বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০৫) শ্রাবণী দাশগুপ্ত

বুনোট



সামনে সুতো জোড়া চারটে সোজা। আবার সামনে সুতো জোড়া...। পরের কাঁটায় সব উলটো। এককাঁটা সোজা এককাঁটা উলটো...। অসংখ্য রঙের টুকরো গিঁট দিয়ে জুড়ে জুড়ে মস্ত একখানা গোলা। উলগুলো কতবার বোনা খোলা ধোয়া হয়েছে এই অবধি, বলা কঠিন।



বুড়িকে দেখতে এখন ওই বয়সে মানুষকে যেমন দেখতে হয়, তেমনই। সুন্দর না অসুন্দর, পুরুষ বা মহিলা, অনুমান করা শক্ত। শুকিয়ে গুটিয়ে ছোট এতটুকু তুলতুলে। দুধে আলতা রং থেকে আলতাটি উবে গেছে। চোখের ভারী চশমা দিয়ে সম্ভবত আর দেখা যায় না কিছু। মাঝে মাঝে ডিগডিগে ঘাড় তুলে উর্ধ্বমুখে আকাশে তাকিয়ে থাকে। হয়তো সারাক্ষণ বুনে ঘাড়ে ব্যথা করে। আবার তারপর সাদা মোমবাতির মতো সরু আঙুলে চলতে থাকে সরু সুতোর মতো অসংখ্য রঙের নড়াচড়া।



বুড়ির পরনে গাউনের মতো কিছু একটা। নীলা পায়ের কাছে ঘাসে এসে বসে। বুড়ির পায়ে আলতো হাত বোলায়। নরম করে তুলোর মতো মাথা আঁচড়ে দেয়। তখন আধখোলা মুখের ভেতরে আদুড়ে সাপের মাথার মতো নড়ে। কিন্তু শোনা যায় না কিছু। খানিকটা তবু নীলা আর রতনই বুঝতে পারে। ওরা দেখাশোনা করে, হয়তো তাই! নীলা বলে, কত্তাঠাম্মা চাটুকু খাইয়ে দিই?



একতলা ছোট্ট বাড়ি প্রেক্ষাপটে। অযত্নের ছোট বাগানে সোঁদা গন্ধ। ওপরে নীল শূন্য। ছুটিছাটায় বেড়াতে এলে ঘাসের ওপরে খালি পায়ে স্কিপিং করে বুড়ির ছেলের কিশোরী নাতনি। বুড়ির চশমার কাচে নতুন চঞ্চল ঢেউয়েরা হেলেদোলে। বুড়ি দেখতে পায়! কেমন একটা হাসিমুখ ফুটে থাকে। অন্য সময়ে বুড়ির বেতের ঘন বুনোটের চেয়ারখানাতে হিম আর চাঁদের আলো পড়ে রাত্তিরে। সকালে ওটা রোদ্দুর পোহায়।



সারাটা শীতকাল জুড়ে এই উল বোনাবুনির খেলা। মাঝবয়সী নীলার অনেক সময়ে অসহ্য বোধ হয়। বিরক্তিকর লাগে। মনে হয় চেঁচিয়ে ওঠে, কার জন্যে বোনো কত্তাঠাম্মা? কেউ কি পরে আজকাল হাতে বোনা? তাও আবার এইসব আদ্যিকালের টুকরো উলে? আমাদের ঘরের কেউই পরে না! নীলা নিজের অধিকার ছাড়ায় না। এবং কিছু বলতে পারে না। তাই হয়তো উত্তর পায় না।



...সামনে সুতো জোড়া একটা সোজা... নির্ভুল চলতেই থাকে। বুড়ির মুখখানা সামনের দিকে। হাতের আঙুলে পেঁচানো উল ক্রমশ রঙ বদলে বদলে যাচ্ছে। লাফাচ্ছে উলের গোলা। বুনোটের আকার বাড়ছে। নীলা নিবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ জ্বালা করে। এত কি সহজ জলের মতোন গড়িয়ে গড়িয়ে...?



পেছনের কাঁটায় সব উলটো...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন