বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০৩) অমিতাভ প্রহরাজ

গুপ্তধন এবং বসু পরিবার

আবার বেবিবকবক - (মজা পান। মজে যান। গো ক্রেজি উইথ বাংলা)


আজকের সেরা উপার্জন......



এই বইটির অস্তিত্বের কথাই ভুলতে বসেছিলাম আমরা। হঠাৎ করে হাত ঠেকতে নিজেই চমকে গেছি। বহুক্ষণ বিশ্বাস হয়নি চোখকে। এ যেন মা-তারা হোটেলে দুপুরে খেতে গিয়ে কি আছে জিজ্ঞেস করে যদি শোনেন পিরানহার ঝাল-দেওয়া, ডোডোর ডিমের ঝোল, সেই লেভেলের চমক। ক্ষীণ সুরে ছোটবেলা থেকে কিছু আলোচনা ভেসে আসে। দাদা মানে ঠাকুর্দা কার সাথে কথা প্রসঙ্গে বলছেন এই বইটির কথা। বাংলাভাষায় পুরাণের এত ভালো ও ক্রেডিবল ডকুমেন্টেশান আর দুটি নেই। আর গিরীন্দ্রশেখর বসু? কী বলে পরিচয় দেওয়া যায়... এক বলতে পারি বড়ভাই-এর নাম শশিশেখর বসু, মেজভাই রাজশেখর বসু আর ছোটভাই গিরীন্দ্রশেখর। তিনটি অদ্ভুত চরিত্র। তত্যদ্ভুত তাঁদের প্রতিভা। যেহেতু এই বই ছোটভাই-এর তাই তাঁকে দিয়েই শুরু করি। গিরীন্দ্রশেখর বসু ফ্রয়েড সাহেবের সাক্ষাৎ ছাত্র। প্রথম বাঙালি মনোবৈজ্ঞানিক এই গিরীন্দ্রশেখর। মনঃস্তত্ত্বের ওপর বিস্তর বইপত্র ১৮৪২ থেকে পাওয়া গেলেও, মনোঃবিশ্লেষণের ওপর প্রথম বাংলা বই ‘স্বপ্ন’, লেখক গিরীন্দ্রশেখর বসু। অনবদ্য সেই পাতলা বইখানি। বস্তুতঃ ওটির সন্ধানেই বেরিয়েছিলাম। পেয়ে গেলাম এই রত্ন। রামায়ণ, মহাভারতের ওপর অথরিটি তিন ভাইই। কিন্তু তিনজনের আক্রমণ তিনদিক দিয়ে। মেজভাই-এর ‘মোটো’ মহাকাব্যগুলিকে সরল ও সুগম করে তোলা। ছোটভাই-এর মনঃস্তাত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ। কিন্তু সবচেয়ে চমক হলো বড় ভাই অর্থাৎ শশিশেখর বসু। পরিমানে সবচেয়ে বেশি লিখে গেছেন শশিশেখর। কিন্তু তাঁর ছাপা লেখা (বাংলা) বিরল ও দুষ্প্রাপ্য। বই মাত্র একটি, তাও একেবারে শেষ বয়সে মেজোভাই অর্থাৎ রাজশেখরের আবদারে করা, মূলতঃ ওনার লেখা প্রবন্ধের সঙ্কলন, ‘যা দেখেছি, যা শুনেছি’ নাম। প্রকাশক মিত্র অ্যান্ড ঘোষ (জয়মা বলে একবার কলেজস্ট্রীট ঠুকে দিতে পারেন, বলা যায় না লেগে গেল, পেয়ে গেলেন!!)।


শশিশেখরের ভারি মজলিসি কথনভঙ্গি ছিল। অনেকটা মুজতবা আলি সায়েবের ঘরানা। ‘যা দেখেছি যা শুনেছি’ বইটিতে শশিশেখরের একটি চিঠি আছে যে ভূমিকায়, সেই চিঠিতেই স্পষ্ট হয় কেন ওনার লেখা এত কম প্রকাশিত। শশিশেখর মনে করতেন, শব্দ ব্রহ্ম, তাই শালীন অশালীন কোনো ভেদাভেদ হয় না। (ভাবা যায়, রাজশেখর বসুর দাদা!) ওনার বেশির ভাগ লেখাই ফেরত আসতো সোজা বাংলায় সেন্সর করার জন্য। যে কাজটি উনি করতে একেবারেই রাজী থাকতেন না। ওনার একটি চিঠি পরিমল গোস্বামীর (হিমাণীশ গোস্বামীর পিতা, ‘যুগান্তর’ সম্পাদক, ‘শনিবারের চিঠি’ সহ সম্পাদক, বেতার কথক) সমগ্র স্মৃতি চিত্রর মধ্যে রয়েছে। যার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ওনার ‘ভূমিকম্প’ নামক একটি প্রবন্ধ, পরিমলবাবু রিজেক্ট করে পাঠিয়েছেন, কারেকশান করতে বলেছেন, তার উত্তরে শশিশেখর লিখছেন--
"ভূমিকম্প পাঠালাম, একদম নিরামিষ। ভাই কৈলাস বোস স্ট্রিট ও বাগবাজারে যাতে আপত্তি, তাতে তো বঙ্কিমের আপত্তি নেই!
যথা - দুর্লভ ছোটে। হায় কাছা খুলিয়া গিয়াছে। (দেবী চৌধুরাণী ১ম খণ্ড)
- ছুটিতে যুবতীদের কাপড় খুলিয়া পড়ে (ঐ ৩য় খণ্ড)
- কি রে মাগী! (চন্দ্রশেখর, মাগী দেদার)
ভাই একটু লাইসেন্স না দিলে আমার নাম, লেখা দুই ডুববে। ভূমিকম্প প্রবন্ধে এসব কিছু নেই। ভুঁইকম্পে যখন ছুটছিলাম তখন কি বীচির জায়গায় বীচি ও কাছার জায়গায় কাছা ঠিক ছিল?
- শশিশেখর"

কল্পনা করা যায় ১৯৫৪ সালে লেখা এই চিঠি স্বয়ং রাজশেখর বসুর বড়দার??!! প্রসঙ্গতঃ ভূমিকম্প বলতে বিহারে, মূলতঃ মজঃফরপুর অঞ্চলে এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে, বহু ব্রিজ ভেঙে পড়ে। জিটি রোড মাঝখান থেকে চিরে দিয়ে ভেতর থেকে ভুসভুস করে গরম বালি বেরিয়ে আসছে এই দৃশ্য পূর্ব ভারতের মানুষের কাছে কল্পনার একেবারে বাইরে এক ঘটনা ছিল। ফলে তুঙ্গে ওঠে গুজব। হতাহতের সংখ্যা তার ধাক্কায় উর্ধ্বশ্বাসে বাড়তে বাড়তে বাড়তে লাখ ছাড়িয়ে  কোটিতে গিয়ে পৌঁছোলে লোকের খানিকটা হুঁশ হয় যে, না তেত্রিশ কোটি মানুষের দেশে একধাক্কায় কয়েক কোটি মানুষকে মেরে ফেলা ঠিক নয়। বিহারের এই ভূমিকম্পের ওপর অনবদ্য কিছু গল্প আছে বনফুলের, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের। শশিশেখর বসু ছিলেন বিহার হেরাল্ড, মণীন্দ্রচন্দ্র সমাদ্দারের সম্পাদনায় 'পশ্চিম'-এর   বাঙালিদের সবচেয়ে প্রিয় ইংরেজী সংবাদপত্রের, প্রধান সাংবাদিক। S.S.Boseকে উল্টো  করে লিখতেন Esobss ছদ্মনামে। এই 'এসব্‌'-এর ফীচার বা প্রবন্ধ পড়েনি এমন লোক খুব কমই ছিল। দেখতে গেলে রাশভারী মেজভাই-এর চেয়ে রসসিক্ত বড়দা বহু  বহুগুন পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম ছিলেন। কিন্তু ওনার মৃত্যুর বহু পরেও লোকে জানতো না, বিহার হেরাল্ডের এসব্‌স হচ্ছেন রাজশেখর বসুর বড়দা। চিঠিটি পড়ে   স্বাভাবিক লোভ হচ্ছিল, কী সেই লেখা একজন আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধের? যা পরিমল গোস্বামী ছাপতে হিমশিম খাচ্ছেন। গত কয়েক মাসের ডিটেকটিভগিরিতে পোক্ত অভিজ্ঞতার কল্যাণে খুঁজে পাওয়াও গেল একটা, যা সামান্য লাইসেন্স পেয়ে (সবটা  নয়) লিখেছেন শশিশেখর, মনে পড়লো অল্পদিন আগের শ্লীলতা অশ্লীলতা বিতর্ক, হাসি পেল। যাক সে কথা, লেখাটি দেখাই। একজন আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধের গদ্যের ধার ও জীবনের প্রতি এ্যাটিচিউড, দুটোই আমার নাম ধরে ডাকবে বাঙালিদের।  



মিথিলা ও উত্তর প্রদেশের জেলা বিশেষে সাহিত্যে বা (স্কচ, স্প্যানিশ গানের মতন) সঙ্গীতে চুম্বনের স্থান নেই। থিয়েটারে ৫০ বছর পূর্বে যখন গোবিন্দলাল জলে ডোবা রোহিণীর মুখে ফুঁ দিতেন, তীরহুতিয়া দর্শকরা বাঙ্গালী দর্শককে ঘৃণায় বলতো --   কেহন গন্ধানালাকি পোঁথি লিখলঁ তোহর বঙ্কিম?? ছোঁড়ীয়াকে মুহাসে ওঠ লাগাকর বাঙ্গালীবাবু হাওয়া ফুকঁত্‌, রাম্‌! রাম্‌!!

অথচ এত ঘৃণা করেও সেই একই দল প্রতি পারফরম্যান্সে যেত, আমরাও প্রতি পারফরম্যান্সে রোহিণী দেখতাম রাগ না করে। বাড়িতে দর্শকেরা রোজই ফুঁ দিচ্ছেন,  কিন্তু পরের ফুঁ দেখা চাই। একেই ফ্রয়েডীয়ান পণ্ডিতগন 'পীপিং মেনিয়া' বলেন। আড়িপাতার সঙ্গে প্রায় এক, একই মহাপাপ।

শেলী এরকম লোককে মেল প্রুড নাম দিয়েছেন। তাঁর দি চেনচি নাটক পড়ে জনকয়েক বালিকার পিতা রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছিলেন এই বলে যে, এরকম অস্বাভাবিক পিতা জন্মায় নাই। অথচ দেখা যায়, এ কল্পনা নয়।

বঙ্কিমের মনে রিপ্রেশান বা অবদমন দ্বিধা লক্ষ্য হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ব'লে লজ্জা আছে। ভয়ে ভয়ে ভূমিকা ক'রে প্রেমের রহস্য বৃত্তান্ত লেখেন 'গ্রন্থকার প্রাচীন, লিখিতে লজ্জা নাই' (আহা ন্যাকা!! অর্থাৎ হচ্ছে।) মার্জিত-রুচি পাঠক পড়া বন্ধ করবেন, আ ছি ছি, ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে চুম্বন করিলেন’.....

নিজের পত্নীকে ব্রজেশ্বর কিস্‌ করছে, তাতে বঙ্কিমের এত লজ্জা!! যেন বঙ্কিমের বউকে কিস্‌ করছে!!

...... এসব ধোঁয়া ধোঁয়া কথা পাঠকের প্রত্যাশা সফলীকৃত করে না, যেমন সাদা কথা – ‘দৃঢ় বলে দুই হাতে বিনোদিনীকে বক্ষে টানিয়া লইলেন করে থাকেঔপন্যাসিক মনে রাখবেন স্যাকরার ঠুকঠাক কামারের এক ঘায়ের কাছে কিছুই না। দুটোতে দুরকম আর্ট অবশ্য আছে।

উচ্চশিক্ষিত পাঠকের কাছে নায়ক নায়িকার ঘুজুঘুজু বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ঘটনা কম, বাজে কথাবার্তা অতিরিক্ত, পাঠকের এবং চরিত্রের (উভয়ার্থে) ধৈর্য নষ্ট করে... কার্যকলাপ খাপছাড়া ফেলে যাওয়া, এমনতরো কথা অনেক পাঠক চান না। আর এখানেই সেই ভুল বোঝাবুঝিটি হয়, ফ্রয়েড সাহেব যাকে বলেন স্লিপ। কিছুদূর গিয়ে গ্রন্থকার থেমে গেলেন, পাঠক অনুমান করে নেবে, ভারী আর্ট হবে!! আহা!! এ আর্টে যে অনেক কুঁড়ে পাঠকের মেহনত হয় গ্রন্থকার ভেবেও দেখেন না। তারা ভাবেন ঔপন্যাসিক যখন গাজিয়াবাদ অবধি নিয়েই এলেন, তখন দিল্লী দেখালেন না কেন...

চোখ কচলে আরেকবার পড়ুন। আপনি ঠিকই দেখছেন, এটি ১৯৪৯ সালে লেখা আশি বছর বয়স্ক বালকের গদ্য!! যিনি অন্য পরিচয়ে রাজশেখর বসুর দাদা এবং টানা ৫০ বছর ধরে বিহার হেরাল্ডে এসব্‌স হয়ে দুহাতে ফীচার লিখেছেন, বাইলাইন  লিখেছেন, রিপোর্ট লিখেছেন, এবং তার সাথে সাথে হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন বাংলা গল্প। মাথায় রাখবেন, তখন কথায় কথায় ফ্রয়েড মারানো তো বহুদুর, প্রেমকেই  কাঞ্চনবর্ণ নিকষিতহেম জাতীয় প্লেটো থেকে শরীরের ময়দানে নামাতে হিমসিম খাচ্ছেন  বাঘা বাঘা সব রথী মহারথী -- বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ইত্যাদি  কল্লোলিয়ানস। তার মাত্র দশ বছর আগেই প্রমথ চৌধুরীর ডান্ডায় কোনোমতে থামানো  গেছে সাধু বনাম চলিত বাংলা বিশ্বযুদ্ধ। তখনও মানুষের কাছে চার অধ্যায় একটা  ফিসফিস আর ল্যাবরেটরি গুরুদেবের ভীমরতির প্রকট নিদর্শন বলে মোটামুটি  গৃহীত। তখনো সন্দেশের সুকুমার রায়-এর ছেলের বানানো পথের পাঁচালী নামক  বায়োস্কোপটি শহরে আসেনি। বিবর লেখা হতে আরো দুদশক বাকি। জীবনানন্দ  দাশ তখন বাংলা কবিতার হাস্যকৌতুক, যাকে শ্রেষ্ঠ প্যারোডি করা যায় এবং শ্রেষ্ঠতম হ্যাসাস্পদ করা যায়। তখনো বিয়ের বয়স ১৪-১৬ (এবং তাও অত্যন্ত অসন্তোষের সঙ্গে গৃহীত), এমন একটি সময়খণ্ডে বসে এই লেখা (তাও সামান্য লাইসেন্সের সুফল  নিয়ে এবং সেন্সরিং-এর পরে) যে কী পরিমা প্রাণশক্তির উদাহরণ, তা ভাবা  যায় না। হ্যাঁ, আপনাকে বলছি চন্দ্রিলবাবু, ননভেজ স্যাটায়ারি বাংলা ভাষার যে জঁর, যা দিয়ে মূলতঃ স্যাটাস্যাট লেখা যায় বা স্যাট স্যাট শব্দে এক একটি প্রবন্ধ নেমে যায়  মার্কিন নৌবাহিনীর মতো, আপনাকে হর্তা কর্তা অবধি ঠিক আছে, কিন্তু তারপরের পোস্টগুলি, বিধাতা, ত্রাতা, আবিষ্কর্তা, নির্মাতা ইত্যাদি দেওয়া যে খুব চাপ হয়ে গেল! তার ওপর এই ভদ্রলোকের, শশিশেখরের স্যাটায়ার, এ্যাপ্লায়েড স্যাটায়ারও ছিল। মানে প্রায়োগিক জায়গাও কিছু তৈরি করে গেছেন স্ব স্ব কীর্তির সাহায্যে।

একদিন চৌরঙ্গি প্লেসে একজন পুলিসের কাছে বিনীতভাবে এবং সসম্মানে জিজ্ঞেস করলেন, "আপকা ইডিয়সি কনজেনিট্যাল হ্যায় কি এ্যাকোয়ার্ড হ্যায়?" কনস্টেবল কিছুই না বুঝতে পেরে ঘাবড়ে গিয়ে তারপর গর্বের সঙ্গে বললো, "কনজেনিট্যাল হ্যায়""! কনজেনিট্যাল!! ভেরি গুড, তো আপ একদম বর্ন ইডিয়ট হ্যায়, ভেরি গুড। তব তো ঠিক হ্যায়, ইয়ে সাইকেল পকড়িয়ে, হাম থোড়া... আতে হ্যায়" বলে কনস্টেবল পোস্টিং যে কাজটি নিবারণের জন্য, সেটিই সেরে এলেন...

এই গল্প আমি অবশ্য বহুলোকের মুখে স্বীয় কীর্তি বা উপস্থিত বুদ্ধির প্রমা স্বরূপ শুনেছি। 

সবচেয়ে মজার জায়গা লক্ষ্য করা যায় এই প্রবন্ধের অংশটিতে যে, তিন ভাইয়ের মিলিত উপার্জন (গান্ধী নয়, জ্ঞান) যেন একটা মেজর ড্রাইভিং ফোর্স। একভাই-এর  সাহিত্যিক ফিনেস, ছোটভাই-এর মনঃবিশ্লেষণী দৃষ্টিকোণ ও নিজের স্যাটায়ার। কেমন একটা পারিবারিক বিদ্যা, অন্যান্য সাবজেক্ট ডিভিশান মুছে গিয়ে, আভাস পাওয়া   যায়। যার মধ্যে ল্যাংগুয়েজ, রেটরিক্স, সাইকোলজি, মাইথোলজি সব যেন মেশানো রয়েছে। এই ডাইভার্স ক্যারেক্টার সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত মেজভাই-এর সৃষ্টিগুলির  মধ্যে। চলন্তিকার সংকলক, বিজ্ঞানবিষয়ক পরিভাষা কমিটির সদস্য এক রাজশেখর  বসু, যিনি ভাষা ও বানানের শুদ্ধতা নিয়ে অতি মাত্রায় খুঁতখুঁতে। মহাভারত সহজ   সরল করে তোলা এক রাজশেখর বসু। বেঙ্গল কেমিক্যালস’-এর চীফ কেমিস্ট কাম বিজ্ঞাপনের কপিলেখক রাজশেখর বসু। আর ৪২ বছর বয়সে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী  লিমিটেড দিয়ে শুরু হওয়া পরশুরাম। এই শশিশেখরের একটি মহা মূল্যবান রচনা  রাজশেখরের বাল্যকাল, এটি রাজশেখরকে না জানিয়ে লিখেছিলেন শশিশেখর শারদীয় যুগান্তরএর জন্য, এবং রাজশেখরের ছোটবেলায় লেখা একটি কবিতা ফাঁস করে  দিয়েছিলেন

আর কত দেরী, আর যে সহে না,
ধড়ে প্রাণ আর থাকিতে চাহে না।
এইবার মেল ঢোকে ইস্টিশান
ভ্যাকুঅম ব্রেকে পড়েছে কি টান?
গুম গুম গুম গুম কড় কড় কড়
হড়াৎ হড়াৎ হড় হড় হড়
ক্যাঁচ ক্যাঁচ কোঁ থামিল গাড়ি।

শশিশেখরের ওই রচনাতেই জানা যায়, ভুশণ্ডীর মাঠে কারিয়া পিরেত-এর মুখে যে গান, সেটি রাজশেখরেরই আরেকটি বাল্যরচনা। রাজশেখর-এর সুমিষ্ট প্রতিশোধ স্বরূপ   শশিশেখরের একটি হিন্দি কবিতা পাঠিয়ে দেন যুগান্তরেএহেন গুরুগম্ভীর লোকেদের এমন দুষ্টুমি দেখলে কেমন একটা অদ্ভুত ফীলিংস হয় না?? শশিশেখরের কবিতাটি, আরেক মোক্ষম ধাক্কা...

মা যা হইয়াছেন-

কহো কালী হামে
কৌন লুটা তুমে
       খোপাড়ি তোড়েগা হাম।
বোলো মা কালিকে
তুমারা শাড়ীকে
       কিতনা থা মায়ী দাম??
শাড়ি মোল দেগা
তুমে পিনাহে গা
       এহি তো বেটাকা কাম।
য়হাঁকা বঙ্গালী
ঝুট মুট কালী
       দেওয়ে ফুল কেলা আম।
ঝুটে মা-মা বোলে
খুব চন্দহ্‌ মিলে
       রুপেয়া উসুল কাম
চন্দহ্‌ কি রুপেয়া
সব গল্‌ গয়া
       খানা পিনা ধুমধাম
বোম বোম কালী
কলকাত্তা বালী
তোবা তোবা রাম নাম

(ফিন্‌ সে বোলো)

কহো কালী হামে
কৌন লুটা তুমে
        খোপাড়ি তোড়েগা হাম।
বোলো মা কালিকে
তুমারা শাড়ীকে
       কিতনা থা মায়ী দাম??

- শশিশেখর বসু (লেখা আগে, ছাপা ১৯৫২)


কবে যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলোতে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার কালীকে   সাঁওতালি মাগী বলেছেন বলে হুল্লোড়বাজি পড়ে গেল রুচিরক্ষা সমিতি ইত্যাদি ইত্যাদি?? কতো কী এলো সেই সূত্রে কলোনিয়াল, পোস্ট কলোনিয়াল, অনার্য দেবী,  সাব-অলটার্ন, নো-রাইট-টার্ন, নো-লেফট-টার্ন হ্যায়সা হ্যায়সা কতো তত্ত্বের বুকড়ম, কৃষ্টির পিন্ডি ইত্যাদি। এনারা আর কতোদিন ওই গর্তে মুখ ঢুকিয়ে, বাকিটা বাইরে  রেখে, এ্যাটম বম্ব আমার পাছায় পড়বে না, পড়বে না আ না আ না আ না গান করবেন???

যাক গে, এই আশ্চর্য বসু পরিবারের আরেক সদস্য যে মনোবিজ্ঞান ও মনোবিশ্লেষণ  নিয়ে পড়াশোনা করবেন, তা নিয়ে কি আর কোনো সন্দেহ থাকে?? আর সেই পড়াশোনাটা যদি হয় খোদ ফ্রয়েড সাহেবের কাছে, তাহলে কী রাজযোটক মিলটাই না  হয়!!! শুধু ছাত্র নয়, পরে ফ্রয়েডের সহবৈজ্ঞানিক গিরীন্দ্রশেখর  এরপর কোনো কিছু  উৎকট বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে কুড়ি বছর কথাবার্তা চালিয়ে এক সাঙ্ঘাতিক বস্তু  ফ্রয়েড-বোস করেসপন্ডেন্স নামে তৈরি করেছিলেন। বলতে গেলে এশিয়ার প্রথম  মনোরোগ চিকিৎসক এই গিরীন্দ্রশেখর বসু যিনি সোসাইটি অফ সাইকো এ্যানালিসিস, এন আর এস এ মনোরোগ বিভাগ হ্যানাত্যানা চালু করেছিলেন। মোদ্দা কথা, প্রথম   পাগলের ডাক্তার এই গিরীন্দ্রশেখর। সে চুলোয় যাক, এই নিয়ে তো আর প্রশ্ন আসবে না। সব ভাই-এর মধ্যেই একটা কালেক্টরস স্পিরিট কাজ করেছে। রাজশেখর যে রকম  শুদ্ধ শব্দ সংগ্রহ করেছিলেন, গিরীন্দ্রশেখর একই রকম ভাবে পুরাণের গল্পগুলির এক অমূল্য সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন তার মনঃস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখা সহ।    তারপর প্রায় প্রবাদপ্রতিম হওয়া একটা বই জাস্ট হারিয়ে যায়... কলেজস্ট্রীটের যে সমস্ত দোকান মিলিয়ে মহান ডেটাবেস বানানো হয়েছে, তাতে দেখছি শুধুমাত্র  লালকালো আছে, তাও ওটি নিয়ে এক ভাঁটের এ্যানিমেশান তৈরি  হয়েছে বলে...     লালকালোর লিংক দিচ্ছি না, মিত্র ঘোষ-এ পাওয়া যায়, ৩০/- দাম... তবে বাচ্চাদের বলে খাটো করবেন না যেন, অসামান্য এই উপন্যাস... সামান্য একটু চাখনা দেওয়াই যথেষ্ট...

[ঘোষদের পুরনো ভিটার ধারে যে ডোবা আছে, তার একদিকে কালো পিপীলিদের রাজ্য, আরেকদিকে লাল পিঁপড়েদের রাজত্ব। দুই রাজত্বে বিশেষ বনিবনা নেই। কালো ও লাল পিঁপড়েদের মধ্যে প্রায়ই খুঁটিনাটি নিয়ে ঝগড়া-মারামারি হয়।
আজ বড়ই গুমোট করেছে, পিপীলিদের কালো বউ ডোবার ধারে জল নিতে এসেছে। কালো বউয়ের রূপের ঠ্যাকারে মাটিতে পা পড়ে না। তার ওপর সে কালো রানীর পেয়ারের সখি। এ ঘাটে যখন কালো বউ জল ভরছে, ডোবার ওপারে লাল পিঁপড়েদের একদল পল্টন কুচকাওয়াজ করতে এলো। পল্টনের দলের এক ডেঁপো ছোকরা কালো বউকে দেখে সুড়সুড় করে এপারে এগিয়ে এসে হাত-মুখ নেড়ে কালো বউয়ের উদ্দেশ্যে ঠাট্টা-তামাশা জুড়ল। কালো বউ রেগে ঘাড় বাঁকিয়ে, ঘাট থেকে উঠে এসে গালাগালি দিতে দিতে বাড়ির দিকে চলল। লাল ডেঁপো গান ধরলে--
কালো বউ কালো কোলো।
জলে ঢেউ সামলে চোলো।

কালো বউ একেবারে হন্হন করে রানীর কাছে উপস্থিত হয়ে আছড়ে পড়ল। কী হলো কী হলো বলে রানী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন

রাঙামুখো বজ্জাতে করে অপমান
গরল ভখিব আমি তেজিব পরাণ।

রানী সব কথা শুনলেন – ‘এক্ষুনি এর প্রতিকার করব। সখি আমরুলপাতা আর  বেলকাঁটা নিয়ে আয়, আমি রাজাকে লিপি পাঠাই’

চিঠি লেখা হলো; সাঁড়াশিমুখো প্রতিহারী শুঁড় বাঁকিয়ে লিপি নিয়ে রাজসভায় গেল। কালো পিপীলিদের রাজা পাত্র-মিত্র সঙ্গে নিয়ে সজনেতলায় সভা কালো করে বসেছেন। ডাইনে কালো মন্ত্রী, বাঁয়ে কেলে কোটাল সেনাপতি। সভায় সড়সড়ে পিঁপড়ে ফরফর করে এদিক-সেদিক ঘুরে খবরদারি করছে। অর্থী-প্রার্থী সব জোড়হাতে শুঁড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় প্রতিহারী ঝুঁকে মাটিতে শুঁড় ঠেকিয়ে রাজাকে অভিবাদন করলে। রাজা চিঠি পড়লেন। ]


১৪ নম্বর পার্শীবাগান লেন/বসুভবন, যা রাজশেখর বসুর ঠিকানা, যা পরশুরামের  গল্পে ১৪ হাবসিবাগান লেন, সেইখানে গিরীন্দ্রশেখর একটি ক্লাব করেছিলেন, যার নাম রাজশেখরের দেওয়া উৎকেন্দ্রিক সমিতিএই উৎকেন্দ্রিক সমিতির সদস্য কে না  ছিলেন? জলধর সেন, দাদাঠাকুর, পরিমল গোস্বামী, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, শরৎচন্দ্র পন্ডিত (পরশুরামের ছবিগুলি যাঁর আঁকা), যতীন্দ্রনাথ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, হারীতকৃষ্ণ দেব, রাজশেখর বসু, স্বয়ং শশিশেখর। এই সমিতির আড্ডার মাধ্যমে গিরীন্দ্রশেখর আরেকটা কালেকশানের কাজ করছিলেন, তাঁর তিন নম্বর। সেটি হলো অদ্ভুত বা আশ্চর্য  টপিকের কালেকশান। যেমন

) রবীন্দ্রনাথ একটি সভায় হঠাৎ বলে উঠেছিলেন এখানে একটা বাঁদরক) একবার গোরুতে কম্পোজিটরের কপি খেয়ে নিয়েছিল বলে যুগান্তর বেরোতে  পারেনি
 আছে  (পরে অবশ্য এটার একটা রাবীন্দ্রিক ব্যখ্যা পাওয়া যায়, উনি বলতে চেয়েছিলেন এই ঘরটার যেমন একটা ডানদোর আছে, তেমনি বাঁ-দোর আছে)
) সজনীকান্ত দাসের ভূত আমাদের কি কি ক্ষতি করতে পারে?
) বসুমতীর কেরামতি বা বসুমতীর ফেমাস অনুবাদের ভুলের নমুনা
    . The police are patrolling the street of Dacca
     ঢাকায় পুলিশের লোকেরা রাস্তায় কেরোসিন তেল ঢালছে...
    . Mr. Day was shot by 32 bore pistol by Gopinath Saha
     ৩২ নলা পিস্তল দিয়ে ডেকে গুলি করা হয়েছিল
    . Gandhiji was going through the menu card while having lunch
     গান্ধীজি মনুসংহিতা পড়তে পড়তে মধ্যাহ্নভোজন করছিলেন... 
) হ্যালির ধূমকেতু আসছে বলে পানচাষীরা কেন ভেবেছিল পানে পোকা হবে? (ইয়ার্কি না, এটি সত্যিই একটি গুরুতর গুজব যা মেদিনীপুরকে পানহীন করে দিয়েছিল

এটি আনফিনিশ্‌ড থেকে গেছে... এতেও একটা মূল্যবান সংযোজন হলো শশিশেখরের Marriages of Elephants


রাজশেখর তাঁর মৃত্যুর দুদিন আগে লিখিত নির্দেশ দিয়ে যান

সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে - শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ পত্রে এ যেন লেখা না হয়। মরবার  আগে অজ্ঞান হবো নিশ্চিত, এবিষয়ে আমার কোনো দ্বিধা নেই। আর প্রাণ যাবে গৃহে,  কোনোভাবেই গঙ্গায় নয় তাই সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি নিরর্থক। আর আশি পেরিয়ে যায় যে,  তার মৃত্যুতে শোচনীয়তা কোথায়? সুতরাং পত্রের শুরুতে ভাগ্যহীন লিখো না, লিখো  বিনীত”

এবার বইটির জন্য

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন