সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

০১) অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী


যিশু-জীবনের দু’টি আবৃত অধ্যায় : কিছু ভারতীয় যোগসূত্র


এ-কথা আমাদের সবারই জানা আছে যে, বাইবেল অথবা খ্রীস্টীয় শাস্ত্রগুলিতে যিশুর জীবনের ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। সে-ইতিহাসে ছেদ পড়েছে যিশুর বারো বছর বয়সের পর থেকে। তারপর প্রায় আঠারো উনিশ বছরের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। কিশোর যিশুর পরেই পাওয়া যাচ্ছে একেবারে ত্রিশ বছরের যুবক যিশুর কথা। এই ফাঁকটি স্বভাবতই গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কারণ, মানুষের মানসিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পর্বটির অনুল্লেখ প্রশ্ন না জাগিয়ে পারে না। যিশু খ্রীস্টের জীবনের দ্বিতীয় রহস্যাবৃত পর্বটি হচ্ছে তাঁর ক্রুশারোহণের পরবর্তী অধ্যায়। খ্রীস্টান শাস্ত্রগুলির মতে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ‘মৃত্যুর’ পর তাঁর ‘পুনরুত্থান’ হয় ও তিনি ‘কবর’ থেকে উঠে ছ’ সপ্তাহ পৃথিবীতে ছিলেন, এরপর এক পাহাড়ের ওপর থেকে তিনি সোজা আকাশে উঠে মিলিয়ে যান। বাস্তববুদ্ধি দিয়ে অবশ্যই এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

যিশুর জীবনের এই দু’টি আবৃত বা বিতর্কিত অধ্যায় সম্পর্কে যে-সব কাহিনী বা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, তার কয়েকটির সঙ্গে প্রাচীন ভারতবর্ষ আর হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের নানা অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। খ্রীস্টীয় পুঁথিপত্রে অনুল্লেখিত ঐ দু’টি পর্বে যিশু ভারতে এসেছিলেন কিনা -- এ বিতর্ক বহু দিনের। অন্য যে কোনো বিষয়ের মতোই এই বিতর্কটিও দুটি দিক দিয়ে বিবেচ্য -- তথ্যের দিক, আর তত্ত্বের দিক। তথ্যের দিক দিয়ে বিচার করা প্রয়োজন, যিশুর ভারতে আগমনের কি কোনো বস্তুগত প্রমাণ পাওয়া যায়! আর তত্ত্বগতভাবে দেখতে হবে, খ্রীস্টধর্মের দর্শন ও সিদ্ধান্তগুলিতে ভারতের তৎকালীন ধর্ম ও মতবাদগুলির কোনো তাত্ত্বিক প্রভাব আছে কিনা! এই দু’টি দিক সম্পর্কেই অবশ্য বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ বর্তমান পরিসরে নেই, আমরা শুধু কয়েকটি সূত্রের উল্লেখ এখানে করবো।

জিজ্ঞাসু কিশোর থেকে মানবপুত্রে উত্তরণ 


 
ল্যুক লিখিত সুসমাচারের ‘মন্দিরে বালক যিশু’ বিষয়ক অধ্যায়ে ইহুদিদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ‘তারণোৎসব’ উপলক্ষে যিশুর মা-বাবার তাঁকে নিয়ে জেরুজালেমে যাবার কথা আছে। সেখানে বারো বছর বয়সী যিশুকে মন্দিরের শাস্ত্রীদের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা করতে দেখতে পান তাঁর মা-বাবা। তারপর যিশুকে নিয়ে তাঁরা যথারীতি ন্যাজারেথে ফিরে এলেন ও এই বালক বয়সে ও জ্ঞানে দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন এবং ক্রমে ক্রমে ঈশ্বর ও মানুষের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন, এ- পর্যন্তই উল্লেখ পাওয়া যায়। এর পর খ্রীস্টীয় সাহিত্যে যিশু-জীবনের যবনিকা উত্তোলন হচ্ছে তাঁর ত্রিশ বছর বয়সে। ম্যাথু লিখছেন, যিশু যখন জর্ডন নদীর তীরে জন দি ব্যাপটিস্টের কাছে দীক্ষা নিতে যাচ্ছেন, তখন তিনি পূর্ণবয়স্ক যুবা। জনের মতো দীক্ষকও এই তরুণকে বলছেন, “আমারই উচিত আপনার কাছে দীক্ষাগ্রহণ করা, আর আপনি এসেছেন আমার কাছে!” কিন্তু কী ভাবে কবে কোথায় যিশু এই পরিণতি ও খ্যাতি অর্জন করলেন, সেই মধ্যবর্তী ইতিহাস কিছুই পাই না আমরা।

এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যিশুর জীবনের এই সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা তাঁর উন্মেষপর্ব, একটি জিজ্ঞাসু কিশোর থেকে পরিত্রাতা খ্রীস্ট হয়ে ওঠার পর্ব, যে প্রস্তুতিপর্ব সম্পর্কে খ্রীস্টীয় সাহিত্যগুলো বিশ্বকে অন্ধকারে রেখেছে। কোন্‌ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ন্যাজারেথের বালকটি মানবপুত্র যিশু হয়ে উঠলেন, খ্রীস্টান পন্ডিতদের নিজেদের কাছেই তার কোনো জবাব নেই, এটা একটু অদ্ভুতই মনে হয়। এ-কথা অবশ্য আমরা শতাধিক বছর ধরে জানি যে, রুশ পর্যটক [কেউ বলেন ডাক্তার, কারও মতে গুপ্তচর] নিকোলাস নটোভিচের লেখা একটি বইয়ে যিশু-জীবনের এই অজ্ঞাতপর্বটি সম্পর্কে কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। ১৮৯৪ সালে বইটি প্রথম ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়, তারপর ইংরেজি, জার্মান, স্পেনীয় ও ইটালিয়ান ভাষায়ও অনূদিত হয়। ইংরেজি সংস্করণটির নাম ‘দি আননওন লাইফ অব জেসাস ক্রাইস্ট’।

১৮৯০ সাল নাগাদ নেপাল, তিব্বত ও কাশ্মীরের নানা মঠে ও গুম্ফায় ঘুরে বেড়াবার সময় নটোভিচ লাদাখের রাজধানী লে শহরের উপকন্ঠে বিশাল বৌদ্ধ মঠ হিমিস গুম্ফার গ্রন্থশালার এক লামার কাছ থেকে জানতে পারেন, সেখানে তিব্বতী ভাষায় লেখা একটি পুঁথির কয়েকটি প্রতিলিপি আছে, যাতে প্রাচ্যদেশে যিশুর জীবনযাপনের কাহিনী রয়েছে। তাঁর বইয়ের ভূমিকায় নটোভিচ জানিয়েছেন, এটি নাকি পালিভাষায় লেখায় মূল পুঁথির তিব্বতী অনুবাদ, যা তিনি একজন লামা ও এক দোভাষীর সাহায্য নিয়ে নোটবুকে নিজের ভাষায় লিখে নেন। নিজের বইয়ে এই শ্লোকগুলিকে তিনি কাহিনীর পারম্পর্যের খাতিরে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন। তাঁর প্রকাশিত বইটিতে চোদ্দটি অধ্যায়ে শ্রেণিবদ্ধ ২৪৪টি স্তবক রয়েছে। ভারতের ও নেপালের ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ ইতিহাসকারদের লেখা যে-পুঁথিটি নটোভিচ হিমিস গুম্ফায় দেখেছিলেন, তার নাম, তাঁর অনুবাদে - ‘দি লাইফ অব সেন্ট ইশা; দি বেস্ট অব দি সানস অব মেন’। এটিতে বর্ণিত কাহিনীর অনেক ঘটনা আবার বাইবেলের বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়।

এবার এই বইটিতে বিবৃত কাহিনীটি বলা যাক। বালক যিশু বা ইশার তেরো বছর বয়সে, যে সময়ে সে-দেশে বিবাহিত জীবন শুরু হয়, তাঁর মা-বাবার কাছে কন্যাপক্ষের লোকজনদের যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। এই সময়েই বালক ইশা গোপনে তাঁর পিতার গৃহ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। নিজেকে অধ্যাত্মবিদ্যায় পারঙ্গম করে তুলতে চেয়ে মহান বুদ্ধের নীতিসমূহের পাঠ নিতে তিনি জেরুজালেম থেকে বেরিয়ে একদল বণিকের সঙ্গে সিন্ধুদেশের দিকে রওনা হন। ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য চোদ্দ বছরের ইশা সিন্ধুপ্রদেশের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে ঈশ্বরের প্রিয় দেশে আর্যদের মধ্যে বসবাস শুরু করলেন। ইতিমধ্যেই সিন্ধুর উত্তরাঞ্চলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি যখন পঞ্চনদীর দেশ ও রাজপুতানার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জৈন [‘D Jaine’] উপাসকেরা তাঁকে তাদের সঙ্গে থাকতে অনুরোধ করলেও তিনি ঐ বিপথগামী ভক্তদের ছেড়ে চলে যান ওড়িশা [orsis] প্রদেশের জগন্নাথধামে [‘Juggernaut’]।

সেখানে ব্রহ্ম বা ব্রহ্মার শ্বেত উপাসকেরা তাঁকে স্বাগত জানান। এই পুরোহিতেরাই তাঁকে বেদপাঠ ও শাস্ত্রব্যাখ্যা করতে শেখান। এদের কাছে ইশা আর যা যা শেখেন, তা হলো – প্রার্থনার মাধ্যমে রোগ সারানো, অশুভ আত্মার প্রভাব কাটিয়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলা ইত্যাদি।

এরপর ছ’ বছর ধরে ইশা, জগন্নাথধাম, রাজগৃহ ও বারাণসীর পবিত্র নগরীতে বৈশ্য ও শূদ্রদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করেন। এরা তাঁকে ভালোবাসতো ও এদের কাছে তিনি পরস্বাপহরকদের নিন্দা ও সাম্য, শান্তি আর সৌভ্রাত্রের বাণী প্রচার করতেন। শূদ্রদের তিনি বলতেন, “গরীব ও দুর্বলের সহায় হও, অপরের ক্ষতি কোরো না, অন্যের সম্পত্তিতে লোভ কোরো না” ইত্যাদি। তাঁর এ-ধরনের উপদেশে ক্রুদ্ধ হয়ে জগন্নাথের সেই ‘শ্বেত পুরোহিতে’র দল ও যোদ্ধারা [warriors] ইশার প্রাণনাশের চেষ্টা করে, কিন্তু শূদ্রদের কাছে এই চক্রান্তের খবর পেয়ে তিনি রাতারাতি পুরীধাম থেকে পালিয়ে যান। অতঃপর তিনি আশ্রয় নেন বুদ্ধের জন্মস্থান গোতমীয় দেশে [Gothamide country] ও সেখানে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসকদের কাছে ছ’বছর থেকে বৌদ্ধশাস্ত্র ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এই বিবরণ থেকে মনে হয় যে, এই তরুণ পরিব্রাজককে পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডারা ও রাজশক্তির বেতনভূক সৈনিকেরা মিলে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তিনি সম্ভবত এরপর নেপালে চলে যান।

যা-ই হোক, বইটির ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে, এরপর তরুণ ইশা নেপাল ও হিমালয় অঞ্চল ছেড়ে তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করতে করতে রাজপুতানা হয়ে পশ্চিম দিকে চলতে থাকেন। তাঁর প্রচারে আতঙ্কিত হয়ে পারস্যের পুরোহিতেরা স্থানীয় লোকজনকে ইশার উপদেশ শুনতে নিষেধ করে। কিন্তু তবু গ্রামবাসীরা ইশাকে সমাদর করে সাগ্রহে তাঁর উপদেশ শুনছে দেখে পুরোহিতেরা তাঁকে বন্দী করে প্রধান পুরোহিতের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু এই বিচক্ষণ লোকটি ইশার কথা শুনে তাঁর কোনো ক্ষতি না করে ছেড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত পুরোহিতেরা ইশাকে নগরপ্রাচীরের বাইরে রাজপথের ওপর ছেড়ে দেয় এই ভেবে যে, অচিরেই তিনি বন্যজন্তুর শিকার হবেন। কিন্তু প্রভুর আশীর্বাদে ইশা নির্বিঘ্নে ইজ্রায়েলের দেশে এসে পৌঁছান। এই কাহিনী অনুযায়ী তখন তাঁর বয়স উনত্রিশ বছর। এর পরে ঐ তিব্বতী পুঁথিতে এই পরিব্রাজকের পরবর্তী জীবনের যে-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তা অনেকাংশেই খ্রীস্টীয় গসপেলে বর্ণিত যিশুর জীবনকাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়।

কনটোভিচের পরিবেশিত কাহিনীটির পর তার প্রকাশনা ও প্রতিক্রিয়ার কথা কিছুটা শোনাও জরুরী। তিব্বতী পুঁথিতে বর্ণিত কাহিনী যে যিশুরই তরুণ বয়সের অজ্ঞাত কাহিনী, এ-কথা বুঝতে পেরে তিনি ইয়োরোপের কয়েকজন ধর্মবেত্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু প্রাচ্যদেশীয় ধর্ম ও দর্শনের কাছে যিশু বা তাঁর প্রতিপাদিত ধর্মমতের কোনো রকম ঋণ ছিল, তা খ্রীস্টীয় সমাজের পক্ষে মেনে নেওয়া যথেষ্ট কঠিন ছিল। কিয়েভের স্বনামধন্য আর্কবিশপ মঁসেন্যুর প্লাতন, পারীর কার্ডিনাল রোটেলি প্রমুখ নটোভিচকে ঐ বইয়ের প্রকাশনা থেকে নানাভাবে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। ইতালির এক উচ্চপদস্থ কার্ডিনাল নাকি বইটি প্রকাশ না করার ক্ষতিপূরণ হিসেবে নটোভিচকে অর্থও দিতে চান, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তিনি চিঠি লেখেন জুলস সাইমনকে, জবাবে তিনি বইটি প্রকাশ করা বা না করা সম্পর্কে বিচার করে নটোভিচকেই সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। অতঃপর ফরাসি ভাষায় নটোভিচের বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন যে, তাঁকে সমালোচনা করার আগে বৈজ্ঞানিকসমাজ ওই বৌদ্ধ পুঁথিটি যেখানে আছে, সেখানে গিয়ে যেন এর ঐতিহাসিক মূল্য যাচাই করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য খ্রীস্টীয় সমাজের ও তার বাইরের কেউ কেউ হিমিস গুম্ফায় গিয়ে ওই চেষ্টা করেছেন। এঁদের মধ্যে ১৯২১ সালে হেনরিয়েটা মেরিক, ১৯২২ সালে বাঙালি সন্ন্যাসী স্বামী অভেদানন্দ ও ১৯২৫ সাল নাগাদ রুশ চিত্রকর নিকোলাস রোয়েরিখের হিমিস গুম্ফায় আগমন উল্লেখযোগ্য এবং তাঁরা ওই পুঁথিটি দেখেছেন বলে দাবি করে ইশা-কাহিনীর যে-বিবরণ দেন, তা মোটামুটি নটোভিচের কাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়। এঁরা ছাড়াও শ্রী রামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ [কোন্‌ সালে জানা যাচ্ছে না], ১৯৩৯ সালে আলাদা ভাবে মিসেস গেস্ক আর ই. কাস্পারি, ১৯৭০ সালে এডোয়ার্ড নোওয়াক, ’৭৩ সালে ডঃ রেভিজ, ’৭৪ সালে ইউ এইক্সটাড প্রমুখ হিমিস গুম্ফায় আসেন। এঁরা সকলেই সেখানে ওই পুঁথিটি দেখেছেন অথবা সেটির কথা লামাদের কাছে শুনেছেন বলে দাবি করেছেন। তা সত্ত্বেও এঁদের কথায় বিশ্বাস করেননি, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। শোনা যায়, স্বনামধন্য প্রাচ্যবিদ ম্যাক্সমূলর এঁদের অন্যতম। এই অবিশ্বাসী খ্রীস্টানদের বক্তব্য প্রচারের জন্য বেশ কিছু ওয়েবসাইট চালু আছে, যার মূল বক্তব্য, নটোভিচ ধাপ্পাবাজ ছাড়া আর কিছু নন। ‘দি ফোর্থ আর’ নামে এক পত্রিকায় রবার্ট প্রাইস নামে এক লেখক ২০০১ সালে জানিয়েছিলেন, আগ্রার জনৈক অধ্যাপক ডগলাস নাকি নটোভিচের বই প্রকাশের সমকালে হিমিস গুম্ফায় গিয়ে লামাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বিগত পনেরো বছরে কোনো পর্যটকই ঐ গুম্ফায় আসেননি এবং নটোভিচ-কথিত কোনো পুঁথিও নাকি হিমিস মঠে নেই।



ক্রুশারোহণের পরে


রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেটের আদেশে যিশুকে ক্রুশে ঝোলানো হয়েছিল, এ-কথার উল্লেখ বাইবেল সাহিত্যগুলিতে পাওয়া যায়। কিন্তু তার পরে তাঁর মৃত্যু বা সৎকারের কথা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। সন্ত ল্যুকের বর্ণনায় আছে, ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে দেখে মন্দিরের পুরোহিত ও শাস্ত্রীরা, পথচারীরা, এমন কি, ক্রুশে ঝোলানো একটা চোরও নানা রকম ব্যঙ্গবিদ্রূপ করছিল। মার্ক লিখিত সমাচারেও আছে, যিশুর প্রাণদন্ডের পরে তাঁকে ক্রুশে চড়াবার আগে সৈন্যেরা তাঁকে উপহাস ও আঘাত করছিল আর তাঁর গায়ে থুথু দিচ্ছিল। এ-থেকে বোঝা যায় যে, গলগাথা নামক ওই বধ্যভূমিতে যিশুর প্রতি সহানুভূতিশীল একজনও ছিল না। পুরোহিতেরা স্থানীয় জনতাকে তাঁর বিরুদ্ধে ভালো ভাবেই খেপিয়ে তুলেছিল। বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ী, সকাল ন’টা নাগাদ যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, দুপুর বারোটার পর চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। বেলা তিনটের সময় যিশু উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন, “ঈশ্বর আমার, কেন তুমি আমায় ত্যাগ করেছ?” তারপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। যিশুর মা মরিয়ম সহ তাঁর আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মানুষ দূর থেকে সব দেখছিলেন। সন্ধ্যা নাগাদ যোশেফ নামে এক প্রভাবশালী ইহুদি পন্টিয়াস পাইলেটের কাছে গিয়ে যিশুর মৃত্যুর কথা জানিয়ে তাঁর দেহটি কবর দেবার জন্য নিয়ে যাবার অনুমতি চাইলেন। মৃত্যুর খবরে পাইলেট বিস্মিত হলেন ও বধ্যভূমিতে প্রহরারত সেনানায়কের কাছে খবরটি যাচাই করে নিয়ে দেহটি নিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন। যোসেফ ক্রুশ থেকে দেহটি নামিয়ে একটি নতুন চাদরে জড়িয়ে সেটিকে পাহাড়ের একটি গুহার ভেতরে শুইয়ে দিলেন ও একটি পাথর দিয়ে সমাধির মুখ বন্ধ করে দিলেন। দূর থেকে যারা সব লক্ষ্য রাখছিলেন, সেই মাদ্গালা-নিবাসিনী মরিয়ম ও যিশু-জননী মেরী যিশুকে কোথায় রাখা হলো দেখে গেলেন।

বাইবেলীয় বিবরণের এ-টুকু অংশ থেকে কয়েকটি ব্যাপার ভেবে দেখার মতো মনে হয়। প্রথমত, ছ’ঘন্টা একজন ক্রুশবিদ্ধ মানুষের সজ্ঞান অবস্থায় থাকা ও কথা বলতে বলতে হঠাৎ মৃত্যু হওয়াটা খুব স্বাভাবিক মনে হয় না। মৃত্যুর সংবাদে রোমান শাসকের বিস্ময়ের কারণও সেটাই হতে পারে। দ্বিতীয়ত, গলগাথায় শত্রুভাবাপন্ন লোকেরা যিশুকে ঘিরে রাখলেও তাঁর শিষ্য-অনুরাগীরা তাঁর ওপর দূর থেকে নজর রাখছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, এমনটা হওয়া সম্ভব যে, যিশু সাময়িকভাবে মূর্ছিত হয়েছিলেন ও তা মৃত্যু বলে ধরে নিয়েছিল সমবেত জনতা ও পাহারায় থাকা রোমান সেনানায়কটি। ফলে তাঁর দেহটি শিষ্য-অনুগামীরা ক্রুশ থেকে নামিয়ে আনার সুযোগ পান ও তার পরেই সম্ভবত তাঁরা বুঝতে পারেন যে, তিনি মারা যাননি। তাঁর দেহকে যে-ভাবে কবর দেওয়ার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, তা এতই অস্বাভাবিক যে, তাতে এই সন্দেহই দৃঢ় হয় যে, যিশু সে-সময় মারা যাননি।

বাইবেলের বিবরণে এর পরের কাহিনী অলৌকিক উপাদানে মেশানো। একদিন পার হবার পর দুই মেরী সমাধিগুহার সামনে গিয়ে দেখেন যে, গুহামুখের পাথরটি সেখান থেকে সরিয়ে তার ওপর এক দেবদূত বসে আছেন। তিনি মহিলাদের জানান যে, যিশু সেখানে নেই, তাঁর ‘পুনরুত্থান’ হয়েছে। কোথায় গেলে যিশুর দেখা পাওয়া যাবে, সেকথাও তিনি এঁদের বলে দিচ্ছেন। এরপর তাঁদের ফিরে যাবার পথে আবির্ভূত হচ্ছেন স্বয়ং যিশু ও এঁদের বলছেন শিষ্যবন্ধুসহ গালীল প্রদেশে যেতে, সেখানেই তিনি দর্শন দেবেন। খ্রীস্টীয় কাহিনীগুলিতে এরপরেও শিষ্যদের সামনে যিশুর আবির্ভাবের কথা আছে – কখনও তিনি বোঝাচ্ছেন যে, তাঁর ঐ পুনরুত্থানে অবিশ্বাস্য কিছু নেই, কখনও বা তিনিই যে জলজ্যান্ত যিশু, তা বোঝাতে নিজের ক্রুশক্ষত দেখাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত গালীল প্রদেশে শিষ্যভক্তদের সামনে এক পাহাড়ের ওপর থেকে তিনি সোজা আকাশে উঠে অদৃশ্য হয়ে যান। জন ও অন্যান্যদের লেখা সুসমাচারের এই অলৌকিক বিবরণেই যিশুর সর্বশেষ বর্ণনা পাওয়া যায়।

অবাস্তব বা অলৌকিক বর্ণনাকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে যাঁরা ঐ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, তাঁদের অনেকের মতে, ঐ ‘পুনরুত্থান’ খুব সম্ভব একটি পরিকল্পিত ব্যাপার। অচৈতন্য যিশুকে ক্ষত নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত ভেষজ আর ওষধির [বাইবেলেই এর বিবরণ আছে] সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলে শত্রুভাবাপন্ন পুরোহিত ও শাসককুলের নজর এড়িয়ে নিরাপদ স্থানে শিষ্যভক্তদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব‍্যবস্থা করার জন্যই ওই সব অলৌকিক কাহিনী ছড়ানো হয়েছিল। যিশুর অন্তর্হিত হবার সোজা অর্থ, তিনি গা ঢাকা দিয়েছিলেন ও সম্ভবত কোনো দূরদেশে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রভাবশালী শিষ্যেরা তাঁকে শত্রুরাজ্য থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দৃশ্য কেউ দেখেনি বলেই বাইবেলে তার বর্ণনা কোথাও নেই। তাঁর এই নিরুদ্দেশকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে মেঘের মধ্যে মিলিয়ে যাবার রূপক কাহিনীর মধ্য দিয়ে।

এতক্ষণ যা বলা হলো, তা সবই বাইবেলের অলৌকিক কাহিনীর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, যিশু সত্যিই যদি অন্য কোনো দেশে চলে গিয়ে থাকেন, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ বা সাক্ষ্য পাওয়া যায় কিনা! এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, যিশুর ক্রুশারোহণ-উত্তর পর্বের জীবন সম্পর্কে সত্যিই বিভিন্ন জনশ্রুতি ও কাহিনী আর তার সপক্ষে নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাহিত্যিক ও নৃতাত্ত্বিক সাক্ষ্য নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে যিশুর এই ‘অজ্ঞাত’ জীবনের কাহিনীগুলির বিভিন্ন শাখাগুলি এ-রকম। একটি শাখা অনুসারে যিশু তুরস্ক, পারস্য ও পশ্চিম ইয়োরোপ হয়ে পৌঁছন ইংলন্ড ও ফ্রান্স পর্যন্ত। আরেকটি শাখা পৌঁছেছে জেরুজালেমে। ওই অঞ্চলে ১৯৮০ সালে আবিষ্কৃত এক প্রাচীন সমাধিতে চিত্রলিপিতে খোদিত এমন কিছু নাম পাওয়া যায়, যা নাকি নিউ টেস্টামেন্টের বিভিন্ন চিত্রের সঙ্গে মিলে যায়। অনেকের মতে, এটি যিশু খ্রীস্টের পারিবারিক কবর – টোপেল নামে এক মার্কিন সাংবাদিক এ-বিষয়ে ‘দি লস্ট টোম অব জেসাস’ নামে এক তথ্যচিত্র তৈরি করেন, যা ২০০৭ সালে টি-ভি-তে প্রথম দেখানো হয়। আবার প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রাপ্ত এক প্রাচীন পুঁথিতে লেখা আছে, পুনরুত্থানের পর যিশু আবার তাঁর আদি কর্মভূমি হিমালয় অঞ্চলে ফিরে আসেন ‘শয়তানদের রাজ্য’ পরিত্যাগ করে এবং সেখানে শিষ্যদের নিয়ে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। যিশুজীবনের অজ্ঞাত পর্বের এই বিভিন্ন শাখাগুলির মধ্যে যেটি ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত, আপাতত সেটি নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা করবো।

যিশুর ক্রুশ-উত্তর জীবনকাহিনীর ভারত-সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংক্ষেপে এ-রকম। নিজের মা মেরীকে নিয়ে যিশু প্রায় ষোলো বছর পশ্চিম এশিয়া ও ইয়োরোপের নানাদেশে ও সম্ভবত ইংল্যান্ডে সফর করেন ও শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে এসে উপস্থিত হন। সেখানেই মেরী মাতার মৃত্যু হয়। সেখানকার মানুষের কাছে বহু বছর ধর্মীয় উপদেশ প্রচার করেন তিনি, এরা তাঁকে একজন মহান পয়গম্বর, সন্ত ও সংস্কারক হিসেবে শ্রদ্ধা করতো। কাশ্মীরেই তাঁর মৃত্যু হয় ও সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। প্রাচীন ও আধুনিক নানা গ্রন্থেই এই কাহিনী পাওয়া যায়। ইরানের পন্ডিত এফ মহম্মদের ‘জোমি উৎ তুওয়ারিক’, ইমাম আবু জাফর মুহম্মদের ‘তফাসি-ইবন-ই-জামিরাৎ’ প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থ, ফিদা হাসনাইনের ‘Jesus from Apocryphal, Buddhist, Islamic & Sanskrit sources’, হলগার কের্স্তেনের ‘Jesus lived in India’ ইত্যাদি বইয়ের নাম এ-প্রসঙ্গে করা যায়। তুরস্ক ও পারস্য দু’দেশেরই প্রাচীন কাহিনীতে ইয়ুজ আসফ নামে এক সন্তের নাম পাওয়া যায়। পূর্বোক্ত লেখক কের্স্তেন লক্ষ্য করেছেন, এই ব্যক্তির অলৌকিক কাজকর্ম ও কথাবার্তা যেন যিশুর সঙ্গেই মিলে যায়। পূর্ব আনাতোলিয়ায় কুর্দ উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী ক্রুশারোহণের পর যিশু কিছুদিন পূর্ব তুরস্কে বসবাস করেছিলেন।

চার্চের ক্ষমতাসীন অধিকারীরা [থিওলজিকাল কম্যুনিটি] যিশু-জীবনের অনেক প্রচলিত কাহিনীকেই শোনা কথা বলে বর্জন করেন। এই সব অসমর্থিত বিবরণ বা ‘অ্যাপোক্রাইফা’-গুলির মধ্যেই যিশুর নিরুদ্দেশ-জীবনের অনেক সূত্র লুকিয়ে আছে বলে অনেকের বিশ্বাস। এ-রকম দু’টি বিবরণ হচ্ছে ‘দি অ্যাপোক্রাইফাল অ্যাক্ট অব জেসাস’ আর ‘দি গসপেল অব জেসাস’। দু’টিতেই পাওয়া যাচ্ছে, ক্রুশারোহণের পরে যিশুর সঙ্গে বেশ কয়েকবার সেন্ট টমাসের দেখা হয় ও তিনিই টমাসকে ভারতে প্রচারের উদ্দেশ্যে পাঠান। এই টমাসের গসপেলটি মূলত সিরিয়ান, খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতক বা তারও আগেকার। এটিতে টমাস আনাতোলিয়ার আন্দ্রোপলিসে রাজা আন্দ্রাপ্পার অতিথি হিসেবে যিশুর উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। প্রাচীন এক ইসলামি পুঁথিতে মেসোপটেমিয়ার নিসবিসে মাতা মেরী ও শিষ্যদের সঙ্গে যিশুর আগমন ও ধর্মপ্রচারে বাধা পাবার কথা আছে। ‘ফরহাং ই আসাফিয়া’ নামে একটি বইয়ে ইরানে যিশুর আগমন, অসুস্থদের রোগ নিরাময় ও তাদের সংঘবদ্ধ করার কথা আছে। ‘অ্যাক্টা থোমায়ে’ নামে একটি বইয়ে ভারতের তক্ষশিলায় এক রাজপরিবারের বিবাহ-অনুষ্ঠানে যিশুর উপস্থিতির কাহিনী রয়েছে। কোরআনের ‘সুরাত-উল-সুমিনাম’ অংশের একটি বইয়ে বলা হচ্ছে --“আমরা মেরীপুত্রকে ও তাঁর জননীকে আশ্রয় দিয়েছি সবুজ উপত্যকায় ও প্রবহমান ঝর্ণার সেই উচ্চভূমিতে।” এখানে কাশ্মীরের নামোল্লেখ না করা হলেও হজরত ইশার ইয়ুজ আসফ নাম নিয়ে কাশ্মীর উপত্যকায় বসবাস, নানা স্থানে ভ্রমণ ও মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করার কথা পাওয়া যায় মুল্লা নাদরির ‘তারিখ ই কাশ্মীরি’ [১৮২০ খ্রিঃ], ‘ওয়াজিস-উৎ-তাওয়ারিখ’ [১৮৫৭] আর তারিখ-ই-হাসান’, শেখ আল সৈদ-উস-সাদিকের ‘ইকমাল-উদ-দিন’, মীর শাদুল্লা শাহাবাদীর ‘বাগ-ই-সুলাইমান’ [১৭৮০] ইত্যাদি বহু প্রাচীন ও অর্বাচীন গ্রন্থে।

গোপানন্দ বা গোপদত্ত ৪৯ থেকে ১০৯ খ্রীঃ পর্যন্ত কাশ্মীরের শাসক ছিলেন। ‘তারিখ ই কাশ্মীরি’ জানাচ্ছে, সন্ত ইয়ুজ আসফ এই অঞ্চলের সব মানুষের কাছেই দিব্যপুরুষ হিসেবে শ্রদ্ধেয় ছিলেন, যদিও তাঁর নিজস্ব ধর্মপ্রচার সম্পর্কে হিন্দুদের কিছু আপত্তির কথা রাজা গোপদত্ত তাঁকে জানিয়েছিলেন। কাশ্মীরের রাজ্য অভিলেখাগারের প্রাক্তন ডিরেক্টর ডঃ ফিদা হাসনাইনের ‘এ সার্চ ফর হিসটোরিকাল জেসাস’ বইটিতে ‘ভবিষ্য মহাপুরাণ’ নামে একটি হিন্দু গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাতে শাক্য নরপতি শালিবাহনের হিমালয় অঞ্চলে ‘হুনরাজ্যে’ ভ্রমণের সময় এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে রাজা শ্বেতবস্ত্রপরিহিত এক দিব্যদর্শন ব্যক্তিকে পাহাড়ে উপবিষ্ট দেখতে পান, তাঁর গায়ের রং ফরসা। রাজা তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি কুমারীগর্ভসঞ্জাত ইশাপুত্র, সত্যব্রতপরায়ণ ও ম্লেচ্ছধর্মের প্রবক্তা।” তাঁর ধর্ম কী, রাজার এই প্রশ্নের উত্তরে ঐ ব্যক্তি বলেন, “মহারাজ, ম্লেচ্ছদেশে সত্য ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আমি সেখানে মসীহা [অবতার] রূপে সমাগত হই।” [‘নির্মর্যাদে ম্লেচ্ছদেশে মসীহো২হং সমাগত’] ডঃ হাসনাইনের মতে, এই হুনদেশ এখনকার লাদাখ উপত্যকা, যা সে-সময় কুশান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।



‘হারানো ভেড়া’দের খোঁজে -- নৃতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্বের পাথুরে প্রমাণ


ম্যাথু লিখিত সুসমাচারে পাওয়া যায়, যিশু তাঁর বারোজন শিষ্যকে নির্দেশ দেন, ‘ইজ্রায়েল বংশের যে-সব হারানো ভেড়ারা’ রয়েছে, তাদের কাছেই যেন তাঁরা যান। যিশুর কাশ্মীর বা ভারতে যাবার তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের মতে ইহুদিদের মাত্র দু’টি বংশ ছাড়া আর সব বংশের লোকেরাই তাদের বাসভূমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল নানা দেশে, হারানো ভেড়া বা ‘লস্ট শীপ’ বলতে যিশু তাদেরই বুঝিয়ে ছিলেন। সে-জন্যই যিশুর পুনরুত্থানের পর তাঁর শিষ্যেরা জেরুজালেমে মিলিত হয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়া ইহুদিদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তখন ভারতবর্ষ বলতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বর্তমান ভারত পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বোঝাতো। তাই অনেকের বিশ্বাস, যিশুর নির্দেশ মেনেই সেন্ট টমাস প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন ও এ-দেশের প্রথম খ্রীস্টান সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় সাহিত্য ও লোককথায় এই বিশ্বাসের কিছু সমর্থনের কথা আমরা বলেছি। এখন দেখতে হবে যে, এ-সব শুধুই বিশ্বাস, না এর সপক্ষে কোনো ‘পাথুরে প্রমাণ’ অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক কোনো সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায়।

যিশুর ইংলন্ড সফরের সপক্ষে ব্রিটেনে ‘হ্যালেড ট্রি’ নামে এক প্রাচীন ওকগাছের উল্লেখ করা হয়, যা যিশু পুঁতেছিলেন বলে জনশ্রুতি। তবে যিশুর সঙ্গে জড়িত প্রাচীন স্মৃতিচিহ্নের সংখ্যা ইয়োরোপের চেয়ে এশিয়াতেই বেশি। যেমন স্বভূমি থেকে যিশুর ভারতে আসার কথিত পথের [প্রাচীন ‘রেশম পথ’] ওপর ছিল ‘হোম অব মেরী’ নামে এক বিশ্রামস্থল, পাকিস্তানের পিন্ডি পয়েন্ট নামক পাহাড়ে মুরি [অথবা ‘মারি’] শহরের কিনারায় ‘মাই মেরী কা আস্থান’ নামে একটি কবর ইত্যাদি সম্ভবত যিশু-জননীর স্মৃতির সঙ্গেই জড়িত। ঐ পিন্ডি পয়েন্ট, যে-পর্বতের অংশ, সেই ‘কুইন্স মাউন্টেন’ নামটিও মেরীর নামেই বলেই অনেকে মনে করেন, এমন কি, জায়গাটির ‘মারী’ নামটিও মেরী থেকেই এসেছে বলে অনেকের ধারণা। এই কবরটি মুসলিম এলাকার মধ্যে হলেও এটি ইহুদি প্রথা অনুযায়ী পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। আফগানিস্তানের হেরাত ও তার আশেপাশে বাস করে এক প্রাচীন মুসলিম উপজাতি, যারা নিজেদের মরিয়মপুত্র ইশার অনুগামী বলে পরিচয় দেয়, যা এক সময়ে যিশুর এ-অঞ্চলে ধর্মপ্রচারের ইঙ্গিত দেয়। কাবুলের কাছে ‘ইশা তালাও’ নামে এক জলাশয়ের কথাও শোনা যায়, যেখানে ভারতে যাবার পথে যিশু তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি।

এর পর যিশুর ‘স্মৃতিচিহ্নে’র সন্ধানে আসা যাক ভারতে। তাঁর ভারতে আসার কথিত পথটির সন্নিহিত অঞ্চলে নানা আফগান ও কাশ্মীরী জাতি ও উপজাতির মধ্যে এখনও এমন অনেক নাম পাওয়া যায়, যা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে রয়েছে। বস্তুত এত বেশি বাইবেলীয় নাম কাশ্মীর ও আফগানিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই দুই অঞ্চলের অনেক স্থানের নামও বাইবেলে পাওয়া যায়। এ-গুলি এই সব অঞ্চলের ঘরছাড়া ইহুদিবংশীয়দের কাছে যিশুর ধর্মপ্রচারের ইঙ্গিত দেয় বলে ‘দি টোম অব জেসাস’ নামক ওয়েবসাইটটি দাবি করে। শুধু কাশ্মীরেই রয়েছে যিশু খ্রীস্টের স্মৃতি বিজড়িত একাধিক স্থান। শ্রীনগরের ওপরেই দি থ্রোন অব সলোমান নামে প্রায় তিন হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন এক মন্দিরের গায়ে খোদিত আছে চারটি লিখন, যার একটির মর্মার্থ – “এই সময়ে, এই ৫৪ অব্দে ইয়ুজ আসফ ঘোষণা করেন তাঁর স্বর্গীয় আহ্বান”, এবং -- “তিনিই যিশু – ইজরায়েলের সন্তানদের দিব্যপুরুষ”। শ্রীনগরের দক্ষিণে রয়েছে এক তৃণভূমি, যার নাম ‘য়ুজি মার্গ’ আর এই শহরের দক্ষিণ পূর্বে রয়েছে এক পবিত্র ইমারত, যার নাম ‘আইশ মোকাম’। এই বাড়িটির মধ্যে আছে একটি পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন, যাকে কেউ বলেন ‘মোজেস রড’, কেউ বা বলেন ‘জেসাস রড’। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচিহ্নটি রয়েছে শ্রীনগরেই ‘রোজাবাল’ [শব্দটির অর্থ ‘পয়গম্বরের কবর’] নামে একটি বাড়িতে। এখানে সমাধি কুঠুরির ভেতরে সন্ত য়ুজ আসফ ও আর একজন মুসলিম সন্তের কবর রয়েছে। এর মধ্যে য়ুজ আসফের পাথরের কবরটি বসানো হয়েছে ইহুদি প্রথা মেনে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর এবং সমাধিপ্রস্তরে খোদাই করা রয়েছে দুটি পায়ের ছাপ। উল্লেখযোগ্য যে, দুটি পদচিহ্নের মাঝখানেই দেখা যায় একটি গোলাকার ক্ষতচিহ্ন। গবেষক অধ্যাপক হাসনাইনের মতে, হতে পারে এগুলি ক্রুশের পেরেক পোঁতারই দাগ। এই কবরের দেওয়াল থেকে একদা মৃগনাভির সুগন্ধ নির্গত হতো বলে শোনা যায়। এ-রকমও শোনা যায় যে, এক সময় স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ‘মলুন-ই-ইশা’ নামে এক মলম নাকি পাওয়া যেত, যা কাশ্মীরে আগত যিশুর ক্রুশক্ষত নিবারণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল বলে এদের বিশ্বাস।



বিবেকানন্দের আশ্চর্য স্বপ্ন


যিশু খ্রীস্টের জীবনের রহস্যাবৃত অধ্যায়গুলির সঙ্গে জড়িত ভারতীয় অনুষঙ্গগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও পুরাতাত্ত্বিক তথ্যাদি নিয়ে আমরা কিছু নাড়াচাড়া করেছি। এর পরিপূরক দিকটি, অর্থাৎ খ্রীস্টীয় ধর্মতত্ত্বে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক উপাদানের উপস্থিতি বা প্রভাব সম্পর্কে আলোচনার মধ্যে আপাতত আমরা না গিয়ে শুধু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের একটি অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ সব শেষে করতে চাই। ১৮৯৬ সালে স্বামীজি যখন জাহাজে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছেন, তখন এক রাতে নেপলস ও পোর্ট সৈয়দের মাঝামাঝি এক জায়গায় ভূমধ্যসাগরের বুকে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা এক ঋষিপ্রতিম বৃদ্ধ এসে তাঁকে বলছেন, “তুমি এখন যেখনে এসেছ, সেটা ক্রীট দ্বীপ, এখানেই খ্রীস্টধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল। আমি এখানকার প্রাচীন থেরাপুত্তিদের [বৌদ্ধদের একটি সম্প্রদায়] একজন। আমরা যে-সব তত্ত্ব প্রচার করতাম, খ্রীস্টানরা সে-গুলিই যীশুর উপদেশ বলে প্রচার করছে। আসলে যিশু খ্রীস্ট বলে কেউ কোনোদিন ছিলেন না। এই জায়গায় খনন করলে আমার কথার অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে।”

স্বামীজির তখনই ঘুম ভেঙে গেল ও তিনি জাহাজের ডেকে এসে এক কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, তখন মধ্যরাত্রি ও জাহাজ রয়েছে সত্যিই ক্রীট দ্বীপ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে। তিনি পরে ইংল্যন্ডে তাঁর এক প্রত্নতাত্ত্বিক বন্ধুকে নাকি এই স্বপ্নবৃত্তান্তের কথা জানিয়ে এ-বিষয়ে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেছিলেন। বিবেকানন্দের জীবনীকার স্বামী গম্ভীরানন্দ জানাচ্ছেন, স্বামীজির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গিয়েছিল যে, ক্রীট দ্বীপে খনন চালিয়ে এক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক নাকি এমন অনেক লিপি পেয়েছেন, যা থেকে খ্রীস্টধর্মের উৎপত্তি বিষয়ে অনেক আশ্চর্যজনক তথ্য জানা যায়। এখানে অবশ্য বলে রাখা উচিত, বিবেকানন্দ নিজে কোনোদিনই যিশু খ্রীস্টের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেননি। তবে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, আলেকজান্দ্রিয়া নগরে ভারতীয় ও মিশরীয় ভাবধারার যে মিশ্রণ হয়, তা-ই ছিল খ্রীস্টধর্ম গঠনের মুখ্য উপাদান। তিনি এমন কথাও বলেছেন :- “খ্রীস্টধর্ম... সোজা হিন্দুধর্ম থেকে উদ্ভুত।”

আমরা এতক্ষণ যে-সব কাহিনীর কথা বলেছি, সে সূত্রে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যিশুর উদ্দেশে লেখা একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র মনে পড়ে যায় -- “ওখানে ঠাঁই নাই প্রভু আর, এই এশিয়ায় দাঁড়াও সরে এসে / বুদ্ধ-জনক-কবীর-নানক-নিমাই-নিতাই-শুক-সনকের দেশে।।...” এখানে অবশ্য যদিও যিশুর শারীরিকভাবে ভারতে চলে আসার কথা বলা হয়নি, হিংসাদীর্ণ ইয়োরোপে যিশুর আদর্শের কোনো স্থান নেই, এ-কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে; তবু আমাদের বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, যিশু সত্যিই তাঁর জীবনে এক বা একাধিকবার এশিয়ায় এসেছেন, এখানে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন ও এখানকার মানুষজনের কাছে নিজের বিশ্বাসের কথা প্রচার করেছেন। আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে, ভারতের মাটিতে এই মহান মানবপ্রেমিক ও ঐশী পুরুষ বসবাস করে গেছেন ও হিমালয়ের কোলে তিনি পেতেছিলেন তাঁর শেষ শয্যা।


তথ্যসুত্র :-

১। reluctant-messenger.com/issa.htm
২। Smithbrad.nventure.com/unknown JC.htm
৩। Jesus in Tibet : A modern Myth By Robert M. Price- The Fourth R, May-June,2001
৪। Tomb of Jesus.com
৫। en.wikiepedia.org
৬। যুগনায়ক বিবেকানন্দ / স্বামী গম্ভীরানন্দ, দ্বিতীয় খন্ড।

1 টি মন্তব্য:

  1. খুব ভালো লাগল। তথ্যসমৃদ্ধ সুলিখিত প্রবন্ধ। কিছু কথা জানা ছিল, কিছু নতুন কথা জানা গেল।

    উত্তরমুছুন