীরু এবং প্রভূত মায়া-মমতার অধিকারিণী। কিন্তু মশককুলের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র মমত্ববোধ নাই। দেখিলেই ক্ষেপিয়া যান। এবং উহাদের হত্যা করিতে উদ্যত হন। তখন তাঁহার সুন্দর মুখখানি যে কোনো খুনির খোমার ন্যায় প্রতিভাত হয়। মশককুলের প্রতি আমার আশকারা তাঁহাকে আরও ক্ষিপ্ত করিয়া তোলে। এবং তুমুল চিৎকার করিয়া মশক নিধনে উদ্যত হন। তাঁহার যুদ্ধ ভেরির এই আওয়াজ মশককুল শুনিতে পায় কিনা তাহা প্রাণীবিজ্ঞানীদের বিচার্য বিষয়, কিন্তু আমার প্রতিবেশীগণকে যে তাঁহাদের জানালায় সকৌতুহল আসিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য করে তাহা আমি স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়াছি।

যুদ্ধের বিবরণ দিবার পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রটির বর্ণনা আবশ্যিক। আমি জানালার দিকে পিছন করিয়া আমার প্রিয় খাটটিতে আসীন। সম্মুখবর্তী দেওয়ালে টিভির পর্দায় কুটকচালি দেখিতে মগ্ন আমি, আর মশককুল তাহাদের কর্মে। অর্থাৎ, আমার রক্তপানে। টিভির হাই ডেসিবেল তর্কাতর্কি সত্বেও মশককুলের পানোন্মত্ত কোরাস শুনিতে অসুবিধা হইতেছে না। উহাদের হুল আমার কাছে এতকালের অভ্যাসে সুড়সুড়ির ন্যায় মোলায়েম ও উপভোগ্য বোধ হয়। ইহাতে আরও একটি সুবিধা এই হইয়াছে যে, নিয়মিত সুগার টেস্টের জন্য যিনি রক্ত সংগ্রহের জন্য আসিয়া থাকেন, তাঁহার কর্মটি খুবই সহজ ও মসৃণ হইয়া গিয়াছে। ত্বকের উপর অসংখ্য ছিদ্র (মশক কুলের সৌজন্যে, বলা বাহুল্য) থাকায় সূচ ফুটাইবার প্রায় প্রয়োজনই হইতেছে না। যে কোনো একটি ছিদ্রের উপর তাঁহার টিউবটি চাপিয়া ধরিলেই ঝরনা ধারার মতো রক্ত বাহির হইতেছে। যুদ্ধের কথায় ফিরিয়া আসি।



রন্ধনকার্য শেষ না হওয়া অবধি পাকশালা হইতে আমার উদ্দেশে ব্রাহ্মণীর চিৎকার শুনিতে পাই, “হাত-পা নাড়াইতে থাকো, ধ্যানস্থ হইয়া বসিয়া থাকিও না, ডেঙ্গু হইয়া মরিবে”। আদেশানুসার হাত নাড়াইয়া সস্নেহে আলতো করিয়া উহাদের উড়াইয়া দিই। আমার স্নেহময় ভঙ্গি দেখিয়া গৃহিণী আরও ক্ষিপ্ত হইয়া উঠেন। সামান্য মশা মারিবার ক্ষমতাও নাই বলিয়া হাত মুছিতে মুছিতে আসিয়া আমার মুখোমুখি বসেন। এক্কেবারে নড়িবে না, চাপা হুঙ্কার। তীক্ষ্ণ চক্ষুতে মশাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছেন এবং সুযোগ বুঝিয়া হাত চালাইতেছেন। তাঁহার হাত লক্ষ্যবস্তুতে যত না আঘাত করিতেছে, উহার শতগুণ আঘাত আমার শরীরের বিভিন্ন স্হানে নামিয়া আসিতেছে। কিন্তু নড়িবার উপায় নাই। “একদম নড়িবে না, স্হির বসিয়া থাকিবে”। আমার এহেন পরিস্থিতিতেও এই ভাবিয়া অবাক হইতেছিলাম যে, মশা মারিতে এত জোরে চড় মারা কি জরুরি? ইহা তো মশা মারিতে কামান দাগা! অকস্মাৎ এই কুচুটে ব্রাহ্মণের মস্তিষ্কে প্রশ্ন জাগিলো - স্ত্রীর ঐরুপ সহিংস আক্রমণের আসল লক্ষ্য কে বা কাহারা?
উত্তর পাইতে বিলম্ব হয় নাই।

মর্নিংওয়াক হইতে ফিরিবার সময় বান্ধব সমিতির ক্ষুদ্র মাঠটিতে বসিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম লই। সেইদিন নীরেনবাবুও আসিয়া পাশে বসিলেন। নিকটতম প্রতিবেশী হইলেও ঘনিষ্ঠতা ছিলো না। কেমন আছেন, কি গরমটাই না পড়িয়াছে জাতীয় খেজুরি আলাপেই সীমিত ছিলো সম্পর্ক। বরং আমার স্ত্রীর সহিত নীরেন-স্ত্রীর সম্পর্ক গাঢ়তর ছিলো। একেবারে গায়ে পড়িয়া আসিয়া কথা বলায় কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ হইলো।


রাজনৈতিক ও আবহাওয়া বিষয়ক কথা হইলো। শুনিলাম। শুনিবার ভাণ করিলাম। একাকীত্ব খুঁজিতে ছিলাম। কী বিপদ!
ইহা আপনি ঠিক করিতেছেন না -
কী করিলাম? বিমূঢ়তা কাটাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম।
প্লীজ ডোণ্ট মাইন্ড, মদ্যপান আমরাও করিয়া থাকি, কিন্তু আপনার মতো পেঁচো মাতাল হইতে কাহাকেও দেখি নাই।
শুনিয়া আমার বাক্‌রোধ হইয়া গেলো।
বৌদির মতো নরমসরম মানুষ, মধ্যরাত্রে, আপনার জ্ঞান ফিরাইবার জন্য শেষপর্যন্ত অবিরাম চড় বর্ষণ করিয়া গেলেন, তখনও আপনি নট নড়নচড়ন! কী পরিমাণ মদ্যপান... আপনি আমার শ্রদ্ধেয়...
আমার কর্ণকুহরে কিছুই ঢুকিতেছে না। এইক্ষণে আমি বোধহয় সত্যই জ্ঞান হারাইতেছি।

মধুর সঙ্গীত ভাসিয়া আসিল। দূর হইতে নিকটতর। আমার চেতনা ফিরিলো। উহারা আসিতেছে। মাঠটিতে ঝোপঝাড় বিদ্যমান। আমার গন্ধে আকৃষ্ট হইয়া আসিতেছে। একটি দুটি করিয়া। শরীরের অনাবৃত অংশ কৃষ্ণবর্ণের ডট চিহ্নে ভরিয়া যাইতেছে। আইস, আইস, বাছা সকল!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন