‘বিহানের কথা’ শেষ হলে
............দূর পাগল, থাম না!
বিহানের কথা শুনতে শুনতে, বিহানের বেঁচে থাকা জানতে জানতে দহন এক সময়ে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ অতিক্রম করে। অধিকতর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তখন যেন বলে ফেলতেই হয়, দূর পাগল, থাম না!
পূর্ণচন্দ্রগ্রাস-এর রাত্রে বিহান সজোরে যে কথা ছুঁড়ে দিয়েছিল, আর্তস্বরে সে শব্দসমূহই পুনরায় উচ্চারণ করতে হয় আমাকে। তারপর ‘অপ্রাকৃতের স্মৃতি’ ম্লান হলে অথবা শৃঙ্খলার অনেক বাইরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ রকম বলা হলো কেন! এ কি পরিত্রাণের জন্য, এ কি অন্য রকম বেঁচে থাকাকে আবাহনের জন্য! জানতাম, ‘বিহানের গল্প’ যখন শুরু করেছিলাম, তখনই জানতাম, নতুন কোনো নিটোল সন্ধান এই ন’টা গল্পের কোথাও পাব না। ঐ যে এক সময়ে ভাবা হয়েছে, একটা ছোটগল্পে, আখ্যায়িকার ঘটনা পরম্পরায় ধারাবাহিকতা থাকবে, পাঠক চরিত্রগুলির হাড়মজ্জ্বার উষ্ণতা টের পাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিবিধ চরিত্রের আচরণের কার্যকারণও অনুভব করবেন; ‘বিহানের গল্প’-এ, পূর্ব কিছু অভিজ্ঞতার কারণে, আশা করি নি। সুতরাং, অপ্রাপ্তির সে অর্থে কোনো কারণ নেই। কিন্তু যা পেলাম, তা-ও কি প্রত্যাশিত ছিল! আমার সাধ, স্বপ্ন, আমার বেঁচে থাকা, আমার সত্য, আমার অসততা এ ভাবে, এমন অপূর্ব লিখিত থাকবে এ গ্রন্থে, এমন তো ভাবি নি। ফলে গল্পগুলির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার পর কেমন যেন পক্ষপাতিত্ব জন্মে যায়। এই জীবনটাকে বারবার ফেলে দিতে চেয়েও যেমন ফেলে দেওয়া যায় নি আজ-ও, এই তাবৎ বাক্যকে অস্বীকার করতে চাইলেও তেমনই পারি নি শেষ অবধি। পরিবর্তে বড় মমতায় তুলে নিতে হয়েছে খুব কাছে, বুকের কাছাকাছি। মনে মনে দাঁড়িয়েছি, অন্তত প্রয়াস করেছি দাঁড়াতে ঐ কলমের বোধের কাছে, মমতার কাছে, ভালোবাসার কাছে। দেখেছি তাঁর হাত ধরে “...ঘুমের মধ্যে তাদের কৃষ্ণ স্তনবৃন্ত থেকে পৃথিবীর বুকে চুঁইয়ে পড়ে ভোরের মতো দু চার ফোঁটা দুধ”। আর বিহানের হাত ধরে খুব নিঃশব্দে ছাতিম শিরিষ পলাশ হরিতকির অন্ধকারে, স্তব্ধতা আরও গূঢ় হলে বৃত্তের অন্ধকার তীরে দাঁড়িয়েছি বারবার।
আর এ ভাবেই গল্প জমে ওঠে। খুব কাছের এক জীবনের গল্প, যা অতি নৈকট্যের কারণে প্রায় অদৃশ্য, কেবল নিরন্তর ঢেউয়ে ভিজে যারা অবয়ব হয়, তাদের নিয়মিত সংসর্গে সে গল্প ক্রমে মূর্ত হয়ে ওঠে, ঐ কাচের ঘরের মতোন। ‘ভাঙা জানালার তীরে’ গল্পটা ভালো লাগল! বোধ হয়, এর সারা শরীর জুড়ে “রূপ গড়ে ওঠা আর ভেঙে যাওয়ার খেলা”-র অঙ্কন মুগ্ধ করেছে। বোধ করি, “শিশিরের জল আর সুরে হাতে হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নাচ” প্রতিটি শব্দে জড়িয়ে আছে, তাই।
দেখার প্রচলিত অভ্যাস থেকে অব্যাহতি চেয়ে এই যে ক্রমশ নবতর কৌণিক দৃষ্টির জন্য অভ্যাস, অপ্রয়োজনীয়বোধে বাহুল্য নির্মম ভাবে বর্জন করার প্রয়াস আমাকে অভিভূত করে। গল্প বলা আর তার বিনির্মাণ -এ দুইয়ে যে বিস্তর ফারাক, এমন ধারণা ক্রমে দৃঢ় হয়। নতুবা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় “মানুষের ভাষা জানলে এই শক্তিমানরাই বড় হয়ে সভায়, লেখায়, দীনদুঃখী ভাইবোনদের সমস্যা ও উত্তরণের কথা গুছিয়ে জানাতো”-এমন বলা সম্ভব হতো না। কবিতা ভালোবাসি। আসলে কবিতার যে বহুতর জানালা-কপাটের ভা্লোবাসা, তাকেই। এই ন’টা লেখাতেও তেমন। সব পৃষ্টা শেষে বারবার ফিরে আসি ‘বাসনার মতো ভালবাসা’-র কাছে। খন্ডকে পূর্ণতা ভেবে রানির নগ্ন হাতের মায়ায় চামচিকের মুক্তিকে বারবার দেখতে চাই।
১ থেকে শুরু করে ১-এ ফেরার কথা বিহানের মতো আমিও ভাবতে পারি নি। সে বড় সংকটের ভাবনা। তবু বিহানের সঙ্গে সঙ্গে আমার-ও মনে হয়, “শুরুর ঠিক পরবর্তী সংখ্যাটাই মানুষের চরম বিন্দু”। রাম কিংবা রামলখনের এমন না-ও মনে হতে পারে। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঐটাই স্বাভাবিক। যেহেতু “একটা অস্থির দিক্ভ্রান্ত রেখা”-র বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি অহরহ আমিও দেখে থাকি। এই ভাঙা রেলিংমুগ্ধ জীবনে দেখতে চাই “দু একটা সৌন্দর্জের ভাঁজ”, বলতে চাই একজনকে কখনো নিশ্চয়ই “কেন এত ভালোবাসা শেখাও”।
এ ভাবে, বিবিক্ত আমি পাতা থেকে অপর পাতায় যাই। সাবলীল নই, তবু এক বাধ্যতা। জীবনের খন্ড মুহূর্তের দিকে অথবা অভিজ্ঞতার বিচ্ছিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে নয়, যথার্থ প্রেক্ষিতে এই প্রাপ্তিকে বুঝতে চাইলে সমগ্রতায় ধ্যান রাখতেই হবে। এই সত্য না বোঝা আমার ভুল। আর সে অপরাধ থেকে, ভ্রান্তিজনিত ক্ষয় থেকে পরিত্রাণের তাগিদে যুদ্ধে ‘বিহানের কথা’ ক্রমশ খুব জরুরি অস্ত্র হয়ে উঠতে থাকে আমার কাছে।
............দূর পাগল, থাম না!
বিহানের কথা শুনতে শুনতে, বিহানের বেঁচে থাকা জানতে জানতে দহন এক সময়ে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ অতিক্রম করে। অধিকতর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তখন যেন বলে ফেলতেই হয়, দূর পাগল, থাম না!
পূর্ণচন্দ্রগ্রাস-এর রাত্রে বিহান সজোরে যে কথা ছুঁড়ে দিয়েছিল, আর্তস্বরে সে শব্দসমূহই পুনরায় উচ্চারণ করতে হয় আমাকে। তারপর ‘অপ্রাকৃতের স্মৃতি’ ম্লান হলে অথবা শৃঙ্খলার অনেক বাইরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ রকম বলা হলো কেন! এ কি পরিত্রাণের জন্য, এ কি অন্য রকম বেঁচে থাকাকে আবাহনের জন্য! জানতাম, ‘বিহানের গল্প’ যখন শুরু করেছিলাম, তখনই জানতাম, নতুন কোনো নিটোল সন্ধান এই ন’টা গল্পের কোথাও পাব না। ঐ যে এক সময়ে ভাবা হয়েছে, একটা ছোটগল্পে, আখ্যায়িকার ঘটনা পরম্পরায় ধারাবাহিকতা থাকবে, পাঠক চরিত্রগুলির হাড়মজ্জ্বার উষ্ণতা টের পাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিবিধ চরিত্রের আচরণের কার্যকারণও অনুভব করবেন; ‘বিহানের গল্প’-এ, পূর্ব কিছু অভিজ্ঞতার কারণে, আশা করি নি। সুতরাং, অপ্রাপ্তির সে অর্থে কোনো কারণ নেই। কিন্তু যা পেলাম, তা-ও কি প্রত্যাশিত ছিল! আমার সাধ, স্বপ্ন, আমার বেঁচে থাকা, আমার সত্য, আমার অসততা এ ভাবে, এমন অপূর্ব লিখিত থাকবে এ গ্রন্থে, এমন তো ভাবি নি। ফলে গল্পগুলির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার পর কেমন যেন পক্ষপাতিত্ব জন্মে যায়। এই জীবনটাকে বারবার ফেলে দিতে চেয়েও যেমন ফেলে দেওয়া যায় নি আজ-ও, এই তাবৎ বাক্যকে অস্বীকার করতে চাইলেও তেমনই পারি নি শেষ অবধি। পরিবর্তে বড় মমতায় তুলে নিতে হয়েছে খুব কাছে, বুকের কাছাকাছি। মনে মনে দাঁড়িয়েছি, অন্তত প্রয়াস করেছি দাঁড়াতে ঐ কলমের বোধের কাছে, মমতার কাছে, ভালোবাসার কাছে। দেখেছি তাঁর হাত ধরে “...ঘুমের মধ্যে তাদের কৃষ্ণ স্তনবৃন্ত থেকে পৃথিবীর বুকে চুঁইয়ে পড়ে ভোরের মতো দু চার ফোঁটা দুধ”। আর বিহানের হাত ধরে খুব নিঃশব্দে ছাতিম শিরিষ পলাশ হরিতকির অন্ধকারে, স্তব্ধতা আরও গূঢ় হলে বৃত্তের অন্ধকার তীরে দাঁড়িয়েছি বারবার।
আর এ ভাবেই গল্প জমে ওঠে। খুব কাছের এক জীবনের গল্প, যা অতি নৈকট্যের কারণে প্রায় অদৃশ্য, কেবল নিরন্তর ঢেউয়ে ভিজে যারা অবয়ব হয়, তাদের নিয়মিত সংসর্গে সে গল্প ক্রমে মূর্ত হয়ে ওঠে, ঐ কাচের ঘরের মতোন। ‘ভাঙা জানালার তীরে’ গল্পটা ভালো লাগল! বোধ হয়, এর সারা শরীর জুড়ে “রূপ গড়ে ওঠা আর ভেঙে যাওয়ার খেলা”-র অঙ্কন মুগ্ধ করেছে। বোধ করি, “শিশিরের জল আর সুরে হাতে হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নাচ” প্রতিটি শব্দে জড়িয়ে আছে, তাই।
দেখার প্রচলিত অভ্যাস থেকে অব্যাহতি চেয়ে এই যে ক্রমশ নবতর কৌণিক দৃষ্টির জন্য অভ্যাস, অপ্রয়োজনীয়বোধে বাহুল্য নির্মম ভাবে বর্জন করার প্রয়াস আমাকে অভিভূত করে। গল্প বলা আর তার বিনির্মাণ -এ দুইয়ে যে বিস্তর ফারাক, এমন ধারণা ক্রমে দৃঢ় হয়। নতুবা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় “মানুষের ভাষা জানলে এই শক্তিমানরাই বড় হয়ে সভায়, লেখায়, দীনদুঃখী ভাইবোনদের সমস্যা ও উত্তরণের কথা গুছিয়ে জানাতো”-এমন বলা সম্ভব হতো না। কবিতা ভালোবাসি। আসলে কবিতার যে বহুতর জানালা-কপাটের ভা্লোবাসা, তাকেই। এই ন’টা লেখাতেও তেমন। সব পৃষ্টা শেষে বারবার ফিরে আসি ‘বাসনার মতো ভালবাসা’-র কাছে। খন্ডকে পূর্ণতা ভেবে রানির নগ্ন হাতের মায়ায় চামচিকের মুক্তিকে বারবার দেখতে চাই।
১ থেকে শুরু করে ১-এ ফেরার কথা বিহানের মতো আমিও ভাবতে পারি নি। সে বড় সংকটের ভাবনা। তবু বিহানের সঙ্গে সঙ্গে আমার-ও মনে হয়, “শুরুর ঠিক পরবর্তী সংখ্যাটাই মানুষের চরম বিন্দু”। রাম কিংবা রামলখনের এমন না-ও মনে হতে পারে। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঐটাই স্বাভাবিক। যেহেতু “একটা অস্থির দিক্ভ্রান্ত রেখা”-র বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি অহরহ আমিও দেখে থাকি। এই ভাঙা রেলিংমুগ্ধ জীবনে দেখতে চাই “দু একটা সৌন্দর্জের ভাঁজ”, বলতে চাই একজনকে কখনো নিশ্চয়ই “কেন এত ভালোবাসা শেখাও”।
এ ভাবে, বিবিক্ত আমি পাতা থেকে অপর পাতায় যাই। সাবলীল নই, তবু এক বাধ্যতা। জীবনের খন্ড মুহূর্তের দিকে অথবা অভিজ্ঞতার বিচ্ছিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে নয়, যথার্থ প্রেক্ষিতে এই প্রাপ্তিকে বুঝতে চাইলে সমগ্রতায় ধ্যান রাখতেই হবে। এই সত্য না বোঝা আমার ভুল। আর সে অপরাধ থেকে, ভ্রান্তিজনিত ক্ষয় থেকে পরিত্রাণের তাগিদে যুদ্ধে ‘বিহানের কথা’ ক্রমশ খুব জরুরি অস্ত্র হয়ে উঠতে থাকে আমার কাছে।
সূত্র : বিহানের কথা (গল্প সংকলন)/ মধুময় পাল/ দীপ প্রকাশন /প্রকাশকাল : ২০০৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন