শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

০৭) অনির্বাণ

তখনও রোদ্দুর আসত সকালে


গন্ধের নিজস্ব একটি পরিচয় আছে। এমনি করেই সব ঋতুকেই চিনে নেওয়ার বেশ একটা গন্ধ থাকে। এই যেমন বিকেলে বোরোলীনের গন্ধ পেলেই সংকেত পাই, হ্যাঁ শীত আসছে। শীতের শেষে আরেকটা গন্ধ ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়, মাধ্যমিক পরীক্ষার গন্ধ। সাঁড়াশিতন্ত্রের প্রথম ধাপ। একটা দুরুদুরু থাকেই সব পরীক্ষা ঘিরে। একমাস আগে থেকে ভালো রেজাল্ট করা দাদাদের বাড়ি গিয়ে কথা বলা। টু বি- এইচবি পেন্সিল, সেলো বলপেনের রিফিল, জ্যামিতিবক্স সাজানো। সে এক অদ্ভুত রিহার্সাল, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ জুড়ে। সাধারণত রবিবারের বিকেলগুলো বরাদ্দ থাকত ডিডি বাংলার জন্য। যাদের মাধ্যমিক তারা নিষিদ্ধ। বাকিরা সিনেমার গল্পটা শোনাবে অঙ্ক টিউশানির শেষে।



তখন গ্রামে সাকুল্যে তিনখানি টিভি। বাঁড়ুজ্যেদের, সরকারদের আর চাটুজ্জেদের মানে আমাদের। আমাদের মানে আমাদের গুষ্ঠির অই একখানি। প্রায় জনা চল্লিশেক লোকের অই একটিই। অনিডা কোম্পানির বড় টিভি। অবশ্য গ্রামে তখনও উত্তমকুমারের চেয়ে রাখাল সিংই বেশি জনপ্রিয়। তার যেমন হাসি তেমনি গলা। পালার নাম : লঙ্কেশ্বর রাবণ। সামাজিকের চেয়ে পৌরাণিকই এখানে বেশি হিট। তার ওপর অগ্রিম টিকিটের ওপর লটারী। ফার্স্ট প্রাইজ হিরো সাইকেল। পুরস্কার তুলে দেবে রাখাল সিং স্বয়ং। তাই লোক কিছু কম হতো না শীতের শুরুতে!

তখনও শীত মানে ‘ভাস্কর ও সুপর্ণা’ জানতাম না। শীত মানেই সরস্বতী (পড়ুন সরসত্যি) পুজো। পুজোর জিনিসপত্র যোগাড় - বাগানে বাগানে আমের মুকুল-জামের কলি-জোড়া কুল। কম হ্যাপা নাকি! হ্যাপা মানে মজাও বটে অবশ্য। কয়েকটা বাঁশ আর একটা ত্রিপল দিয়ে প্যান্ডাল। রাতে শুতাম কয়েকজন। নিচে খড় পেতে কম্বল মেরে। বাড়ি থেকে কেন জানি না কোনো সাহায্যই পেতাম না। রাতে প্যান্ডালে শোওয়ার রেওয়াজটা চলেই আসছে। আগেরবার মাধ্যমিকে হাই ফার্স্ট ডিভিসন পেল টুবানের দাদা বুবানদা। তাই এখন টুবানও আমাদের সাথে শোয়। ওর ক্লাস সিক্স। আমাদের ফাই ফরমাস খাটে। সময় সময় এই একটু কাঁচালঙ্কা-নুন দিয়ে কুলের চাট কিম্বা একটু লবাত (নলের গুড়ের শক্ত ঢ্যালা)। প্যান্ডালে শোওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য -- মাঝরাতে গ্রাম ঘুরে পরের দিনের মোচ্ছবের জন্য জ্বালানি যোগাড়। লোকের দেওয়াল থেকে ঘুঁটে, বেড়ার বাতা, শুকনো বেগো (তালগাছের পাতাসমেত ডাল) হাপিস।


চুরিতে যে অদ্ভুত এক আনন্দ থাকে, তখনই বুঝেছিলাম। তাই মাঝে মাঝেই মানুষের চুরি দেখতে পেয়ে খুব পুলক জাগে। চুরি আসলে একটি নিত্য ঘটনা। কখনও তার সাইজ বড়। কখনও ছোট। রিম্পা শাড়ি পরে বেরোলে কিছু যেন একটা চুরি হয় রোজ! যেটা চোখে পড়ে না, সেটাই সব থেকে বড় চুরি। চোর এবং ভূতের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল - অন্ধকার। দিন মানেই তো মানুষ। মহারাষ্ট্রে এক প্রজাতির চোর দেখা যায়, যারা উল্‌টোপায়ে ছুটে পালায়। সেই দৃশ্য ভূতের চেয়ে কিছু কম ভয়ংকর নয়। ভূত আসলে খুব উপেক্ষিত চরিত্র। মানুষ মরলেই যে তারা হয় - এই সত্যিটা কেউ বুঝতেই চাইল না! এখন আর ছেলেপিলে তাকে ভয় পায় না। ভূতের ভবিষ্যৎ ছিল - “ভয় নয়, হাসি হয়ে ছড়িয়ে পড়তে হবে আমাদের”। ‘ভয়ের বিকল্প হাসি’ এই আবিষ্কারটি শতাব্দীর সেরা নির্বাচিত হতে পারতো, মানুষ কাঠি না করলে।

তাই কাঠিই শতাব্দীর সেরা আবিষ্কার হয়ে গেল, সংবিধানে লুজশিট লাগিয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন