বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

কালিমাটি অনলাইন / ১১

সম্পাদকীয়




গত ২২শে ডিসেম্বর ২০১৩ কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি সভাঘরে ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকার ১০০তম সংখ্যার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হলো। বিগত ৩৫ বছর ধরে এই সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়ে চলেছে ভারতের অধুনা ঝাড়খন্ড রাজ্যের জামশেদপুর শহর থেকে। কিন্তু অঞ্চল বিশেষে সীমাবদ্ধ না থেকে ‘কালিমাটি’ অল্প দিনেই ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে। তারপর যখন ইন্টারনেটে শুরু হয় অনলাইন পত্রিকা ‘কবিতার কালিমাটি’, বলা বাহুল্য, তখন ‘কালিমাটি’ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। ‘কবিতার কালিমাটি’র পর ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’। এবং তার পরেই ‘কালিমাটি’র এই দুটি অনলাইন পত্রিকাকে সম্মিলিত করে শুরু করা হয় ‘কালিমাটি অনলাইন’। এরপর একে একে সংযোজিত হয় ‘কালিমাটির কথনবিশ্ব’, ‘চারানা আটানা’, ‘দীর্ঘ কবিতা’, ‘অণুরঙ্গ’ এবং ‘ছবিঘর’। ‘কালিমাটি’র এই দীর্ঘ ‘জার্নি’ বা যাত্রায় অসংখ্য মানুষের সমর্থন, সহযোগিতা, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা, উষ্ণতা পেয়েছি। এবং সেইসঙ্গে ভবিষ্যতেও পাব বলে আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস।

এই আনন্দের দিনেও আমরা অবশ্য শোকাহত হয়ে আছি, আমাদের প্রিয় কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্যের প্রয়াণে। মণিদা ‘কালিমাটি’তে অনেক কবিতা লিখেছেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের এবং ‘কালিমাটি’র ছিল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক। আর বলাই বাহুল্য, বাংলা কবিতায় তিনি এক উজ্জ্বল কবিব্যক্তিত্ব। তাঁর কলম ছিল সাহসী ও আপোষহীন। ব্যক্তিজীবনে তিনি যে আদর্শ ও মতবাদে বিশ্বাসী এবং দায়বদ্ধ ছিলেন, তাঁর কাব্যচর্চায় তা প্রতিফলিত হয়েছে। আর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অবিচলিত থেকেছেন সেই ভাবনায়। তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’এ সম্মানিত হয়েছেন জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে। যদিও আরও অনেক বছর আগেই তা কাঙ্ক্ষিত ছিল। শারীরিক ভাবে কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য আর আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর লেখা অসংখ্য কবিতা আমাদের কাছে আছে। এবং সেই কবিতাগুলি যখনই আমরা পড়ব, মণিদা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবেন, আমাদের উৎসাহিত করবেন, প্রেরণা যোগাবেন; আর জীবনে সৎ ও সচেতন থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন। মণিদা চিরদিন থাকবেন আমাদের মনের মণিকোঠায়।

প্রসঙ্গত ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ সম্পর্কিত একটি কথা উল্লেখ করার আছে। আমাদের অনুরোধে অনেকেই ঝুরোগল্প পাঠাচ্ছেন সম্পাদকীয় দফতরে। আমরা তাঁদের সবাইকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু সেইসঙ্গে একথা মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা কিন্তু প্রচলিত ছোটগল্প পাঠাতে অনুরোধ করছি না, বরং একটা নতুন ধারায় গল্প লেখার জন্য আহ্বান করছি, যে ধারার আমরা নামকরণ করেছি ‘ঝুরোগল্প’। যখন শুরু করেছিলাম, তখন শব্দসংখ্যা ২৫০ থেকে ৩০০র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। এখন শব্দসংখ্যা বাড়িয়ে মোটামুটি ৫০০র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য অনুরোধ জানাই। আর আঙ্গিক যেহেতু নতুন, তাই আমরা কোনো নিটোল একটা গল্প নয়, বরং নতুন ভাবনার টুকরো গল্প বা ছেঁড়া গল্প বা পরিকল্পিত অসমাপ্ত গল্প বা পরিকল্পিত অবিন্যস্ত গল্প বা না-গল্প... আসলে ঝুরোগল্প পাঠাতে অনুরোধ করছি। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ আরও বৈচিত্র্ময় ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।

প্রসঙ্গত আরও জানাই, আপনারা কবিতা, ঝুরোগল্প, কথনবিশ্ব’র জন্য প্রবন্ধ বা নিবন্ধ, অণুরঙ্গ’র জন্য নাটক ইত্যাদি যে লেখাই পাঠাবেন, অনুগ্রহ করে বাংলা ‘অভ্র’ ফন্টের ‘বৃন্দা’তে কম্পোজ করে পাঠাবেন। অন্য কোনো বাংলা ফন্টে কম্পোজ করে পাঠালে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হব।



আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kalimationline100@gmail.com / kajalsen1952@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :
0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

১) সমীর রায়চৌধুরী ও নাসের হোসেন


কালিমাটি পত্রিকার ১০০


ঝাড়খন্ডের ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০০তম সংখ্যাটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হলো গত ২২শে ডিসেম্বর। কলকাতায় কলেজ স্কোয়ারের অদূরে মহাবোধি সোসাইটি হলে। কাজল সেন সম্পাদিত এই সাহিত্যের পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। জামশেদপুরের পূর্বনাম কালিমাটি। এখানকার মাটিতে কয়লা, লোহা ইত্যাদি পাওয়া যায়। সে কারণেই হয়তো স্থানীয় নাম এর কালিমাটি। জামশেদজী টাটার আগমনে জায়গাটির নাম বদল ঘটে, একথাও সকলেই জানেন।

কাজল সেন এই ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ও যত্নের সঙ্গে একটানা ৩৫ বছর ধরে বের করে চলেছেন, এই কাজকে অসাধ্যসাধন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে জানি না। কাজল নিজে পড়ুয়া মানুষ, কবিতা গল্প ও নিবন্ধ লেখেন, এই পত্রিকায় লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন পৃথিবীর যেখানে যত বাঙালি আছেন তাদের সবাইকে। বিভিন্ন পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নানান সাহিত্যিক গোষ্ঠী তৈরি হয় ও হয়েছে, এ তো আমাদের জানা এবং চোখে দেখা। কিন্তু মজার ব্যাপার এবং আশার কথা এই যে, কাজল সম্পাদিত এই পত্রিকাটি কোনো গোষ্ঠী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেনি, বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকেই গোষ্ঠী হিসেবে তোল্লাই দেয়নি। ‘কালিমাটি’ পত্রিকার যে-কোনো সংখ্যা হাতে নিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ধারার লেখকদের কবিতা গল্প নিবন্ধ এতে স্থান পেয়েছে, পাশাপাশি যাঁরা কোনো ধারারই নন, কিংবা একক অভিলাষে লিখে চলেছেন, তাঁদের লেখাও গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে, পরিবেশিত হয়েছে।



‘কালিমাটি’ ১০০ সংখ্যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘটে সমীর রায়চৌধুরীর হাতে, মলাট উন্মোচন ঘটিয়ে উপস্থিত সকলকে সেটি প্রদর্শন করেন তিনি। মঞ্চে আরও যাঁরা বিশেষ অতিথি রূপে ছিলেন, তাঁরাও ‘কালিমাটি’ ১০০ সংখ্যার পৃথক-পৃথক কপি হাতে নিয়ে প্রদর্শন করেন -- মঞ্চে ছিলেন সাধন চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতরঞ্জন রায় এবং নাসের হোসেন। অনুষ্ঠানে ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটি সকলের হাতে হাতে পৌঁছে দিলেন সম্পাদক কাজল। প্রভাতবাবু রচিত ‘বঙ্গভাষা সাহিত্যের বিশ্বপরিচয়’ পুস্তিকাখানি সকলের হাতে পৌঁছে দিলেন নাসের। প্রভাতরঞ্জন তাঁর পুস্তিকায় বলতে চেয়েছেন – মানবজাতির উৎস ও ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে চলেছে উৎস থেকে ভাষার বর্ণময় ধ্বনিময় ক্রম বিভিন্নতার ধারা। বিভিন্নতার নিহিত ঐক্যে প্রত্যয়ী হলে ক্রমবিকাশের অনিবার্য বিভিন্নতা নিয়ে ভুল বোঝার এবং আত্মীয়তাবোধের অবকাশ তৈরি হতো না। তাঁর মূল অবস্থান জামশেদপুরেই, এখন আছেন বেহালায়।

সম্পাদক কাজল সেনের বক্তব্যে উঠে এলো তাঁর ৩৫ বছরের সংগ্রাম এবং এই পত্রিকাটির দিকে যাঁরা সাহায্যের ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্নভাবে, তাঁদেরও কথা। ‘কালিমাটি’ এখন আর শুধু প্রিন্টেড ম্যাগাজিনই নয়, ইন্টারনেট জগতে তার পরিচিতি বিশাল এক ব্যাপ্তি পেয়েছে, ইতিমধ্যে নেটে ‘কালিমাটি অনলাইন’এর ১০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘কালিমাটি অনলাইন’ পত্রিকার এখনও পর্যন্ত সাতটি বিভাগ আছে, সেগুলি হলো – কবিতার কালিমাটি, কালিমাটির ঝুরোগল্প, কালিমাটির কথনবিশ্ব, চারানা আটানা, দীর্ঘ কবিতা, অণুরঙ্গ ও ছবিঘর। যিনি অনলাইনের কাজে কাজলকে সহায়তা করেন, তাঁর নাম সুমিতরঞ্জন দাশ। মঞ্চে উঠে সুমিতরঞ্জন তাঁর মৃদু ভাষ্যে জানিয়েছেন, অনলাইন নিয়ে তাঁর তৎপরতা কতটা এবং কতদূর ক্রিয়াশীল।



সমীর রায়চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে জানিয়েছেন, ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটি কেন বাংলা ভাষার একটি অদ্বিতীয় পত্রিকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কোথায় কোথায় তার বিশেষত্ব। সাধন চট্টোপাধ্যায় বলেন, কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দূরে অবস্থান করেও বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্য পাঠকের নয়নের মণি হয়ে উঠেছে আজ ‘কালিমাটি’, কেন বাংলা পত্রিকার জগতে ‘কালিমাটি’র ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রভাতরঞ্জন রায় জানিয়েছেন, বাংলাভাষা যেমন বিশ্বভাষা পরিবারের একটি প্রাণবন্ত অস্তিত্ব, ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটিও তাই। দীর্ঘ বক্তব্য ছিল তাঁর। নাসের তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘কালিমাটি’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যাতেই নানা উল্লেখযোগ্য লেখার সন্ধান পেয়ে যাই আমরা। যেমন, ভূদেব ভকতের ছবি, কবিতা এবং গদ্যের অসাধারণ সম্ভার সব।

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন তরুণ কবি সুবীর মন্ডল, তিনি ‘কবীর’ নামে একটি চমৎকার পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সুবীরের ভাই প্রবীরও পরিচিত কবি। প্রবীর এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।


এসেছিলেন অনেকে – বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সচিব ড. সুবিমল মিশ্র, সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা ও জামাতা ম্যাডোনা চট্টোপাধ্যায় ও দ্বৈপায়ন সেন। এসেছিলেন অনেক কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক এবং ‘কালিমাটি’-প্রেমী – অতীন্দ্রিয় পাঠক, সুবিমল বসাক, অজিত বাইরী, উদয় চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত্য দাশ, অনিশ্চয় চক্রবর্তী, ধীমান চক্রবর্তী, প্রণব পাল, অলোক বিশ্বাস, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়, মৌলিনাথ বিশ্বাস, দেবযানী বসু, রঞ্জন মৈত্র, প্রভাত মিত্র, অশোক চক্রবর্তী, দিলীপ ভট্টাচার্য, সব্যসাচী হাজরা, উল্কা, ঊষসী ভট্টাচার্য, অরূপ মাইতি, বিশ্বজিৎ, তানিয়া চক্রবর্তী, সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন সেন, সুমন্ত ঘোষ, লেনা ঘোষ, প্রবীর চক্রবর্তী, অভিজিৎ সেন, রুচিস্মিতা ঘোষ, জয়দীপ সেন, কুঞ্জলাল মুখোপাধ্যায়, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়, তপনকর ভট্টাচার্য, চিত্রা সেন। এছাড়া দিল্লী থেকে এসেছিলেন ‘দিল্লী হাটার্স’ পত্রিকার সম্পাদক দিলীপ ফৌজদার এবং মুম্বাই থেকে ‘মায়ামেঘ’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জিতা সেন। আরও এসেছিলেন আমেরিকা থেকে আগত চিকিৎসক ড. শৌভিক সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী মৌসুমি সেনগুপ্ত। চমৎকার দুটি গান গেয়ে শোনালেন ম্যাডোনা চট্টোপাধ্যায়। আর চলচ্চিত্র পরিচালক এবং নাটক ও গানের দলের অধিনায়ক অরিন্দম গুপ্ত তাঁর ছোট্ট গানের দল নিয়ে মাতিয়ে দিলেন অনুষ্ঠানের শুরুতেই। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সুরঙ্গমা লালা দাশগুপ্ত এবং সুরম্য দাশগুপ্ত। সুরম্য গিটার বাজিয়ে খুব সুন্দর গান গেয়েছেন। আবৃত্তি করেছেন কয়েকজন – কৌস্তুভ নাগ, অভিষেক রায়, গৌতম মন্ডল। কবিতা পাঠ করেছেন ঊষসী ভট্টাচার্য, উল্কা, প্রবীর মন্ডল, সায়ন দাশ। মৌসুমি সেনগুপ্ত আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন প্রণব পালের কবিতা। দর্শকের আসনে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র ও বাংলা সিরিয়ালের বিশিষ্ট অভিনেতা প্রদীপ চক্রবর্তী। শিল্পী ভূদেব ভকতের শিল্পীত ‘ব্যানার’ এবং ‘পোস্টার’ দিয়ে সাজানো হয়েছিল সভাঘর।



এই সামগ্রীক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন উল্কা। আর নেপথ্য থেকে এই পত্রিকাটিকে আরও একজন শ্রম ও সমর্থন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তিনি কাজল সেনের স্ত্রী চিত্রা সেন। ‘কালিমাটি’ ১০০ সংখ্যা প্রকাশ অনুষ্ঠানে কাজল ও চিত্রা দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো অনুপম-ব্যস্ততায় সবাইকে আপ্যায়ণ করে চলেছিলেন।

সব মিলিয়ে মনে হলো, ‘কালিমাটি ১০০’ অনুষ্ঠান একটি এলাহি ঘটনা। এই অনুষ্ঠানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন এবং যাঁরা শুধুমাত্র দর্শকাসনে বসে সমস্তটা অবলোকন ও শ্রবণ করেছেন – দু’পক্ষই অসম্ভব সমৃদ্ধ ও নন্দিত হয়েছেন। ‘কালিমাটি’ পত্রিকার উত্তরোত্তর আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক, আমাদের সকলের এটাই একান্ত কামনা। যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁরা জানেন না, কী বিশাল অভিজ্ঞতা-নজরানা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন!

০২) অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

গবেষণাগার, প্রযুক্তি-বিদ্যালয় ও শিল্প-উপনিবেশ : বিবেকানন্দের বিজ্ঞান-স্বপ্ন


ভ্যাঙ্কুভারের ‘দি ডেইলি নিউজ অ্যাডভারটাইসার’ কাগজটিতে ১৮৯৩ সালের ২৬শে জুলাই একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার সারমর্ম – ‘দি এম্প্রেস অব ইন্ডিয়া’ জাহাজটি আগের দিন সন্ধ্যায় ভ্যাঙ্কুভারে উপস্থিত হয়েছে, এবং এর যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন জনৈক ‘মিঃ ভিভোস্কানন্দ্র’ ও আরেকজন মিঃ টাটা, সঙ্গে তাঁর পরিচারক। আজ আমরা অনেকেই জানি যে, উল্লিখিত এই দুই ভারতীয় যাত্রী যথাক্রমে স্বামী বিবেকানন্দ ও জামশেদজি টাটা, জাপানের ইয়োকোহামা থেকে এই জাহাজ-সফরে তাঁরা দু’জন সহযাত্রী ছিলেন। বিবেকানন্দ তখন অধিকাংশ ভারত ও বহির্বিশ্বের কাছে অপরিচিত, যদিও জামশেদজি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তরুণ সন্ন্যাসী সে-সময় চীন ও জাপান হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসছিলেন শিকাগোয় বিশ্বধর্মস্মমেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে। সে-বছরই জুন মাস নাগাদ জাপানে পৌঁছে স্বামীজী যেসব স্থান দেখতে যান, তার মধ্যে ছিল, জাপানী এঞ্জিনীয়রদের তৈরি এক মাইল লম্বা এক টানেল আর একটি দেশলাইয়ের কারখানা, যেগুলিকে তিনি বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিতে ‘একেবারে দেখার মতো জায়গা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কেউ কেউ এমন অনুমানও করেছেন যে, দেশলাই-কারখানা দেখতে গিয়েই বিবেকানন্দের সঙ্গে টাটার আলাপ হয়। অপরপক্ষে জামশেদজি টাটা তখন জাপানে কী করছিলেন? যতদূর জানা যায়, তিনি কিছু বাণিজ্যিক পরিকল্পনা নিয়েই ও-দেশে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল জাপানী সহযোগিতায় এক ভারতীয় জাহাজ পরিবহন কোম্পানি চালু করা, জাপান থেকে তুলোর বীজ এনে স্বদেশী কাপড়ের মিল খোলা ও জাপান থেকে দেশলাই আমদানি করে ভারতের বাজারে বিক্রি করা। আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা বিবেকানন্দের এক সমকালীন চিঠি [১০ই জুলাই, ১৮৯৩] থেকে জানা যায় যে, জাপানের দেশলাই শিল্প ও জাহাজ-পরিবহন ব্যবসা – এই দু’টি ব্যাপার ছাড়াও জাপ সেনার জন্য নিজস্ব কামান উদ্ভাবন ও তার নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ সম্পর্কে স্বামীজি শুধু ওয়াকিবহালই ছিলেন না, জাপানের প্রয়োজনীয় সব কিছু নিজের উদ্যোগে তৈরি করার উদ্যমের সপ্রশংস উল্লেখও করেছিলেন। এই পূর্ব ইতিহাসটুকু থেকে এ-কথা অনুমান করতে সুবিধা হতে পারে যে, আপাতদৃষ্টিতে ভিন্নধর্মী প্রযত্নে নিযুক্ত এই দু’জন ভারতসন্তানের মনেই ছিল মানুষের উপযোগিতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে এক সাধারণ আগ্রহ ও উদ্যোগ। এই অনুমান আরও জোর পায়, যদি জাপান থেকে আমেরিকার ঐ জাহাজ-সফরে দু’জনের আলোচনার বিষয়গুলো ভেবে দেখা যায়।



ঠিক কী কী বিষয়ে এই দু’জনের আলোচনা হয়েছিল, সে-সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও বিবরণ পাওয়া না গেলেও যে-সব সূত্র থেকে সংক্ষিপ্ত ও টুকরো টুকরো খবর পাওয়া যায়, তার মধ্যে সর্বপ্রথমে উল্লেখনীয় ১৮৯৮ সালে স্বামীজিকে লেখা টাটার একটি চিঠি, যা থেকে জানা যায় যে, স্বামীজি টাটাকে প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিকতার আদর্শের বিকাশ ও তাকে নষ্ট হতে না দিয়ে উপযোগী খাতে প্রবাহিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। এরপর উল্লেখযোগ্য বিবেকানন্দের ছোটভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের একটি বইয়ের [‘স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের ঘটনাবলী’, তৃতীয় খন্ড] এমন এক দাবি যে, স্বামীজি নাকি তাঁর কোনো চিঠিতে দু’জনের এই আলোচনা সম্পর্কে লিখেছিলেন। যদিও এখনও স্বামীজির তেমন কোনও চিঠির খোঁজ পাওয়া যায়নি, মহেন্দ্রনাথের বিবরণটি এখানে দেখা যেতে পারে। এই বিবরণ অনুযায়ী তিরিশ বছরের সন্ন্যাসী চুয়ান্ন বছর বয়স্ক শিল্পপতিকে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিলেন, “জাপান থেকে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেশে বিক্রয় করে জাপানকে টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি তো সামান্য কিছু দস্তুরী পাও মাত্র। এর চেয়ে দেশলাইয়ের কারখানা করলে তোমারও লাভ হবে, দশটা লোকেরও প্রতিপালন হবে ও দেশের টাকা দেশে থাকবে।” [ভাষা মহেন্দ্রনাথের] বিবেকানন্দের এই পরামর্শ অবশ্য টাটা স্বীকার করেননি, কারণ তিনি বাণিজ্যটা ভালোই বুঝতেন। তিনি জানতেন, ভারতে তাঁর দেশলাই ব্যবসা একচেটিয়া। অপর দিকে স্বামীজির কাছে কী ব্যবসা হোক, বা বিজ্ঞান, প্রথম ও শেষ বিবেচ্য বিষয় ছিল জনমানুষের কল্যাণ। মুনাফার কথা না ভেবে জনহিতে ব্যবসার লাভকে ব্যয় করার অভিনব পরামর্শ তিনি পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী রকফেলারকেও দিয়েছেন ও কিছু পরিমাণে উদ্বুদ্ধ করতেও সমর্থ হয়েছেন।

যা-ই হোক, আপাতত এ-টুকু বোঝা যাচ্ছে যে, ঐ চিঠিটিতে বিবেকানন্দ-টাটা আলোচ্য বিষয়ের যে-বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে প্রত্যক্ষভাবে বিজ্ঞানসংক্রান্ত কিছু না থাকলেও জনকল্যাণ ও স্বদেশী বাণিজ্যের প্রসঙ্গগুলি অবশ্যই জড়িত ছিল। পরবর্তী ইতিহাস অবশ্য এ-কথার সাক্ষ্য দেয় যে, ভারতের মানুষের উৎকর্ষসাধনে বিজ্ঞানের ব্যবহারের ভাবনা এই দুই মনীষীর মনকেই যথেষ্ট পরিমাণে অধিকার করে রেখেছিল। বিবেকানন্দের দিক থেকে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় আমেরিকায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নানা বক্তৃতায় তাঁর ভারতের জন্য শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত উক্তিগুলি থেকে। এখানে বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে তার কিছু সংক্ষিপ্ত নমুনা দেখা যেতে পারে।

‘সালেম ইভনিং নিউজ’- “ভারতের লোকদের ধর্মশিক্ষা দিতে মিশনারি না পাঠিয়ে তাদের শিল্পশিক্ষা দিতে পারবে, এমন লোক পাঠালেই আমেরিকানরা ভালো করবে।” [২৯.৮.১৮৯৩.] ‘ডেইলি গেজেট’- “দেশের উন্নয়নের জন্য সন্ন্যাসীদের সংগঠন তৈরি করতে চাই, যাতে এঁরা জনগণকে তাঁদের শিল্পজ্ঞানের ফল দিতে পারেন, এতে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে।” [২৯.৮.১৮৯৩.] ঐ- “মিশনারিরা আধুনিক ভারতবর্ষে ধর্মশিক্ষা না দিয়ে সামাজিক ও শিল্পবিষয়ক শিক্ষা দিলেই ভালো করবেন।” [৫.৯.১৮৯৩.] আমরা দেখবো, ভবিষ্যতেও বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য-সতীর্থদের এ-জাতীয় কথা চিঠিপত্রে লিখবেন।

এরপর আমরা জামশেদজি টাটার দিক দিয়ে ভারতের বিজ্ঞান-প্রগতির বিষয়টি লক্ষ্য করার চেষ্টা করবো। উনিশ শতকের শেষ ভাগে বিবেকানন্দ যখন শিকাগোতে ধর্মপ্রচারে তাঁর সাফল্যের সূত্রে ভারতে ও পশ্চিমী দুনিয়ায় সুপরিচিত, তখন টাটাও পশিম ভারতে স্থাপন করেছেন স্বদেশী কাপড়ের মিল, হোটেল-ব্যবসা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইস্পাতশিল্পের মতো উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন। এই সময়েই তিনি ভারতীয় ছাত্রদের জন্য এক বিজ্ঞান গবেষণা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ভাবনাচিন্তাও শুরু করেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর প্রতিনিধি বরজোরজি পাদশা ইংলন্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি পাঁচটি দেশের শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এর ফলস্বরূপ তিনি ভারতীয় ছাত্রদের জন্য শিল্পবণিজ্য-সংক্রান্ত বিজ্ঞান গবেষণা ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার এক প্রতিষ্ঠানের স্থাপনার জন্য আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেন, যা ভারতীয় খবরের কাগজগুলিতে প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ‘টাটা পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত এই প্রস্তাব দেশীয় মহলে বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয়। এই পরিকল্পনা রচনার সময় টাটা যে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগর পার হবার সময় তাঁর পাঁচ বছর আগের আলোচনার কথা মাথায় রেখেছিলেন, তাঁর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে আরো কয়েক মাস পরে বিবেকানন্দকে লেখা তাঁর এক ঐতিহাসিক চিঠিতে। ২৩শে নভেম্বরের এই চিঠিটির প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ এ-রকমঃ- “প্রিয় স্বামী বিবেকানন্দ, আমার বিশ্বাস, জাপান থেকে শিকাগো সফরে আপনার সহযাত্রীরূপে আপনি আমাকে মনে রেখেছেন। এই মুহূর্তে ভারতে সন্ন্যাসের ভাবধারার বিকাশ ও তাকে ধ্বংস না করে উপযোগী পথে চালিত করার ব্যাপারে আপনার মতামতের কথা আমার খুবই মনে পড়ছে।

“আমার এই সব ভাবধারার কথা মনে পড়ছে ভারতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার পরিকল্পনার সূত্রে, যে-বিষয়ে আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন বা পড়েছেন। আমার মনে হয়, যদি এমন মঠ বা আবাসিক ভবনের স্থাপনা করা যায়, যেখানে সন্ন্যাসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষেরা সাধারণভাবে বসবাস করে প্রাকৃতিক ও মানবিক বিজ্ঞানের চর্চায় তাদের জীবনকে নিয়োগ করবে, তা হলে ঐ আদর্শের উৎকৃষ্টতর প্রয়োগ আর কিছু হতে পারে না। আমার মতে কোনো সুযোগ্য নেতা যদি এ-রকম সন্ন্যাসীসুলভ ত্যাগের আদর্শে চালিত ধর্মযুদ্ধের দায়িত্ব নেন, তাহলে তা সাধারণভাবে সন্ন্যাসের আদর্শ, বিজ্ঞান ও আমাদের স্বদেশের সুনামের সহায়ক হবে এবং আমি জানি না, এই অভিযানে বিবেকানন্দের চেয়ে যোগ্যতর নায়ক আর কে হবেন! আপনি কি মনে করেন, আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে জীবনে প্রোথিত করার এই মহদুদ্দেশ্যে আপনি আত্মনিয়োগ করবেন?....” এই চিঠিটিতেই টাটা বিবেকানন্দকে প্রস্তাব দেন যে, ঐ উদ্দেশ্যে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য স্বামীজি একটি পুস্তিকা রচনা করতে চাইলে তিনি সানন্দে তার ব্যয়ভার বহন করবেন।


>
এই ঐতিহাসিক পত্রটির সূত্রে টাটা-বিবেকানন্দ যোগাযোগের পরবর্তী কাহিনীতে যাবার আগে আমরা পত্রটির বক্তব্য আরও একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। নিজের গবেষণায়তন প্রকল্প প্রসঙ্গে টাটার যে প্রথমেই স্বামীজির প্রেরণার কথা মনে পড়েছিল, সেটা এই চিঠি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখানে টাটা বিবেকানন্দ সম্পর্কে শুধু এ-টুকুই বলেছেন যে, তিনি জাহাজ-যাত্রাকালে তাঁকে ভারতে সন্ন্যাসের আদর্শের উজ্জীবনের কথা বলেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, টাটা শুধু সন্ন্যাসব্রতধারীদের মঠস্থাপনার ধারণাটিই বিবেকানন্দের থেকে নিয়েছিলেন, ঐ প্রবুদ্ধ মানুষগুলিকে দিয়ে বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় চর্চার পরিকল্পনাটি তাঁর নিজস্ব। কিন্তু আমরা ‘ডেইলি গেজেটে’র সংবাদে দেখেছি, টাটার সঙ্গে আলোচনার সমকালেই বিবেকানন্দ মার্কিন দেশে সন্ন্যাসী-সঙ্ঘ তৈরি করে শিল্পশিক্ষা দেবার কথা বলেছেন। এমন কী, আমেরিকায় আসারও আগে, যখন তিনি এক অপরিচিত পরিব্রাজক, তখনও তিনি ভারতের দারিদ্র্যের প্রতিষেধক হিসেবে ইয়োরোপ থেকে শিল্পশিক্ষা নেবার কথা ভেবেছেন। এ-সময় খেতরির মহারাজাকে তিনি বিজ্ঞালের প্রাথমিক পাঠও দিয়েছেন। আমেরিকায় থাকাকালীন এক ভারতীয় মেকানিককে লোহার কারখানা দেখার জন্য নিজের শিষ্যা মিসেস বুলের কাছে পাঠিয়ে স্বামীজি তাঁকে লেখেন, “...এর বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু লোকটি যদি পাক্কা বদমাশও হয়, তবু আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে এ-রকম বেপরোয়া মনোভাব দেখলে তাকে উৎসাহ দিতে চাই।”[১৪ই এপ্রিল, ১৮৯৬]। কয়েক মাস পরেই [৫ই জুন] তিনি আবার লিখছেন যে, যদিও তাঁর বাবা উকিল ছিলেন, তবু তিনি ভারতের জন্য আর উকিল চান না, তাঁর ইচ্ছে, তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান হন- “নিজের ও স্বজাতির জন্য সে একটা নতুন পথ উদ্ভাবনের চেষ্টা করুক। যদি সে ব্যর্থও হয়, তবু জানবো সে বড়ো হবার, দেশের যথার্থ কাজে লাগার চেষ্টা করেছিল। একজন ইলেক্ট্রিকাল এঞ্জিনীয়ার ভারতে অনায়াসে জীবিকা অর্জন করে বাঁচতে পারে।”

পশ্চিমী দুনিয়ার কাছ থেকে ভারতীয়দের বিজ্ঞান ও শিল্পশিক্ষা নেবার বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ নানাভাবে বারবার বলেছেন, ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার নভেম্বর, ১৯৩০ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধে সে-সব উক্তি সংকলিত হয়েছিল, সেখান থেকে তার কয়েকটি এখানে উদ্ধৃত করা যায়।

“তোরা একটা ছুঁচ পর্যন্ত তৈরি করতে পারিস না, তবু ইংরেজদের সমালোচনা করিস! ওরে নির্বোধ, আগে তাদের পায়ের কাছে বসে ব্যবসা-বাণিজ্য, কার্যকরী বুদ্ধি শিখে নে, যাতে জীবনযুদ্ধে জিততে পারিস।” কিংবা – “পাশ্চাত্ত্যের কাছ থেকে বস্তুবিজ্ঞান শিখতে হবে, যাতে আমরা জীবনসংগ্রামের বেশি উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারি।” জামশেদজি টাটাকে যেমন পরামর্শ দিয়েছিলেন তেমনটা তিনি অন্যত্রও বলেছেনঃ-“মাড়োয়ারিরা ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে সামান্য মুনাফা করে। তারা যদি ইয়োরোপীয়দের পকেট ভরাবার চেষ্টা না করে কিছু কলকারখানা, কর্মশালা তৈরি করত, তা হলে তাদেরও লাভ হতো, আর দেশেরও স্থায়ী কল্যাণ হতো।” আর সেই বিজ্ঞানব্রতী সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ করার স্বপ্ন - “প্রতি শহরে ও গ্রামে একটি করে মঠ করতে হবে। একজন সুশিক্ষিত সন্ন্যাসী মঠাধ্যক্ষ হয়ে থাকবেন। তাঁর অধীনে কার্যকরী বিজ্ঞান ও শিল্পশিক্ষার নানা বিভাগ থাকবে। সে বিভাগগুলি পরিচালনা করবেন এক একজন বিশেষজ্ঞ সন্ন্যাসী।” আরও স্পষ্টভাষায় তাঁর দাবিঃ- “যদি বাঁচতে হয়, আমাদের বৈজ্ঞানিক জাতি হতে হবে।” কিংবা সুনির্দিষ্টভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার কথাঃ- “আমাদের প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষা বা ওইরকম জিনিস, যা শিল্পোন্নয়নে সহায়তা করবে।”

মার্কিন দেশ থেকে ভারতে ফিরে আসার পরেও এই শিল্পবিজ্ঞান-ঋদ্ধ ভারতবর্ষের স্বপ্ন বিবেকানন্দকে অধিকার করে রেখেছিল। ১৮৯৭ সালে কলকাতায় যখন এক ঘরোয়া সভায় রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রস্তাব নেওয়া হয়, তখন মানুষের সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য জনসমাজে বেদান্ত ও অন্যান্য ধর্মভাব প্রবর্তন ছাড়াও ‘বিদ্যাদানের উপযুক্ত লোক শিক্ষিতকরণ’ ও ‘শিল্প ও শ্রমোপজীবিকার উৎসাহবর্ধন’ – এ-গুলিও প্রস্তাবিত সঙ্ঘের উদ্দেশ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। এ-বছর শেষ পর্যন্ত যখন রামকৃষ্ণ মিশন গঠিত হ্য়, তখনও তার কর্মধারার খসড়ায় অনিবার্যভাবেই স্থান পায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগণ্য ভূমিকাঃ- “এই মঠটিকে ধীরে ধীরে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করিতে হইবে। তাহার মধ্যে দার্শনিক চর্চা ও ধর্মচর্চার সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট করিতে হইবে। এইটি প্রথম কর্তব্য, অন্য সব অবয়ব ক্রমে-ক্রমে যুক্ত হইবে।” শুধু শিল্প-বিজ্ঞানের চর্চাই নয়, বিস্ময়ের কথা, তাঁর স্বপ্নের শিল্পবিজ্ঞান-প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য স্থান নির্দেশও করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ঐ খসড়াতেইঃ- “....মধ্যভারতে হাজারিবাগ প্রভৃতি জেলার নিকট উর্বর, সজল, স্বাস্থ্যকর অনেক ভূমি এখনও অনায়াসে পাওয়া যাইতে পারে। ঐ প্রদেশে এক বৃহৎ ভূমিখন্ড লইয়া তাহার উপর একটি বৃহৎ শিল্প-বিদ্যালয়, ধীরে-ধীরে কারখানা ইত্যাদি খুলিতে হইবে। অন্নাগমের নূতন পথ যেমনই আবিষ্কৃত হইতে থাকিবে, লোক তেমনই উক্ত উপনিবেশে আসিতে থাকিবে।” ভারতে আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর শিল্পপত্তনের ইতিহাস যাঁরা সামান্য অবগত আছেন, তাঁদের কাছে উপরোক্ত উল্লেখগুলিকে শুধু কর্মসূচি নয়, ভবিষ্যদ্বাণী বা নির্ভুল পূর্বাভাস বলেই মনে হতে পারে। এই ভবিষ্যদ্দর্শনের বিষয়টিতে আমরা পরে আবার আসব, তার আগে স্বামীজির বিজ্ঞানভাবনার আরো কিছু সংবাদ আমাদের নিতে হবে।

স্বামীজি যে এ-সময় শুধু তাঁর স্বপ্নের সন্ন্যাসী-সঙ্ঘে শিল্পশিক্ষা বা উৎপাদনকেন্দ্রের কথাই ভেবে ক্ষান্ত হননি, তার বিপণন বা বাণিজ্যের দিকটিও ভেবে রেখেছিলেন, তা বোঝা যায় রামকৃষ্ণ মিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার কয়েকদিন আগে সরলা দেবীকে [ঘোষাল] তাঁর এই পত্রাংশটি থেকেঃ- “ক্রমশঃ ঐ সকল প্রধান কেন্দ্রে কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি শিখানো যাবে এবং শিল্পাদিরও যাহাতে এদেশে উন্নতি হয় তদুপায়ে কর্মশালা খোলা যাবে। ঐ কর্মশালার মালবিক্রয় যাহাতে ইউরোপ ও আমেরিকায় হয় তজ্জন্য উক্ত দেশসমুহেও সভাস্থাপনা হইয়াছে ও হইবে।।...”[২৪শে এপ্রিল] অতঃপর বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীদের মধ্যে রীতিমতো বিজ্ঞানের পঠনপাঠন চালু করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন তিনি, গুরুভাইদের বারবার তাড়া দিয়ে চিঠি লিখতে থাকলেন। ১১ই জুলাইয়ের এমনই একটি চিঠির অংশঃ- “আগে একবার লিখেছিলাম যে, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার যন্ত্রপাতি কিনে ওইসব বিষয়ে, বিশেষত শারীরবিজ্ঞান সম্বন্ধে প্রাথমিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা দিলে ভালো হয়, কই সেসব ব্যাপারে তো কোনো উচ্চবাচ্য নেই? আরো একটি কথা লিখেছিলাম – যেসব বিজ্ঞানের বইয়ের বাংলায় অনুবাদ হয়েছে, সেগুলি কিনে ফেলা উচিত, সে সম্পর্কেই বা কী হলো? [স্বামী শুদ্ধানন্দকে লেখা] স্বামীজির পরিকল্পনা অনুসরণ করে ভগিনী নিবেদিতা কিছুদিন মঠে বিজ্ঞানের ক্লাশও নিয়েছিলেন। মিসেস বুলকে লেখা নিবেদিতার এক চিঠি [৬.৩.১৮৯৯] থেকে জানা যাচ্ছে যে, তাঁর গুরু ভারতের জনসাধারণের জীবিকা অর্জনের উপায় নিয়ে তাঁর সঙ্গে যে-আলোচনা করেন, তার মধ্যে ছিল শিল্প-উপনিবেশ স্থাপন, খাদ্যশস্য উৎপাদন, পুরনো পদ্ধতিতে তৈরি শিল্পসামগ্রীর জন্য ইয়োরোপে বাজার সৃষ্টি, সেখানকার পেটেন্ট কেনার জন্য কীভাবে অর্থসংস্থান করা যায় ইত্যাদি বিষয়। নিবেদিতার নানা চিঠিপত্র থেকে বিবাকানন্দের অন্যান্য যেসব শিল্পস্বপ্নের কথা জানা যায়, তা হলো – মঠের খরচ চালাবার জন্য শিল্পসামগ্রী তৈরি, কৃষিখামার স্থাপন ইত্যাদি।

দ্বিতীয়বার মার্কিন মুলুক সফরের সময়েও বিবেকানন্দ তাঁর ঐ শিল্প-বিজ্ঞানস্বপ্নকে লালন ও অনুসরণ করে চলেছিলেন। সেখানকার একটি কাগজ জানাচ্ছে, শুধু দর্শনশিক্ষা দেওয়াই স্বামী বিবেকানন্দের উদ্দেশ্য নয়, ভারতবর্ষের মানুষের উন্নয়নে শিল্পবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এদেশে আগ্রহসৃষ্টিও তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য।[‘লস এঞ্জেলস টাইমস’, ১৪.১.১৯০০] ‘প্যাসাডোনা ডেইলি স্টার’ কাগজটি লিখেছিল, স্বামীজি আরও বক্তৃতা দিতে রাজি আছেন, যদি স্থানীয় মানুষ ভারতে শিল্পবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁকে সাহায্য করেন।[১৬-১-১৯০০] এই কাগজটি থেকেই জানা যাচ্ছে, স্বামীজির থ্রপ পলিটেকনিক ইন্সটিট্যুট [পরবর্তীকালে কালিফোর্নিয়া ইনস্টিট্যুট অব টেকনোলজি নামে বিখ্যাত] পরিদর্শনের ও এর ম্যানুয়াল ট্রেনিং বিভাগটি দেখে তাঁর খুশি হবার খবর। এমন কথাও কাগজটি লিখেছিল যে, স্বামীজি এখানকার কাঠখোদাই পদ্ধতিটি স্বামীজি নাকি তাঁর পরিকল্পিত ভারতীয় বিদ্যালয়গুলিতে চালু করতে চেয়েছিলেন।[৮ই ফেব্রুয়ারি]

স্বামী বিবেকানন্দের শিল্পবিজ্ঞান চিন্তার প্রসঙ্গটি এখানে স্থগিত রেখে আমরা আপাতত ফিরে যাবো জামশেদজি টাটার কাহিনীতে। এতক্ষণ আমরা যেসব সংবাদ পরিবেশন করেছি, তার ভিত্তিতে এটুকু অনুমান মোটেও অসঙ্গত হবে না যে, টাটার বিজ্ঞান ও শিল্পসংক্রান্ত নিজস্ব বাণিজ্যিক পরিকল্পনা থেকে থাকলেও তার সঙ্গে জনহিত ও ত্যাগব্রতের আদর্শকে [ টাটার নিজের ভাষায় ‘ascetism’] যুক্ত করার ব্যাপারে তাঁকে খুব সম্ভব স্বামী বিবেকানন্দই অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এই প্রেরণার স্বীকৃতিস্বরূপ টাটা তাঁকে যে-চিঠিটি লেখেন, তাতে এ-বিষয়ে প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে স্বামীজিকে যে একটি পুস্তিকা রচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা’ও আমরা দেখেছি। বিবেকানন্দ ঐ চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন কিনা বা ওইরকম কোনও পুস্তিকা রচনা করেছিলেন কিনা, তা জানা না গেলেও এটুকু জানানো যায় যে, জামশেদজি কিন্তু শুধু ঐ চিঠি লিখেই নিরস্ত হননি। তিনি ভালোই জানতেন যে, নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগব্রতীদের সঙ্ঘবদ্ধ করে শিল্প বিজ্ঞানের প্রচার তাঁর সাধ্যায়ত্ত্ব নয়। তাই যা তিনি করতে পারেন অভ্রান্ত পদক্ষেপে সেটাই করলেন। প্রাথমিক অর্থসংস্থানের ঘোষণা করেই প্রথমে চিঠি লিখলেন বিবেকানন্দকে ও তাঁর কাছে এক ব্যক্তিগত দূতও পাঠালেন। পরের বছরই [১৮৯৯] তাঁর শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্পের সংগঠক পাদশা এসে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই সাক্ষাৎকারের কাছাকাছি সময়ে [আগে না পরে সঠিক ভাবে জানা যাচ্ছে না] স্বামীজির প্রতিষ্ঠিত ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় টাটা-পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রথম মন্তব্য করা হয়। ঐ পত্রিকার এপ্রিল, ১৮৯৯ সংখ্যার সহৃদয় ও উৎসাহপূর্ণ সম্পাদকীয় মন্তব্যের অংশবিশেষ ছিল এ-রকমঃ- “ভারতবর্ষের মঙ্গলের জন্য আজ অবধি যত পরিকল্পনা হয়েছে, তার মধ্যে শ্রীযুক্ত টাটার স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পটির চেয়ে বেশি সময়োচিত, আর সদূরপ্রসারী ফলদায়ী অন্য কিছু হয়েছে কিনা সন্দেহ।... কারো কারো কাছে এই প্রকল্পটি কল্পনাবিলাসে পূর্ণ, কেননা এর জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থ, অন্তত চুয়াত্তর লক্ষ টাকা। এই আশঙ্কার যথোচিত জবাব হচ্ছে – দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি না হয়েও একজন মানুষ একাই যদি তিরিশ লক্ষ টাকা দান করতে পারেন, তবে দেশের অন্যান্যরা কি বাকি অর্থের সংস্থান করতে পারেন না!... তাই সমগ্র জাতি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়-স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে যেন প্রকল্পটিকে সার্থক করার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে।....”


স্বদেশী মহলে টাটার পরিকল্পনাটিকে স্বাগত জানানো হলেও সরকারী মহলে কিন্তু প্রথম থেকেই এ-নিয়ে ছিল শীতল ঔদাসীন্য! ভারতে বাধাগ্রস্ত হয়ে জামশেদজি শিক্ষাবিভাগের কর্তাদের বোঝাতে ইংলন্ডেও যান ও সেখানে স্বামীজির শিষ্যা মিসেস বুল ও নিবেদিতার উদ্যোগে ঐ বিভাগের স্যার বার্ডউডের সঙ্গে আলোচনাও করেন, সরকারের বিরূপতার কারণে যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। অবশ্য নিবেদিতা এতে ক্ষান্ত না হয়ে গুরুর স্বপ্নকে নিজের ‘মিশন’ হিসেবে নিয়ে নানা দেশের বিদগ্ধ মানুষদের সঙ্গে টাটার প্রকল্পটির ব্যাপারে যোগাযোগ ও আলোচনা আর পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চালিয়ে যান। তাঁর এই প্রযত্ন স্বামীজি ও টাটার দেহাবসানের পরেও ক্রিয়াশীল ছিল। স্বামীজির মৃত্যুর [১৯০২] আগে আরও দু’বার টাটা প্রকল্প বিষয়ে ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’ মন্তব্য করা হয়েছিল। ১৯০১ সালের মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল যে, সরকার ‘দেশপ্রেমিক পার্সি শ্রী টাটা’-র প্রকল্পকে সমর্থন ও সহায়তা করলে ভারতবর্ষের জন্য নবীন জীবন, নবযুগ ও নতুন সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হবে। বিবেকানন্দের জীবনকালে পত্রিকাটির সর্বশেষ মন্তব্যে [মার্চ, ১৯০২] বাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠিতব্য ঐ গবেষণাসংস্থার নাম হবে ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অব সায়েন্স’ ইত্যাদি সংবাদ প্রকাশিত হলেও শেষ পর্যন্ত বিবেকানন্দ বা টাটা কারও জীবনকালেই ঐ বিজ্ঞান শিক্ষায়তন বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করেনি। ১৯০৪ সালে টাটার প্রয়াণের পরে তাঁর উত্তরসূরিদের নিবেদিতা, মিসেস বুল, মিস ম্যাকলয়েড প্রমুখ বিবেকানন্দের শিষ্যেরা ঐ শিক্ষায়তন প্রকল্পের রূপায়নে কীভাবে সহায়তা করেছিলেন, সে নিয়ে বিস্তারিত কাহিনীতে আমরা আপাতত যাবো না। এখানে এটুকু জানানোই যথেষ্ট হবে যে, অবশেষে ভারত সরকার ও মহীশূর সরকারের আর্থিক বরাদ্দের ওপর নির্ভর করে ১৯১১ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অব সায়েন্স-এর ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল।

শুধু বিজ্ঞান-গবেষণাগারের কথাতে শেষ করলে কিন্তু বিবেকানন্দের স্বপ্নপূরণের কাহিনী সম্পূর্ণ হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বদেশের শিল্পনির্ভরতা নিয়েও স্বামীজির ছিল সমান্তরাল এক স্বপ্ন, যার সঙ্গে তাঁর বিজ্ঞানস্বপ্নও ছিল অঙ্গাঙ্গী জড়িত আর জামশেদজিও ছিলেন সেই স্বপ্নের অংশীদার। আমরা জানি যে, ভারতে ইস্পাত-কারখানা স্থাপনা ছিল জামশেদজির অন্যতম উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। এই উদ্দেশ্যে সরেজমিনে লৌহ আকরিক ও কারখানার উপযুক্ত জমি অনুসন্ধানের কাজটিও শুরু হয়েছিল স্বামীজি ও টাটা দু’জনেরই প্রয়াণের পরে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, প্রথমে চম্বা, দুর্গ প্রভৃতি যে-সব অঞ্চলে লৌহ-আকরের জন্য টাটা কোম্পানির তরফে ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো হচ্ছিল, সে-গুলো কিন্ত সেই মধ্যভারতেই, যে অঞ্চলে কারখানা ও প্রযুক্তি-বিদ্যালয় স্থাপনের কথা বিবেকানন্দ তাঁর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের খসড়া-পরিকল্পনায় ঐ সব প্রচেষ্টা শুরুর অনেক আগেই উল্লেখ করেছিলেন। এই আশ্চর্য সমাপতনের সূত্রে কারও কারও মনে এমন প্রশ্নও জেগেছে, যে স্বামীজি যেহেতু একদা মধ্যভারতের নানা স্থানে পর্যটন করেছেন, তিনি কি লৌহ-আকরিকের অস্তিত্ব সম্পর্কে ব্যক্তিগত ধারণার ভিত্তিতেই ওই-রকম স্থানে কারখানার স্বপ্ন দেখেছিলেন? এই সমাপতনের শেষ কিন্তু এখানেই নয়। শেষ পর্যন্ত ভূতাত্ত্বিক প্রমথনাথ বসুর সুপারিশে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে আকরিকের সন্ধান পেয়ে টাটারা সুবর্ণরেখা ও খরকাইয়ের নদীসঙ্গমে যেখানে কারখানার স্থান নির্বাচন করেন, সেই সাকচি গ্রাম, বা পরবর্তীকালের জামশেদপুরও কিন্তু স্বামীজি-নির্দেশিত হাজারিবাগ অঞ্চলের থেকে খুব দূরে নয়। ইতিহাসবিধাতার অদ্ভুত ঘটনাসন্নিবেশে এই দুই স্বপ্নদর্শীর ঐহিক জীবনাবসানের কয়েক দশকের মধ্যেই জামশেদপুরে টাটা স্টীল কোম্পানির পত্তন [১৯০৭] ও ইস্পাত উৎপাদনের সূচনা [১৯১২] ও টেকনিকাল ইন্সটিট্যুটের প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল। আরও স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, বিবেকানন্দের শিল্পস্বপ্ন ও বিজ্ঞানস্বপ্ন দু’টিকেই সাকার করার ক্ষেত্রে সংঘটকের অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন জামশেদজি টাটা ও তাঁর উত্তরসূরিরা।

০৩) অমিতাভ প্রহরাজ

গুপ্তধন এবং বসু পরিবার

আবার বেবিবকবক - (মজা পান। মজে যান। গো ক্রেজি উইথ বাংলা)


আজকের সেরা উপার্জন......



এই বইটির অস্তিত্বের কথাই ভুলতে বসেছিলাম আমরা। হঠাৎ করে হাত ঠেকতে নিজেই চমকে গেছি। বহুক্ষণ বিশ্বাস হয়নি চোখকে। এ যেন মা-তারা হোটেলে দুপুরে খেতে গিয়ে কি আছে জিজ্ঞেস করে যদি শোনেন পিরানহার ঝাল-দেওয়া, ডোডোর ডিমের ঝোল, সেই লেভেলের চমক। ক্ষীণ সুরে ছোটবেলা থেকে কিছু আলোচনা ভেসে আসে। দাদা মানে ঠাকুর্দা কার সাথে কথা প্রসঙ্গে বলছেন এই বইটির কথা। বাংলাভাষায় পুরাণের এত ভালো ও ক্রেডিবল ডকুমেন্টেশান আর দুটি নেই। আর গিরীন্দ্রশেখর বসু? কী বলে পরিচয় দেওয়া যায়... এক বলতে পারি বড়ভাই-এর নাম শশিশেখর বসু, মেজভাই রাজশেখর বসু আর ছোটভাই গিরীন্দ্রশেখর। তিনটি অদ্ভুত চরিত্র। তত্যদ্ভুত তাঁদের প্রতিভা। যেহেতু এই বই ছোটভাই-এর তাই তাঁকে দিয়েই শুরু করি। গিরীন্দ্রশেখর বসু ফ্রয়েড সাহেবের সাক্ষাৎ ছাত্র। প্রথম বাঙালি মনোবৈজ্ঞানিক এই গিরীন্দ্রশেখর। মনঃস্তত্ত্বের ওপর বিস্তর বইপত্র ১৮৪২ থেকে পাওয়া গেলেও, মনোঃবিশ্লেষণের ওপর প্রথম বাংলা বই ‘স্বপ্ন’, লেখক গিরীন্দ্রশেখর বসু। অনবদ্য সেই পাতলা বইখানি। বস্তুতঃ ওটির সন্ধানেই বেরিয়েছিলাম। পেয়ে গেলাম এই রত্ন। রামায়ণ, মহাভারতের ওপর অথরিটি তিন ভাইই। কিন্তু তিনজনের আক্রমণ তিনদিক দিয়ে। মেজভাই-এর ‘মোটো’ মহাকাব্যগুলিকে সরল ও সুগম করে তোলা। ছোটভাই-এর মনঃস্তাত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ। কিন্তু সবচেয়ে চমক হলো বড় ভাই অর্থাৎ শশিশেখর বসু। পরিমানে সবচেয়ে বেশি লিখে গেছেন শশিশেখর। কিন্তু তাঁর ছাপা লেখা (বাংলা) বিরল ও দুষ্প্রাপ্য। বই মাত্র একটি, তাও একেবারে শেষ বয়সে মেজোভাই অর্থাৎ রাজশেখরের আবদারে করা, মূলতঃ ওনার লেখা প্রবন্ধের সঙ্কলন, ‘যা দেখেছি, যা শুনেছি’ নাম। প্রকাশক মিত্র অ্যান্ড ঘোষ (জয়মা বলে একবার কলেজস্ট্রীট ঠুকে দিতে পারেন, বলা যায় না লেগে গেল, পেয়ে গেলেন!!)।


শশিশেখরের ভারি মজলিসি কথনভঙ্গি ছিল। অনেকটা মুজতবা আলি সায়েবের ঘরানা। ‘যা দেখেছি যা শুনেছি’ বইটিতে শশিশেখরের একটি চিঠি আছে যে ভূমিকায়, সেই চিঠিতেই স্পষ্ট হয় কেন ওনার লেখা এত কম প্রকাশিত। শশিশেখর মনে করতেন, শব্দ ব্রহ্ম, তাই শালীন অশালীন কোনো ভেদাভেদ হয় না। (ভাবা যায়, রাজশেখর বসুর দাদা!) ওনার বেশির ভাগ লেখাই ফেরত আসতো সোজা বাংলায় সেন্সর করার জন্য। যে কাজটি উনি করতে একেবারেই রাজী থাকতেন না। ওনার একটি চিঠি পরিমল গোস্বামীর (হিমাণীশ গোস্বামীর পিতা, ‘যুগান্তর’ সম্পাদক, ‘শনিবারের চিঠি’ সহ সম্পাদক, বেতার কথক) সমগ্র স্মৃতি চিত্রর মধ্যে রয়েছে। যার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ওনার ‘ভূমিকম্প’ নামক একটি প্রবন্ধ, পরিমলবাবু রিজেক্ট করে পাঠিয়েছেন, কারেকশান করতে বলেছেন, তার উত্তরে শশিশেখর লিখছেন--
"ভূমিকম্প পাঠালাম, একদম নিরামিষ। ভাই কৈলাস বোস স্ট্রিট ও বাগবাজারে যাতে আপত্তি, তাতে তো বঙ্কিমের আপত্তি নেই!
যথা - দুর্লভ ছোটে। হায় কাছা খুলিয়া গিয়াছে। (দেবী চৌধুরাণী ১ম খণ্ড)
- ছুটিতে যুবতীদের কাপড় খুলিয়া পড়ে (ঐ ৩য় খণ্ড)
- কি রে মাগী! (চন্দ্রশেখর, মাগী দেদার)
ভাই একটু লাইসেন্স না দিলে আমার নাম, লেখা দুই ডুববে। ভূমিকম্প প্রবন্ধে এসব কিছু নেই। ভুঁইকম্পে যখন ছুটছিলাম তখন কি বীচির জায়গায় বীচি ও কাছার জায়গায় কাছা ঠিক ছিল?
- শশিশেখর"

কল্পনা করা যায় ১৯৫৪ সালে লেখা এই চিঠি স্বয়ং রাজশেখর বসুর বড়দার??!! প্রসঙ্গতঃ ভূমিকম্প বলতে বিহারে, মূলতঃ মজঃফরপুর অঞ্চলে এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে, বহু ব্রিজ ভেঙে পড়ে। জিটি রোড মাঝখান থেকে চিরে দিয়ে ভেতর থেকে ভুসভুস করে গরম বালি বেরিয়ে আসছে এই দৃশ্য পূর্ব ভারতের মানুষের কাছে কল্পনার একেবারে বাইরে এক ঘটনা ছিল। ফলে তুঙ্গে ওঠে গুজব। হতাহতের সংখ্যা তার ধাক্কায় উর্ধ্বশ্বাসে বাড়তে বাড়তে বাড়তে লাখ ছাড়িয়ে  কোটিতে গিয়ে পৌঁছোলে লোকের খানিকটা হুঁশ হয় যে, না তেত্রিশ কোটি মানুষের দেশে একধাক্কায় কয়েক কোটি মানুষকে মেরে ফেলা ঠিক নয়। বিহারের এই ভূমিকম্পের ওপর অনবদ্য কিছু গল্প আছে বনফুলের, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের। শশিশেখর বসু ছিলেন বিহার হেরাল্ড, মণীন্দ্রচন্দ্র সমাদ্দারের সম্পাদনায় 'পশ্চিম'-এর   বাঙালিদের সবচেয়ে প্রিয় ইংরেজী সংবাদপত্রের, প্রধান সাংবাদিক। S.S.Boseকে উল্টো  করে লিখতেন Esobss ছদ্মনামে। এই 'এসব্‌'-এর ফীচার বা প্রবন্ধ পড়েনি এমন লোক খুব কমই ছিল। দেখতে গেলে রাশভারী মেজভাই-এর চেয়ে রসসিক্ত বড়দা বহু  বহুগুন পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম ছিলেন। কিন্তু ওনার মৃত্যুর বহু পরেও লোকে জানতো না, বিহার হেরাল্ডের এসব্‌স হচ্ছেন রাজশেখর বসুর বড়দা। চিঠিটি পড়ে   স্বাভাবিক লোভ হচ্ছিল, কী সেই লেখা একজন আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধের? যা পরিমল গোস্বামী ছাপতে হিমশিম খাচ্ছেন। গত কয়েক মাসের ডিটেকটিভগিরিতে পোক্ত অভিজ্ঞতার কল্যাণে খুঁজে পাওয়াও গেল একটা, যা সামান্য লাইসেন্স পেয়ে (সবটা  নয়) লিখেছেন শশিশেখর, মনে পড়লো অল্পদিন আগের শ্লীলতা অশ্লীলতা বিতর্ক, হাসি পেল। যাক সে কথা, লেখাটি দেখাই। একজন আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধের গদ্যের ধার ও জীবনের প্রতি এ্যাটিচিউড, দুটোই আমার নাম ধরে ডাকবে বাঙালিদের।  



মিথিলা ও উত্তর প্রদেশের জেলা বিশেষে সাহিত্যে বা (স্কচ, স্প্যানিশ গানের মতন) সঙ্গীতে চুম্বনের স্থান নেই। থিয়েটারে ৫০ বছর পূর্বে যখন গোবিন্দলাল জলে ডোবা রোহিণীর মুখে ফুঁ দিতেন, তীরহুতিয়া দর্শকরা বাঙ্গালী দর্শককে ঘৃণায় বলতো --   কেহন গন্ধানালাকি পোঁথি লিখলঁ তোহর বঙ্কিম?? ছোঁড়ীয়াকে মুহাসে ওঠ লাগাকর বাঙ্গালীবাবু হাওয়া ফুকঁত্‌, রাম্‌! রাম্‌!!

অথচ এত ঘৃণা করেও সেই একই দল প্রতি পারফরম্যান্সে যেত, আমরাও প্রতি পারফরম্যান্সে রোহিণী দেখতাম রাগ না করে। বাড়িতে দর্শকেরা রোজই ফুঁ দিচ্ছেন,  কিন্তু পরের ফুঁ দেখা চাই। একেই ফ্রয়েডীয়ান পণ্ডিতগন 'পীপিং মেনিয়া' বলেন। আড়িপাতার সঙ্গে প্রায় এক, একই মহাপাপ।

শেলী এরকম লোককে মেল প্রুড নাম দিয়েছেন। তাঁর দি চেনচি নাটক পড়ে জনকয়েক বালিকার পিতা রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছিলেন এই বলে যে, এরকম অস্বাভাবিক পিতা জন্মায় নাই। অথচ দেখা যায়, এ কল্পনা নয়।

বঙ্কিমের মনে রিপ্রেশান বা অবদমন দ্বিধা লক্ষ্য হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ব'লে লজ্জা আছে। ভয়ে ভয়ে ভূমিকা ক'রে প্রেমের রহস্য বৃত্তান্ত লেখেন 'গ্রন্থকার প্রাচীন, লিখিতে লজ্জা নাই' (আহা ন্যাকা!! অর্থাৎ হচ্ছে।) মার্জিত-রুচি পাঠক পড়া বন্ধ করবেন, আ ছি ছি, ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে চুম্বন করিলেন’.....

নিজের পত্নীকে ব্রজেশ্বর কিস্‌ করছে, তাতে বঙ্কিমের এত লজ্জা!! যেন বঙ্কিমের বউকে কিস্‌ করছে!!

...... এসব ধোঁয়া ধোঁয়া কথা পাঠকের প্রত্যাশা সফলীকৃত করে না, যেমন সাদা কথা – ‘দৃঢ় বলে দুই হাতে বিনোদিনীকে বক্ষে টানিয়া লইলেন করে থাকেঔপন্যাসিক মনে রাখবেন স্যাকরার ঠুকঠাক কামারের এক ঘায়ের কাছে কিছুই না। দুটোতে দুরকম আর্ট অবশ্য আছে।

উচ্চশিক্ষিত পাঠকের কাছে নায়ক নায়িকার ঘুজুঘুজু বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ঘটনা কম, বাজে কথাবার্তা অতিরিক্ত, পাঠকের এবং চরিত্রের (উভয়ার্থে) ধৈর্য নষ্ট করে... কার্যকলাপ খাপছাড়া ফেলে যাওয়া, এমনতরো কথা অনেক পাঠক চান না। আর এখানেই সেই ভুল বোঝাবুঝিটি হয়, ফ্রয়েড সাহেব যাকে বলেন স্লিপ। কিছুদূর গিয়ে গ্রন্থকার থেমে গেলেন, পাঠক অনুমান করে নেবে, ভারী আর্ট হবে!! আহা!! এ আর্টে যে অনেক কুঁড়ে পাঠকের মেহনত হয় গ্রন্থকার ভেবেও দেখেন না। তারা ভাবেন ঔপন্যাসিক যখন গাজিয়াবাদ অবধি নিয়েই এলেন, তখন দিল্লী দেখালেন না কেন...

চোখ কচলে আরেকবার পড়ুন। আপনি ঠিকই দেখছেন, এটি ১৯৪৯ সালে লেখা আশি বছর বয়স্ক বালকের গদ্য!! যিনি অন্য পরিচয়ে রাজশেখর বসুর দাদা এবং টানা ৫০ বছর ধরে বিহার হেরাল্ডে এসব্‌স হয়ে দুহাতে ফীচার লিখেছেন, বাইলাইন  লিখেছেন, রিপোর্ট লিখেছেন, এবং তার সাথে সাথে হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন বাংলা গল্প। মাথায় রাখবেন, তখন কথায় কথায় ফ্রয়েড মারানো তো বহুদুর, প্রেমকেই  কাঞ্চনবর্ণ নিকষিতহেম জাতীয় প্লেটো থেকে শরীরের ময়দানে নামাতে হিমসিম খাচ্ছেন  বাঘা বাঘা সব রথী মহারথী -- বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ইত্যাদি  কল্লোলিয়ানস। তার মাত্র দশ বছর আগেই প্রমথ চৌধুরীর ডান্ডায় কোনোমতে থামানো  গেছে সাধু বনাম চলিত বাংলা বিশ্বযুদ্ধ। তখনও মানুষের কাছে চার অধ্যায় একটা  ফিসফিস আর ল্যাবরেটরি গুরুদেবের ভীমরতির প্রকট নিদর্শন বলে মোটামুটি  গৃহীত। তখনো সন্দেশের সুকুমার রায়-এর ছেলের বানানো পথের পাঁচালী নামক  বায়োস্কোপটি শহরে আসেনি। বিবর লেখা হতে আরো দুদশক বাকি। জীবনানন্দ  দাশ তখন বাংলা কবিতার হাস্যকৌতুক, যাকে শ্রেষ্ঠ প্যারোডি করা যায় এবং শ্রেষ্ঠতম হ্যাসাস্পদ করা যায়। তখনো বিয়ের বয়স ১৪-১৬ (এবং তাও অত্যন্ত অসন্তোষের সঙ্গে গৃহীত), এমন একটি সময়খণ্ডে বসে এই লেখা (তাও সামান্য লাইসেন্সের সুফল  নিয়ে এবং সেন্সরিং-এর পরে) যে কী পরিমা প্রাণশক্তির উদাহরণ, তা ভাবা  যায় না। হ্যাঁ, আপনাকে বলছি চন্দ্রিলবাবু, ননভেজ স্যাটায়ারি বাংলা ভাষার যে জঁর, যা দিয়ে মূলতঃ স্যাটাস্যাট লেখা যায় বা স্যাট স্যাট শব্দে এক একটি প্রবন্ধ নেমে যায়  মার্কিন নৌবাহিনীর মতো, আপনাকে হর্তা কর্তা অবধি ঠিক আছে, কিন্তু তারপরের পোস্টগুলি, বিধাতা, ত্রাতা, আবিষ্কর্তা, নির্মাতা ইত্যাদি দেওয়া যে খুব চাপ হয়ে গেল! তার ওপর এই ভদ্রলোকের, শশিশেখরের স্যাটায়ার, এ্যাপ্লায়েড স্যাটায়ারও ছিল। মানে প্রায়োগিক জায়গাও কিছু তৈরি করে গেছেন স্ব স্ব কীর্তির সাহায্যে।

একদিন চৌরঙ্গি প্লেসে একজন পুলিসের কাছে বিনীতভাবে এবং সসম্মানে জিজ্ঞেস করলেন, "আপকা ইডিয়সি কনজেনিট্যাল হ্যায় কি এ্যাকোয়ার্ড হ্যায়?" কনস্টেবল কিছুই না বুঝতে পেরে ঘাবড়ে গিয়ে তারপর গর্বের সঙ্গে বললো, "কনজেনিট্যাল হ্যায়""! কনজেনিট্যাল!! ভেরি গুড, তো আপ একদম বর্ন ইডিয়ট হ্যায়, ভেরি গুড। তব তো ঠিক হ্যায়, ইয়ে সাইকেল পকড়িয়ে, হাম থোড়া... আতে হ্যায়" বলে কনস্টেবল পোস্টিং যে কাজটি নিবারণের জন্য, সেটিই সেরে এলেন...

এই গল্প আমি অবশ্য বহুলোকের মুখে স্বীয় কীর্তি বা উপস্থিত বুদ্ধির প্রমা স্বরূপ শুনেছি। 

সবচেয়ে মজার জায়গা লক্ষ্য করা যায় এই প্রবন্ধের অংশটিতে যে, তিন ভাইয়ের মিলিত উপার্জন (গান্ধী নয়, জ্ঞান) যেন একটা মেজর ড্রাইভিং ফোর্স। একভাই-এর  সাহিত্যিক ফিনেস, ছোটভাই-এর মনঃবিশ্লেষণী দৃষ্টিকোণ ও নিজের স্যাটায়ার। কেমন একটা পারিবারিক বিদ্যা, অন্যান্য সাবজেক্ট ডিভিশান মুছে গিয়ে, আভাস পাওয়া   যায়। যার মধ্যে ল্যাংগুয়েজ, রেটরিক্স, সাইকোলজি, মাইথোলজি সব যেন মেশানো রয়েছে। এই ডাইভার্স ক্যারেক্টার সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত মেজভাই-এর সৃষ্টিগুলির  মধ্যে। চলন্তিকার সংকলক, বিজ্ঞানবিষয়ক পরিভাষা কমিটির সদস্য এক রাজশেখর  বসু, যিনি ভাষা ও বানানের শুদ্ধতা নিয়ে অতি মাত্রায় খুঁতখুঁতে। মহাভারত সহজ   সরল করে তোলা এক রাজশেখর বসু। বেঙ্গল কেমিক্যালস’-এর চীফ কেমিস্ট কাম বিজ্ঞাপনের কপিলেখক রাজশেখর বসু। আর ৪২ বছর বয়সে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী  লিমিটেড দিয়ে শুরু হওয়া পরশুরাম। এই শশিশেখরের একটি মহা মূল্যবান রচনা  রাজশেখরের বাল্যকাল, এটি রাজশেখরকে না জানিয়ে লিখেছিলেন শশিশেখর শারদীয় যুগান্তরএর জন্য, এবং রাজশেখরের ছোটবেলায় লেখা একটি কবিতা ফাঁস করে  দিয়েছিলেন

আর কত দেরী, আর যে সহে না,
ধড়ে প্রাণ আর থাকিতে চাহে না।
এইবার মেল ঢোকে ইস্টিশান
ভ্যাকুঅম ব্রেকে পড়েছে কি টান?
গুম গুম গুম গুম কড় কড় কড়
হড়াৎ হড়াৎ হড় হড় হড়
ক্যাঁচ ক্যাঁচ কোঁ থামিল গাড়ি।

শশিশেখরের ওই রচনাতেই জানা যায়, ভুশণ্ডীর মাঠে কারিয়া পিরেত-এর মুখে যে গান, সেটি রাজশেখরেরই আরেকটি বাল্যরচনা। রাজশেখর-এর সুমিষ্ট প্রতিশোধ স্বরূপ   শশিশেখরের একটি হিন্দি কবিতা পাঠিয়ে দেন যুগান্তরেএহেন গুরুগম্ভীর লোকেদের এমন দুষ্টুমি দেখলে কেমন একটা অদ্ভুত ফীলিংস হয় না?? শশিশেখরের কবিতাটি, আরেক মোক্ষম ধাক্কা...

মা যা হইয়াছেন-

কহো কালী হামে
কৌন লুটা তুমে
       খোপাড়ি তোড়েগা হাম।
বোলো মা কালিকে
তুমারা শাড়ীকে
       কিতনা থা মায়ী দাম??
শাড়ি মোল দেগা
তুমে পিনাহে গা
       এহি তো বেটাকা কাম।
য়হাঁকা বঙ্গালী
ঝুট মুট কালী
       দেওয়ে ফুল কেলা আম।
ঝুটে মা-মা বোলে
খুব চন্দহ্‌ মিলে
       রুপেয়া উসুল কাম
চন্দহ্‌ কি রুপেয়া
সব গল্‌ গয়া
       খানা পিনা ধুমধাম
বোম বোম কালী
কলকাত্তা বালী
তোবা তোবা রাম নাম

(ফিন্‌ সে বোলো)

কহো কালী হামে
কৌন লুটা তুমে
        খোপাড়ি তোড়েগা হাম।
বোলো মা কালিকে
তুমারা শাড়ীকে
       কিতনা থা মায়ী দাম??

- শশিশেখর বসু (লেখা আগে, ছাপা ১৯৫২)


কবে যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলোতে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার কালীকে   সাঁওতালি মাগী বলেছেন বলে হুল্লোড়বাজি পড়ে গেল রুচিরক্ষা সমিতি ইত্যাদি ইত্যাদি?? কতো কী এলো সেই সূত্রে কলোনিয়াল, পোস্ট কলোনিয়াল, অনার্য দেবী,  সাব-অলটার্ন, নো-রাইট-টার্ন, নো-লেফট-টার্ন হ্যায়সা হ্যায়সা কতো তত্ত্বের বুকড়ম, কৃষ্টির পিন্ডি ইত্যাদি। এনারা আর কতোদিন ওই গর্তে মুখ ঢুকিয়ে, বাকিটা বাইরে  রেখে, এ্যাটম বম্ব আমার পাছায় পড়বে না, পড়বে না আ না আ না আ না গান করবেন???

যাক গে, এই আশ্চর্য বসু পরিবারের আরেক সদস্য যে মনোবিজ্ঞান ও মনোবিশ্লেষণ  নিয়ে পড়াশোনা করবেন, তা নিয়ে কি আর কোনো সন্দেহ থাকে?? আর সেই পড়াশোনাটা যদি হয় খোদ ফ্রয়েড সাহেবের কাছে, তাহলে কী রাজযোটক মিলটাই না  হয়!!! শুধু ছাত্র নয়, পরে ফ্রয়েডের সহবৈজ্ঞানিক গিরীন্দ্রশেখর  এরপর কোনো কিছু  উৎকট বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে কুড়ি বছর কথাবার্তা চালিয়ে এক সাঙ্ঘাতিক বস্তু  ফ্রয়েড-বোস করেসপন্ডেন্স নামে তৈরি করেছিলেন। বলতে গেলে এশিয়ার প্রথম  মনোরোগ চিকিৎসক এই গিরীন্দ্রশেখর বসু যিনি সোসাইটি অফ সাইকো এ্যানালিসিস, এন আর এস এ মনোরোগ বিভাগ হ্যানাত্যানা চালু করেছিলেন। মোদ্দা কথা, প্রথম   পাগলের ডাক্তার এই গিরীন্দ্রশেখর। সে চুলোয় যাক, এই নিয়ে তো আর প্রশ্ন আসবে না। সব ভাই-এর মধ্যেই একটা কালেক্টরস স্পিরিট কাজ করেছে। রাজশেখর যে রকম  শুদ্ধ শব্দ সংগ্রহ করেছিলেন, গিরীন্দ্রশেখর একই রকম ভাবে পুরাণের গল্পগুলির এক অমূল্য সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন তার মনঃস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখা সহ।    তারপর প্রায় প্রবাদপ্রতিম হওয়া একটা বই জাস্ট হারিয়ে যায়... কলেজস্ট্রীটের যে সমস্ত দোকান মিলিয়ে মহান ডেটাবেস বানানো হয়েছে, তাতে দেখছি শুধুমাত্র  লালকালো আছে, তাও ওটি নিয়ে এক ভাঁটের এ্যানিমেশান তৈরি  হয়েছে বলে...     লালকালোর লিংক দিচ্ছি না, মিত্র ঘোষ-এ পাওয়া যায়, ৩০/- দাম... তবে বাচ্চাদের বলে খাটো করবেন না যেন, অসামান্য এই উপন্যাস... সামান্য একটু চাখনা দেওয়াই যথেষ্ট...

[ঘোষদের পুরনো ভিটার ধারে যে ডোবা আছে, তার একদিকে কালো পিপীলিদের রাজ্য, আরেকদিকে লাল পিঁপড়েদের রাজত্ব। দুই রাজত্বে বিশেষ বনিবনা নেই। কালো ও লাল পিঁপড়েদের মধ্যে প্রায়ই খুঁটিনাটি নিয়ে ঝগড়া-মারামারি হয়।
আজ বড়ই গুমোট করেছে, পিপীলিদের কালো বউ ডোবার ধারে জল নিতে এসেছে। কালো বউয়ের রূপের ঠ্যাকারে মাটিতে পা পড়ে না। তার ওপর সে কালো রানীর পেয়ারের সখি। এ ঘাটে যখন কালো বউ জল ভরছে, ডোবার ওপারে লাল পিঁপড়েদের একদল পল্টন কুচকাওয়াজ করতে এলো। পল্টনের দলের এক ডেঁপো ছোকরা কালো বউকে দেখে সুড়সুড় করে এপারে এগিয়ে এসে হাত-মুখ নেড়ে কালো বউয়ের উদ্দেশ্যে ঠাট্টা-তামাশা জুড়ল। কালো বউ রেগে ঘাড় বাঁকিয়ে, ঘাট থেকে উঠে এসে গালাগালি দিতে দিতে বাড়ির দিকে চলল। লাল ডেঁপো গান ধরলে--
কালো বউ কালো কোলো।
জলে ঢেউ সামলে চোলো।

কালো বউ একেবারে হন্হন করে রানীর কাছে উপস্থিত হয়ে আছড়ে পড়ল। কী হলো কী হলো বলে রানী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন

রাঙামুখো বজ্জাতে করে অপমান
গরল ভখিব আমি তেজিব পরাণ।

রানী সব কথা শুনলেন – ‘এক্ষুনি এর প্রতিকার করব। সখি আমরুলপাতা আর  বেলকাঁটা নিয়ে আয়, আমি রাজাকে লিপি পাঠাই’

চিঠি লেখা হলো; সাঁড়াশিমুখো প্রতিহারী শুঁড় বাঁকিয়ে লিপি নিয়ে রাজসভায় গেল। কালো পিপীলিদের রাজা পাত্র-মিত্র সঙ্গে নিয়ে সজনেতলায় সভা কালো করে বসেছেন। ডাইনে কালো মন্ত্রী, বাঁয়ে কেলে কোটাল সেনাপতি। সভায় সড়সড়ে পিঁপড়ে ফরফর করে এদিক-সেদিক ঘুরে খবরদারি করছে। অর্থী-প্রার্থী সব জোড়হাতে শুঁড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় প্রতিহারী ঝুঁকে মাটিতে শুঁড় ঠেকিয়ে রাজাকে অভিবাদন করলে। রাজা চিঠি পড়লেন। ]


১৪ নম্বর পার্শীবাগান লেন/বসুভবন, যা রাজশেখর বসুর ঠিকানা, যা পরশুরামের  গল্পে ১৪ হাবসিবাগান লেন, সেইখানে গিরীন্দ্রশেখর একটি ক্লাব করেছিলেন, যার নাম রাজশেখরের দেওয়া উৎকেন্দ্রিক সমিতিএই উৎকেন্দ্রিক সমিতির সদস্য কে না  ছিলেন? জলধর সেন, দাদাঠাকুর, পরিমল গোস্বামী, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, শরৎচন্দ্র পন্ডিত (পরশুরামের ছবিগুলি যাঁর আঁকা), যতীন্দ্রনাথ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, হারীতকৃষ্ণ দেব, রাজশেখর বসু, স্বয়ং শশিশেখর। এই সমিতির আড্ডার মাধ্যমে গিরীন্দ্রশেখর আরেকটা কালেকশানের কাজ করছিলেন, তাঁর তিন নম্বর। সেটি হলো অদ্ভুত বা আশ্চর্য  টপিকের কালেকশান। যেমন

) রবীন্দ্রনাথ একটি সভায় হঠাৎ বলে উঠেছিলেন এখানে একটা বাঁদরক) একবার গোরুতে কম্পোজিটরের কপি খেয়ে নিয়েছিল বলে যুগান্তর বেরোতে  পারেনি
 আছে  (পরে অবশ্য এটার একটা রাবীন্দ্রিক ব্যখ্যা পাওয়া যায়, উনি বলতে চেয়েছিলেন এই ঘরটার যেমন একটা ডানদোর আছে, তেমনি বাঁ-দোর আছে)
) সজনীকান্ত দাসের ভূত আমাদের কি কি ক্ষতি করতে পারে?
) বসুমতীর কেরামতি বা বসুমতীর ফেমাস অনুবাদের ভুলের নমুনা
    . The police are patrolling the street of Dacca
     ঢাকায় পুলিশের লোকেরা রাস্তায় কেরোসিন তেল ঢালছে...
    . Mr. Day was shot by 32 bore pistol by Gopinath Saha
     ৩২ নলা পিস্তল দিয়ে ডেকে গুলি করা হয়েছিল
    . Gandhiji was going through the menu card while having lunch
     গান্ধীজি মনুসংহিতা পড়তে পড়তে মধ্যাহ্নভোজন করছিলেন... 
) হ্যালির ধূমকেতু আসছে বলে পানচাষীরা কেন ভেবেছিল পানে পোকা হবে? (ইয়ার্কি না, এটি সত্যিই একটি গুরুতর গুজব যা মেদিনীপুরকে পানহীন করে দিয়েছিল

এটি আনফিনিশ্‌ড থেকে গেছে... এতেও একটা মূল্যবান সংযোজন হলো শশিশেখরের Marriages of Elephants


রাজশেখর তাঁর মৃত্যুর দুদিন আগে লিখিত নির্দেশ দিয়ে যান

সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে - শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ পত্রে এ যেন লেখা না হয়। মরবার  আগে অজ্ঞান হবো নিশ্চিত, এবিষয়ে আমার কোনো দ্বিধা নেই। আর প্রাণ যাবে গৃহে,  কোনোভাবেই গঙ্গায় নয় তাই সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি নিরর্থক। আর আশি পেরিয়ে যায় যে,  তার মৃত্যুতে শোচনীয়তা কোথায়? সুতরাং পত্রের শুরুতে ভাগ্যহীন লিখো না, লিখো  বিনীত”

এবার বইটির জন্য