মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

কালিমাটি অনলাইন / ০৯

সম্পাদকীয়



এমন একটা সময়ে ‘কালিমাটি অনলাইন’এর সম্পাদকীয় লিখতে বসেছি, যখন পৃথিবীর সব ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এক অভূতপূর্ব লগ্ন এসে উপস্থিত হয়েছে। একদিকে তাঁরা তাঁদের প্রিয় ক্রিকেটব্যক্তিত্বের মাঠ থেকে অবসর গ্রহণের বিরল দৃশ্য দেখে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন, অন্যদিকে তাঁরা আশ্চর্যভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন সেই মহান ক্রিকেটারের গত চব্বিশ বছরের অনন্য লড়াইয়ের কথা স্মরণ করে। শচীন রমেশ তেন্ডুলকার, সতি সত্যিই সেই সব অসামান্য মানুষদের মধ্যে একজন, যাঁরা জীবন পণ করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস রচনা করে যান এবং নিজেরাও হয়ে যান এমন এক একজন ঐতিহাসিক আলোকসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, যাঁদের আলোয় আলোকিত হয় পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা ‘কালিমাটি অনলাইন’এর সদস্যরা, এই বিরল প্রতিভাবান ক্রিকেটশিল্পীকে জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং অভিবাদন। শচীন রমেশ তেন্ডুলকার, তোমাকে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা এবং সেলাম।

‘কালিমাটি অনলাইন’এর পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আমাদের একটি নিবেদন আছে। প্রসঙ্গটি ছবি সম্পর্কিত। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এর আগে যখন ‘কবিতার কালিমাটি’ ও ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ স্বতন্ত্র ভাবে প্রকাশিত হতো, তখন কয়েকটি কবিতা ও কয়েকটি ঝুরোগল্পের পর শিল্পীদের অঙ্কনচিত্র ও আলোকচিত্র প্রকাশ করা হতো। পাঠক-পাঠিকারা তখন সেইসব ছবিগুলি সম্পর্কে তাঁদের ভালো লাগা বা নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করতেন। এবং সেইসব অভিমত পড়ে আমরা নিশ্চিত হতাম, ছবিগুলি তাঁদের কাছে কতটা আদৃত হচ্ছে। কিন্তু ‘কালিমাটি অনলাইন’এ ছবির জন্য আলাদা বিভাগ ‘ছবিঘর’ আছে। অথচ সেইসব ছবি সম্পর্কে খুব কম অভিমতই পাওয়া যায়। পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, আপনারা যেভাবে প্রকাশিত লেখাগুলি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত জানিয়ে থাকেন, সেভাবেই প্রকাশিত প্রতিটি ছবি সম্পর্কেও অভিমত জানান। বলা বাহুল্য, আমরা যে ছবিগুলি প্রকাশ করি, সেই ছবিগুলিতে অন্তর্লীন হয়ে থাকে কোনো কবিতা বা গল্প, অথবা কোনো কবিতা বা গল্পের অনুষঙ্গ ও উপাদান। আর তাই পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ‘ছবিঘর’এ প্রকাশিত ছবিগুলির প্রতি আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

প্রসঙ্গত ‘কালিমাটি অনলাইন’এর আর একটি বিভাগ ‘অণুরঙ্গ’ সম্পর্কেও আপনাদের কাছে একটি নিবেদন আছে। আপনারা অবহিত আছেন যে, এই বিভাগে অণুরঙ্গ অর্থাৎ অণু বা ছোট নাটক প্রকাশ করা হয়। সেইসঙ্গে এটাও আপনারা জানেন যে, সাহিত্য ক্ষেত্রে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, প্রাবন্ধিক অনেকে আছেন, কিন্তু নাটকলেখক বা নাট্যকার সেই তুলনায় খুবই কম। বিশেষত এইসব নাট্যকারদের সন্ধান আমাদের ঠিকঠাক জানাও থাকে না। আর তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনাদের মধ্যে যাঁরা নাটক রচনা করেন, তাঁরা আমাদের সঙ্গে অনুগ্রহ করে যোগাযোগ করুন। আমরা আশা করি, আপনাদের সহযোগিতায় ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগটি আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।

এছাড়াও আপনাদের জানাই, আপনারা কবিতা, ঝুরোগল্প, কথনবিশ্ব’র জন্য প্রবন্ধ বা নিবন্ধ ইত্যাদি যে লেখাই পাঠাবেন, অনুগ্রহ করে বাংলা ‘অভ্র’ ফন্টের ‘বৃন্দা’তে কম্পোজ করে পাঠাবেন। অন্য কোনো বাংলা ফন্টে কম্পোজ করে পাঠালে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হব।



আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : kalimationline100@gmail.com / kajalsen1952@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :
0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India


০১ অমিতাভ প্রহরাজ

কিছু ভার্ষাস, একটা ক্রনিকল-



ঈশোপোনিষদ-এর বিগিনিং, বলা যায় একরকম উপনিষদেরই বিগিনিং


ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্নাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায়ঃ পূর্ণমেবাবশিষ্যতে
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

অদঃ অর্থাৎ সে, পূর্ণম মানে সর্বব্যাপী, ইদম্‌ অর্থাৎ এই ও পূর্ণম বা অনন্ত, সর্বব্যাপী। এই পূর্ণ থেকে আবার পূর্ণ উদচ্যতে মানে প্রকাশিত হয়েছেন। আবার পূর্ণস্য পূর্ণমাদায়ঃ মানে পূর্ণ থেকে পূর্ণ আদায় অর্থাৎ সরিয়ে দিলে পূর্ণই অবশিষ্যতে অর্থাৎ অবশিষ্ট থাকে।

এবার দ্বৈতবাদী ও অদ্বৈতবাদী দুজনেই করেছেন কি, প্রথম 'সেই'টিকে পরমব্রহ্ম আর দ্বিতীয় 'এই'টিকে জগৎব্রহ্ম ধরে নিয়ে, হাতে গণ্ডা গণ্ডা 'পূর্ণ' পেয়েছেন আর মনের সুখের 'অসীম', 'অনন্ত', 'অবাধ', 'অগাধ', জাতীয় 'অ'এর মোচ্ছব লাগিয়ে দিয়েছেন। আর তারপর যে যার রাস্তায় ঢুকে গেছেন। একদল পরমব্রহ্ম, জগৎব্রহ্ম হাতে নিয়ে "দুই পেয়েছি, দুই পেয়েছি" বলে চিল্লিয়েছেন। আর আরেকদল জগৎকে ব্রহ্মার একটি দৃশ্যমান জামা মাত্র, পরানো আছে, বলে "কে জিতেছে? এক জিতেছে আবার কে?" চিল্লিয়েছেন। (সাধে বলি উপনিষদের থেকে খচড়া বই দুনিয়ায় দুটো নেই)

দুটির কোনো পথেই না গিয়ে কাছাকাছি একটি ল্যাম্পপোস্টে চড়ে যদি উপর থেকে দেখি। ধরেনি এটি কোনো বিষয় বা জ্ঞানেরই মুখড়া। ধরে নিন আপনি বাঁটুলের লাথি খেয়ে সটান জারোয়াদের মধ্যে পড়লেন। আপনি জারোয়া সম্পর্কে কিছুই জানেন না, এমন কি শব্দটিও না। এবার সেই জারোয়াজগত শিখতে গেলে আপনাকে দুটি পয়েন্ট ক্রিয়েট করতেই হবে। একটা ‘এই’ অর্থাৎ জারোয়া, আর একটা ‘সেই’ অর্থাৎ বাঙালি। তবেই আপনার বিষয় শুরু হবে, "সেই বাঙালিরা যে রকম হাত তুলে হরেকৃষ্ণ নাচে, এরা না শুয়োর মারলে শুয়োরকে ঘিরে একইরকম নাচে", সিগনিফায়ার আর সিগনিফায়েড মনে পড়ে? আর বেশি না হেজিয়ে সোজাসুজি বলি, এটি একটি এ্যাপ্রোচ। এবং এই এ্যাপ্রোচটির সঠিক শিক্ষা থাকলে বিভিন্ন বিষয় বা গন্তব্য বিশেষ ব্যাপার নয়।

(অনেকটা এরকম জায়গা থেকেই আমি ‘ব্যাপার’এর কনসেপ্ট আনি। ‘সেইব্যাপার’ আর ‘এইব্যাপার’এর বদলে করি ‘ব্যাপার’ আর ‘অন্যব্যাপার’, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, মুক্তগদ্য, ছবিওয়ালা লেখা, লেখাওয়ালা ছবি, এইসব ক্লাসিফিকেশনগুলি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এদের দিকে এ্যাপ্রোচটা খুঁজে বের করা। যে এ্যাপ্রোচ অতীত থেকে চলে আসছে, তা হলো ‘সেইব্যাপার’, আমাকে খুঁজতে হবে আরেকটা এ্যাপ্রোচ, ‘এইব্যাপার’ যা আমার সাধের কলমি ফুলে ‘অন্যব্যাপার’ নাম নিয়ে কলম দোলায়। প্রসঙ্গতঃ ‘এই’ মানে জানা আছে কি? ধ্বনিভিত্তিক বিশ্লেষণে পাই 'এ'+'ই', 'এ'- থাকে/রাখ/করে/ যাহাতে অথবা ক্রিয়ার আধার। 'ই'- ঈশ্বর বা অনন্ত আনন্দের অংশ, খেয়াল করে দেখবেন 'ই' বলার সময় আমাদের মুখের আকৃতি হাসিকবলিত হয়ে ওঠে, হি হি হি মনে করলেই হলো। মোদ্দা কথা দুয়ে মিলে যেটা পাই তা হলো এমন একটি ক্রিয়া/কার্য যা অনন্ত আনন্দ বা ঈশ্বরের আধার। এবারে এই ধ্বনিভিত্তিক ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণের ম্যাজিক ফুটে উঠবে যখন আপনি জানবেন 'এই' এর তৎসম 'ইদম' এর শঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ব্যখ্যা -- কার্যরূপে ব্রহ্ম বা ব্রহ্ম যেখানে দৃশ্যমান জগত হয়ে প্রতিফলিত (অদ্বৈত করতে গেলে এই ক্রিয়াটির জুড়ি নেই, প্রতিফলনও), এবার আসুন 'সেই'তে অর্থাৎ সহিত 'এই', কার সহিত? কিসের সহিত, কেন সহিত? এইটিই তো অনন্ত জিজ্ঞাসা যা দৃশ্যমান জগতে প্রকাশের অযোগ্য বা আরো ছুঁচলো করে বলা যায় প্রকাশযোগ্যতা নেই। যাকে পারসিভ করা ছাড়া গতি নেই। এইটিই সেই খোঁজ। পরম ব্রহ্ম বলো, বম ভোল বলো কি র‍্যাম্বো বলো। আটকাচ্ছে কে? হতেও তো পারে ব্রহ্ম একটি র‍্যাম্বো। তখন সিনেমাটিতে থাকবে যে কোনো একটি থ্রি-এক্স-এর অন্তিমতম দৃশ্য থেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক মোডে ঢুকে যাওয়া। তারপর দেখা যাবে র‍্যাম্বোর বাবার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি স্পার্ম দৌড়চ্ছে আর শুধুমাত্র মেডেল পরে দাঁড়িয়ে আছে র‍্যাম্বোর মায়ের ডিম্বাণু। দৌড়চ্ছে দৌড়চ্ছে এবং দৌড়চ্ছে দিয়ে সিনেমা শেষ। র‍্যাম্বো ফার্স্ট ব্লাড পার্ট জিরো। শালা ব্ল্যাকে টিকিট কেটে বিস্তর মারামারি করে, স্ট্যালোনের পোস্টারে চুমু খেয়ে, এই সিনেমাটা দেখলে যা লাগবে না!!! ব্রহ্মোপলব্ধি আর কাকে বলে??!!! আরে সহমরণ বলো, পাগড়ি দেখবো। সহবাস বলো, স্ট্রবেরি-ভ্যানিলা দেখবো। সহচর বলো, শুয়োরের বাচ্চা দেখবো। কিন্তু সহ এই, একি বিটকেল ব্যাপার, দেখা যায় নাকি?? একটা অসমাপ্ত এক্সপ্রেসান যার অনন্ত সম্ভাবনা। এবার ‘সেই’এর তৎসম ‘অদ’-এর প্রতীকী অর্থ অমরকোষ অনুযায়ী বা শঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ব্যখ্যা "যাহা বাক্য ও মনের অতীত, অবাঙমানসগোচর", মাঝে মাঝে মনে হয় হরিচরণবাবু একটু প্রথম প্রথম চলে আসতেন যদি তবে বাচ্চা ছেলেটাকে শাস্ত্রবিদ্যের জাহাজ হয়ে উঠতে আর দেশজুড়ে তক্কো করে করে ঝগড়াঝাটি করে করে নিজের টিন এজটা হারাতে হতো না। এই যে হাঁটা শেখাটাই আসল। সোজাসুজি হাঁটলে বাড়ির দরজা থেকে পুকুরের পাড় অবধি হাঁটা যাবে, তারপর আর যাবে না, এইটে জানার জন্য কেউ হাঁটা শেখে না। একেই বলে ব্যাপার)



যাকগে প্রসঙ্গ থেকে তো প্রশান্ত মহাসাগরে চলে এসেছি, শুধু অন্তর নিতে নিতে। হ্যাঁ, ২০১৩ সালে আলোচনা এমনই হওয়া উচিত। আলোচনা যখন প্রথা বা প্রচলকে উগ্রপন্থীর মতো আক্রমণ করে, ব্লটিং পেপারের রেনকোট বানিয়ে নামিয়ে দেয় টু-মাচ-শ্রাবণে, বা এস্কিমোকে বিক্রি করতে যায় রেফ্রিজারেটর, তখন আলোচকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছে ফেলার ননস্টপ, আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় (যদিও তা থেকেই যায়, কিন্তু ক্রাইম এথিকস বলে তো একটা ব্যাপার আছে!!)এই মুছে ফেলার চেষ্টায় বার বার অন্তর নিতে নিতে। যখন সকলেই চোখের সামনে মহা পাখির মহা চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না (কোন ব্যাপার?? হাই মেগাপিক্সেল চোখ পারফেক্ট মহাজুম করলেই হলো।),
মায় তালকানা যুধিষ্ঠিরকেও জিজ্ঞেস করলে

দ্রোণ- "কি দেখছো?"

যুধিষ্ঠির- "আজ্ঞে, দেখিতেছি এক নয়নমণি ভুবনজোড়া"
এই অবস্থায় বাইরে কতরকম জিনিসকে তীর মারলে, সেই ডাইভার্সিটি কাউন্ট হবে।

দ্রোণ- "অর্জুন??"
অর্জুন- "আজ্ঞে, মগডালে মেরেছি, সাইডের ডালে মেরেছি, দাঁড়কাকটাকে মেরেছি, তিনটে গুঁড়িতে মেরেছি, পাঁচুর মা’কে মেরেছি, ভুবন ঘোষের জেঠুর বগলে মেরেছি, রেলিং-এ মেরেছি, আর একটা স্যার, আপনি যেমন বলেছিলেন তেমন করে প্যারাবোলাতে বুমেরাং করে নিজেকে মেরেছি।।"
দ্রোণ- "গ্রেট বেটা, দ্যাটস এ ওয়ান্ডারফুল ডিসকোর্স"

ভীম তৎক্ষণাৎ নকুলকে বললে "(ফিসফিস করে) দেখলি নক্‌লে, বুড়ো বেটা কি বললে, ডিসকোর্স না ফিসকোর্স... এ নির্ঘাত সুপুত্তুর অর্জুনটার পাকামি, বুড়ো কোর্সের বাইরের কোনো সাবজেক্ট পড়াচ্ছে। দাঁড়া, বুড়োটাকে স্ট্রেটকাট জিজ্ঞেস করি। (বিকট চিল্লিয়ে) স্যার, ওই ডিসকোর্স থেকে কি কোশ্চেন আসবে কুরুক্ষেত্রে?"

দ্রোণ- "(চমকিয়ে) ওফ্‌!! টোল্ড ইউ সো মেনি টাইমস মিস্টার ভীমসেন যে, ওরকম দুমদাম গরিলার মতো চেঁচিয়ো না... জেনে রাখবে আমরা প্রাচ্য, পাশ্চাত্য নই... প্রাচ্য ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় কথা বলে আর পাশ্চাত্য লোগোসেন্ট্রিক..."

ভীম- "(জনান্তিকে) এই রে আবার সেই ফাটা রেকর্ড চালিয়েছে... (জোরে) জানি স্যার, হরিবাবু ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে বলেছেন, বারীনবাবু কবিতার ক্লাসে বলেছেন, কলিমবাবু ডিকশনারি ক্লাসে বলেছেন, আর ওই নতুন ছোকরা, চশমা চোখে সিগারেট খায়, ও তো কথায় কথায় বলে এ জিনিস... সেদিন বললেম, দ্যাখো ভাই তুমিও একটা অখাদ্য জিনিস খাও, পেট ভরে না। আমিও একটা অখাদ্য জিনিস খাই, পেট ভরে না। কিন্তু তোমার খেয়ে খুব আনন্দ হয় আর আমার খেয়ে খুব দুঃখ। তুমি সিগারেট খাও, মেজাজ আসে, আনন্দ হয়। আমি গদা খাই, খুব লাগে, দুঃখ হয়। তাহলে পাটিগণিতের নিয়মে সিগারেট ইকোয়াল টু আনন্দ আর গদা ইকোয়াল টু দুঃখ। তাহলে ধরো তুমি যদি আমার হাতে গদা খাও আর আমি যদি তোমার সিগারেট খাই, তবে কি তোমার আনন্দ আর দুঃখ কাটাকুটি হয়ে যাবে আর আমার দুঃখ আর আনন্দ কাটাকুটি হয়ে যাবে? আমরা কি শান্তিঃ হয়ে যাবো? এ শুনেই তো ছোকরার কি হাসি... বলে বললে, ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা বলেই ওই কাটাকুটিটা হবে না, বলে কিনা 'খায়' ক্রিয়াপদ নাকি দেবতার বাবা, ৩৪টি অবতার আছে তার... ওই ভার্বসেন্ট্রিক আর লোগোসেন্ট্রিক শুনতে শুনতে কানে পচা গোবর হয়ে গেল... ওটা জানি"

দ্রোণ- "না জানো না পুরোটা... বিষয়টা শুধুমাত্র ক্রিয়া আর প্রতীক দিয়ে নয়। কগনিটিভ সায়েন্সের চোখ দিয়ে দেখলে কথা বলার সময় একটা প্রেশার ওয়েভ পড়ে মধ্যবর্তী স্পেসটিতে... ফলে একটি তরঙ্গ তৈরি হয় যা মধ্যবর্তী কণিকাগুলিকে দুলিয়ে দেয়, যে দোলন কানে এসে ধাক্কা মারে বা বলা যায় মাথায় ধাক্কা মারে... এবার ক্রিয়াভিত্তিক বলে প্রাচ্যের ভাষা তরঙ্গপ্রধান আর লোগোসেন্ট্রিক বলে পাশ্চাত্যের ভাষা, কণিকা প্রধান... এবার তরঙ্গপ্রধান যে ভাষা সেই ভাষা ফ্রিকোয়েন্সি নির্ভর হবে আর কণিকাপ্রধান যে ভাষা সেই ভাষা ওয়েভ লেন্থ নির্ভর... এবার তুমি ওই যে বিকট চিল্লালে, উচ্চগ্রামে, এর তরঙ্গের অভিঘাত সরাসরি মস্তিষ্কে আঘাত করবে..."

ভীমসেন- (বেজায় অবাক হয়ে) ভাষায় তরঙ্গ আর কণিকা!!!
দ্রোণ- কণিকাপ্রধান ভাষায় বললে সাবজেক্টিভিটি আর অবজেক্টিভিটি
ভীমসেন- আরে দূর মশাই, কুরুক্ষেত্রে কোন সাবজেক্টে কোন পেপারে থাকবে এই ভিরিকিটি?
শোনা মাত্রই আমার মাথায় মিগ-২১ এর মতো ভেঙে পড়লো, আরে কোথায় ছিলাম যেন?? ঠিক সেই দিনটির মতো যেদিন আমি চার বস্তা বই আর এক ট্রলিব্যাগ জামাকাপড়, একটা ল্যাপটপ, একটা ল্যাপটপ কুলার নিয়ে সক্কালবেলা তন্ময়ের সাথে বেরিয়ে গেলাম। (এখন তুমি যদি ইজমিক রাইটিং পাঠে অভ্যস্ত না হয়ে থাকো তাহলে হয় তন্ময়ের পদবী খুঁজবে নয়তো তন্ময়ের চশমার কেমন গন্ধ, এবং সেখানেই হড়কাতে বাধ্য তুমি হে পাঠক। নতুন পথঘাট, একটু চিনিয়ে দি হাত ধরে, শুধু ময় নিয়ে তুমি চলো তুমি পাঠক। জাস্ট একটা ময়। আমার একটি নতুন ময় হয়েছে ধরো), দিয়ে সারাদিন কুদঘাট থেকে ঢাকুরিয়া থেকে বেলঘরিয়া। নেহাৎ আমার সেভেন ফিফ্‌টির পাণ্ডুলিপির সাথে প্রিয় ছাদ-সিরিজটিও হারিয়ে গেছে, নইলে তার জন্য এ্যাত হ্যাঙ্গাম পোয়াতে হয়! রাত্রি দশটায়, ৪ ভবনাথ সেন স্ট্রীটে দোতলায়, মেট্রোর কম্পার্টমেন্টকে মাঝামাঝি চিরে দিলে যেমন হয়, তেমনি সরু একফালি শসার মতো ঘর, তার মাঝে আরো সরু শসার মতো রাখা দুটি তক্তাপোষ পরপর... তার ওপর নুন মরিচের গুঁড়োর মতো ছড়িয়ে আমি, আমার বই, আমার নানারকম ময়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘটে গেছি একটি নূতন স্পেসের মধ্যে, আর আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না পাঁচ অক্ষরের শব্দটি কি যেন?? কি যেন?? যেখানে আমি ছিলাম এই আজ শুরুর আগে... হঠাৎ!! ঘটনাচক্রে!!!!! মনে পড়ে গেল কোথায় ছিলাম; ঘটনাচক্রে!!!!!!



খুব গুরুগম্ভীর এইসব বলার পর মনে হতেই পারে গুরুগিরি চালাচ্ছে... তাই শেষাবতারে নিজের খোলস নিজেই ছাড়াতে বাধ্য হলাম...

কালী ক্রনিকলস-

কিছু বিতে হয়ে যাওয়া কালের ছবি, অফিস ছবি, আজের ছবি, কালের ছবি......... ছোটবেলায় কত কী মজার ধারণা থাকে, কিছু অন্যের দুষ্টুমিতে তৈরি হয়, তো কিছু নিজের দুষ্টু বোকামিতে... যেমন যার কাছ থেকে প্রথম ‘মারকাটারি’ শব্দটা শুনি, সেই অজানা ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছিলেন শব্দটা হচ্ছে "মারকাটারি মর জানা/ ও ইয়ার জানে জানা"... এই এতবড় শব্দটিকে তো বলা যায় না, তাই ছোট করে ‘মারকাটারি’ বলতে হয়... উনি বলেছিলেন, না স্বরচিত‌, জানি না, এখন ঝাপসা হয়ে গেছে উৎস, কিন্তু মোদ্দা ব্যাপার বহু বড় বয়স অবধি আমি বিশ্বাস করতাম সঠিকভাবে ‘মারকাটারি’ বলতে গেলে "মারকাটারি মর জানা/ ও ইয়ার জানে জানা" বলতে হবে... একইরকম জানতাম যে, পুরো শব্দটা হলো "জয় মা কালী/পাঁঠাবলি"... এখনো প্রথম অংশ উচ্চারণ করতে গেলে মনে মনে বলিপ্রদত্ত ছাগশিশু আপনা থেকে চলে আসে... না না, আমি এমন কোনো উৎকট রকমের কালীভক্ত নই যে, আজ মনে মনে জয় মা কালী বলেছি...


(বস্তুত্ব বলতে গেলে আমি ঘোরতর নাস্তিক... আগে আক্রমণাত্মক নাস্তিক ছিলাম, ছোটবেলা থেকেই আমার হিরো ডিরোজিও... একটু বড় হতে আব্রাহাম কোভুর... আহা, ডিরোজিও!! এখন আর আসে না, কিন্তু সেই সময়ে স্কুলের বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ডিরোজিও ভক্ত ছিলাম... আর সেই আমরা যখন প্রথম উৎপল দত্তের ‘ঝড়’ দেখলাম, রাধাকান্ত দেব -- উৎপল দত্ত, উজ্জ্বল সেনগুপ্ত বললে বুঝবে না আজকের পোলাপান্‌, যীশুর বাবা -- ডিরোজিও, দক্ষিণারঞ্জনের ভূমিকায় অকালপ্রয়াত স্বরূপ... স্বরূপই তো নাম, না? সর্বোত্তম ভিলেনির স্বাক্ষর ‘বাঘবন্দি খেলা’য় যিনি উত্তমকুমারের ছেলে হয়েছিলেন? কোথেকে কোথায় যাচ্ছি!! তা যাই, মাঝরাত্রে এমন একটি আমোদ হলো যে মজলিশি মেজাজের হানা অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল... যাকগে, ডিরোজিও প্রসঙ্গ শেষ করি... তা সেই প্রথমবার ‘ঝড়’ দেখার ফীলিংস একজন কট্টর ইয়ং বেঙ্গলের কাছে যে কি, তা বলে বোঝাবার নয়!!! ভেতরে এমন টগবগের জোর আর জোশ যে, বাইরে থেকে শুনলে পাঁচটা ম্যামথ কথাকলি শিখছে মনে হবে... ‘ঝড়’ আর দ্বিতীয়বার দেখিনি, ওই ফীলিংস নষ্ট হয়ে যাবে ওই ভয়ে... উৎপল দত্ত সিনেমাটিতে একটা যাত্রা এফেক্ট এনেছিলেন, বস্তুত ‘ঝড়’ যাত্রাপালা রূপেই এনেছিলেন উনি প্রথমে, প্রণম্য মানুষ... এখন সেই যাত্রা এফেক্ট চোখে লাগবে জানি... তাই আর দেখিনি... আর আমার প্রিয়তম সিনেমার লিস্টে ‘ঝড়’ পার্মানেন্টলি থেকে গেছে কোনো সিনেমাটিক কারণে নয়, আমার হীরোকে জ্বলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখার সুযোগ করে দিয়ে... তাও এমন সময়ে যখন আমার হীরো বিপন্ন...
বিপন্ন মানে, কীভাবে যে এই সাহেব আমার জীবনে ঢুকেছিলেন মনে নেই, সম্ভবতঃ একটি বই যাতে ওনার কবিতাগুলি, কিছু ক্লাস আর জীবনী ছিল, এর জন্য দায়ী... সিলেবাসের বহু আগে জেনে গেছিলাম ইয়ং বেঙ্গলের কথা... ওই সমাজ নিয়ে খিল্লি আমার চুম্বক হয়েছিল... নেহাত দুর্গাপুরে দুমদাম বীফ পাওয়া যায় না তাই, না হলে ক্লাস সিক্সেই অনাসৃষ্টি বাধিয়ে ছাড়তাম... এমন কী কীভাবে খেয়ে হাড়গুলো কোন্‌ কোন্‌ কাকু আর জেঠুদের বাড়িতে ছুঁড়বো, তাও ঠিক করা ছিল... বাক্যটিকে একই রেখে দেব ঠিক করেছিলাম ১৮২৩ সালে যেটা ছিল, "ওই দেখ গোহাড়! গোহাড়!!"... প্রচণ্ড দুঃখ হতো আমার হিরোর জীবনটি মাত্র ২২ বছরের বলে... সেই থেকে যুক্তিবাদ ও প্রশ্নের প্রতি অর্গাজমিক আকর্ষণ, তার থেকে আর মুক্তি মিললো না... গায়ে কাঁটা দিত/দেয় যখন চোখের সামনে দেখতে পেতাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ক্লাসে বলছেন "সবকিছুকে প্রশ্ন করবে... সবকিছুকে..." গর্জে উঠছেন "...এমন কি আমাকেও... ভাববে আমিও ভুল হতে পারি... জেনে রাখবে প্রশ্নের ওপরে কেউ নেই, কিছু নেই"... মুশকিলটা হয়েছিল যে আমার হীরো, যে রাধাকান্ত দেবের মুখের ওপর পদত্যাগ পত্র দিয়ে আসে, বলে আসে "আমি হিন্দু কলেজে না থাকলেও আমার ক্লাস থাকবে না, ভাবছেন কী করে??" সে দুরন্ত দেখতে, দুর্দ্ধর্ষ গাম্ভীর্য তাঁর, তাঁর ব্যক্তিত্ব অসামান্য, না হলে এতগুলো দামড়া ছেলেকে ঘরছাড়া করা যায়?? এদিকে ডিরোজিওর ওপর যা কিছু জিনিসপত্র আমার কাছে আছে তাকে সামান্য মনে হচ্ছে... আরো জানার ইচ্ছে, স্কুলের হিসট্রি টিচার এ বিষয়ে বিশেষ সাহায্য করতে পারলেন না... তখন কলকাতায় এসেছি একবার, দুবার... ঠিক কলকাতা নয়, কাকুর বাড়ি, উত্তরপাড়া... ওটাই কলকাতা আমাদের কাছে... উত্তরপাড়ায় একটা জাঁদরেল লাইব্রেরি আছে রাজার বানানো... যদিও ভদ্রলোক মানে রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় আমার কাছে ভিলেন... কারণ একটাই, স্বামীজীকে চিঠি লিখেছিলেন, সাহায্য করেছিলেন!!! তখন যুক্তিবাদের সাথে এ্যাটাচড ফাউ হয়ে যে গোঁড়ামি আসে তাকে ছাড়িয়ে ফেলে গ্রহণ করার মানসিক ক্ষমতা জন্মায়নি... আধ্যাত্মিক আ হয়েছে কি হয়নি, রে রে রে রে করে তেড়ে যাওয়াটাই ধর্ম... অগ্রাহ্য করার শক্তি যে বিরোধিতা করার শক্তির চেয়ে অনেক বেশি, বহু পরে বুঝেছি... ফ্রুটলেস তর্ক আমাদের জীবনের মস্ত এক খাবলা তুলে নিয়ে যায় যদি না সাবধান হওয়া যায়... যাকগে, রাজা না হয় কংগ্রেসকে অবজ্ঞা করেছিলেন, দেশীয় রাজ প্রথার সমর্থক ছিলেন, সব বাদ দিলেও যে লাইব্রেরীটি রেখে গেছেন তার জন্যই সকাল বিকেল প্রণাম জানাতে কোনো দ্বিধা নেই... তো সেই উত্তরপাড়া, আমার প্রিয়তম ও চষে ফেলা শহরগুলির মধ্যে একটা... কাকার নিজেরই দর্শন ও সাহিত্যের, বিশেষতঃ বামপন্থী দর্শন ও সাহিত্যের লাইব্রেরীসম কালেকশান... কাকিমা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, থিসিস পেপার মনুসংহিতার ওপর... কাকিমার সাথে চলে যাই ইউনিভার্সিটি, সংস্কৃত ডিপার্টমেন্টে ক্লাসে টুক করে বসেও যাই (ওসব আরেকটু পরে)... তা এইরকম সোনায় সোহাগা কম্বিনেশান আমার হীরোকে বিপন্ন করে ফেলবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি... লাইব্রেরী থেকে পেলাম ‘রামতনু......’, ‘জ্ঞানপ্রকাশ’, রসিককৃষ্ণ মল্লিকের সম্পাদিত ‘ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট- বেঙ্গলি কালচারাল রেনেসাঁ’... ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সুফল ও কুফল’... বাড়ির দৌলতে গবেষণার দু একটা জিন উপহার পেয়েছিলাম... আমাদের পরিবারে বাবাকে নিয়ে, কাকুদেরকে, কাকিমাদেরকে নিয়ে সর্বমোট ৫ জন গবেষক... বাবার মামা বিষ্ণুপদ পন্ডা বাংলা ও ওড়িয়া সাহিত্যের রীতিমতো নামকরা গবেষক... পরবর্তীকালে ভুবনচন্দ্রের চৈতন্যমঙ্গল, একটি সম্পূর্ণ নতুন চৈতন্যমঙ্গল আবিষ্কার করেন, তাঁর প্রথম গবেষণা পেপার বিহারীলালের ওপর... যাকগে ওই বইগুলি পড়তে পড়তে আমার হীরোর মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো ড্রোজু সাহেব, যে অমিতব্যয়ী এবং অত্যন্ত হাস্যকর দেখতে... পাঁচ ফুটেরও কম তার উচ্চতা, তা ঢাকার জন্য উঁচু জুতো ও লম্বা টুপি পরতেন... টকটকে লাল ব্রিচেস পরে বিকেলবেলা ড্রোজু সাহেব যখন ঘোড়ায় চড়ে বেরোতেন, তখন "তা দেখিয়া হাস্য সম্বরণ করা দায় হইত, বিশাল আরবি ঘোড়ার ওপর খর্বকায় লাল পোশাকের ড্রোজু সাহেবকে দেখা খুবই আমোদের ব্যাপার ছিল নগরবাসীর কাছে"... পড়ানোর সময় ভয়ঙ্কর লাফ ঝাঁপ ও অঙ্গভঙ্গি করতেন যা এক কৌতুকের জন্ম দিত"......... আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে পড়তে পড়তে... জানছি দক্ষিণারঞ্জনের সাথে তাঁর বোনের প্রণয়কাহিনী... জানছি তাঁর মৃত্যুর পর মিছিল বেরিয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত, ঢাক ঢোল নিয়ে, "ড্রোজুর ব্যাটা মরেছে" গান করে... এইরকম সময় দেখলাম ‘ঝড়’... উৎপল দত্তকে ধন্যবাদ, উনি বাস্তবানুগ না হয়ে ডিরোজিওকে নায়কের মতোই দেখিয়েছিলেন... আমার সেই যন্ত্রণা খানিকটা ঠাণ্ডা করে দিয়ে গেল ‘ঝড়’... পরে পুরনো কলকাতার, অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতা ও ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা নিয়ে যখন রিসার্চে মেতে আছি, কেন এই কলকাতা কেন্দ্রিকতা বাংলায় তার রহস্য ভেদ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষায়, তখন আমার হীরো সম্বন্ধে আরো অপ্রিয় সত্য কিছু উদ্ধার করি, যেগুলি অজানা... দেনায় আকণ্ঠ ডুবে থেকেও প্রতিদিন রাজকীয় পার্টি দিতেন তাঁর ছাত্রদের নিয়ে, থামাননি... এবং তাঁর টাকা জোগাড় করার জন্য কি কি পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, এইসব আবিষ্কার করার সময় আর অত কষ্ট হয়নি... কারণ ততদিনে আমি আমার হীরোর ক্যারিশ্মা ছেড়ে বিশ্বাসে মন দিয়েছিলাম এবং ওরই বলে যাওয়া কথা, মৃত্যুশয্যায় পর্যন্ত, "প্রশ্ন ছেড়ো না, প্রশ্ন থামিও না" মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

ছিলাম কোথায়, আর এলাম কোথায়!!! তা এতে হয়রাণ হওয়ার কিছু নেই, আগেই বলেছি ২০১৩ সালে লেখা নতুন কোনো দিশার সন্ধানে সময় নষ্ট করবে না... কারণ দিশাগুলি বহুচর্চিত... এখন লেখা দিশেহারা হওয়ার দিকেই এগোবে... তা বলছিলাম মা কালীর কথা... কদিন আগে স্বপ্ন দেখেছি এক্সিপ্লোন সিরাপের ছিপি খুলতেই মা কালী বেরিয়ে এলেন, এসে ঠাসঠাস করে থাপ্পড় মারলেন, তারপর আমাকে বললেন, "আমার জন্য কিছু নিয়ে আয়, যা তোর মনে হয়"... আমি দৌড়ে গিয়ে একটা জিভছোলা নিয়ে এলাম (তখন এক জায়গায় গেছিলাম, ব্রাশ নিয়ে গেছি, ওটি নিয়ে যেতে ভুলে গেছি, সেই সূত্রে মাথায় ছিল)... সেটি পেয়ে খুব খুশি হয়ে আমাকে স্বেচ্ছামৃত্যু বর দিলেন... আমিও স্বেচ্ছামৃত্যু বর শুনে হেব্বি খুশি হয়ে বললাম স্বেচ্ছামৃত্যু, মানে সেই স্বামী বিবেকানন্দের মতো, অমরনাথে নিবেদিতার/মার্গারেটের সঙ্গে যাত্রা করে লিঙ্গ দর্শনের সময় যেমন পেয়েছিলেন, তেমনি?? বলতে আমাকে উদুম ক্যালালেন, "নিজেকে বিবেকানন্দ ভাবছিস, তোর সাহস হয় কী করে ইত্যাদি" বলে আরো কয়েকটা থাপ্পড় মেরে চলে গেলেন...... মাইরি বলছি, সত্যিই এই স্বপ্ন দেখেছিলাম...! এবারে পুজোয় একা, পা ভাঙা, ভালো লাগছে না... সকাল থেকে বসে বসে বারীনদার আত্মজীবনীটা বেশ কয়েকবার পড়লাম... একা থাকলে আলো টালো জ্বালানোর বালাই নেই... মন ফেরাতে সদ্য শিখতে শুরু করা স্প্যানিশ লেসন নিয়ে বসলাম... এই খুটুর খুটুর করছি... হঠাৎ পেছনে খুটুর খুটুর, রাত্রি প্রায় একটা... দেখি আমার বাড়িওয়ালা, বুবুদা... এই বুবুদাকে নিয়ে গোটা বই হতে পারে এমন চরিত্র... অসাধারণ মানুষ, ততোধিক অসাধারণ মন... কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ভদ্রলোক আন্তর্জাতিক মানের গবেট... একটাই উদা দি, পরে বিস্তারে গল্প করা যাবে... ওনার ফোন রিচার্জের দোকান আছে... আমার নেট ফুরিয়ে গেছে, ডংগল সিমটার নাম্বার দুটি মনে পড়ছে, যে কোনো একটা ঠিক... ওনাকে দুটি নাম্বার দিয়ে বললাম, দেখুন একটি ঠিক, একটি ভুল... আপনি একটু ফোন করে দেখে নেবেন রিং হচ্ছে কি হচ্ছে না (মানে, যেটায় হবে না সেটাই ডংগল সিম)... ভদ্রলোক অত্যন্ত দায়িত্ব সহকারে ফোন করলেন একটিতে, রিং হচ্ছে দেখলেন, অপেক্ষা করলেন, একজন মহিলা ফোনটি তুললেন... উনি নম্বরটা বলে কনফার্ম করলেন মহিলার সাথে যে, এটা সেই নম্বর কিনা (ফোন যখন তুলেছেন তখন অন্য কী করে হয়!!)... তারপর কনফার্ম করলেন মহিলাটি অমিতাভ প্রহরাজকে চেনেন কিনা... দুর্ভাগ্যজনক ও রহস্যজনকভাবে ভদ্রমহিলা আমায় চেনেন বললেন... উনি নিশ্চিন্ত হয়ে ৩৯৯/- র ডংগল সিম নেট প্যাক মেরে দিলেন ওই ভদ্রমহিলার নম্বরে এবং অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ফোন করে আমাকে জানালেন যে, উনি প্যাক মেরে দিয়েছেন এবং আমার ডংগলটি যে ভদ্রমহিলা তুলেছিলেন তাঁর সাথে কথা বলে কনফার্ম করে নিয়েছেন উনি আমাকে চেনেন!!!!!!!!!!!
তো সেই বুবুদা, রাত্রি একটার সময়... নড়বড়ন্ত... "আপনার জন্য আমার খুব দুঃখ হলো তাই এলাম"... এই রে এককালে এমন দুঃখ আমার প্রচুর হতো, এর অভিঘাত কী হতে পারে আমি জানি... "পুজোর দিন, আর আপনি ল্যাংড়া হয়ে বসে আছেন... খুব দুঃখ হলো... শুয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তারপর উঠে চলে এলাম (বিটিডাব্লু ওনার বাড়ি হেঁটে প্রায় মিনিট কুড়ি) জানি আপনি জেগে থাকবেন, একা বসে বসে সেই খটাখট করবেন, আপনি ল্যাংড়া হয়ে গেলেন, আমার খুব দুঃখ হলো"
- "আরে না না, এখন ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে, পরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে" এবার আমার সান্ত্বনা দেওয়ার পালা
- "না না, আপনি ল্যাংড়া হয়ে গেলেন, খুব দুঃখ হলো"
এনাকে এখন ল্যাংড়া, ফজলি পার্থক্য বোঝানোর চেষ্টা বৃথা... হঠাৎ হাতে একটা জবাফুল দিয়ে বললেন "মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করে জয় মা কালী বলুন জোরে, আপনি আর ল্যাংড়া হবেন না... আমি নিজে পুজো দিয়েছি দক্ষিণা কালীর মন্দিরে আপনার নামে... আর আমার খুব দুঃখ হলো তাই কয়েকটা প্রদীপ আর মিষ্টি আনলাম, আপনারা আর্টিস্ট মানুষ, আপনাদের ঘরে প্রদীপ জ্বলবে না, তা হয়???"
হাল ফ্যাশানের লাল নীল, মোমবাতি প্রদীপ... "নিন খান প্রসাদ"... নিয়ে মুখে পুরলাম, মুখে পুরেই বুঝলাম কি ঘটেছে... বুবুদাও "এ্যা হা হা হা , ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ, থুঃ থুঃ"
কেস কিছুই না, মিষ্টিগুলোও লাল নীল, ফলে জাক্সটাপজিশন হয়ে গেছে... বললাম "তাও ভালো, মিষ্টিগুলো জ্বালতে যাননি ভাগ্যিস প্রথমে, দুটোই যেত"
"কিন্তু আপনি ল্যাংড়া হয়ে গেলেন, আমার খুব দুঃখ হলো" এবার কিঞ্চিত রাগ হতে শুরু করেছে দুঃখের ওপর, কাঁহাতক দেওয়ালীর দিন মাঝরাত্রে ল্যাংড়া ল্যাংড়া শুনতে ভালো লাগে??!! আমাদের না খাওয়া প্রদীপগুলো জ্বাললেন, প্রশান্ত হাসি হেসে বললেন "দেখবেন একটু, বাড়িটাতে যেন আগুন না ধরে যায়" যেন "দেখবেন একটু, বাথরুমের কলগুলো ঠিকঠাক বন্ধ আছে কিনা" এমন ব্যাপার! এই নতুন দায়িত্ব নিয়ে গুডনাইট করতে যাব... বুবুদা আবার ফিরে এলেন "কেন পুজো দিলাম জানেন?? আমার বাপ শেষবয়সে ল্যাংড়া হয়ে গেছিল, গ্যাংগ্রীন হয়ে গেছিল, পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল... ল্যাংড়া হওয়ার কষ্ট আমি জানি, বুঝলেন... (একটু বিরতি)... আপনারা আর্টিস্ট মানুষ, আপনাদের হাতের কাজই আলাদা... (এখন বোঝাতে যাওয়া বৃথা যে আমি কেমন আর্টিস্ট ও হাতের কাজ বলতে আমি কি পারি)... আমিও কিন্তু হাতের কাজ জানি, জানেন... বাবাকে দুটো পা পুরো নিখুঁত, ওই যে নাচ ময়ূরী পা শুনেছেন, এক্কেবারে ওই পা, বানিয়ে দিয়েছিলাম... একটা পরেছিল, আর একটা পরেনি... আপনার যদি পা লাগে তো বলবেন... ওটা আছে, মা কসম, কালী মায়ের কিরা, কেউ পরেনি... আপনার লাগলে বলবেন... আমার খুব দুঃখ হলো আপনি ল্যাংড়া হয়ে গেলেন..." বলতে বলতে বুবুদা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন, যেতে যেতে, "বললেন না তো জয় মা কালী! বুকভরা দম নিয়ে বলুন, জয় মা কালী"
আমি বললাম। ব্যাস ওই প্যাকেজ জয় মা কালী বেরোলো মুখ দিয়ে "জয় মা কালী/ পাঁঠাবলি"...
"এ্যাঁ!!!" বুবুদা তাকালেন পেছন দিকে, হ্যা হ্যা হ্যা করে হাসতে বেরিয়ে গেলেন...

তখন রাত্রি আড়াইটে, শ্যামাপুজোর দিন, একজন দুঃখিত মানুষ এসে আমাকে প্রদীপ খাইয়ে, তারপর আমার পা লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে, শেষে বোধহয় দুঃখ কাটিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল......

সাধে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি কবিতা ঘটে...





০২ অনিমিখ পাত্র

নীলের বানান কিংবা রোদের অনুবাদ :
নীলাব্জ’র বই কিংবা বাক্‌-এর ই-বুক


বইয়ের নাম : ‘গুলমোহর... রিপিট হচ্ছে’
বাক্ প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিনামূল্যে আন্তর্জালে বিতরিত



কখনও উপলভরা, কখনও মরুময়, কখনও বা সমুদ্রসোঁদা বিস্তীর্ণ ভূমির ওপর দিয়ে পথ করে নিয়েছে আমাদের বাংলা কবিতা। এই যাত্রায় হাইওয়ে ও গলি-উপগলি -- দুইই সামিল। আর এই মুহূর্তে হয়তো সমস্ত রকম রাস্তার সন্ধিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। কেউ কেউ বলছেন, আর্ট ফর্ম হিসেবে কবিতার আয়ু আর খুব বেশিদিন নয়। কেউ বলছেন, আস্ত বাংলা ভাষাটাই নাকি বিপদের মুখে। ফেসবুক এসে গিয়ে অনেক রকম পুরনো নক্‌শাও পালটে দিয়েছে। কবিতা হাত ধরে নিচ্ছে আরও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমগুলির। এরকম একটা আবহের মধ্যেই, দীর্ঘদিনের সুপরিচিত বাংলা ব্লগজিন ‘বাক্‌’ ( সম্পাঃ অনুপম মুখোপাধ্যায় ) প্রকাশনার জগতে পা রাখলো। এবং তার ইঙ্গিতময়তা এখানেই যে, সে তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রকাশ করলো নীলাব্জ চক্রবর্তীর দ্বিতীয় কবিতা সঙ্কলন -- বাক্‌ প্রকাশনীর প্রথম ই-বুক ‘গুলমোহর... রিপিট হচ্ছে’।


আজ থেকে পঞ্চাশ কি একশো বছর পরে কবিতা থাকবে কিনা তথা বাংলা ভাষায় কবিতা লেখা হবে কিনা, সেটা অন্য বিতর্কের বিষয়। তবে রক্ষণশীল বইপাঠের অভ্যাসে প্রাথমিক আঘাতটুকু সইয়ে নেওয়ার পর এ বইটি (হাতে নয়) ডাউনলোড করে পড়া শুরু করলে অস্বস্তি কেটে যেতে থাকে। ছোট্ট এই বইটিতে মাত্র এগারটি কবিতা। ছাপা হলে বলা যেত রোগাপাতলা এক ফর্মার একটি বই। প্রবেশক কবিতাংশেই এই কবির স্থানাঙ্কটি টের পান পাঠকঃ ‘এই পেরিয়ে যাওয়াটার নাম তোমরা আলো রেখেছ আর ধরে নিয়েছি কীভাবে সমস্ত ছায়ার থেকে একলাইন স্মৃতি অনুবাদ করে নেওয়ার কথায় চোখের ভেতর দিয়ে দেখতে পাওয়া হাসপাতালের নিজস্ব জাহাজঘর...’ নীলাব্জ চক্রবর্তীর ভাষাদুনিয়ায় ঢুকে পড়া, এইভাবে। আলো আর ছায়ার যাতায়াত। স্মৃতির অনুবাদপ্রয়াস।

এক ক্রমে ছোট হয়ে আসতে থাকা হেমন্তের কথা নীলাব্জ’র লেখায়। এবং তার ভেতর ঢুকে পড়ে এক অসদৃশ মোটিফঃ ‘গুটি গুটি হেমন্ত ফ্যালা হয় এইখানে / ক্লিন শেভেন...’ এই ‘ক্লিন শেভেন’ শব্দবন্ধ যেমন মেধার ভেতর ক্ষুর চালিয়ে দেয়, তেমনি কোথাও কোথাও উপর্যূপরি ইংরেজি শব্দবন্ধের ব্যবহার কেবল এক প্রবণতা বলেও বোধ হয় বটে! কিন্তু কখনই কবি তাঁর লেখা থেকে ছায়াময়তা ছাড়িয়ে ফেলে তাকে হাজার ওয়াটে এনে ফেলেন না। এরকমই এক উদাহরণ, ‘নিওন’ কবিতার শেষ অংশটি পড়া যাকঃ

প্রিয় ব্যারিটোন থেকে দূরে
টাউনহাউস শব্দটার গায়ে
                 একেকটা জুবেইদা নামের আলো
নাজনীন ইত্যাদির মায়া লেগে আছে দেখি ...
নানান প্রপার নেম-এর উল্লেখ তাঁর লেখার শরীরে। নীলাব্জ’র প্রিয় নামগুলি, ধীরে, আমাদেরও ব্যক্তিগত মনে হতে থাকে। এইখানেই কবির মুন্সিয়ানা। ‘নাজনীন ইত্যাদির মায়া’ যেমন তিনি না দেখিয়ে পারেন না, তেমনি ‘ক্ষয়’ কবিতায় এক অপূর্ব অনুপস্থিতির মায়াঅঞ্জন লাগিয়ে দেন, নিজেকে ক্রমাগত মুছে মুছে ক্ষয় করতে থাকেন আর তার মায়াটিও অন্যভাবে ফোটে। বলেন, ‘এখানে নীলু নামের কেউ / কোনোদিন ছিলই না কখনো’। একটা সম্পূর্ণ আবহ গড়ে ওঠে, নিজের ওপর ক্রিয়া আরোপ হয়, অথচ তা হয় ক্রমাগত প্রত্যাহারের মাধ্যমে। তাঁর ভালোবাসা আমরা টের পাই।
‘জানলার ভেতর আর জানলার বাইরে
একইরকম স্বপ্নদৃশ্য
               এখানে
                        নীলু নামের কেউ
রোদের অনুবাদ করে না
               ফেনা আঁকে না
জেব্রাঘড়ির ছায়ায় বসে বসে ...’

আমাদের সময়ের অনেক কবিই এখন গল্প বা অন্য ধরণের ছোট গদ্যে কলমের ধার পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। খুবই কৌতূহল উদ্দীপক এই প্রবণতা নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো বা গবেষণা হবে একসময়। তাহলে কি কবিতায় লেখকের সমস্তটা সম্ভব নয়? কবিতার ধারণক্ষমতা সন্তুষ্ট করতে পারছে না আর? নাকি আমরা চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাচ্ছি?

হয়তো এই চ্যালেঞ্জটাকেই হালকা করে আঙুল বোলায় নীলাব্জ’র কবিতা। সে যেন হিমশৈলের শীর্ষবিন্দুর আভাটুকু ছড়িয়ে রাখে কবিতাশরীরে। কোনো গল্প বলে না। তার ঢংটুকু বলে। আরো অনেক চরিত্রনাম উল্লিখিত হয়ে সরে সরে যায়। ‘চেন্নাই’ শীর্ষক টানা গদ্যের দুই কবিতার সিরিজ এমনই এক আভাসকোলাজ। যার ২নংটি তে ফিল্ম শ্যুটিং-এর উত্তেজনা আছে। তবে ১নং-এ ‘রুক্মিনী’ নামটিকে ভেঙে ‘রুক তোর মিনি তোর স্কার্ট’ -- এমন উচ্চারণকে দম ফুরিয়ে ফেলা বলে মনে হয়। এরপরের ‘তারিখ’ নাম্নীটিও ওই একই ফর্মের দুই কবিতার সিরিজ। এবং এখানে নীলাব্জ’র প্রাণটিকে বড়ো কাছের বলে বোধ হতে থাকে। তার গায়ের ধুলোবালি পাঠকের হয়। যতিহীন এই দুটি অংশ কবিতা টানা একেক দৌড়কে পৌঁছে দেয় আমাদের খোলামাঠে। এর স্বেদবিন্দু প্রকৃত অর্থে পেতে গেলে পুরোটা পড়তে হবে। এবং পুরো বইটাই। তবু আপাতত অঙ্গহানির দায় নিলামঃ ‘জন্মদিনের হাতল থেকে গড়িয়ে আসছে এক একটা স্বাদু দস্তানা ও খসে যাওয়া আলোর সিরিঞ্জে এইভাবে উত্তাপ ও শীতলতা ধীরে বিনিময়যোগ্য হয়...’। নীলাব্জ’র এইসব কবিতায় ‘স্তনের জাফরি’ থেকে ‘স্তনের ডাকটিকিট’ পর্যন্ত এক পরিক্রমাকে দেখি। এও তো স্মৃতিরই অনুবাদ যা কবি প্রথমেই স্বীকার করে নেন। এমনকি বিদেশি শব্দগুলিও নীলাব্জ স্মার্টনেসের অছিলায় ব্যবহার করেন না। তাঁর মৃদু স্বভাবটিই পাঠকমনে রিপিট হতে থাকেঃ

যেভাবে একটি পোষা
নগ্নতার পায়ের কাছে
ফিরে গেছে দুপুরের বোতামবেলা

কবি ‘রাস্তার জন্য একলাইন রাস্তাও পড়ে নেই’ -- এরকম বলতে বলতেই পাঠকের জন্য তেমাথা-চৌমাথার ট্রাফিক খুলে দেন।

আর প্রচ্ছদ এবং সমগ্র ই-বুক তৈরির কারিগর অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা না বললে এই ‘ওপেন-এন্ডেড গল্পরেখা’টি মুড়নো যাবে না।

০৩ দীপঙ্কর বসু

গানের ঝর্ণাতলায়



অনেকটা বিশ্বভারতীর আদলে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা প্রভৃতি কলাবিদ্যা চর্চার কেন্দ্র হিসেবে রবীন্দ্রজন্ম শতবর্ষে গড়ে উঠেছিল জামশেদপুর টেগোর সোসাইটি। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য বহু বিশিষ্ট শিক্ষকরা তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে প্রতিমাসে একটি রবিবার কলকাতা থেকে সুবিনয় রায় আসতেন ‘স্পেশালক্লাস’ নিতে। সেই ক্লাসে শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন আমাদের শিক্ষকরাও। গান তো শেখাতেনই, তার সঙ্গে চলতো রবীন্দ্রনাথের গানের নানা দিক নিয়ে নানান আলাপ আলোচনা। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, অল্প বয়সে সেই সব আলোচনায় যোগ দেওয়া তো দূরস্থান – তার অনেক কথাই বুঝতাম না। কিছুটা হয়তো বুঝেছি উত্তরকালে সঙ্গীত চর্চার মধ্য দিয়ে।

আবার প্রণালীবদ্ধ সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি বহু সেমিনার ওয়ার্কশপ প্রভৃতিরও আয়োজন হতো প্রায়ই, যার দৌলতে সাহিত্য, সংগীত তথা শিল্পকলা জগতের অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাওয়া যেত। মনে পড়ে এই রকমই একটি সভায় প্রথম শুনেছিলাম সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতা। খোদ রবীন্দ্রনাথের পৌত্র অনিন্দ্যকান্তি মানুষটিকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার শিহরণ আমি আজও ভুলিনি। আর মানুষটি যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে বক্তৃতা আরম্ভ করলেন, তখন মঞ্চের ওপরে তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, শব্দচয়ন, উচ্চারণের বিশিষ্টতা সব কিছুর মধ্য দিয়ে যেন অনুভব করতে পারছিলাম যে সাহিত্য, সংগীত বা অন্যান্য কলাচর্চার মধ্য দিয়ে সুন্দরতা যদি জীবনের সঙ্গে এই ভাবে সম্পৃক্ত না হয়ে ওঠে, অন্তরের গভীরে যদি সৌন্দর্যবোধ জেগে না ওঠে, তবে নাচ গান বাজনা শেখা এবং সাহিত্যচর্চা সবই বৃথা – সবই পন্ডশ্রম।

স্পেশাল ক্লাসে তাত্ত্বিক আলাপ আলোচনার মধ্যে পুরোপুরি ঢুকতে না পারলেও গানটা শ্রবণ মাধ্যমে প্রাণে অবশ্যই ঢুকতো। মনে আছে, প্রথম যেদিন আমি ওই ‘স্পেশালক্লাসে’ যোগ দেবার যোগ্যতা অর্জন করে দুরুদুরু বক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠদের মাঝে এক কোণে গিয়ে বসেছিলাম, সেদিন সুবিনয় রায় আমাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত গানের তালিকা চেয়ে নিয়ে শেখাতে শুরু করলেন – “আমার না বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে, তোমার ভাবনা তারার মত বাজে” গানটি।

বালখিল্য ঔদ্ধত্বে নিজের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, গানের তালিকায় থাকা কঠিন কঠিন গানগুলি ছেড়ে সুবিনয় রায় হঠাৎ এই সহজ কীর্তনাঙ্গ সুরের গানটিকেই বেছে নিলেন কেন! এখন মনে হয়, গানটির আপাত সরল সুরের মধ্য দিয়ে গীতিকবিতার সাবলাইম রূপের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হয়তো তাঁর লক্ষ্য ছিল সেদিন। একালের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের গানে এই বস্তুটির অভাব ভীষণ ভাবে পীড়িত করে আমাকে। শিল্পী সুবিনয় রায়ের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে বারেবারে আমার ওই সাবলাইম রূপের কথাই মনে হয়েছে। আমি নিজেও আমার গানের পরিবেশনায় চেষ্টা করি ওই সাবলাইম রূপটিকে স্পর্শ করতে। বেতারে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর কন্ঠে শুনেছিলাম – “আমার পরাণ লয়ে কি খেলা খেলাবে ওগো পরাণপ্রিয়”। এ গান আর কারো কন্ঠে অমন করে জাগিয়ে তোলেনি আমার চেতনাকে। ‘বাড়াবাড়ি’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে আপত্তি নেই আমার – তবু এ গান আর কারো গলায় শুনতে রাজি নই আমি।

সুবিনয় রায়ের প্রতি মুগ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানবিশী বেলায় একটু সন্ত্রস্ত হয়েও থাকতাম। কারণ গান শেখাতে শেখাতে মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুতি ঘটত তাঁর। গানের কোথাও সুরটি যথাযোগ্য ওজনে লাগল না বা সুরের সূক্ষ্ম কারুকাজটি পরিপাটি ভাবে সম্পাদিত হলো না – এটা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। আর ক্লাসের কনিষ্ঠতম সদস্য হওয়ার অপরাধে রসভঙ্গের যাবতীয় দায় এসে পড়ত আমারই ঘাড়ে। এটাই আমার কাছে একটা বড় পীড়ার কারণ ছিল সেকালে।

মনে পড়ে, একবার এক সুন্দরী ছাত্রী গানের খাতার বদলে তিনখন্ড গীতবিতান নিয়ে ক্লাস করতে এসেছিলেন বলে সুবিনয় রায় কঠিন স্বরে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন – “কলকাতায় কোনো ছাত্র বা ছাত্রী খাতা না নিয়ে ক্লাসে এলে তাকে বলি, বাইরে বাজার থেকে একটা খাতা কিনে নিয়ে তবে ক্লাসে আসতে। এখানে দোকান বাজার কাছে নেই বলে সে কথাটা বলতে পারছি না। পরের দিন থেকে খাতা না নিয়ে ক্লাসে আসবেন না”। সুকন্ঠী এবং সুন্দরী মেয়েটির অবস্থা সেদিন দেখার মতো হয়েছিল। মেয়েটি সুবিনয় রায়ের বিশেষ অনুরাগী তথা জামশেদপুরের এক প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের আত্মীয়া বলেই বোধহয় অল্পে রক্ষা পেয়েছিলেন সেদিন।

গান ছাড়া সুবিনয় রায়ের আর দুটি বৈশিষ্ট্য আমাকে আকর্ষণ করত, তার প্রথমটি হলো তাঁর বেশভূষা। পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবী পরেই তাঁকে বেশির ভাগ সময় দেখতাম। সেই সাজের মধ্য দিয়ে এক ধরনের আভিজাত্য প্রকাশ পেত। আবার পুরোদস্তুর ড্রেসস্যুটেও দেখেছি খুব পরিপাটি ভাবে সাজতেন। এমনি পোশাকসচেতন মানুষ আরও একজনকে দেখেছি আমি, তিনি বিমলভূষণ।

দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য আমাকে আকর্ষণ করত, তা হলো তাঁর বাচনভঙ্গি। এই বাচনভঙ্গি সম্ভবত কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্ম পরিবার সূত্রে পাওয়া। সে সময়ে বাজারে ছিল চিনির আকাল। সাধারণ লোকে গুড় দিয়ে চা খাওয়া অভ্যাস করতে বাধ্য হয়েছিল – চিনি দেওয়া চায়ের খোঁজ পড়ত শুধুমাত্র অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়নের বেলায়। সেই চিনি দেওয়া স্পেশাল চা বরাদ্দ ছিল সুবিনয় রায়ের জন্য। যে লোকটির ওপরে চা দেওয়ার ভার ছিল, সে একবার অন্যমনস্ক হয়ে সবার সঙ্গে সুবিনয় রায়কেও গুড়ের চা-ই দিয়ে গেছে। আমরা দেখলাম, কথার ফাঁকে সুবিনয় রায় চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে মুখটা বিকৃত করলেন এবং তারপর আর সেই কাপ হাতে তুললেন না। জনৈক কর্মকর্তার চোখে ব্যাপারটা পড়া মাত্রই গোলমালটি অনুমান করে নিয়ে অপ্রস্তুত কন্ঠে সুবিনয় রায়কে বললেন -- “ইসস্‌... বোধহয় ভুল করে আপনাকেও গুড়ের চা-ই দিয়ে গেছে! দেখি আর এককাপ আপনার জন্য পাঠিয়ে দিতে বলি”। সুবিনয় রায় তাঁর পরিচিত বাচনভঙ্গিতে বললেন – “আরে না না, ব্যস্ত হবেন না! গুড়ের চা খেতে আমার বেশ ভালোই লাগে”। বলার ধরনের কারণে এই বাক্যটি নিয়ে আমরা হাসাহাসিও করেছি বহুদিন।


০৪ প্রশান্ত গুহমজুমদার

‘বিহানের কথা’ শেষ হলে



............দূর পাগল, থাম না!

বিহানের কথা শুনতে শুনতে, বিহানের বেঁচে থাকা জানতে জানতে দহন এক সময়ে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ অতিক্রম করে। অধিকতর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তখন যেন বলে ফেলতেই হয়, দূর পাগল, থাম না!

পূর্ণচন্দ্রগ্রাস-এর রাত্রে বিহান সজোরে যে কথা ছুঁড়ে দিয়েছিল, আর্তস্বরে সে শব্দসমূহই পুনরায় উচ্চারণ করতে হয় আমাকে। তারপর ‘অপ্রাকৃতের স্মৃতি’ ম্লান হলে অথবা শৃঙ্খলার অনেক বাইরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ রকম বলা হলো কেন! এ কি পরিত্রাণের জন্য, এ কি অন্য রকম বেঁচে থাকাকে আবাহনের জন্য! জানতাম, ‘বিহানের গল্প’ যখন শুরু করেছিলাম, তখনই জানতাম, নতুন কোনো নিটোল সন্ধান এই ন’টা গল্পের কোথাও পাব না। ঐ যে এক সময়ে ভাবা হয়েছে, একটা ছোটগল্পে, আখ্যায়িকার ঘটনা পরম্পরায় ধারাবাহিকতা থাকবে, পাঠক চরিত্রগুলির হাড়মজ্জ্বার উষ্ণতা টের পাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিবিধ চরিত্রের আচরণের কার্যকারণও অনুভব করবেন; ‘বিহানের গল্প’-এ, পূর্ব কিছু অভিজ্ঞতার কারণে, আশা করি নি। সুতরাং, অপ্রাপ্তির সে অর্থে কোনো কারণ নেই। কিন্তু যা পেলাম, তা-ও কি প্রত্যাশিত ছিল! আমার সাধ, স্বপ্ন, আমার বেঁচে থাকা, আমার সত্য, আমার অসততা এ ভাবে, এমন অপূর্ব লিখিত থাকবে এ গ্রন্থে, এমন তো ভাবি নি। ফলে গল্পগুলির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার পর কেমন যেন পক্ষপাতিত্ব জন্মে যায়। এই জীবনটাকে বারবার ফেলে দিতে চেয়েও যেমন ফেলে দেওয়া যায় নি আজ-ও, এই তাবৎ বাক্যকে অস্বীকার করতে চাইলেও তেমনই পারি নি শেষ অবধি। পরিবর্তে বড় মমতায় তুলে নিতে হয়েছে খুব কাছে, বুকের কাছাকাছি। মনে মনে দাঁড়িয়েছি, অন্তত প্রয়াস করেছি দাঁড়াতে ঐ কলমের বোধের কাছে, মমতার কাছে, ভালোবাসার কাছে। দেখেছি তাঁর হাত ধরে “...ঘুমের মধ্যে তাদের কৃষ্ণ স্তনবৃন্ত থেকে পৃথিবীর বুকে চুঁইয়ে পড়ে ভোরের মতো দু চার ফোঁটা দুধ”। আর বিহানের হাত ধরে খুব নিঃশব্দে ছাতিম শিরিষ পলাশ হরিতকির অন্ধকারে, স্তব্ধতা আরও গূঢ় হলে বৃত্তের অন্ধকার তীরে দাঁড়িয়েছি বারবার।

আর এ ভাবেই গল্প জমে ওঠে। খুব কাছের এক জীবনের গল্প, যা অতি নৈকট্যের কারণে প্রায় অদৃশ্য, কেবল নিরন্তর ঢেউয়ে ভিজে যারা অবয়ব হয়, তাদের নিয়মিত সংসর্গে সে গল্প ক্রমে মূর্ত হয়ে ওঠে, ঐ কাচের ঘরের মতোন। ‘ভাঙা জানালার তীরে’ গল্পটা ভালো লাগল! বোধ হয়, এর সারা শরীর জুড়ে “রূপ গড়ে ওঠা আর ভেঙে যাওয়ার খেলা”-র অঙ্কন মুগ্ধ করেছে। বোধ করি, “শিশিরের জল আর সুরে হাতে হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নাচ” প্রতিটি শব্দে জড়িয়ে আছে, তাই।

দেখার প্রচলিত অভ্যাস থেকে অব্যাহতি চেয়ে এই যে ক্রমশ নবতর কৌণিক দৃষ্টির জন্য অভ্যাস, অপ্রয়োজনীয়বোধে বাহুল্য নির্মম ভাবে বর্জন করার প্রয়াস আমাকে অভিভূত করে। গল্প বলা আর তার বিনির্মাণ -এ দুইয়ে যে বিস্তর ফারাক, এমন ধারণা ক্রমে দৃঢ় হয়। নতুবা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় “মানুষের ভাষা জানলে এই শক্তিমানরাই বড় হয়ে সভায়, লেখায়, দীনদুঃখী ভাইবোনদের সমস্যা ও উত্তরণের কথা গুছিয়ে জানাতো”-এমন বলা সম্ভব হতো না। কবিতা ভালোবাসি। আসলে কবিতার যে বহুতর জানালা-কপাটের ভা্লোবাসা, তাকেই। এই ন’টা লেখাতেও তেমন। সব পৃষ্টা শেষে বারবার ফিরে আসি ‘বাসনার মতো ভালবাসা’-র কাছে। খন্ডকে পূর্ণতা ভেবে রানির নগ্ন হাতের মায়ায় চামচিকের মুক্তিকে বারবার দেখতে চাই।

১ থেকে শুরু করে ১-এ ফেরার কথা বিহানের মতো আমিও ভাবতে পারি নি। সে বড় সংকটের ভাবনা। তবু বিহানের সঙ্গে সঙ্গে আমার-ও মনে হয়, “শুরুর ঠিক পরবর্তী সংখ্যাটাই মানুষের চরম বিন্দু”। রাম কিংবা রামলখনের এমন না-ও মনে হতে পারে। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঐটাই স্বাভাবিক। যেহেতু “একটা অস্থির দিক্‌ভ্রান্ত রেখা”-র বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি অহরহ আমিও দেখে থাকি। এই ভাঙা রেলিংমুগ্ধ জীবনে দেখতে চাই “দু একটা সৌন্দর্জের ভাঁজ”, বলতে চাই একজনকে কখনো নিশ্চয়ই “কেন এত ভালোবাসা শেখাও”।

এ ভাবে, বিবিক্ত আমি পাতা থেকে অপর পাতায় যাই। সাবলীল নই, তবু এক বাধ্যতা। জীবনের খন্ড মুহূর্তের দিকে অথবা অভিজ্ঞতার বিচ্ছিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে নয়, যথার্থ প্রেক্ষিতে এই প্রাপ্তিকে বুঝতে চাইলে সমগ্রতায় ধ্যান রাখতেই হবে। এই সত্য না বোঝা আমার ভুল। আর সে অপরাধ থেকে, ভ্রান্তিজনিত ক্ষয় থেকে পরিত্রাণের তাগিদে যুদ্ধে ‘বিহানের কথা’ ক্রমশ খুব জরুরি অস্ত্র হয়ে উঠতে থাকে আমার কাছে।

সূত্র : বিহানের কথা (গল্প সংকলন)/ মধুময় পাল/ দীপ প্রকাশন /প্রকাশকাল : ২০০৫

০৫ রমিত দে

কামিল ক্লদেল
“কিছু শস্য আঁকড়ে থাকে মাটি… উড়ে যায় কিছু স্বপ্ন স্থাপত্যপ্রবণ”


“I am free! I am free! I am free!
No more life in the prison for me!
I am free as a bird! I am free!”

ইবসেনের বিখ্যাত নাটক “হোয়েন উই ডেড অ্যাওকেনের’ কথা মনে পড়ছে! ভাস্কর স্বামী আর্নল্ড রুবেককে তার প্রাক্তন প্রেমিকা ইরিনের হাতে ছেড়ে আসতে আসতে এমনই ছিল মাইয়া রুবেকের খোলা কন্ঠস্বর। শূন্যতাময় বাতাবরণের থেকে বাতাসের শিস তুলে তুলে সে যেন বাসাবদলের গন্ধ। তবে এখানেই ইবসেনের নাটকের হাইপাররিয়ালিটি নয়, সূচনাবিন্দু অথবা উপসংহার নয়, বরং জীবন, অন্ধকার আর মৃত্যু নিয়ে তাঁর নাটক এগিয়েছে রুবেক ও ইরিনের জড়াজড়ি মৃত্যুদৃশ্য অবধি, গড়িয়ে আসা হিমবাহের মাঝে হিমরঙের দুটি সত্ত্বার পিছলে যাওয়া অবধি। ইবসেনের নাটক নাকি ভাস্কর রঁদ্যা আর তাঁর গোপন প্রেম কামিল ক্লদেলের অলিখিত গল্প, যে গল্পে আসলে সমগ্রতার কোনো বিন্যাস নেই, কেবল অনতিক্রম্য জেগে থাকা, স্থান ও কালখন্ডের মাঝে জাগিয়ে রাখা এক নারীর তীব্র শ্লেষ, প্রকৃত বাঁচার অধিকার দিতে অক্ষম এক পুরুষের প্রতারণার আঁশটে গন্ধ। কেবল ভাবা ভাবা আর বিপজ্জনক ভাবা অনিভিজাত পৃথিবীর গল্প নিয়ে। না, ইবসেন হয়তো এত কিছু বলেননি। চরিত্রের বাইরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তমাখা চিৎকারগুলোকেও দাঁড়িয়ে থাকতে বলেননি আঘাত ও অস্তি সমেত। আবহমান শিল্পমিশ্রণে পৃথিবীর রুপোলি মার্কশিটে কেবল রেখে গেছেন মিলিয়ে দেওয়ার খেলা, কিন্তু সেই চেতনার দাগ সেই একদম নিচে থেকে উঠে আসা আড়ষ্ট গভীর সে কি কোথাও জীবনমুখী শব্দের ভলিইউম কমিয়ে রেখে আজও কোথাও জেগে থাকে নৈঃশব্দের মাতম দেখবে বলে? প্রেমিকের প্রত্যাখান আর ভালোবাসার পতনের শব্দ শুনতে শুনতে আজও কি জমা জলের ওপর দোলনের গণিত লেখে ভাসমান পিপাসাগুলো? না আমরা জানি না, ঠিক যেমন জানি না ১৯শে অক্টোবর, ১৯৪৩ মন্টফ্যাবেটের উন্মাদ আশ্রমে তিরিশ বছর কাটাবার পর মৃত্যুর আগে, পৃথিবীর ভারসাম্য ছাড়ার আগে কুয়াশায় গচ্ছিত পরদাগুলো সরিয়ে কামিলও গেয়েছিলেন কিনা ‘আই এম ফ্রি, ফ্রি এজ এ বার্ড’! এমনই কী ছিল নীরব বিচ্ছিন্ন শিল্পী কামিল ক্লদেলের তারিখশূন্য কথাবার্তা? অতল মাংসের নিচের এক অসহায় মানুষ কি এভাবেই পাখি হয়ে যেতে চেয়েছিল! নাকি নির্মোহ একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আসলে কিছুতেই দরজাটা খুলতে পারে না এই ঘন পাতার মানুষগুলো, পরিত্যাগের মানুষগুলো, খুলতে পারে না হলুদ মৃতদেহগুলো। কেবল আগুনে পুড়তে চায় অথচ ছাই থেকে উঠে আসে মর্গের শীতলতা। নিঃস্ব পরিত্যক্ততাকে জরিপ করতে করতে পৃথিবীর ধূসর অতল ফিরে ফিরে আসে বড় বড় পায়ের আওয়াজে, গ্যাসের বাতি নিভিয়ে শান্ত জীবন নিভিয়ে থলথলে এক তীব্র নগ্নতা উঠে আসে নির্জন বিশ্রামে! হ্যাঁ, কেবল একটি মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে, কেবল একজন শিল্পী সূর্যাস্তের কথা বলতে বলতে ডানার পথ ধরে ফিরে যায়, কিন্তু জীবন আর মৃত্যুর দেশে পড়ে থাকে ভালোবাসার প্রশ্ন, বিস্মৃতির প্রশ্ন, প্রতিভার প্রশ্ন, যন্ত্রণার প্রশ্ন, পড়ে থাকে তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সম্পর্কের মাঝের সেই নিরুদ্দেশ জলধ্বনি…

কী চেয়েছিলেন কামিল? সৃষ্টির সমস্ত কিছুর মাঝে সজীব কন্ঠস্বর হতে! প্রতিথযশা ভাস্কর হতে! নাকি ইবসেনের নাটকের ইরিনের মতো চড়া দামে ভালোবাসার, বঞ্চনার প্রতিটি লবণসুর প্রতিটি বন্ধুনী সুতো চড়িয়ে বারবার ফিরে ফিরে আসতে রঁদ্যার মতো প্রেমিকের কাছে! রঁদ্যার সাথে কামিলের পরিচয় হয় ১৮৮২তে রঁদ্যারই ওয়ার্কশপে শিক্ষানবীশ হিসেবে, কারণ সে সময় একোল দে বোর্জাটের মতো প্রতিষ্ঠিত আকাদেমিগুলোতে নারীদের অনুপ্রবেশের অধিকার ছিল না। অথচ শিল্পী ভাস্কর কামিলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে শিল্পী ব্যুশে পরিচয় করিয়ে দেন রঁদ্যার সাথে, নিয়ে আসেন অগুস্তের স্টুডিওতে ১৮৮৩ সালে। কামিলের মাটি আর কাদার প্রতি চিরন্তন প্রেমে সায় ছিল তার বাবা আর ভাই পল ক্লদেলেরও। শুরু হয় রঁদ্যার শিক্ষানবীশ থেকে মডেল থেকে গোপন প্রেমিকা থেকে এক মস্তিষ্কশূণ্যতার নির্জিত পরাজিত কাহিনী। আলো চেয়েছিলেন কামিল। আর পর্যবসিত হয়েছিলেন অন্ধকারের অতীন্দ্রিয় ছায়ানৌকোয়। সে সময়ের তরুণী কামিল ছিলেন প্রতিশ্রুতিময়ী শিল্পী, ষোলো বছরের প্রেমে এক আশ্চর্য রঁদ্যাকে আবিষ্কার করেন কামিল আর আবিষ্কার করতে করতে বেদনার খন্ডপৃষ্ঠার মতো হারিয়ে যান নিজেরই অন্ধকারে। তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারেননি রঁদ্যা অথবা তাকে ব্যবহার করেছেন নিজেরই স্বার্থে, প্রকৃত মানুষের অ্যানাটমির বাইরের হাড় পঞ্জর আর মাংসপেশীর মাঝে শিল্পীর নিজস্ব অ্যানাটমিটুকু খুঁজতে। এ এক অস্থিরচিত্ত ডুবোপাহাড়ের গল্প যার গভীর কোটরে ধরে রাখা গ্রহের এক আশ্চর্য গ্রন্থনা। ফুলের বোঁটার মতো কামিলকে রসসিঞ্চনের শেষে পাতার ঝিলিমিলি থেকে আলাদা করে দেন রঁদ্যা; গর্ভপাত করতে বাধ্য করেন তাঁরই ঔরসের সন্তানকে; বিয়ে করতে অস্বীকৃত হন দীর্ঘ বয়সের ব্যবধান হেতু এবং মেরী রোজ ব্যুরের সাথে দীর্ঘকালীন সম্পর্কের খাতিরে। প্যারানোইয়া রোগে আক্রান্ত হন কামিল, শিরাগুলির স্পন্দন অব্দি পৌঁছে যায় তার ব্যক্তিগত রক্তক্ষরণ। সংরক্ষণশীল গোঁড়া ক্যাথলিক মা ও ভাইও তাকে ত্যজ্য করে ধর্মের দোহাই দিয়ে গর্ভপাতের অজুহাতে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের যুক্তিতে আর নিজেরই হাতে দিয়ে আসে মন্টফ্যাবেটের উন্মাদ আশ্রমে। আশ্চর্যের বিষয় আশ্রমের সুপারিন্ডেন্টের যে কটা চিঠি উদ্ধার হয় তার কোনোটাই প্রমাণ করে না কামিল উন্মাদ ছিলেন। একজন উদীয়মান শিল্পী এক বিশ্বশ্রুত ভাস্কর্যের ধ্রুপদী অসুস্থতায় শেকলবন্দী হয়ে গেলেন, সমাজের আদিম নৈতিকতায় কঠোর নীতিবোধের কাছে অ্যালিয়েনেট হয়ে গেলেন। প্রশ্ন উঠল না শিল্পীর মানসিক দ্বৈততা নিয়ে। মহাযাত্রিক ভালোবাসার মেঘমার্গ নিয়ে। দ্বিখন্ডিত সৃজনের নায়িকা কামিল, নন্দনতত্ত্বের আলোর তলাতেই রয়ে গেল যার অধরা রোমান্টিসিজম।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, কে এই কামিল ক্লদেল? যার মৃত্যু স্মরণীয় হয়ে উঠল হঠাৎ; যার জীবন মরীয়া হয়ে উঠল ভালোবাসার বিশুদ্ধ রক্ত চিনতে অথবা প্রত্যাখানের অতন্দ্র বার্তা আঁকতে! কম মডেলের সংস্পর্শে তো আসেননি রঁদ্যা, বৃদ্ধা বারাঙ্গনা থেকে শুরু করে মোহিনী হ্লাদিনি -- কে ছিল না! আর সেটাই স্বাভাবিক, ফেমি ন্যুডের পৃথিবী শাসন করা এক শিল্পীর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। যাঁর হাতে গড়া মূর্তির নায়ক নায়িকাকে দেখেই মনে হয়ে পরমুহূর্তেই নড়ে উঠবে যার প্রতিটা স্থিতিশীল খোদাইয়ে গতির ব্যঞ্জনা, সেখানে কে এ ইস্থাবর কামিল! আসলে কামিল ক্লদেলকে কেবল রঁদ্যার শিক্ষানবিশ বা প্রেমিকা বা বঞ্চিত মহিলা হিসেবে চিহ্নিত করা এক চরম ভুল; কামিল ছিলেন স্পষ্টবাদী এক শিল্পী এবং প্রতিভাবান; তার সময়ের চেয়েও অনেক এগিয়ে ছিল শিল্পসর্ম্পকিত তার পর্যবেক্ষণ আর অভিনিবেশ। ঠিক যে কারণে পারীর প্রথাবিরুদ্ধ ভাস্কর লেখক বারবার মতবিরোধ হওয়া স্বত্ত্বেও রঁদ্যাকে তাঁর প্রিয় ছাত্রের জায়গা দিয়েছিলেন, ঠিক সে কারণেই কোথাও কামিলের প্রতি ছিল রঁদ্যার সার্থক গুরুশিষ্যের সমীকর্ণ। কামিলের সাবলম্বী সত্ত্বাই কোথাও রঁদ্যাকে আকর্ষণ করেছিল সর্বোপরি। পরস্পরকে অসূয়া না করে উভয়ের উচ্চারণকে আলাদা না করে যা হয়ে উঠেছিল সৃষ্টির সমগ্রতা। কামিলের সাথে পরিচয়ের প্রথম পাঁচ বছরেই রঁদ্যা যে নারীমূর্তিগুলি গড়েছিলেন, তার বেশির ভাগই কামিলের গোপন আত্মপ্রতিকৃতি। শিক্ষানবীশ কামিলকে সেখানে মডেল বানিয়েছিলেন রঁদ্যা। ‘Danaide(দানেদ)’, ‘EternalSpring(চিরবসন্ত)’, ‘Andromeda(এ্যন্ড্রোমেডা)’, ‘Dawn(প্রভাত)’এর মতো ভাস্কর্যগুলিতে কামিলকে মডেল করেই মূর্তি গড়েছিলেন রঁদ্যা। ছেনি হাতুড়ি দিয়ে দানেদ বানিয়েছেন রঁদ্যা, গড়ে তুলেছেন দেহবিবর্জিত এক নারীর যন্ত্রণা, যে দানবকন্যা দানেদকে গ্রহণ করেননি রাজপুত্র লিনসিয়ুস, যে দানবকন্যা দানেদকে গ্রহণ করেননি তার রাজ্যের বাসিন্দারাও, সে রাজকন্যা পতিত হয়েছেন নরকপ্রান্তে। সেই দানেককে ফুটিয়ে তুলেছেন রঁদ্যা কামিলের মধ্যে। হ্যাঁ, নগ্ন কামিলের দেহ নিয়ে গড়া তাঁর প্রাথমিক ভাস্কর্য সেই কথাই বলে, কিন্তু রসোত্তীর্ণ শিল্পের শিখরে থাকা শিল্পীও তো কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে নন, দেহাতীত প্রেমের সপক্ষে নন, তা তাঁদের ষোলো

বছরের পরবর্তী জীবনই প্রমাণ দিয়ে যায়। যদিও সামাজিকভাবে স্ত্রীর স্বীকৃতি তখনও দেননি রঁদ্যা, তবু তাঁর বিগত কুড়ি বছরের প্রেমিকা ও সন্তানের মা মেরি রোজকে লুকিয়ে চলতে থাকে রঁদ্যা-কামিল প্রেমপর্ব। বাস্তবতার এক অন্য উদ্ভাস খুঁজছিলেন রঁদ্যা, ছুঁয়ে দেখতে চাইছিলেন পার্থিবের মাঝের অতীন্দ্রিয়লোকের অসীমতা আর ভুলে চলছিলেন আসলে এক তরুণী এক যুবতী তার শরীরভর্তি প্রত্যাশাগুলির পাঠোদ্ধার করে চলেছে গোপনে। ডুবে গিয়ে ভেসে ওঠার তাড়নায় মরিয়াভাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন মননশীল এক প্রৌঢ খড়। কিন্তু রঁদ্যা তো মূর্তি গড়ছেন, মানুষের প্রাণকে দিচ্ছেন পাথরের সচলতা, পাথরের স্মৃতিকে দিচ্ছেন মৃতের সম্ভাবনা। একদিকে মেরি রোজের মতো শিল্গজ্ঞানহীন মডেলের সাথে তাঁর দীর্ঘকালীন সম্পর্ক, যে কিনা রঁদ্যার সুখদুঃখের কান্ডার্‌ আবার অন্যদিকে অষ্টাদশী তরুণীর ঠোঁটে খুঁজে ফেরা অনুকূল মূর্তির ঠাঁট। নারায়াণ সান্যাল একেই বলেছেন – ‘ঘরের কোণে ভরা পাত্র’ আর ‘ঝরনাতলার উছলপাত্র’ দুটোই দরকার শিল্পী অগুস্ত-এর। গঙ্গা প্রাণদায়িনী, গঙ্গা জীবন সঞ্চারিনী; কিন্তু প্রেম যমুনার নবঘননীলাঞ্জছায়াও যে শিল্পীর প্রয়োজন। Venus Coelestes আর Venus Naturalis! কেউ কারও কম নয়। দু নৌকোয় পা রেখে চলেছেন অগুস্ত রঁদ্যা”। ১৮৪৩এ রঁদ্যার বয়স তখন তেতাল্লিস আর কামিলের উনিশ। প্রথিতযশা শিল্পী তখন রঁদ্যা আর শিক্ষানবীশ কামিল নিজের পায়ে দাঁড়াতে আসা এক স্বনির্ভর যুবতী। অ্যানে হিগনেট তাঁর ‘মিথ অফ ক্রিয়েশন’ এই অসম প্রেমের স্বপক্ষে লিখছেন -- “He represented not only the success she desired, but also the success of desire. She wanted to be a sculptor in her own right, and every young artist then took the interest of an eminent senior artist as a good sign that one day he or she too would be famous….. Nor does anyone wonder why Rodin was drawn to Claudel, although for different reasons. She was a beautiful young woman who was willing to have an affair withut demanding the usual bourgeois feminine rewards of marriage, a household, children and social status.She freely gave herself as the object of his desire…..Rodin was also seduced by Claudel’s artistic gifts, and his mind as well as his emotions engated onver the years by an intellectual dialogue with her and the potential to become a sculptor in her own right”. --অ্যানে হিগনেটের বক্তব্য অনেকাংশে সত্য মেনে নিলেও বেশ কয়েবার গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং জন্মদানের পর নিজের সন্তানকে দান করে দেওয়ার ঘটনা কোথাও আধুনিকা কামিলকেও শেকড়ের দিকে টেনে ধরেছিল, স্বাধীন সাবলম্বী নারীও রক্তপাত আর আঘাতগুলোকে লুকোতে অবলম্বন খুঁজছিল দাম্পত্য জীবনের সামাজিক স্বীকৃতির। কিন্তু রঁদ্যা তো বিয়ে করবেন না, তাঁর মানসকমলে তো বাঁধা বলে কিছু নেই; মানুষটিকে, ত্বক ও চামড়ার কারিকুরিটিকে ছুঁতে ছুঁতে তাঁর চিরন্তন রস যে অবিচিত্র নির্জীব। ‘দু হাতের দশটা আঙুলে মডেলের কন্ট্যুর, তরঙ্গভঙ্গ’ অনুভব করে দর্শনেন্দ্রিয়কে আটকে স্পর্শনেন্দ্রিয়ের সর্বস্বতাতেই রঁদ্যা খুঁজে নিতেন তাঁর সৃষ্টিকে। তিনি চাইতেন মডেল অস্থির হয়ে উঠুক, বিচ্ছিন্ন না থেকে আদানপ্রদানের হয়ে উঠুক, কেবল মুখাকৃতি বা দৈহিক অবয়বের মধ্যে নয়, রঁদ্যা তাঁর শৈল্পিক স্বরূপে পৌঁছতে শিল্পী ও কারুকর্মীর মাঝের সেই প্রেরণা নামের রূপকথাগুলোকে গুলিয়ে দিতে চাইতেন। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিল্প ও দেহতত্ত্ব’ প্রবন্ধে বলছেন -- “ঐতিহাসিকের মাপকাঠি ঘটনামূলক, ডাক্তারের মাপকাঠি কায়ামূলক আর রচয়িতা যারা তাদের মাপকাঠি অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়ামূলক। ঐতিহাসিকের রচনা করতে হয় না, তাই তার মাপকাঠি ঘটনাকে চুল চিরে ভাগ করে দেখিয়ে দেয়, ডাক্তারকেও জীবন্ত মানুষ রচনা করতে হয় না, কাজেই জীবন্মৃত ও মৃত মানুষের শবচ্ছেদ করার কাজের জন্য চলে তার মাপকাঠি, আর রচয়িতাকে অনেক সময় অবস্তুকে বস্তুজগতে, স্বপ্নকে জাগরণের মধ্যে টেনে আনতে হয়, রূপকে রসে, রসকে রূপে পরিণত করতে হয়, কাজেই তার হাতের মাপকাঠি সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের, রূপকথার সোনার ও রূপোর কাঠির মতো অদ্ভুত শক্তিমান। ঘটনা যাকে কুড়িয়ে ও খুঁড়ে তুলতে হয়, ঠিক ঠিক খোন্তা হলো তার পক্ষে মহাস্ত্র, মানুষের ভৌতিক শরীরটার কারখানা নিয়ে যখন কারবার, ঠিক ঠিক মাংসপেশী অস্থিপঞ্জর ইত্যাদির ব্যবচ্ছেদ করার শূল ও শলাকা ইত্যাদি হলো তখন মৃত্যুবাণ, কিন্তু রচনা প্রকাশ হবার আগেই এমন একটি জায়গার সৃষ্টি হয়ে বসে যে সেখানে কোদাল, কুড়ুল, শূল, শাল কিছু চলে না, রচয়িতার সেই মনোজগত বা পটকাশ, যেখানে ছবি ঘনিয়ে আসে মেঘের মতো, রস ফেনিয়ে ওঠে, রং ছাপিয়ে পড়ে আপনা আপনি”। -- এ যেন রঁদ্যারও চিরন্তন দ্বৈতবাদ, যেখানে আত্মআবর্তিত জাগরণের বাইরেও এক খন্ডিত উপস্থিতি এক শূন্যতার কেন্দ্র। সে অবধি পৌঁছতে স্নেহমোহবন্ধনী মানুষের চলে শেকড় ওপড়ানোর খেলা, আসক্তির শেষেও যে অস্বীকার যে ক্ষীণ ছায়া যে অন্বিত উদার উদাস সেখানেই কোথাও লুকিয়ে থাকে অলিখিত যাপনের গন্ধ। রঁদ্যার সার্বিক শিল্পের মাঝে অন্যতম আলোচিত মূর্তি ‘দ্য কিস’ বা ‘চুম্বন’(১৮৮৮)যার মডেল ছিলেন কামিল, যে মিথুন ভাস্কর্যকে নিয়ে আজও আমরা সন্ন্যাসী রঁদ্যার আলোচনা করি, মরীয়াভাবে খুঁজে মরি দ্রষ্টা রঁদ্যার কল্পনামিতি, তারও গভীরে কি এজাতীয় কুয়াশানির্মিত কোনো বিবর্ণ সূদূর নেই! নেই কোনো মৃত্যুর পরিমার্জনা? এক অসমাপ্ত চুম্বনের মাঝে লেগে আছে এক নারীর আত্মকথন, রুগ্ন অসুখী একাকীত্বের এক অলিখিত ব্রহ্মান্ড। মুখের সামনে মুখ এনে যেখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে কেবল এক মুখ, কেবল এক আত্মনিবেদনের আবেগিত খেদ! এই অনবদ্য মিথুন ভাস্কর্যের উপজীব্য আসলে দান্তের ইনফার্নোর দুই চরিত্র পাওলো আর ফ্রাঁসেসকা, যারা সম্পর্কে দেওর ও বৌদি। জিওভান্নি ম্যালাটেস্টার ভাই পাওলোর প্রেমে পড়েন ফ্রাঁসেসকা, যার প্রতিদান দিতে হয় স্বামীর হাতে তার মৃত্যু দিয়ে। ল্যান্সালট আর জিওনিভেরের গল্প পড়তে পড়তে তাদের প্রণয়পর্বের শুরু আর তাই রঁদ্যার মূর্তিতেও পাওলোর হাতে রয়ে গেছে সে বইয়ের কিছু অংশ। তাদের প্রণয় আদিযুগের অবৈধ, রঁদ্যাও এ মূর্তি পরিকল্পনা করেছিলেন ‘নরকের দ্বার’এ সংস্থাপনের উদ্দেশ্যে। কামিল ছিলেন নারী মডেলটি এবং পুরুষ ও নারী মডেলটিকে পৃথক পৃথক বসিয়ে রঁদ্যা ভাস্কর্যটিকে গড়েন। ১৯৮৯এ প্রথম প্রদর্শনীতে কামিলের ভাই পল ক্লদেল উক্তি -- “the man is so to speak attablé [sitting down to dine] at the woman. He is sitting down in order to make the most of his opportunity. He uses both his hands, and she does her best”। এমনকি পরবর্তীকালের শিল্পসমালোচক ও সংগ্রাহকের চোখেও এ এক অতীন্দ্রিয় আবেগঘন চুম্বনের দৃশ্য হিসেবেই বারবার সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু যেখানে গিয়ে আমাদের স্থির হয়ে যেতে হয়, ভাবতে হয় ভাস্কর্যের প্রদর্শিত চেহারার সেই চেতনারঞ্জিত শূণ্যতার কাছে তা হলো মিলনআবেগঘন চুম্বনতিয়াসী নারী ও পুরুষের মাঝের চুম্বনটি কই? হ্যাঁ, একটা ইন্টারাপটেড ইমোশন যেখান থেকে পাওলো আর ফ্রাঁসেসকার পরিণতি হয়, নরকে ঠিক সেখান থেকেই কি কামিল রঁদ্যার পরিণ তি এক অতৃপ্ত মিলনে? এই একটিমাত্র স্বতঃস্ফূর্ত ও সম্পূর্ণ চুম্বনই কি আক্ষেপ করে গেছেন কামিল তাঁর ষোলো বছরের রঁদ্যাপ্রণয়ে! একটিমাত্র চুম্বনই কি গর্ভস্তব্ধ ভাষ্য হয়ে উঠেছে তার শেয তিরিশ বছরের উন্মাদ আশ্রমে! মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয়, রঁদ্যা কি এই মূর্তি বানাতেও কামিলকে ছুঁয়েছেন তাঁর চিরাচরিত দর্শনেন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে স্পর্শনেন্দ্রিয়ের মাদকতায়? ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিলেন অধর ওষ্ঠ আর ফুল ফোটার সেই শব্দহীন মুহূর্ত! গান বাঁধার সলাজ সত্য! রঁদ্যার আশ্রয় কি সে মুহূর্তে কেবলই ছিল পাথরের অতিপ্রাকৃত অকালটে নাকি শরীরের নিচের শতাব্দীর আত্মসমপর্ণে! কামিলকে কী ভেবেছিলেন রঁদ্যা? স্কাল্পচারের পাথর ছেনি হাতুড়ি নাকি স্রেফ এক মডেল, নাকি ফ্রাঁসেসকা? কীই বা ভেবেছিলেন কামিল? স্ত্রী–প্রণয়ী, নাকি এক অবহেলিত পরিত্যক্ত অভাগা মডেল, মূর্তির শেষে যার মূল্যায়ন কেবল এক বিশ্ববন্দিত আর্টিস্টের অ্যানাটমিতে! ‘দ্য কিস’ বা ‘চুম্বন’ সম্ভবত মডেল কামিলাকে নিয়ে রঁদ্যার প্রতিষ্ঠিত সর্বোত্তম মূর্তি। ঘাড় বেঁকিয়ে আসক্ত আগ্রাসী নারী তুলনায় দ্বিধাজড়িত পুরুষকে চুম্বনে আগ্রাসী, অথচ চুম্বনের অপরাধ নিয়ে অপারগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘ অপেক্ষা। এক নিষ্প্রাণ হৃদয়কে আঁকড়ে ধরে, বাস্তবকে ঠেলে দিয়ে পার্থিব ধূলোর পথে, স্রোতে ও আবর্তের প্রলাপ প্রহেলিকার পথে কামিল যেন একাই পুড়ে চলেছে শতাব্দীর চিৎকারে, ডুবে চলেছে জাহাজডুবির শব্দে, একাঙ্ক নাটকের ফুলের গাছ রঁদ্যাকে ঘিরে কেবল মূল কান্ড শাখা ও পত্র যে কোনো রূপেই ইন্দ্রিয়গোচর হতে রাজী হতে চেয়েছেন কামিল, স্বীকৃতি চেয়েছেন রঁদ্যার। স্বীকৃতি চেয়েছেন সমাজের। আবহমানে গলে মিশে যাওয়া এক যুবতী জড়িয়ে ধরতে চেয়েছেন একটিমাত্র অস্তিত্বকে, একটিমাত্র বিশ্বাসকে। পাথরের পরিতৃপ্ততা পেরিয়ে যে যেতে পারেনি নারীর অন্তঃপুরে, তার কাছেই ভিক্ষা করেছেন তামস পথনির্দেশিকা-আকাঙ্ক্ষা ও অনিকেত অচলতার মাঝে দাঁড়িয়ে কোনো পরিচিত মুখ যেন বারবার গেয়ে গেছে, তার বাসনার জগত গেয়ে গেছে-
“হৃদয়ের বনে বনে সূর্যমূখি শত শত।
ওই মুখ পানে চেয়ে ফুটিয়া উঠেছে যত।
বেঁচে থাকে বেঁচে থাক শুকায়ে শুকায়ে যাক,
ওই মুখ পানে তারা চাহিয়া থাকিতে চায়,
বেলা অবসান হবে, মুদিয়া আসিবে যবে
ওই মুখ পানে নীরবে ঝরিয়া যায়!”

রাইনার মারিয়া রিলকে যিনি কিনা দিনের পর দিন রঁদ্যার ভাস্কর্যগুলির প্রত্যক্ষদর্শী, তিনি ‘দ্য কিস’ এর মতো আবেগঘন নারী পুরুষের মূর্তিগুলির উদ্দেশ্যে বলেন-“One does not dare to give it one meaning. It has thousands. Thought glide over it like shadows, new meaning arise like riddles and unfold into clear significance. A heaven is near that has not yet been reached, a hell is near that has not yet been forgotten. Here, too, all splendour flashes from the contact of the two bodies and from the contact of the woman with herself.” রঁদ্যার এই শৈল্পিক উচ্চতা এক শৈল্পিক ওজস্বিতা থেকে দেখা রিলকের, তাই হয়তো মূর্তির মাঝে বসে থাকা মডেলের পাঁজের পরম শূন্যতা অনুভাবিত হয় না। অনুভাবিত হয় না অতল ঝিনুকের মতো তলিয়ে যাওয়া সবুজগুলো। শিল্পী সে বরাবরই আত্মকেন্দ্রিক, আকৃতি থেকে সে রস সৃজন করে বিশ্ব প্রতিকৃতির আর ভিক্ষাপাত্রে মাধুকরীর মতো পড়ে থাকে ক্যানভাসের বাইরের প্যালেটের বাইরের বুনিয়াদী মুখগুলো, বুকের বোতাম খোলা মনগুলো।

রঁদ্যার ভাস্কর্যের এক বিশেষ শৈলী হলো ভাস্কর্যের অংশবিশেষ অসমাপ্ত রেখে যাওয়া যার সমাপ্তির দায়িত্ব দর্শকের। মূর্তির মাঝের এই মধ্যাহ্ন তন্দ্রাই যেন ভিতরকার দ্বন্ধকে অমূর্তকে ক্রম উন্মোচিত করতে থাকে, ভেতরের নিরুদ্দেশ যাত্রাগুলোকে নীরবতার কথাগুলোকে আশ্চর্য লোকাভরণগুলোতে সজীব হয়ে ওঠে অমুদ্রিত ইতিহাস, তাঁর অন্বেষণের সীমান্তে এসে পরম সম্পূর্ণতা কোথাও যেন এই অসম্পূর্ণতাগুলোতে সূদূরগুলোতেই মহাকালের ডিঙা ভাসিয়ে রেখেছে। রঁদ্যার কাজগুলো কামিলের সংস্পর্শে এসেও বিস্তর প্রসারিত হয়েছিল, কামিলের নিজস্বতা থেকে রঁদ্যা শিখেছিলেন মূর্তির মাঝের সেই না মিলিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিটা, গম্ভীর মহিমাময় এবং বহুবর্ণময় স্থাপত্যগুলি থেকে বেরিয়ে এসে কামিলের প্রভাবে রঁদ্যার কাজগুলো হয়ে উঠেছিল আরও বেশি বাস্তবমুখী যেখানে গোলার্ধের কথা আছে, বিরতীহীন যোগাযোগের কথা আছে, নারী পুরষের ভাস্কর্যগুলিতে নীরবে হাত ধরাধরি করার মাঝে চুম্ববনের মাঝেও সেখানে লেগে আছে এক চরম আস্তিক্যবোধ, শরীরের অন্য ঢাল বেয়ে নেমে আসা এক অনুভবী শরীর, পাথর থেকে বেরিয়ে এসে যে দীর্ঘদিন ধরে চিনতে চাইছে নিজেকে, সৃজন থেকে বেরিয়ে এসে চিনতে চাইছে অবরুদ্ধ স্ব-কে। কামিলের সাথে পরিচিত হবার আগে ও পরের কাজগুলোকে তুলনা করলেই খুব স্পষ্টভাবে এই পরিবর্তন রঁদ্যার সামগ্রিক কাজে লক্ষ্য করা যায়। একদিকে কামিল করে গেছেন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সব রকমের প্রচেষ্টা। আর অন্যদিকে মেরী রোজ, কামিল ক্লদেল, মডেল লিজা বা ডাচেস অফ সোয়াজেলের মতো একাধিক নারী ও মডেলের সাথে তাঁর প্রণয় কোথাও যেন সর্মপণের থেকে সান্নিধ্যের থেকেও স্ব-কে প্রতিষ্ঠা করায় শিল্পীসত্ত্বার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় ছিল বিশ্বাসী। আসলে প্রাণের থেকেও পাথরের প্রতিই যেন তাঁর চিরকালীন আলিঙ্গন। নুড়িপাথর কাদা আর মাটিই যেন তাঁকে নিয়ে গেছে সেই একাকী প্রার্থনার কাছাকাছি, নিয়ে গেছে মূর্তির চেয়ে বিমূর্তির কাছাকাছি। মানুষের চাইতে বড় হয়ে উঠেছে তাঁর শিল্পী সাজের কথা, নিরীশ্বর প্রতীতির কথা। চামড়া মাংস আর নগ্ন দেহের পরিচ্ছদের আঁধার খন্ডে খুঁজে বেড়ানো কেবল এক পাথরের মূর্তি, যেখানে হৃদয়ের শব্দ নেই, বিসর্পিল সুঠাম তনু আর নারী শরীরের ঘ্রাণের নিচে কোনো বিরল নির্ভরতা নেই সেখানে; শিল্পী স্রষ্টা মাত্রই কি এমন! নীরন্ধ্র পূর্ণ প্রেম বলতে যেখানে কিছু নেই, যা আছে তা কেবল চিরাচরিত প্রশস্তিতে হারিয়ে যাওয়ার আশংকা! কেবল প্রতিবিম্ব আর প্রতিবিম্বের দ্বারাই বধির ও অবিভাজ্য মানুষটি থেকে ক্রমাগত হারিয়ে যাওয়া আরেকটি প্রেম আরেকটি আলুথালু কবন্ধ লাল টুকরো আর একটি অধৈর্য উত্তেজনার দিকে। আরে এখানেই স্রষ্টা কোথাও মেতেছেন তাঁর আত্মানুসন্ধানের বিশ্লেষণে, সামনে ফেলে রেখেছেন ঘষা কাচ, যেখান থেকে দেখা সম্ভব নয় কীভাবে ছেনি ও হাতুড়ির ঘায়ে কেটে চলেছে কোনো যুবতী শরীরের সাদা হাড়, রক্ত ক্লেদে মাখামাখি হয়ে উঠছে নগ্ন নারী, যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠছে ভালোবাসা আর নির্ভরতার প্রাকৃতিক পুষ্টি। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে সম্পর্কের প্রিয় গন্ধ। ‘Large Clenched Hand With Suppliant Figure’ বা ‘আগ্রাসী হাত ও বন্দিনী’ ভাস্কর্যে রঁদ্যা যখন একটি নারীকে একটি প্রকান্ড হাতের সাথে মিশিয়ে দেন, অক্ষম করে তোলেন, আড়ষ্ট করে তোলে্‌ অনড় ও শূণ্য করে তোলেন নারীর রক্তবাহীশিরাগুলিকে একটি পুরুষ হাতের কাছে এসে। বিশ্লেষকদের কাছে তা হয়ে ওঠে ঊনবিংশ শতকের অবক্ষয়ী প্যারী নগরের পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখা, কোনো একটা মুখ সেখানে ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায়। কিন্তু জীবনকে তো আরও একভাবে দেখা যায়! আর আমরা যদি তা পাথরের বাইরে এসে প্রবঞ্চনার নিরিখে দেখি, যদি ভালোবাসার নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রায় আপসের স্বেচ্ছানির্বাসনে দেখি, তবে কি কামিল ক্লদেলও রঁদ্যার কাছে হারতে আসেননি তাঁর চেতনযুদ্ধে! তাঁর অনুগত অনুভূত নিরীহ আবিষ্ট অবস্থা নিয়ে লাল চুলের কোনো এক বিশ্ববন্দিত পুরষের কাছে সস্তা সঙ্গম কিংবা দামী পাথরের কাছে অবাঞ্ছিত অতিথি হতে আসেননি! আলতো জড়ানো এক পালকের শরীরকে এভাবেই কি কব্জির প্রশংসাই খাঁচার পাখি বানাতে চাননি রঁদ্যাও? যে তাঁর কাছে কেবল মূর্তি কেবল মায়ামৈথুন সেখানে মাংস ডাকের নিচে অদ্ভুত চিৎকার নিয়ে দৌড়ে যাওয়া কোনো মেরুদণ্ডের খোঁজ রঁদ্যা পান না, শুনতে পান না কুঁড়েঘর সাজাবার মতো আঞ্চলিক পাখির কোনো অভিসার, কেবল নরকের দ্বারে বসিয়ে আসেন প্রেমের ক্ষতমুখগুলোকে, নির্দোষ বালিকার বিস্মৃত যন্ত্রণাগুলোকে। প্রেমিক ও তৎকালীন পারীর সরকারী আর্ট কলেজ ব্যো-আর্তের ছাত্র বার্নুভ্যাঁর কাছ হতে পরিত্যক্ত হয়ে রঁদ্যার প্রিয় ছোড়দি এবং তাঁর শিল্পী জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেরণা মেরী সন্ন্যাসিনী হতে চলে গিয়েছিলেন কনভেন্টে। আর মাত্র ছমাস সন্ন্যাসিনীর জীবন অতিবাহিত করে কঠিন পেরিটোনাইটিস রোগে মারা যান। কামিল ক্লদেলও তাঁর থেকে চব্বিশ বছরের এক প্রাক্তনীর প্রেমে প্রবঞ্চিত হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অস্বীকৃত হয়ে জীবনের অন্তিম তিরিশ বছর কাটিয়ে গেলেন উন্মাদ আশ্রমে। একে আমরা কী বলব? এক নারীর ভালোবাসা! নাকি এক পুরুষের ব্যর্থতা!

ক্লাসিকাল শৈলীকে অস্বীকার করতেই, নাকি গ্রীক শৈলী থেকেই ইম্প্রেশনিস্ট উত্তরাধিকার লাভ করেন রঁদ্যা! রেঁনেসা শৈলীতে দাভিদ যে ভাস্কর্য গড়েছিলেন তাকেও তিনি ভাঙতে চেয়েছেন নৈতিক শৃঙ্খলার বাইরে সমাজের অশ্লীলতার বাইরে গিয়ে। সাধনার দ্বারা অনূদিত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিক থেকে বেরিয়ে এসে কল্লোলগোষ্ঠীর শিল্পজাহ্নবীকে রঁদ্যা বহাতে চেয়েছিলেন মানুষের শাশ্বত অস্তিত্বের প্রেক্ষিতে। পৌঁছতে চেয়েছিলেন পোশাকের ভেতর আলোছায়ার ভেতর, মানুষের সমস্ত সম্ভাবনা ও সুরার ভেতরের শূন্যতা অবধি। আয়নার ভেতর দিয়ে দেখতে চেয়েছেন সনাতনী অস্তিত্বগুলোকে, আর তাই নগ্নতা বা ন্যুডিটি তাঁর কাছে হয়ে ওঠে একমাত্র কম্পোজিশন।



পূর্ণ নির্মোহে পৌঁছতে চেয়েছেন রঁদ্যা, প্রত্যক্ষের অপরে পৌঁছতে চেয়েছেন। পৌঁছতে চেয়েছেন রক্তশূন্য অতৃপ্ত তৃষ্ণা অবধি। রঁদ্যার বৈপ্লবিক চিন্তাধারার বীজ যিনি উপ্ত করেছিলেন, তাঁর শিক্ষক ওরাস লেকক দ্য বোয়াবোদ্রান, যিনি সেই শৈশবেই শিখিয়েছিলেন চোখে দেখে হাত দিয়ে আঁকে ড্রাফটসম্যান নকশানবিশ; কিন্তু শিল্পী দেখে হৃদয় দিয়ে আঁকে। মস্তিষ্ক দিয়ে সেই ধারাকেই তাঁর শিল্পমুক্তি তাঁর চিত্তবিপ্লবের অপরিহার্য অঙ্গ করেছিলেন রঁদ্যা। কিন্তু লাল মাংসের ভেতরকার আদিম কুয়াশা খুঁজে পেতে গিয়ে কোথাও কি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন কুমারীর তরল কুসুমিকা! আকাঙ্ক্ষা ও কামনার কাছে নিবেদন করেছিলেন শ্বাসচাপা মানুষগুলোকে! শরীরকে মুক্ত করতে গিয়ে স্মৃতিকে কি আটকে ফেলছিলেন বড়ো আকারের শূন্যের মধ্যে! পাথর ঘষে ঘষে কি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছিল মানুষের শরীর! ন্যাংটো স্কেচের মাঝে যেভাবে নিবিড় বেজে ওঠে শিল্পীর নৈঃশব্দতা, ঠিক সেভাবেই কি হ্রস্ব হয়ে ওঠে না তাঁর ব্যক্তিগত নৈতিকতা! যে রঁদ্যা ন্যুডিটির মাধ্যমে হেজে মজ়ে যাওয়া পৃথিবীর বাষ্প দেখাতে চাইলেন, সেই রঁদ্যাই লুকিয়ে রাখতে চাইলেন ১৯৮২ থেকে ১৯৯৮ ষোলো বছরের কামিল রঁদ্যার প্রণয়পর্ব, সেই রঁদ্যাই কামিলকে নির্দেশ দিলেন একাধিকবার গর্ভপাতের, সেই রঁদ্যাই একই সাথে রোজ ও কামিলের সাথে গোপন সম্পর্কের মান্যতা খুঁজে পেতে চাইলেন। কিন্তু কেন? এসব প্রশ্নই রহস্য ও বিষাদের দিকে যায়, মৃতের সামনে খুলে দেয় জীবিতের বিবর্ণ ঘুলঘুলিটা, আর জীবিতের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় মৃতের মিথ্যা যাপনকে। শরীর থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন নগ্নতাকে কিন্তু সত্যিই কি তিনি পেরেছিলেন নিজের শরীর থেকে পোশাক-আশাকে ঢাকা সংঘের সমাজের নীরব অনুমোদনকে? পেরেছিলেন কি বরফের বাক্স সরিয়ে আঁকড়ে ধরতে সেই শায়িত নারীকে, যে কিনা সামান্য এক জীবন চেয়েছিল, চেয়েছিল ডানা ঝাপটানোর সহজ বারান্দা। নারায়ণ সান্যাল তাঁর ‘রঁদ্যা’ গ্রন্থে ‘রঁদ্যার হাত ও পুতুল’ মূর্তিটিকে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, মূর্তিটির ভেতর দিয়ে অবক্ষয়ী পারীতে নারীর মূল্য নতুন করে নির্ধারণ করতে
চেয়েছেন রঁদ্যা; পুরষের সাথে অসমপাংক্তেয়ে টিকে থাকা ‘নারী পুতুল’কেই শিল্পী যেন তুলে আনতে চেয়েছেন নতুনভাবে। হাত পা নেই কেবল কবন্ধবিশিষ্ট এক নারী, আর পুরুষের হাতটি বাস্তবের মানুষের হাতের চেয়েও স্পষ্ট বাস্তব, নিজের হাতের ছাঁচই নাকি তুলেছিলেন রঁদ্যা এই মূর্তি বানাবার প্রয়োজনে। নারায়ণ সান্যালের মতে পুরুষের হাতে ধরে থাকা নারীর পুতুল অস্তিত্বই কেবল নয়, কোথাও যেন মেরী রোজ বা কামিলের মতো একাধিক নারীর প্রতি ব্যবহারের অনুশোচনাও অদ্ভুত ধূসর হয়ে জড়িয়ে আছে মাটি নিয়ে পাথর নিয়ে পরীক্ষিত হাতময়, জড়িয়ে আছে আত্মধিক্কার, নিজেকে নিঁখুত ভাবে চেনার পর ভয়াবহ অমোঘ সে অপরাধবোধই কোথাও এ জাতীয় মূর্তিতে পূর্ণতা খুঁজছে। কেবল একটি মূর্তির বিশ্লেষণে নারায়্ণ সান্যালের যুক্তির অকাট্যতা যেমন প্রশ্নহীন নয়, তেমনি রঁদ্যার মানসিক ভাষাকে বোঝার আকারে প্রকারে বড় একটা ইতর বিশেষ ঘটে না। কিন্তু দীর্ঘ ভারী ছায়ার মতো প্রশ্ন থেকেই যায়, একজন ভাস্কর একজন শিল্পী একজন দ্রষ্টার আত্মনির্মিত জগতের বাইরে উদ্বাস্তু প্রেমিক হওয়ার বিষয়টির প্রতি। প্রেম সেখানে কেবল এক উদ্দেশ্যহীন উদগতিমাত্র অথবা বলা যেতে পারে প্রেম সেখানে পাথরে যাওয়ার এক ছিদ্র, এক কৌশল, হৃদয়ের কোষ থেকে মস্তিষ্কের কোলাজে এক একক যাত্রা।

১৮৯৯ থেকে ১৯১৩ অবধি কামিল কাই বোরঁতে তাঁর নিজের স্টুডিওতে কিছু কাজ করেন স্বাধীনভাবে। কিন্তু পারিবারিক দিক থেকে তাঁর মা এবং ভাইয়ের অসহযোগিতা বারবার হতাশ করে কামিলকে। যদিও বাবা লুই প্রঁসপার সহযোগিতা করে গেছেন আজীবন, কিন্তু গোঁড়া ক্যাথলিক মা আর ভাই তাঁর বিবাহবর্হিভূত সম্পর্ক ও গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। পাশাপাশি ১৯০৫এ একক প্রদর্শনী করেন কামিল, আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই যুগের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা তাঁর শিল্প তাঁর ভাস্কর্য মেনে নিতে পারেনি রক্ষণশীল সমালোচকরা। ভেঙে পড়েন কামিল। পুড়িয়ে দেন, ভেঙে দেন তাঁর অধিকাংশ ভাস্কর্য। বড় জোর নব্বইটির মতো তাঁর আনক্যাটলগড কালেকশন র‌য়ে গেছে শিল্পপ্রেমীদের জন্য। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে, ধরা পরে প্যারানইয়া। বিষাদগ্রস্থতায় আর ভালোবাসার যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে রঁদ্যা তাঁর পরিকল্পনা চুরি করেছেন বলেও অভিযোগ করেন কামিল। আসলে যন্ত্রণা ক্লান্তি দুর্বলতা তাঁকে ভেতর থেকে শূন্য করে ফেলেছিল, এক রক্তস্রাবী উন্মাদের জগত ঘিরে ধরছিল তাঁকে। নিজেরই ভেতর এক অক্ষম আত্মজীবনী হয়ে পড়ছিলেন কামিল। ১৯১৩এর মার্চ-এ মারা গেলেন কামিলের বাবা, আর তিন দিন বাদে ১৯১৩ সালেই প্রথমে ভিল এভরার্ড ও পরে মন্টফ্যাবেটের উন্মাদ আশ্রমে কামিলকে ভর্তি করে দেন কামিলের মা ও ভাই, আর ১৯৪৩এ মৃত্যুর আগের শেষ তিরিশ বছর তাঁকে দেখতেও যাননি তাঁর পরিবারের কেউ। সমাজ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল কামিলকে। একটি নিষ্পাপ শিল্পী হৃদয়কে, একটি অসাধারণ প্রতিভাকে ভরিয়ে রাখা হয়েছিল ভারী অবহেলা আর করুণা দিয়ে। উন্মাদ আশ্রম থেকে ছাড়া পাওয়ার আর্জি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন কামিল, যার উত্তরে তাঁর মা কামিলের চিকিৎসককে লেখেন -“She has all the vices. I don’t want to see her again.” এমনকি কামিলের মৃত্যুর পরও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি এবং তাঁর মৃতদেহও উন্মাদ আশ্রমের গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়। ১৯০২এ তাঁর শেষ কিছু মূর্তির মাঝেই কামিল তৈরি করেন গ্রীক ডেমি গড পার্সিউসের মেডুসা বধের মূর্তি, আর নিজের মুখের আদলে বানান মেডুসার মুখ। ভয়ংকর মেডুসা যার চোখের দৃষ্টিতে যে কেউ পাথরে পরিণত হতে পারত, তাতেই তিনি বসিয়ে দিলেন স্নিগ্ধ এক নারীমুখ। প্রণয়ে প্রতারিত হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে একি তাঁর নিজের শিল্পের প্রতিই বীতশ্রদ্ধতা? একি তাঁর ইন্টারনাল সাফারিংস, ইন্টেরিওর সলিটিউড! যার উত্তর কোনো নারী দিয়ে গেল না, বরং এক ডুমড রোমান্সের শেষে কোনো এক পুরুষের ডান হাতে সে কেবল রেখে গেল এতসব প্রশ্ন!

মহাকালের কী অদ্ভুত পরিহাস! যে মানুষটাকে জীবিত অবস্থায় সমাজ ফেলে দিল বাতিলের খাতায়, বেঁকে চুরে দুমড়ে মুচড়ে ফেললো, ছিবড়ে করে মাড়িয়ে চলে গেল, তাকে নিয়েই ১৯৮৯ আর ২০১৩তে দু’দুটো চলচ্চিত্র হয়ে গেল পরিচালক ব্রুনো নুইটেন আর ব্রুনো ডুমন্টের পরিচালনায়। নমিনেশন পেল দু’দুটো অ্যাকাডেমি পুরস্কারের; ১৯৯৮এ কমপোজার জেরেমি বেক পরিচালনা করলেন অপেরা সলিলিক ‘ডেথ অফ এ লিটিল গার্ল উইথ ডোভস’। মেরী রোজ ব্যুরেকেই অগুস্ত রঁদ্যার জীবনের সে অর্থে প্রথম ও শেষ বান্ধবী বলা যেতে পারে। যিনি তাঁর দীর্ঘদিনের মডেল হয়েছিলেন। মডেল লিজাকে বাদ দিলে তাঁর প্রথম অনাবৃতা নারীমূর্তিটিও মেরী রোজের, যার নাম দিয়েছিলেন ‘Bacchante’, যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে প্রেমের দেবতা ‘রতি’। ‘ফেমি হেড’ মূর্তি থেকে শুরু করে একাধিক নগ্ন অবয়বের স্বাক্ষর মেরী রোজ এবং চব্বিশ বছরের রঁদ্যার সাথে সতেরো বছরের মেরী রোজের সাক্ষাৎ পরবর্তী যে তথ্যটি সবচেয়ে চমকপ্রদ, তা হলো রোজ তাঁর সন্তানের মা হওয়া স্বত্তেও সহধর্মিনী হতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল তিপান্ন বছর। হ্যাঁ বিবাহ রাত্রে রোজ ব্যুরের বয়স ছিল সত্তর আর রঁদ্যার সাতাত্তর। মাত্র উনিশ দিনের স্বীকৃত বৈবাহিক জীবনযাপনের পর মেরী রোজের মৃত্যু হয়। বিবাহের প্রতি রঁদ্যার চিরকালীন অনিচ্ছা এবং সহশিল্পীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের গোপনীয়তায় সমর্থন যে তাঁর ছিল, তাঁর পারস্পরিক সম্পর্কগুলি থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি তাঁর চৌষট্টি বছর বয়সে ডাচেস অফ সোয়াজেল নামের মধ্যবয়সী নারীর প্রতিও তিনি আকৃষ্ট হন। আর কামিল তো সেখানে অষ্টাদশী তরণী! রোজের বাইরে প্রায় প্রতিটা সম্পর্কই রঁদ্যার কাছে হয়ে উঠেছিল শরীর, কয়েকটা আইসোলেশ্‌ যা থেকে উঠে আসত পাথরের আকুতি। সুঠাম নারীর সাদা ঐশ্বর্য খুঁজেছেন রঁদ্যা, কিন্তু ছেনি হাতুড়ির শব্দে হারিয়ে যাওয়া সেই হলুদ ঝাঁঝালো গন্ধ! আলোর নিচের সেই অক্ষয় অন্ধকার! রঁদ্যাকে তো দান্তের ডিভাইন কমেডি পড়তে শিখিয়েছিলেন ফাদার এইমার্ড, শিখিয়েছিলেন নরকের প্রবেশদ্বারের মুখোমুখি হতে, ঠিক যেভাবে লেকক শিখিয়েছিলেন পবিত্র নরকদ্বারের ধারণা, যা কেবল অন্ধকার নয়, যেখানে অন্ধকারের শেষে রয়েছে আলোর অনুমান। কিন্তু কামিলকে কে শেখাবে, কে জানাবে, কেবল নরকের প্রবেশদ্বারে নয়, ভালোবাসা নামের প্রেম নামের এই সহজ শব্দের শুরুতেও কোথাও যেন অন্য রঙে লেখা আছে -“Abandon all hope, ye who enter here”। সবটুকু রোদ গিলে কেবলই এক পৌরাণিক বধির আঁধার।

ইবসেনের নাটকের শেষ দৃশ্যে গড়িয়ে আসা নিঃশব্দ হিমবাহে ডুবে যেতে থাকা হারিয়ে যেতে থাকা ইরিন আর রুবেককে দেখে যেভাবে মাইয়া আপন মনে বলে উঠেছিলেন, Pax Vobiscum! Pax Vobiscum! (Peace be with you), কামিলের অসমাপ্ত যাপনের দিকে, যন্ত্রণাদীর্ণ এক নারীর চিরস্থায়ী শূণ্যতার দিকেও কি আমাদের রয়ে গেল এই একটিইমাত্র উচ্চারণ -

Pax Vobiscum!

Pax Vobiscum!






০৬ রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রাগৈতিহাসিক প্রতীক্ষা



আমি নৈঃশব্দ্যের নিরাময় নিয়ে খানিকটা তোলপাড়। সময়ের তরঙ্গ মুছে অন্তরঙ্গ হতে চাইছি একলার সঙ্গে। চাইতে গিয়ে দেখি অলিরহিত জীবন থেকেও কীভাবে ফোঁটা ফোঁটা মৌ। নিঝুম দুপুরের গায়ে গুঞ্জন নামাচ্ছে। কিছুটা জলজ। কিছুটা গহন। পর্যাপ্ত আলো পেলেই জলমর্মর উঠবে বুকের ভেতর। নিঃশব্দে জেগে উঠবে শব্দনির্ঝর। নতজানু খেরোখাতা অপেক্ষায় থাকে।

আমি নৈঃশব্দ্যের মৌন চরিত্র নিয়ে ক্রমাগত যাতায়াত করি বিশেষ্য থেকে বিশেষণে। কখনো বা বিশেষণ থেকে বিশেষ্যে। মূক থেকে মুখরের দূরত্ব মাপি আলোকবর্ষ স্কেলে। নিভে যাওয়া নক্ষত্রমণ্ডল থেকে কে যেন ডেকে ওঠে। মনে পড়ে বিহানবেলা। পরীপা। মায়াকানন। মনে পড়ে উচ্ছল প্রহরের পিঠে আলতো আঙুল রাখা। হাওয়ায় এঁকে রাখা হরিণচোখ। কাজলায়িত বিভ্রম। এখন তাদের সবার গায়ে সেঁটে রাখি অলীক বিশেষণ। ফলত খেরোখাতার অপেক্ষা শেষ হয় না।

আমি এক নিভৃত দরজা দেখেছি অতীতের চিলেকোঠা থেকে বর্তমানের কার্নিশ পর্যন্ত। পিছনের পাল্লা খুললেই এক একটা বসন্তকে অঢেল হতে হতে পেরিয়ে যেতে দেখি দাঁড়ি কমা। ছেঁড়াপালে তার ঘূর্ণির ঘোর। চুমুর রহস্য লিখছে নিদারুণ কালবেলা। আমি দাহ সম্পর্কিত সংস্কারগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। দহনের নিমিত্ত জড়ো করে তুলি আকাঙ্ক্ষার মাত্রাগুলো। সংগ্রহে রাখি আসন্ন বার্তার জলীয় সংবাদ। নিদাঘী আকাশ তখনো জল পোড়ায়। আমি কার্নিশে ফিরে এসে হৃদয়কে বিনিময় করে নিই অলখ শব্দবন্ধে। বীক্ষণে রাখি প্রতিটা ক্ষণ। প্রত্যয়ী মুহূর্তগুলো জড়ো হয়ে আসে বুকের কাছে। খেরোখাতা অপেক্ষায় থাকে।

আমি মেঘেদের নিঃশব্দ গর্ভসঞ্চার দেখে কিছুটা আবেগে কিছুটা মোহে গ্রস্ত হই। জমাট জয়ন্তী শুনি পরতে পরতে। জলজ ভাস্কর্যের নিবিষ্ট ধ্যান। যেন কোনো নিঃসঙ্গ সত্যকে আরবার বলবার এই-ই পথ। এই-ই পাথেয়। ঊষর মৃত্তিকাগড়ানো কান্নায় দেখি নত হয়ে আসে তার গর্ভিত চলন। তারপর শুধু বৃষ্টি। রিম ও ঝিম মিশিয়ে দেদার হতে থাকে তুমুল হতে থাকে। মরিয়া হয়ে ওঠা পায়ের তলার মাটি নরম হতে হতে নহবতে বসে। আমি যেমন খুশি রূপ থেকে রূপকে যেতে থাকি। পিছনে দুলতে থাকে অরূপের অনালোকিত রূপ। এমন অনায়াস এমন অনাহত যেন দৈনন্দিনের হাটে ওই রূপটুকুই মূলধন। রূপের হাটে ধন মানে না জন। তাই ফাঁদ। ধরাধরি। লুকোচুরি। রাতরহস্য নিজেকে সমর্পণ করে নির্জন প্রলাপে। আবছায়া ঘোমটায় পাখিডাক। আড়াল ডেকে ডেকে মাতলানো ঠোঁট নিমেষ হারায় নিভাঁজ ভালোবাসায়। খেরোখাতার মার্জিনে আলতো মায়া অপেক্ষায় থাকে।

আমি ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে কিছুটা বিব্রত। মদির রাতভাষা ন্যুব্জ হয়ে এলে ক্লান্তচরণ সদর খোঁজে। আর আমি ভাবি তার আরণ্যক জন্মকথা। কীভাবে বিপন্ন হয় জনারণ্যে। কীভাবে হস্তান্তরিত হয়ে যায় জেহাদি অঙ্গনে। আমার শীতার্ত আঙুলে যেটুকু রোদকাহিনী আজও তোমার কথা বলে, তাদের বিছিয়ে রাখি নেহাইতে। উল্টে পাল্টে সেঁকতে থাকি ফাংগাসমুক্ত রাখতে। খানিকটা দায়মুক্তও। এভাবেই বেলার দাবি মেটাতে গিয়ে দেখি কখন অবেলা একান্তে ডেকে নিয়েছে অকালের ঝরাপাতা। নিহত হরিতে অসহ্য অবসাদ। দু’এক ফোঁটা গ্লানিও। হিমকুড়োনো বেলায় এইভাবেই শীতযাপন। লেনদেনে বেঁধে রাখা মণিবন্ধে এভাবেই শীতল রক্তস্রোত। খেরোখাতা তখনো অপেক্ষায় থাকে উষ্ণ ঝর্ণার তীব্র প্রপাতের।

আমি কাল ও অকালের মাঝে খানিকটা স্পেস দাবি করি। মহাকালের দামামা বাজে মৃত্যুতোরণে -- কালের কাছে তোমার কোনো ন্যায্য স্বত্ব নেই; গর্ভে তোমার বীজরোপণের মন্ত্র নেই; কেবলই অর্থের হাটে অনর্থের বিকিকিনি। তাই সময়কে পিছনে ফেলে বেরিয়ে পড়ি। ইরাটিক ইরেজারে মুছতে মুছতে চলি অতীতের চলন, বর্তমানের বলন আর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আগমনীগুলো। অনন্তের হাটে বাসা বাঁধে এক অচিন পাখি। ভাঙা স্বপ্নে রং দেয় ডানা বসায়। রঙের ভেতর আমি লাল সবুজ বাদ দিই। আঙুলে লেগে যায় গাঢ় কালকূট রং। তীব্র হলাহলে ক্রমশ নীল হয়ে আসে সমস্ত শরীর। হৃদি উপচে কয়েক ফোঁটা গরল গড়িয়ে পড়ে নরম মাটিতে। রোপিত হয় বিষবৃক্ষ। সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি থেমে যায়। মৃদু বাঁশরি বাজে গহনে কোথাও। আমি হাতড়ে বেড়াই দিগনির্ণয়ের প্রথাসকল। ধূসর খেরোখাতা তখনো রঙের অপেক্ষায়।



আমি দিক বা বিদিক নিয়ে এখনও কিছুটা স্বেচ্ছাচারে। তোমার ওই তির্যক ভঙ্গি ক্ষয়া চাহনি আর চলনের চোরাবাঁকগুলো আজ বড় রহস্যহীন লাগে। অথচ দিকের প্রতিকূলেই সূর্যসম্ভব অপেক্ষায় ছিল। বিদিকের অনিশ্চিত বাঁকে অপেক্ষায় ছিল এক অ-সুখ বিস্ফোরণ। আমি কূলের এপারে দাঁড়িয়ে দেখেছি প্রতিশ্রুতি রঙের বোঁটায় কীভাবে সাদারাও নীল হয়ে ওঠে। প্রতিকূলের ওপারে রচিত হতে থাকে এক নাটকীয় ক্যানভাস। দ্রোহের আগে অভিমানী মুখ। বিদ্রোহের পরে বিপদসংকেত। লাল ও সবুজের উদ্দাম যৌথতা। আমি নিঃশব্দে পেরিয়ে যাই মিথ্যে আঙুলের মিথ। খেরোখাতা রয়ে যায় সত্যের অপেক্ষায়।

আমি কোনো গোপন রাতনকশায় তোমার করতল রেখা উচ্চারণ করিনি। বিদ্রোহী বিষবৃক্ষের মলাটে এমন শূন্য প্রচ্ছদ এঁকেছি, এমন শূন্যমাফিক রং, যেন গতকালের রং দাও রং দাও বলে সমস্ত উচ্চারণ আজ অলীক হতে পারে। যেন স্বপ্নের রং থেকে রঙের স্বপ্ন পর্যন্ত জেগে থাকে এক দুরূহ দ্বন্দ্ব। আমাদের নির্মিত কথামালাবৃত্তে দ্বন্দ্ব গড়াতে থাকে। গড়াতে গড়াতে পাঁজরের একোণে ওকোণে লয় ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতে অন্ধবিন্দুতে জেগে ওঠে নিস্পৃহ বৃক্ষুর সারি। সম্ভাব্য বৃত্তের স্পর্শকরেখাগুলি যত্নে মুছে রাখি। ঘরে ফেরার বৃত্ত তাই স্পর্শকাতর তন্দ্রা ছেড়ে মুহূর্তে পরিযায়ী। খেরোখাতা তখনো দিগন্ত থেকে ঘরফেরা অপেক্ষায়।

আমি ছড়ানো ডানায় এঁকে রাখি এক সর্বংসহা মোহ। আলতো পায়ের নিচে মুগ্ধ বালুচর। ভেজা চোখের আগে উদাসীন ঢেউ। আর ব্যথানীল ঠোঁটে সাজিয়ে তুলি সাগরীয় চুয়া চন্দন। গহিনে কোথাও চোরাস্রোত। নিঃশব্দে ভেঙে ভেঙে যায় তার বাদী ও বিবাদী সব ঢেউ। গোপন বালুচরে রেখে যায় তার তরঙ্গচিহ্ন। সে চিহ্নে বাজে না কোনো রাই। বাজে না তার অলক্তরাগ। ভালোবাসার আয়নারহস্য আমি চিনি। তাই ঘসে ঘসে মুছে রাখি পারদপ্রলেপ। আরোপিত মুখে তখনো কিছুটা কামিনীসুলভ দাগ। মুখর হয়ে ওঠার আগেই আমি অ-দৃশ্যে ফিরতে থাকি। দৃশ্যে শুধু জেগে থাকে কৌণিক ঠোঁটের ব্যর্থ প্রয়াস। আঙুলে লেগে থাকে ফেলে আসা মনখারাপের হলুদ রেশ। ফলত খেরোখাতার অপেক্ষা ধূসর হতে হতে ক্রমশ প্রাগৈতিহাসিক হয়ে ওঠে।






০৭ স্বপন রায়

রেলা-৩


আমি পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম, গেছে! এ সেই সময়ের কথা যখন এ.টি.এম প্রায় ২০ বছর দূরে! আমার প্রায় সব কিছুই ছিলো ওই মানিপার্সে, সঙ্গের পিঠব্যাগে পরিধেয় ছাড়া কিছু নেই। আর আমারও গান গাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই, তো মনে মনে গাইতে লাগলাম, ‘কি করি আমি কি করি /বল রে সুবল /বল দাদা...’

সুবলের বলার কিছু ছিলো না, ভাগ্যিস টিকিটটা আমার বুক পকেটে অমিতাভ বচ্চনের জীবনদায়ী বিল্লা নাম্বার ৭৮৬’র মতো লেপটে আছে! আমিতাভকে সাধারণতঃ এই বিল্লা যোগাতো তার মেগাকপাল, আমি এক যাযাবরীয় নগণ্য মানুষ, কী করবো? ক্যালানোবেজার হয়ে নিজের বার্থে এসে বসি, ক্ষিদে জানান দিচ্ছে এতটাই যে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ক্ষুৎকাতর অবস্থায় চলে যাবো...। আজ দাড়িও কামাইনি, শালা ঠিক সময় বুঝে চুলকোচ্ছে!



-আপনি কি কিছু হারিয়েছেন?

তাকালাম! হারালাম!! কথা!!!

আমি পথিক নই, পথ হারাইনি, তবু হঠাৎই এক বঙ্কিমী আবহাওয়া এসে আমায় মনে করিয়ে দিল যে, আমি একটু আড়া প্রোফাইল রাখলে রাজেশ খান্না আমায় ছুঁয়ে যায়, তো রাখলাম!

সে দেখলো কিনা জানি না, আমি তো দেখছিই... সম্বলপুর এক্সপ্রেস নড়ে উঠলো!

আমি বললাম, মানিপার্স... বলার আগে খাঁকারি দিয়ে জমা মেঘ সরাতে হলো কন্ঠনালী থেকে। কারণ, আমি কথা প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম। এত মনটাচি সৌন্দর্য ওই বয়সে ভেতরে বিহ্বলতা তৈরি করে, পেটে সামান্য ব্যথা হয়, অবশ্য আমারটা ক্ষিদে থেকেও হতে পারে!

আমার দিকে তাকিয়ে সে বললো, সরি...

বলা উচিত ছিলো, আপনি সরি বলছেন কেন; বলে ফেললাম, কলকাতা যাচ্ছি

-ও, তাই? কি করে হলো? বুঝতে পারেননি না? আপনাকে দেখলেই মনে হয় আপনি একটা যা তা...

আমি নিভে যাই... যা তা?...

মেয়েটি হাসে। আমিও হাসি।

-কিছু মনে করলেন না তো? আসলে বোঝা যায়, মেয়েরা বুঝতে পারে...

আমি না বুঝে হাসি...



আমার নিচের বার্থ। তাহলে পাশাপাশি? রোমে বেহালা লাগে আমার, ভেতরে ‘ও মেরে দিলকে চয়েন’ গানটা উসকে উঠছিলো, সামলে নিই...

-আমার নাম এলিজাবেথ!

আমি দেখি এক মনোরম তীব্র আঁধারে হারানো সালোয়ার কামিজে সেই মেয়েটি কী সহজ, কী আন্তরিক...

আমিও নিজের নাম বলি, কালো সালোয়ার কামিজে রাখা তার ঘিয়ে রঙের দোপাট্টায় মুগ্ধতা ছড়াতে ছড়াতে...

-আমার মা ব্রিটিশ, বাবা বাঙালি... আপনি?

এবার স্মার্ট হাসি দিয়ে বলি, কেন বাঙালি মনে হয় না আমায়?

-হয়, তবে একটা নেপালি লুক রয়েছে আপনার...

রাম বাহাদুর! শ্যাম থাপা!! দুই ফুটবলার ভেসে উঠলো। কেউ কেউ বলে, আর একটু লম্বা হলে রাজেশ খান্নার ডুপ্লিকেট মনে হতো। এ বলছে নেপালি... কী মুশকিল! এলিজাবেথ হোক বা ক্লিওপেট্রা, বিভ্রম তৈরি করবেই! আমার পাশের যাত্রী ভ্রু নাচায়, একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, আগে থেকেই চেনা, না এখন? তারপর দাঁত বের করে, হলুদাচ্ছন্ন...। আমি বললাম, আগে থেকেই চেনা, মানে আগের জন্মে আমি আর ও... বুঝেছেন তো? আমি একটা চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে ডুয়ার্সে গিয়েছিলাম। আমার নতুন চাকরি, মনে আনন্দ, গান গাইছিলাম, সুহানা সফর, ঔর ইয়ে মৌসম হসিঁ... ও গানের টানে চলে এসেছিলো... তারপর আর কী, চুটিয়ে প্রেম... আমাদের বিয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো... কিন্তু...

লোকটা হাঁ, বললো, কিন্তু কি?

-মারাত্মক একসিডেন্ট হলো আমার, মরে গেলাম আর কী... তারপর এই ট্রেনে আবার ওকে দেখলাম... দেখেই গত জন্মের স্মৃতি মনে পড়ে গেল... আমি ফিরে পেলাম মুনিয়াকে!

-মুনিয়া?

-ওর আগের জন্মের নাম!

লোকটা সোজা ওপরের বার্থে চলে গেল এরপর, যাওয়ার আগে বললো, আমি কিন্তু গান্ডু না...





তবে আমাদের কথা কিন্তু হতেই থাকে। এলিজাবেথ এখন লিজ, আমি পিল্টু।

আমি লিজের কথায় ভেসে ওঠা বুজকুড়ির শব্দ পাই। আমি আরও পাই শরীরের অনাস্থা প্রস্তাব। পেতে থাকি

মনকে আমন দেওয়া এক প্রস্থ উসখুসে রেলতাল, সেই গতির টানে আমার সামনে বসে থাকা লিজের দোপাট্টা যতবার পড়ে, আমি ততবার শক্ত হতে থাকি, হাল ধরার চেষ্টা করি বিবেকানন্দকে ভেবে, তাঁর তেজ, তাঁর শিকাগো ভাষণ... আর লিজ এই তরুণতাপসের অন্যমনস্ক হওয়ার তাগিদে ফুরফুরে দক্ষিণী হাওয়া ছড়িয়ে দিয়ে বলে, কী এত ভাবছেন বলুন তো! আমি কি আপনাকে বোর করছি?



তারপর ফ্লাস্ক কাৎ করে চা ঢালে, অপাঙ্গে তাকায় ঢালতে ঢালতে। আমি শিথিল হতে গিয়েও পারি না, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো...’ মান্না দে... এবারের পুজোর গান... সত্যি তো, কেন হলো?

লিজ ওর রাসবিহারীর ঠিকানা দেয়। আমি ওকে রাউরকেলার। লিজ ওর কাকার কাছে এসেছিলো। একা, একাই ফিরছে...! স্বাভাবিক, ও তো তখনকার বাঙালি মেয়ে নয় যে, বাবা অথবা ভাই সঙ্গে থাকবে! লিজ বলে, তোমায় কিন্তু এখন পুরো বাঙালি মনে হচ্ছে!

-কেন?

-জানি না! বলে মুচকি হাসলো। আমার চায়ে সেই হাসির আসঙ্গ মিশে যায়! আমিও হাসি। ক্যাবলার মতো। বাঙালির মতো।



ট্রেন ছোটে, রাত বাড়ে। লিজ টিফিন ক্যারিয়ার বার করে। ওর আঙুলে লেগে থাকা গরজের চাঁপা কী এক মায়ায় অনবদ্য হয়ে যায়! আমি ক্ষিদে ভুলে তাকিয়ে থাকি। কাগজের প্লেটে রাখা সেইসব স্বাদান্নে আর আমি যেতে পারি না।

লিজ বলে, কী হলো... নাও!

আমি নিতে থাকি... নিতেই থাকি, সারারাত...



ঘুম ভাঙে কোলাহল আছড়ে পড়ায়। চমকে উঠে বসি। হাওড়া! ট্রেন থেমে আছে। নেমে যাচ্ছে যাত্রীরা। সেই সহযাত্রী নামার আগে বলে গেল, উঠুন এটাই হাওড়া, আর আপনার মুনিয়াও উড়ে গেছে...। আমি বিরক্ত হতে গিয়েও হলাম না। লিজের সিট ফাঁকা। যেন লম্বা ছুটি রেখে চলে গেছে ও, সে রকমই একদলা নরম রোদ ওই সিটের ওপর এসে পড়েছে!

আমি নেমে আসি, ঠিকানাটা যেন কী... কী যেন ঠিকানাটা...

০১ অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা



(৫) তেরো-স্পর্শ

বছরটা শেষ হতে চললো।

এই জাস্ট সেদিন ধূপধুনো দিয়ে বরণ করলাম বছরটাকে, এর মধ্যে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চোদ্দ শাক খেয়ে এর চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ফেলা হলো। আর কদিন পড়েই হুড়মুড়িয়ে দু’হাজার চোদ্দ এসে পড়বে।


এলে আর ঠ্যাকাচ্ছে কে! গোরারা তো চায়ই যে, এ বছর জলদি ফুটুক, তেরো নাকি অশুভ। তেরোস্পর্শেই – মানে সংস্কিতোয় আমরা যে বলি ত্র্যহস্পর্শ, তাতেই – নাকি ওদের দেশের হাতে হেরিকেন, মানে ক্যাটরিনা-ফ্যাটরিনা টাইপের বিভিন্ন সেক্সি সেক্সি নামের ঝড়-ঝঞ্ঝ্বা। মারী ও মড়ক নিয়ে আমরা ঘর করছি আজীবন, আমাদের এসবে কিস্যু এসে যায় না। একটু মাড়ি-টাড়ি ফোলে হয়তো, অথবা পুরনো মোড়াটা মড়মড় করে ভেঙে যায়। মুড়ি-মুড়কির দাম বাড়ে। সিন্দুকের মধ্যের কালেকশনের মোড়ক খুলে মিরাকুলাসলি দেখা যায় মর্মরমূর্তি হাপিস, কে ঝেড়ে দিয়েছে! মারোয়াড়ির হাতে বিকিয়ে যায় রূপোর মরিচদান।



মান্না দে চলে গেলেন। একে একে নিভিছে দেউটি! এটা অবশ্য একটু বিশেষ যাওয়া, প্রবাসে দৈবের বশের মতো। বহুদিন ধরে ভুগছিলেন, বয়সও হয়েছিল, স্রেফ এত বছর বেঁচে থাকার জন্যে মোরারজী দেশাইকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হয়েছিল। বাঙালিরা অতিরিক্ত পরিমাণে মিষ্টি আর তেলেভাজা খায় বলে এত বছর বাঁচে না, ব্যতিক্রম জ্যোতিবাবু। অবশ্য জ্যোতিবাবু পদবীতে বসু হলেও সঙ্গে একটা সরকার ছিল, দরকারে কাজে লাগতো। মান্না দে’র শুধুই দে, তাই দিয়েই গেলেন, বদলে পেলেন না তেমন কিছু। ব্যাঙ্গালোরের এক হাসপাতালে বেশ ক’মাস চিকিৎসা হবার পর আর টানতে পারলেন না মান্না। কাগজে বেরলো, তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা নাকি অমানুষ, তাঁকে দেখতোও না। শেষযাত্রায় জনা কুড়ি লোক ছিল, মূলত অবাঙালি। এর চেয়ে তার দল থেকে সাস্পেন্ডেড কুণাল যে কোনো রাস্তার মোড়ে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে কলকাতায় বেশি লোক হবে, অটোয়ালারা অন্তত খানিকক্ষণ প্যাসেঞ্জার না নিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবে। কর্ণাটক সরকার ঘোষণা করল, হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দেবে। বাস, ফুঁসে উঠলো বাঙালি! আমাদের লোক মলো, আর বিল দেবে ওরা! কেন, আমাদের কি মান-ইজ্জত বলে কিছুই নেই?

আছে, ঐ ধুয়েই তো খাচ্চি! তবে সিন্দুকে ট্যাকা আছে কিনা সন্দেহ। যাতে কিছু পুঁজি জমা পড়ে, তার জন্যে সিগারেট-বিড়িতে ঝেড়ে ট্যাক্স বসিয়ে জনগণকে বেশি করে ফোঁকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাতেও কাজ বিশেষ হচ্ছে না বোধ হয়, এখন শুনছি মালের দোকান দিনরাত্তির খোলা, যাতে গ্যাসে কাজ না হলে অন্ততঃ লিকুইডে পুষিয়ে নেওয়া যায়। তো সেই পয়সায় মান্না দে’র চিকিচ্ছের বিল মেটানোটা কি খুব ভালো দেখাতো?

মরদেহ কলকাতায় উড়িয়ে নিয়ে আসার কথাও হয়েছিল, সম্ভবত শেষ কাজ হয়ে যাওয়ার পর! বেঁচে থাকতে যারা খোঁজ নেয় নি কখনো, তারা সদলবলে নেতৃত্বের নিন্দে করতে লাগল। মান্না দে মরিয়া প্রমাণ করিলেন, বাঙালি একই আছে। শুধু তাঁর গুণমুগ্ধ কয়েকজন, যারা তাঁর স্বর্ণকণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ ছিল, তাঁর গানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল ভালোবাসার সংজ্ঞা, তাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নীরবে গুমরে কাঁদতে লাগল নিশুতি রাত।


তেরোর সবই যে কান্নাকাটির নয়, তার জন্যে একশো বছর পেছিয়ে গেলেই বোঝা যাবে। আমাদের কলকাতার লোক, বাংলায় পদ্য ফদ্য লিখতো, হুট করে কী মাথায় চাপলো, তার থেকে মাত্র শ’খানেকের ইংরাজি ট্রানস্লেশন করে ফেললো, আর তার জন্যে নধর একটা নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেল। ঊনিশশো তেরো সালের কথা। মাংসভাতের লোভ দেখিয়ে লরি বোঝাই জনমজুর জুটিয়ে এনে ব্রিগেডে মিটিং করে বা যাদের মা বেঁচে নেই তাদের মাওবাদী ঘোষণা করে জেনেরালি নোবেল প্রাইজ পাওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, পাঁচ পাঁচ রকম ব্যাপারে নোবেল দেওয়া হয়, লেখালিখি তার একটা, তার আগে এশিয়া থেকে সেই পাঁচ রকমের কোনোটার জন্যেই কেউ নোবেল প্রাইজ পায়নি। দারুণ ক্যালির ব্যাপার, তবে ক্যালকাটার লোক হলেও কালীপুজো করত না সেই দাড়িওলা বাহান্ন বছরের বুড়ো। অতগুলো টাকা পেল, কোথায় সারদার মতো চিটফান্ডে হেবি রিটার্ণের জন্যে ইনভেস্ট করবে, তা না পুরো টাকাটা ঢেলে দিল এক ইস্কুল বানাতে! বাঙালিকে শিক্ষিত করবে!



যেমন কম্মো, তেমন ফল। সেই মেডেল ঝেড়ে দিয়েছে কোনো এক বঙ্গসন্তান। হোম মিনিস্ট্রি হকার টকারদের ওপর হম্বিতম্বি করে ওদের ক্যাডার বানিয়ে ফেলেছে, তবে সেই মেডেল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বুড়োটা ‘সহজপাঠ’ বলে বাচ্চাদের জন্যে বই লিখেছিল। বাচ্চারা পড়তো টড়তো। তবে রাজ্যের অভিভাবকরা বললো, না না, এ অতিশয় কঠিন। পুরনো ধ্যানধারণা পালটে বরং আধুনিক কবিদের পদ্য ঢোকানো হোক। দাড়িওলা কবি কি আমাদের দলে শর্ট পড়েছে? এর ইনডিরেক্ট এফেক্টে ইয়াং সুকান্তও চলে গেল মায়ের ভোগে। বেচারী নিজে বিয়ে করার আগেই ‘স্বর্গে’ চলে গেল, কিন্তু এমন ভাইপো রেখে গেল, যে এখন পুন্নিমের চাঁদকে নিয়ে কিছু বললে হাজতবাস হতে পারে।


উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বলে এক ভদ্রলোক, যাঁর ছিল ছাপাখানার ব্যবসা, তিনিও সেই ঊনিশশো তেরো সালেই ‘সন্দেশ’ বলে এক পত্রিকা বের করে বসলেন। টুনটুনির গল্প, ছেলেদের রামায়ণ-মহাভারত এইসব লিখে তিনি বাচ্চাদের মনোরঞ্জন করছিলেন। ছেলে সুকুমারকে লন্ডনে পাঠিয়ে বললেন, যা, ছাপাখানার লেটেস্ট টেকনোলজি শিখে আয়! ছেলে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে ডবল ডিগ্রীধারী। দেশে ফিরে ‘সন্দেশ’ হাতে পেয়ে সেও বাচ্চাদের জন্যে পদ্য-গদ্য লিখে হাত মকশো করা শুরু করে দিল। ‘আবোল তাবোল’, ‘খাই খাই’, ‘পাগলা দাশু’, ‘অবাক জলপান’ – এইসব যা যা সে লিখে গেছে, তা এই একশো বছরেও আর কেউ পারেনি। আমসত্ত্ব-দুধ-কদলী ছাড়াই সেই সন্দেশ চেটেপুটে শেষ করত বাচ্চারা, পিঁপড়ের জন্যে কিস্যু ফেলে রাখত না।



সেই ঊনিশশো তেরো সালেই টাঙ্গাইলের সরকারবাড়িতে প্রতুল বলে এক ছেলে জন্মালো। দেশ চালাচ্ছে বিদেশী সরকার, কিন্তু মা ষষ্ঠীর কৃপায় বঙ্গসন্তানের সংখ্যা কোনো সময়েই অপ্রতুল নয়। বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে ইংরেজদের তাঁবেদারি করতে পারলে ভবিষ্যত গুছিয়ে নেওয়া যেখানে সহজ, সেখানে যেন কোনো এক দৈব ম্যাজিকেই এই প্রতুলের বড় হয়ে শখ হলো ম্যাজিক শেখার। দুনিয়াকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ম্যাজিক দেখিয়ে গেল সে। যাবার আগে যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিয়ে গেল তার আশ্চর্য জগতের যাদুকাঠি।



বাংলার তখন বেশ জটিল পরিস্থিতি। কার্জনসাহেব আট বছর আগে বাংলাকে কাৎলা মাছের মতো কেটে দু-টুকরো করে মুড়ো-ল্যাজায় দ্বন্দ্ব বাধিয়ে ডিভাইড অ্যান্ড রুল চালু করেছেন, যার উত্তরে বাংলা উঠেছে গর্জে। অরবিন্দের নেতৃত্বে বাংলায় বোমা বানানো হচ্ছে ইংরেজদের মেরে তাড়ানোর জন্যে। ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন সমিতি’র ব্যানারে অরবিন্দের সাথে আছেন ভাই বারীন, বাঘা যতীনের মতো বাঘের বাচ্চারা। ভুল জায়গায় বোমা মেরে শহীদ হলো প্রফুল্ল, ফাঁসিতে চড়ানো হলো ষোল বছরের ক্ষুদিরামকে। সারা বাংলার আকাশে বাতাসে ভাসতে লাগলো মর্মস্পর্শী গান – ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’।


ছ’বছর পর কাটা বাংলা জোড়া লাগাতে বাধ্য হলো ইংরেজ, কিন্তু রাজধানী কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে গেল দিল্লী। ভাবলো, দিল্লী দূর হ্যায়! 
সেই ঊনিশশো তেরোতেই ঊড়িষ্যার কটকের র‍্যাভেনশ’ কলেজ থেকে ম্যাট্রিকে সেকেন্ড হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সীতে পড়তে এলো এক সুদর্শন যুবক। সেখানে ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন ভারতীয়দের নিয়ে ভুলভাল মন্তব্য করায় তাকে এমন শিক্ষা দিল যে, তিনি ওঠেন কি বসেন, বুঝতে পারলেন না। ভারতের পরবর্তী ইতিহাসের অনেকটা এই ছেলে সুভাষের নিজের কীর্তি। দিল্লী চলো ডাক দিয়েছিল সে, সেখানে পৌঁছাতে পারলে আজ দেশের হাল অন্যরকম হতো। 
দেশের অন্যপ্রান্তেও সেই তেরো সালে বিচিত্র ঘটনা ঘটছিলো। মহীশূরের উপকণ্ঠে ধারোয়ার ও হুবলি দুই পাশাপাশি শহর, যমজ ভাইয়ের মতো। চিক্কুরাও নাদিগার নামে এক ভদ্রলোক, তাঁর বাড়ি ধারোয়ারে, চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। স্ত্রী অম্বাবাঈ ভালোবাসেন গান, কর্ণাটকী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত। দুর্ভাগ্য তাঁর, যে পরিবারে অম্বা-র জন্ম হয়েছিল, সমাজের চোখে সেটা নিচু জাত, তাদের গান গাওয়ারই অধিকার নেই, স্টেজে পরিবেশন তো দূরের কথা। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন অম্বাবাঈ, সাধনা করে যান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। হয়তো এমন দিন আসবে, যখন এই নিষ্ঠুর জাতপাতপ্রথা দূর হয়ে যাবে। তাঁর নিজের জীবিতকালে না হলেও, হয়তো পরবর্তী প্রজন্মে।


ঊনিশশো তেরো সালে তাঁর কোল আলো করে এলো এক কন্যাসন্তান, চিক্কুরাও তার নাম রাখলেন গাঙ্গুবাঈ। পরে সারা ভারত তাঁর ক্লাসিকাল গানের যাদুতে মুগ্ধ হলো।

আমাদের দেশে গান শুনলেই এখন লোকে বলে, কোন্‌ সিনেমার? তো সেই তেরো সালেই ভারতের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি রিলীজ হলো সিনেমাহলে, তার নাম ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, পরিচালক দাদাসাহেব ফালকে। এ ছবিটি ছিল অ-বাক্‌। ভারতীয় ছবিতে সংলাপ শুরু হওয়া আরো পরের ঘটনা, কিন্তু সেই যুগে পরাধীন ভারতে এটাও এক অবাক কাণ্ডই বটে। আর সেই চলচ্চিত্রের পর্দা কাঁপাতে সেই তেরো সালেই রাওয়ালপিণ্ডি শহরে এক পাঞ্জাবী ক্ষত্রি পরিবারে জন্ম হলো যুধিষ্ঠির সাহনির, আমরা যাঁকে পরে চিনলাম বলরাজ নামে। আর মুম্বইয়ের শহরতলিতে কাপড়ের কলে চাকরি করা আভাজী পালব-এর ঘরে জন্মালেন ভগবান, ক্রমে তিনি হয়ে গেলেন ভগবান দাদা।

মরেচে! রম্যরচনা লেখার কথা, এটা হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস। তার ওপর গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গল ছাড়া এতে আর কোনো মহিলার নাম নেই। ইতিহাস কি শুধু পুরুষের তৈরি এক ইমারত, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিগত দিনের শত শত ভুল?



ঊনিশশো তেরো সালের এক মহিলার কীর্তি দিয়ে শেষ করি এই সংখ্যার চারানা আটানা। সেই বছরের শেষের দিকে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সী আমেরিকার নিউ ইয়র্কের এক তরুণী মেরী ফেল্প্‌স্‌ জেকব আবিষ্কার করলেন মহিলাদের প্রথম আধুনিক বক্ষবন্ধনী। তাঁর করা নতুন ডিজাইনের পেটেন্টও নিলেন তিনি। এর আগে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলাদের ঊর্ধাঙ্গে অন্তর্বাস হিসাবে ব্যবহৃত পোশাক ছিল কর্সেট, তা শুরু করেছিলেন ফরাসী রাজা দ্বিতীয় হেনরির পত্নী রাণী ক্যাথেরিন। মেয়েদের সৌন্দর্য বলতে বোঝানো হতো আওয়ারগ্লাস ফিগার অর্থাৎ ভারী বক্ষ ও নিতম্ব, মধ্যে সরু কোমর, ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্সের সেই ছত্রিশ-চব্বিশ-ছত্রিশ। ক্যাথেরিনের তাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের সরু কোমর বীভৎসভাবে আঁটসাঁট করে রাখা। তাঁর ডিজাইনের কর্সেটে ব্যবহৃত হতো তিমিমাছের কাঁটা অথবা ধাতব সরু রড, যেগুলো দিয়ে কোমরের কাছটা টাইট করে রাখা হতো। মাঝে মাঝেই সেগুলো হয় শরীরে ফুটে যেত, বা পোশাক ভেদ করে দৃষ্টিকটু হয়ে শজারুর মতো খাড়া হয়ে থাকত।

দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর ধরে ফ্যাশনের নামে মেয়েরা সহ্য করে এসেছে যে যন্ত্রণা, মেরীর এই ব্রেসিয়ার আবিষ্কার তা থেকে তাদের মুক্ত করে। দিনে দিনে মেরীর অন্তর্বাসের চাহিদা বাড়তে থাকলেও মেরী এই ব্যবসা চালাতে পারেননি, তিনি তো ব্যবসায়ী ছিলেন না! ভাবলে অবাক লাগে, মাত্র পনেরশো ডলারে তিনি তাঁর পেটেন্ট বিক্রী করে দেন ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নামে এক কোম্পানীকে। এরা কিন্তু সিনেমা বানানোর ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নয়। পরবর্তী তিরিশ বছরে এই কোম্পানী দেড় কোটি ডলারের বাণিজ্য করে শুধু এই বক্ষবন্ধনীরই। ১৯১৭ সালে পুরনো কর্সেট ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছরে প্রায় আঠাশ হাজার টন ষ্টীল অন্য কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পায়।



ঊনিশশো তেরো সালের আগে, তার মানে ব্রা-ফ্রা ছিল না। সে জন্যেই কি কবিরা উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতে পারতেন? রবি ঠাকুরের ঠিক তেরো সালেই নোবেল পাওয়ার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ আছে কিনা, এই নিয়ে একটা থীসিস করা যেতে পারে না? এনিবডি ইন্টারেস্টেড?

দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা -- সব চলে গেল। এ বারের মতো পুজোর সীজ্‌ন্‌ শেষ। তেরোর গেরোয় আটকে থাকা বছরের বাকি ক’টা দিন একই রকম উৎসবমুখরিত থাকুক আপনাদের জীবন, অন্তরে শক্তি থাক, পাতে সুখাদ্য থাক, মুখে থাক অনাবিল হাসি, এই কামনা করেই আজ ছুটি নিচ্ছি।