মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

০২ অলোকপর্ণা

সোনাকাঠি রূপোকাঠি
অলোকপর্ণা



(১)

কাজলের শরীরটা দুলছে। কোথাও হালকা গানও বাজছে বলে মনে হলো চন্দনের, “লগ যা গলে...”, কী গেয়েছেন লতাজী! চন্দনের বুক হু হু করে ওঠে। কিন্তু তার চোখের সামনে কাজলের শরীরটাই দুলছে। ভাঁজ ফেলে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডাঁয়। চন্দনের চোখের মণিতে কাজলের ছায়াও দুলছে। চন্দন, পা ফাঁক করে খাটের ওপর বসা। কাজলের দু’হাত ওর নিজের গা বেয়ে ওপরে উঠছে। দুটো সাপ যেন, বুকে ভর করে, ঘষে ঘষে কোমর থেকে পেট থেকে বুক থেকে মাথা বেয়ে আকাশে উঠে গেল, -- নেশায় চোখ বুজে আসে চন্দনের। কাজল টলতে টলতে চন্দনের কোলে উঠে এসে সাপটার মাথায় হাত রেখে তার কানে হিসহিসিয়ে বলে, “এই যে হাত রাখলাম, এবার সব অসুখ সেরে যাবে।”

চন্দনের ভয় করে, সাপটা এখনও পড়ে আছে মরার মতো। কোথায় ফোঁস করে উঠবে, তা নয়!

“সুখ আসবে,... সুখ আসবে, এইবার...”, সাপের মণিতে চুমু খায় কাজল।

তাও চন্দনের সাপ ফণা তোলে না। কাজল ভুরু কুঁচকে চন্দনের দিকে তাকায়, “ব্যাপার কী বল তো তোর?”

চন্দন ঘেমে যায়। কাজল আবার সাপের মণিতে চুমু খায়। সাপটা যেন হাজার হাজার বছরের শীতঘুমে আছে।

“শালা, ঢ্যামনা! দু’মাস পরে এলি!... তাও শালা...”

চন্দন কিছু বলার আগেই, কাজল নেমে গিয়ে জামা পরতে শুরু করে দেয়। ‘প্যায়ার কি বরসাত’এর মধ্যে দিয়ে যখন সে বেরিয়ে গেল, চন্দন তখনও দু’হাতে ঝাঁকিয়ে সাপটার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করে চলেছে।

(২)

তিনসপ্তাহ হলো সাপ একদম ঘুমিয়ে আছে, নিউজ পেপারের শেষ পাতায় ঘুম ভাঙানোর কিছু অব্যর্থ কৌশলে চোখ বোলাতে গিয়ে চন্দন হিসেব মিলিয়ে নেয়। আরও এক সপ্তাহ যদি সে ঘুমিয়ে থাকে, তবে ঘুমভাঙানি ওষুধ প্রয়োগ করতেই হবে তাকে; কাজলকে না হলে আর ধরে রাখা যাবে না। স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকছে, কেমন সাপের মতোই, ঘোর ভেঙে চন্দন সহযাত্রীকে নিউজপেপার ফেরত দেয়।

কুড়ি মিনিট লেট ট্রেনে দম আটকানো ভিড়। এক হাতে হাতল আঁকড়ে ধরে নিজের জীবনকে নিরাপত্তা দিয়ে চলে চন্দন। জেনারেল কামরার শক্ত কাঁধ, শুকনো কনুই আর নিস্পৃহ মুঠোগুলো কোণঠাসা করে ফেলেছে তাকে। নিজের সাপের মতোই চন্দন ফোঁস করে উঠতে পারছে না, মাথা থেকে পা ভিজে যাচ্ছে ঘামে। এমন সময় টের পায়, কে যেন সাপের মাথায় হাত রাখছে। চন্দন দ্রুত চারপাশে তাকায়, সবাই ব্যস্ত জীবনধারণে। পরক্ষণেই আবার কে যেন শান্ত হাত বুলিয়ে নিল সাপের মণিতে। চন্দন গুটিয়ে আসতে চায়, ভিড়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। পরের স্টেশন এলো, কিন্তু ভিড় সেই একই। ট্রেন চলতে শুরু করলে চন্দন বোঝে, এবার সেই হাত সাপের মুখ চেপে ধরছে। চন্দন বোঝে, সাপের জিভটা এইবার আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। সে টের পাচ্ছে সাপটা হিসহিসিয়ে মাথা তুলল,... সাপটা মাথা তুলছে! চন্দনের সারা গা ভিজে ওঠে আনন্দে, সাপটা জাগছে! পরের স্টেশনে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনে চন্দন, এক্ষুনি তার একটা স্নেক চার্মার প্রয়োজন, মানে কাজলকে, অথবা...

চন্দন ভিড় ট্রেনের দিকে ফিরে তাকায়, -- দেখে সেই ভিড়ে শীতঘুম শেষে ফেলে আসা চন্দনের খোলসটা যেন যুদ্ধ করে চলেছে তখনও। মুখে তার শীত শেষের হাসি লেগে। অজানা আকর্ষণে চন্দন নিজেকে ছুঁড়ে দেয় ট্রেনের ভিড়ে, নিজের খোলসের মধ্যে। চার্মারের হাতও সাথে সাথে সাপকে খুঁজে নেয়। সাপটা ফণা তুলে দাঁড়াতে, হাসি ফেরে চন্দনের মুখে, ভিড়ের ট্রেন স্নেক ও চার্মার সহ বুকে হেঁটে ঢুকে যায় শহরের গর্তের ভেতর।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন